post

আগামী বাজেটে খড়ক নামবে সাধারণ মানুষের ওপর

০৪ মে ২০১৫

মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ#

Orthonityমোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ ধরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। আর বাজেটেরে আকার হচ্ছে প্রায় তিন লাখ হাজার কোটি টাকা। এ দিকে আগামী বাজেটে খড়গ নামছে সাধারণ মানুষের উপর। গরিব ও নি¤œ আয়ের মানুষের পেটে লাথি মারতে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে অল্প টাকায় যারা সরকারের বিভিন্ন সেবা নিয়ে থাকেন তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে বোঝা। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আপাতত কমলেও তা ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েই গেছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ওলটপালট করে দিয়েছে ব্যবসায়-বিনিয়োগের সম্ভাবনা ও পরিকল্পনা। এ অবস্থায় আগামী ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত মূল ধারার রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের আশা করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের বিভিন্ন সেবা ফি বাড়িয়ে সেখান থেকে বাড়তি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা করছে সরকার। একই সঙ্গে বিনা মূল্যে দেয়া সরকারের বিভিন্ন সেবার বিপরীতে নতুন করে ফি আরোপের চিন্তা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের রাজস্ব আয়ের বড় অংশই আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে। সরকারের দেয়া বিভিন্ন সেবা যেমন- টোল, লেভি, নানা ধরনের চার্জ, রেজিস্ট্রেশন ফি ও নানা ধরনের বিল থেকেও রাজস্ব আসে, যেগুলো করবহির্ভূত রাজস্ব নামে পরিচিত। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। নতুন অর্থবছরেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাই করবহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আয় বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছে অর্থ বিভাগ। যদিও চলতি অর্থবছর লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছে পৌঁছতে পারছে না করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ। করবহির্ভূত রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকারের দেয়া বিভিন্ন সেবা ফি বাড়িয়ে নির্ধারণের জন্য সম্প্রতি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে দুই থেকে তিন বছরের অধিক পুরনো রেটগুলো যথাসম্ভব দ্রুত হালনাগাদকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে নতুন করে ফি ধার্য করার পরামর্শ দিয়ে মাহবুব আহমেদ বলেছেন, সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতায় নতুন নতুন সেবা সৃষ্টি করছে। এসব সেবার বিপরীতে ফি ধার্য করা যায় কি না, তা পর্যালোচনা করতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমানে এনটিআরের আওতা ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত করতে হবে।’ ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের আওতাধীন এনটিআর রেটগুলো হালনাগাদের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠিয়েছে উল্লেখ করে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব জানান, এ কার্যক্রমের ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পাবে। এনটিআর আহরণ বাড়াতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের সঙ্গে গত বছরের নভেম্বর মাসে কর্মশালার আয়োজন করে অর্থ বিভাগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের বিভিন্ন সেবার ফি পুনর্নির্ধারণের যৌক্তিকতা আছে। কারণ, এসব ফি কয়েক বছর আগে নির্ধারণের পর মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। অনেক জায়গায়ই সেবা ফি কিছু কিছু করে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। তবে এসব সিদ্ধান্ত সরকারকে অজনপ্রিয় করে তোলে। তাই বেশ কয়েকবার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েও সরকার পিছিয়ে গেছে। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের রাজস্ব আয়ের ৮০ শতাংশই আসে রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করে এ খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। ফি ও সেবা চার্জ বা বিভিন্ন ধরনের বিল বাড়িয়ে করবহির্ভূত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ কিছুটা বাড়ানো সম্ভব হলেও রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত করব্যবস্থা থেকে আদায় না বাড়লে তা সরকারকে স্বস্তি দেবে না। কোন কোন সেবার বিপরীতে এনটিআর রেট বাড়তে পারে বা নতুন করে ফি আরোপ করা হতে পারেÑ সে সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়নি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, এখনো সরকারের বিভিন্ন হাসপাতালে টিকিট মূল্য পাঁচ থেকে ২০ টাকার মধ্যে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বিনামূল্যে তথ্য সরবরাহ করছে সরকার। সরকার মালিকানাধীন বিনোদন কেন্দ্রগুলোর এন্ট্রি ফির পরিমাণও নগণ্য। এ ছাড়া প্রতি বছর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার নতুন নতুন সেবা যোগ করছে, যা বিনামূল্যে ভোগ করছে মানুষ। এসব সেবার বিপরীতে চার্জ বা ফি আরোপ ও পুনর্নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন সেবার ওপর ফি আরোপ করা হলে বা সেবা ফি বাড়ানো হলে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, বাস্তবে এসব ফি বা চার্জ সাধারণ মানুষের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। তিনি বলেন, এখন যে হাসপাতালের টিকিটের মূল্য ২০ টাকা রয়েছে, তা বাড়িয়ে ২৫ বা ৩০ টাকা করা হলেও তাতে রোগীর চিকিৎসায় কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, সাধারণত একজন মানুষ বছরে দুই-তিনবার হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। তাতে পুরো বছরে ২০ থেকে ৩০ টাকা বাড়তি ব্যয় হবে। এই পরিমাণ অর্থ কারো পুরো বছরের আয়-ব্যয়ের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। সূত্র জানায়, আগামী বাজেটের আকার হতে পারে ২ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হতে পারে ৯০-৯১ হাজার কোটি টাকা। আর এনবিআরের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ ধরা হতে পারে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নিয়ে এ বাজেট প্রণয়ন করা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের কাছাকাছি হবে। আর আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হবে ৭ শতাংশের ওপরে। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেট হবে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টিও বাজেটে গুরুত্ব দেয়া হবে। কেননা এ কারণে সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মুখে পড়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভালো হওয়ায় অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচক ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। যদিও অর্থমন্ত্রী চলতি বছরের তুলনায় আগামী বছর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়নই প্রধান লক্ষ্য থাকবে আগামী বাজেটে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১০-১১ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪৬, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫২, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক শূন্য ১ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ অর্জন হবে বলে পর্বানুমান করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা কমিশন দাবি করছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে সবচেয়ে বেশি সফলতা এসেছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এ সময়ে গড়ে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জিডিপি লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। সর্বশেষ হিসাবে ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৮৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির