post

অহঙ্কারমুক্ত জীবনে জান্নাতের হাতছানি

ড. মো: আকতার হোসেন

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮
রাবির পরিচয় সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী ও নবী করিম (সা)-এর নৈকট্য লাভকারী প্রাণপ্রিয় সাহাবী ছিলেন আবু হুরায়রা (রা)। তিনি ছিলেন আহলে সুফফার অন্যতম সাহাবী। আবু হুরায়রা তার উপনাম, প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ বা আবদুর রহমান। তিনি ইয়েমেনের দাওসি গোত্রের লোক ছিলেন। ত্রিশ বছর বয়সে খয়বরে আগমন করে প্রিয় নবীর (সা) হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি যাবতীয় দুনিয়াবি ভোগবিলাস ত্যাগ করে প্রিয় নবীর (সা) সাহচর্যে থেকে ইলম অর্জন করাকেই প্রাধান্য দেন। রাসূল (সা)-এর দোয়ার বরকতে তার মেধা ও স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতেন। রাসূল (সা) থেকে তার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ছিল ৫৩৭৪টি। হযরত মুয়াবিয়া (রা)-এর শাসনামলে তিনি দুইবার মদিনার গভর্নর নিযুক্ত হন। ৫৮-৫৯ হিজরিতে মদিনাতেই ইনতেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮০ বছর। হাদীসের ব্যাখ্যা: আলোচ্য হাদীসে অহঙ্কারের চরম পরিণতি ও শাস্তির কথা বলা হয়েছে। মানুষ যখন নিজকে অন্য কোনো মানুষ থেকে উন্নত, উত্তম, ক্ষমতাধর বা বড় মনে করে অথবা কাউকে কোনোভাবে নিজের চেয়ে হেয় মনে করে তখন তার এই মানসিকতাকে অহঙ্কার বা গর্ব বলে। এটি একটি মানসিক অনুভূতি, তবে কর্মের মধ্যে কিছু প্রকাশ ঘটে থাকে। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী অহঙ্কার একমাত্র আল্লাহর অধিকার। কোনো মানুষ যখন গর্ব অহঙ্কার করে তখন মূলত সে আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। কারণ মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত নিয়েই অহঙ্কারে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তা’আলা পৃথিবীতে সবাইকে তার নিয়ামত ধন সম্পদ, ক্ষমতা, মেধা ও যোগ্যতা সমানভাবে প্রদান করেন না। তার এই নিয়ামত কাউকে দেন আবার কাউকে দেন না। আবার কমবেশি করেও দেন। মানুষের কর্তব্য বা উচিত হলো আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। মানুষ যখন আল্লাহর নিয়ামত বা দানের কথা ভুলে এটাকে নিজের সম্পদ বা উপার্জন মনে করে, তখনই অহঙ্কারের সূত্রপাত হয়। আর এই অহঙ্কারের কারণেই আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। আল-কুরআন ও হাদীসে অহঙ্কারী ব্যক্তির পরিণতি ও শাস্তি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আল্লাহ অহঙ্কারী ব্যক্তিকে ভালোবাসেন না ও পছন্দ করেন না। আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর ঘোষণা : “নিশ্চয়ই আল্লাহ এমন লোককে পছন্দ করেন না, যে বড় হওয়ার গৌরব করে ও অহঙ্কার করে।” (সূরা নিসা : ৩৬) “মানুষের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে কথা বল না এবং পৃথিবীতে গর্বের সাথে চলবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো বড়াইকারী ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা লুকমান : ১৮) “যাতে তোমাদের যতটুকুই ক্ষতি হয়ে গেছে সে জন্য তোমরা হতাশ না হও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তাতে তোমরা খুশিতে আত্মহারা না হও। আল্লাহ এমন লোকদেরকে পছন্দ করেন না, যারা নিজেদেরকে বড় মনে করে এবং অহঙ্কার করে।” (সূরা হাদীদ : ২৩) অহঙ্কারী ব্যক্তির সর্বশেষ পরিণতি হলো জাহান্নাম। কেননা সে অহঙ্কারের মাধ্যমে আল্লাহর গোলামি হতে নিজেকে মুক্ত করে বেপরোয়া হয়ে যায়। নিজকে অনেক বড় ও ক্ষমতাবান এবং শক্তিশালী মনে করে এবং মানুষকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য মনে করে । রাসূলের বর্ণিত অপর একটি হাদীস থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যায়। রাসূল (সা) বলেন : যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার রয়েছে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এক ব্যক্তি বললেন, কোন ব্যক্তি পছন্দ করে তার কাপড় সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক (তাও কি অহঙ্কার?) রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। প্রকৃত পক্ষে অহঙ্কার হলো আল্লাহর গোলামি থেকে বেপরোয়া হওয়া এবং মানুষকে অবজ্ঞা করা।’ (মুসলিম) আল্লাহর বাণী- “এখন যাও জাহান্নামের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়। সেখানেই তোমাদের চিরকাল থাকতে হবে। অহঙ্কারীদের জন্য তা বড়ই মন্দ ঠিকানা।” (সূরা নাহল : ২৯) রাসূল (সা) এ প্রসঙ্গে বলেন, “অহঙ্কারী ও অহঙ্কারের মিথ্যা ভানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (আবু দাউদ) রাসূল (সা) আরো বলেন, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো জান্নাতের অধিবাসী কারা? প্রত্যেক দুর্বল ও যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। তারা হলো এমন যে, যদি তারা আল্লাহর নামে কসম করে, অবশ্যই আল্লাহ তাহা পূর্ণ করেন। আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো, জাহান্নামের অধিবাসী কারা? প্রত্যেক অহঙ্কারী, সীমালঙ্ঘনকারী, উদ্ধত লোক। (বুখারী) আল্লাহ তাআলা অহঙ্কারের শাস্তি শুধুমাত্র আখিরাতে নয় দুনিয়াতেও প্রদান করে থাকেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পূর্বের অনেক জাতি ধন-সম্পদ ও শাসনক্ষমতা নিয়ে অহঙ্কার ও বাড়াবাড়ি করার কারণে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেন- “এমন কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি, সেখানকার লোকেরা ধন-সম্পদের অহঙ্কার করত। এই যে তাদের বাড়িঘর পড়ে আছে, যেখানে তাদের পর কম লোকই বসবাস করেছে। শেষ পর্যন্ত আমি (এ সবেরই) ওয়ারিশ হয়েছি।” (সূরা কাসাস : ৫৮) আদ, সামুদ, মাদিয়ান ও লুত (আ)-এর কওমের ধ্বংসের ইতিহাস কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া পূর্ববর্তী শাসক ও ক্ষমতাধররাও তাদের ক্ষমতার দাপট ও অহঙ্কার প্রদর্শন করায় আল্লাহ তা’আলা তাদের সমুচিত শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাদের করুণ পরিণতির ইতিহাস বিশ্ববাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ফেরাউন, হামান, নমরুদের মতো শাসকদের ইতিহাস আজো মানুষ ঘৃণাভরে স্মরণ করে। যেমন, আল কুরআনে ফেরাউনের অহঙ্কারের করুণ পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আর ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে পৃথিবীতে অহঙ্কার করেছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে না। অতঃপর আমি তাকে ও তার সেনাবাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং তারপর তাদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। দেখ জালিমদের পরিণাম কী হয়ে থাকে।” (সূরা আল-কাসাস : ৩৯-৪০) প্রকৃত মু’মিন আল্লাহর দ্বীনের পথের দায়ীরা যে কোন অবস্থায় গর্ব ও অহঙ্কার পরিত্যাগ করবে। তাদের কথা, কাজ ও আচরণে অহঙ্কার নয় বিনয় প্রকাশ পাবে। কেননা মু’মিনের ভূষণ আর অহঙ্কার খোদাদ্রোহী ও আখিরাতে অবিশ্বাসীদের ভূষণ। মু’মিনদের উদ্দেশে আল্লাহ বলেন- “মাটির বুকে গর্বের সাথে চলবে না। নিশ্চয়ই তুমি কখনো পদচাপে জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না, আর পাহাড়ের সমান উঁচু হতেও পারবে না।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৭) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন- “আখিরাতের সেই ঘর আমি তৈরি করে রেখেছি তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে বড়ত্ব চায় না এবং ফাসাদও সৃষ্টি করতে চায় না। আর ভালো পরিণাম তো মুত্তাকিদের জন্যই।” (সূরা আল-কাসাস : ৮৩) রাসূল (সা) বলেন, আল্লাহ তা’আলা আমার কাছে এই মর্মে অহি প্রেরণ করেছেন, তোমরা সকলে বিনয়ী হও, যাতে কেউ কারোর সাথে বাড়াবাড়ি করতে না পারে এবং কেউ কারোর সাথে গর্ব করতে না পারে। (আবু দাউদ) এর বিপরীতে খোদাদ্রোহী ও অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে আল্লাহর বাণী, “তোমাদের ইলাহ এক ও একক ইলাহ। সুতরাং যারা আখিরাতের প্রতি ঈমান আনে না, তাদের অন্তর সত্যবিমুখ এবং তারা দাম্ভিক ও অহঙ্কারী। নিঃসন্দেহে আল্লাহ জানেন, তারা যা গোপন করে এবং তারা যা প্রকাশ করে। অবশ্যই তিনি অহঙ্কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আন নাহল : ২২-২৩) অনেক মানুষ আছে যারা নিজেদের দামি ও মূল্যবান পোশাক পরিধান করে নিজেদের অহঙ্কার প্রকাশ করে থাকে। তাদের ব্যাপারে রাসূল (সা) বলেন, যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত স্বীয় বস্ত্র মাটির ওপর দিয়ে টেনে চলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তার দিকে তাকাবেন না। তখন হযরত আবু বকর (রা:) বলেন, আমার লুঙ্গি অসতর্ক অবস্থায় ঢিলা হয়ে পায়ের গিরার নিচে চলে যায়, যদি না আমি তা ভালোভাবে বেঁধে রাখি। অতঃপর রাসূল (সা) বলেন, তুমি তা অহঙ্কারবশত কর না। (বুখারী) অহঙ্কার আমাদের নেক আমলকে নষ্ট করে দেয়। অহঙ্কার থেকে বাঁচতে আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ, জ্ঞান যোগ্যতাকে আল্লাহ প্রদত্ত দয়া, রহমত ও নিয়ামত ভেবে তার শুকরিয়া আদায় করতে হবে। আর যে ব্যক্তি এসব নিয়ামত পাননি তার জন্য মহান রবের দরবারে দু’আ করতে হবে যাতে আল্লাহ তাকেও এ সকল নিয়ামত দান করেন। আর এই মানসিকতা পোষণ করতে হবে, আমি যে ইবাদত বন্দেগি করছি তা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের তুলনায় অতি নগণ্য। কাজেই আমার তৃপ্ত হওয়া বা গর্ব করার কিছুই নেই। আল্লাহ প্রদত্ত এ নিয়ামত যে কোন মুহূর্তে ছিনিয়ে নিতে পারেন, তিনি একজন বাদশাকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ফকিরে পরিণত করতে পারেন। আমাদের সকল নিয়ামত আল্লাহর দান। আর এ নিয়ে গর্ব করার অর্থদানকারীর দানের অবজ্ঞা করা। অতএব আমাদের সর্বদা সাবধান থাকতে হবে যাতে কখনোই সম্পদ, শক্তি, ক্ষমতা, শিক্ষা, সৌন্দর্য, পেশা বা অন্য কোন নিয়ামতের কারণে অহঙ্কার না করি এবং হেয়প্রতিপন্ন না করি। আল্লাহর পথের দায়ীদের সর্বোত্তম গুণ হলো বিনয় নম্রতা। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। দায়ীর এমন গুণে ইসলামে সৌন্দর্য প্রকাশ হয়। বিপরীতে অহঙ্কার মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয় ,আল্লাহর দ্বীন প্রচারে নিয়োজিত কারো থেকে এটি কাম্য নয়। লেখক : অধ্যাপক, আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির