post

আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনে কোরবানি

এইচ এম জোবায়ের

২৬ জুলাই ২০১৮
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা মানবজাতির জন্য নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে যুগে যুগে যেসব বিধি-বিধান জারি করেছেন কোরবানি তার একটি। যা মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ)-এর মহান সুন্নত। আল্লাহর তরফ থেকে একের পর এক কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষায় তিনি শতভাগ নম্বর নিয়ে পাস করেছেন। যার স্বীকৃতিস্বরূপ কোরবানি বিধানটি সামর্থ্যবানদের ওপর কিয়ামত পর্যন্ত ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে। কোরবানির মাধ্যমে বান্দা তার রবের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের অনন্য নজির স্থাপন করে। মুসলিম মিল্লাতের ওপর এই কোরবানির আত্মিক, পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক প্রভাব সীমাহীন। খালেস নিয়ত ও আল্লাহভীতি হচ্ছে কোরবানি কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহ পাক বলেন, “আর তাদেরকে আদমের দুই ছেলের সঠিক কাহিনীও শুনিয়ে দাও। তারা দু’জন কোরবানি করলে তাদের একজনের কোরবানি কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না। সে বললো, আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। সে জবাব দিলো, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকেন।” (সূরা মায়িদা : ২৭) কোরবানি কী? কোরবানি শব্দটি আরবি ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ সান্নিধ্য, নৈকট্য, নিকটবর্তিতা, নাগাল ইত্যাদি। ইংরেজিতে যাকে- চৎড়ীরসরঃু, হবধৎহবংং, পষড়ংবহবংং, রহঃরসধপু, ঝবপৎবভরপব ইত্যাদি বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় কোরবানি বলতে- মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাঁর নামে সুস্থ-সবল গৃহপালিত পশু জবেহ করাকে বুঝায়। আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর পথে রাসূল (সা) এর নির্দেশিত পদ্ধতিতে নিজের আত্মত্যাগকেও কোরবানি বলা হয়। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন, “বলো, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য।” (সূরা আল আনআম : ১৬২) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট পবিত্র কুরআনের সূরা আল হজের ৩৪ নম্বর আয়াত থেকে জানা যায় কোরবানির বিধান মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই জারি ছিল। আল্লাহ বলেন- “প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কোরবানির একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদেরকে দিয়েছেন...।” সূরা মায়িদার ২৭ নম্বর আয়াতে হযরত আদম (আ) এর ছেলেদের কোরবানির কথা বলা হয়েছে। পরবর্তীতে অন্যান্য নবী-রাসূল (আ) এবং তাদের উম্মতরাও কোরবানির বিধান পালন করেছেন। বিশেষ করে, হযরত ইবরাহিম (আ) এর কোরবানি আল্লাহ পাকের কাছে এত বেশি পছন্দ হয় যে তার প্রভুপ্রেম ও নিরঙ্কুশ আনুগত্যকে কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে কোরবানির বিধান সামর্থ্যবানদের ওপর ওয়াজিব করে দেয়া হয়। হযরত ইবরাহিম (আ)-এর কোরবানি ইবরাহিম (আ) ছিলেন হযরত নূহ (আ)-এর সম্ভবত এগারোতম অধস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহিম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত সালেহ (আ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহিমের (আ) আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের। তিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা। ইবরাহিম (আ) ছিলেন ইহুদি-খ্রিষ্টান-মুসলমান সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পিতা। কেননা আদম (আ) হতে ইবরাহিম (আ) পর্যন্ত ১০-১২ জন নবী বাদে শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা) পর্যন্ত প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহিম (আ) এর বংশধর। পবিত্র কুরআনের সূরা আলে ইমরানের ৩৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- “নিশ্চয়ই আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইবরাহিম ও আলে ইমরানকে বিশ্ববাসীর ওপরে নির্বাচিত করেছেন।” মূলত হযরত ইবরাহিম (আ) ছিলেন খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু। তবে আল্লাহর ‘খলিল’ হওয়ার জন্য তাকে অসংখ্য কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সব পরীক্ষায় তিনি শতভাগ সফলতা লাভ করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের একান্ত আস্থা অর্জন করেন। পরিশেষে তাকে বিশ^বাসীর জন্য ‘ইমাম’ নিযুক্ত করা হয়। আল্লাহ বলেন, ‘যখন ইবরাহিমকে তার পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও? তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার জালেমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না।’ (সূরা বাকারাহ : ১২৪) হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মত তিনিও নিজের জন্মভূমিতে থাকতে পারেননি। দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে তাকে ফিলিস্তিন, ইরাক, মিসরসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তিনি বাবেল (ইরাক) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তাকে নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলোর সম্মুখীন হতে হয় : মূর্তিপূজারি নেতা-পুরোহিতদের সাথে তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা, পিতার পক্ষ থেকে বহিষ্কারাদেশ, স্ত্রী ও ভাতিজা ছাড়া কেউ তার দাওয়াত কবুল না করা এবং তীব্র সামাজিক বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বীয় দাওয়াতে অবিচল থাকার পরীক্ষা, তারকাপূজারিদের সাথে তর্কযুদ্ধের পরীক্ষা, কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাঙার মত দুঃসাহসিক পরীক্ষা, রাজদরবারে স¤্রাটের সাথে তর্কযুদ্ধ ও বিনিময়ে জ¦লন্ত আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরীক্ষা। এরপর তিনি কেনআনে (ফিলিস্তিন) হিজরত করেন। সেখানে তাকে নিম্নোক্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় : কঠিন দুর্ভিক্ষে নিপতিত হয়ে জীবিকার সন্ধানে মিসর গমন, মিসরের স¤্রাটের বদনজরে পড়ে স্ত্রী সারা অপহৃত হন, মিসর থেকে কেনআনে ফিরে আসার কিছুদিন পর দুধের বাচ্চা ইসমাইলসহ স্ত্রী হাজেরাকে জনমানবহীন বিরানভূমি ও নির্জন উপত্যকা মক্কায় রেখে আসার নির্মম পরীক্ষা, ৮০ বছর বয়সে নিজের খাতনা নিজে করার পরীক্ষা, সবশেষে নিজের রক্তের বাঁধন ১৩-১৪ বছরের প্রাণের চেয়ে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করার পরীক্ষা। চলুন ফিরে যাই আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বের আরব মরুভূমিতে। বৃদ্ধ পয়গম্বর হযরত ইবরাহিম (আ)-কে আল্লাহপাক স্বপ্নযোগে বললেন, তোমার প্রিয়বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর। পর পর তিন দিন হযরত ইবরাহিম (আ) এ স্বপ্ন দেখলেন এবং প্রতিদিন ১০০ করে মোট ৩০০ শত উট কোরবানি করলেন। পুনরায় স্বপ্নাদেশ হলো- তোমার প্রিয়বস্তু কোরবানি কর। আল্লাহর পেয়ারা হাবিব বুঝতে পারলেন তাকে কোন বিষয়ের ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। কাল বিলম্ব না করে তিনি ইসমাইলকে স্বীয় অভিপ্রায় জানালেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন- “সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছুলো তখন একদিন ইবরাহিম তাকে বললো, ‘হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তুমি বলো তুমি কি মনে কর?” সে বললো, “হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।” (সূরা আস সফফাত : ১০২) পিতা তার প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে নিয়ে কোরবানির স্থান মিনায় উপস্থিত হলেন। নিজের চোখ বেঁধে পুত্রকে উপুড় করে তার ঘাড়ে ছুরি চালালেন পিতা ইবরাহিম (আ)। আল্লাহর হুকুমে ইসমাইলের পরিবর্তে বেহেশতি দুম্বা জবেহ হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিলো এবং ইবরাহিম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলো এবং আমি আওয়াজ দিলাম, হে ইবরাহিম! তুমি স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়ে দিয়েছো। আমি সৎকর্মকারীদেরকে এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা। একটি বড় কোরবানির বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম এবং পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তার প্রশংসা রেখে দিলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহিমের প্রতি।” (সূরা আস সফফাত : ১০৪-১০৯) আত্মত্যাগের এত উঁচু মার্গের অনুপম উপমা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি ঘটেনি। এই মহান ত্যাগের নজির আল্লাহপাককে এত খুশি করে যে তিনি কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য কোরবানির বিধান প্রতিষ্ঠা করে দেন। রাসূল (সা) বলেছেন, “কোরবানির দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোনো আমল আল্লাহর কাছে নেই। কোরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশম ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কোরবানির রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কোরবানির সঙ্গে নিঃসংকোচ ও প্রফুল্লমন হও।” (ইবনে মাজা, তিরমিজি) কোরবানির উদ্দেশ্য কোরবানির উদ্দেশ্য মূলত পশু কোরবানির আড়ালে মনের পশুত্বকে কোরবানি দেয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া। তিনি তাদেরকে তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও। (সূরা আল হজ : ৩৭) মহান আল্লাহর তরফ থেকে বান্দাদের আত্মিক ও শারীরিক পরিশুদ্ধতার জন্য বিভিন্ন এবাদত-বন্দেগির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেগুলোর একনিষ্ঠ আমলের মাধ্যমে বান্দাহ তার স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, শুকরিয়া আদায় ও নৈকট্য লাভ করে থকে। ইব্রাহিমি সুন্নত ‘কোরবানি’ তেমনি একটি এবাদত। বান্দার সাথে আল্লাহর সম্পর্ক কিছু চুক্তি ও দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক। বান্দাকে আল্লাহপাক অত্যধিক ভালোবাসেন। বান্দাহ ভুল করলে তিনি ক্ষমা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেন। না চাইতেই তিনি বান্দাকে অবারিত দিয়ে থাকেন। তিনি মেহেরবানি করে বান্দাদের জন্য ভালো-মন্দ দু’টি পথ বাতলে দিয়েছেন। তার নির্দেশিত পথে চললে চিরশান্তির জান্নাত এবং না চললে চির দুঃখের জাহান্নাম প্রস্তুত করে রেখেছেন। অতঃপর তিনি চান বান্দারা যেন তার দেখানো চির শান্তির পথে চলে। বিনা প্রশ্নে এবং পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে তার সকল বিধান মেনে চলে। বান্দাগণ শুধু মৌখিকভাবে তাঁর স্বীকৃতি, গুণকীর্তন ও আনুগত্য প্রকাশ করে না-কি বাস্তব কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তাঁর বিধান মেনে চলে তা তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখে নিতে চান। এভাবে বান্দাগণ নিজেদের জীবন, পরিবার-পরিজন, ধন-সম্পদ সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসবে তার রবকে। তাঁর সন্তুষ্টির জন্য জীবন-সম্পদ অকাতরে কোরবানি করতে তিলমাত্র পিছপা হবে না। মানুষের অর্থনৈতিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান এমনকি প্রাণের চেয়ে প্রিয় জিনিসটিও তাঁর পথে বিলিয়ে দিতে মোটেও কুণ্ঠিত হবে না। ইব্রাহিমি সুন্নত কোরবানিও তেমনি একটি বিধান। মনের পশুত্বকে ধ্বংস করে আত্মিক উৎকর্ষতা ও উন্নয়নই যার উদ্দেশ্য। যার কুরআনিক পরিভাষা হচ্ছে ‘তাক্বওয়া’। সূরা আল হজ এর ৩৭ আয়াতে কোরবানির মাধ্যমে ‘তাক্বওয়া’ অর্জনের কথাই বলা হয়েছে। মানুষ খালেস আল্লাহর জন্য এবং নিজের অন্তরের পাশবিকতা দূরীকরণের নিমিত্তে কোরবানি করবে। পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের অভাবগ্রস্ত মানুষের জন্য কিছু করণীয়ও নির্দেশ করে কোরবানি। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম বাহন এই কোরবানি। হজরত যায়েদ বিন আরকাম (রা) বলেন, রাসূল (সা) এর সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল! এই কোরবানিটা কী? রাসূল (সা) জবাবে বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ) এর সুন্নত বা আদর্শ। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী ফায়েদা রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, (কোরবানির পশুর) প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। সাহাবিরা আবার জানতে চইলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ভেড়া-দুম্বার পশমের ব্যাপারে কী কথা? তিনি বললেন, এর প্রতিটি পশমের বিনিময়েও এক একটি নেকি রয়েছে।” (ইবনে মাজাহ) কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত ছয়টি : প্রথমত- কোরবানি দাতা স্বাধীন হওয়া। দাস-দাসীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। দ্বিতীয়ত- কোরবানি দাতা মুকিম (স্থায়ী অধিবাসী) হওয়া। মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। তৃতীয়ত- কোরবানিদাতা মুসলিম হওয়া। কাফেরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। চতুর্থত- ধনী বা মালিকে নেসাব হওয়া। অর্থাৎ- জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিক হতে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় ধন-সম্পদ বাদে সাড়ে ৭ ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ ভরি রূপা বা তার সমপরিমাণ মূল্যের মালিক হয় তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। পঞ্চমত- বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া। নাবালেগের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। ষষ্ঠত- আকেল বা বুদ্ধিমান হওয়া। পাগলের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। কোরবানি ওয়াজিব এমন ব্যক্তি প্রথমে নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি দেয়ার পর পরে অন্যদের পক্ষ থেকে দিতে পারবে। তবে নিজের পক্ষ থেকে না দিয়ে অন্যের পক্ষ থেকে দিলে তা সহিহ হবে না। নিজের পক্ষ থেকে দেয়ার পর মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও দিতে পারবে। কোরবানি মালে নিসাব হওয়ার শর্তে প্রতি বছরই ওয়াজিব। কোরবানির দিন সাহেবে নিসাব কোন শরয়ি কারণ ছাড়া কোরবানি না করে নগদ অর্থ গরিব-মিসকিনদের মাঝে বিলিয়ে দিলে কোরবানি আদায় হবে না। তবে কোন কারণে কোরবানি করা অসম্ভব হলে সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে সমপরিমাণ অর্থ মিসকিনদের মাঝে দান করে দেয়া ওয়াজিব। সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে কোরবানি করার জোর তাগিদ দিয়ে রাসূল (সা) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের ধারে কাছেও না আসে। (ইবনে মাজা, আহমদ, দারে কুতনি হাকিম) কোরবানি কবুল হওয়ার শর্তাবলি প্রতিটি ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের (সা) তরিকা অনুসরণ বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া কোন ইবাদত আল্লাহপাক কবুল করবেন না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদেরকে তো এ ছাড়া আর কোনো হুকুম দেয়া হয়নি যে, তারা নিজেদের দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করবে।’ (সূরা আল-বাইয়েনা : ৫) সূরা কাহফ এর ১১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- “যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।” এই দু’টি আয়াতের মূলনীতির আলোকে কোরবানি কবুল ও শুদ্ধ হওয়ার জন্য কতিপয় শর্ত নিম্নে আলোচনা করা হলো : নিয়তের পরিশুদ্ধতা কোরবানি কবুল হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে ইখলাস। খালেস নিয়ত ছাড়া অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় কোরবানিও কবুল হবে না। আর নিয়তের খুলুসিয়াত আসে তাক্বওয়ার গুণাবলি অর্জনের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ বলেন- ‘আল্লাহ মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ২৭) পবিত্র কালামে পাকের পর পৃথিবীর সবচেয়ে সহিহ্ কিতাব বুখারি শরীফের প্রথম হাদীস- ‘ইন্নামাল আ‘মালু বিন্নিয়্যাহ’। অর্থাৎ আমল বলতেই সহিহ নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমান সময়ে কোরবানির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। নিয়তের পরিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আলোচনা কারা যেতে পারে : প্রথমত: লোক দেখানো (বীযরনরঃরড়হ) : কোরবানি হতে হবে আল্লাহকে দেখানো ও তার সন্তুষ্টির নিমিত্তে। দুনিয়ার কোন নেতা, প্রতিবেশী ও সাধারণ মানুষকে দেখানোর জন্য বড় বড় পশু লাখ লাখ টাকা দিয়ে কিনে জবাই করলে গোশত খাওয়া হবে কিন্তু কোরবানি হবে না। দেখা যায়, বিশেষত যারা রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধি বা কোন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী এমন ব্যক্তিগণ নিজেদের দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য বেশি দাম দিয়ে একাধিক বড় বড় পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। এগুলোর উদ্দেশ্য কী? কী নিয়তে তিনি এসব করছেন? যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাক্বওয়ার পরিবর্তে অন্য কোন নিয়ত থেকে থাকে তবে কোরবানি কবুল হবে না। এ ছাড়া অনেক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, প্রাক্তন নেতা, প্রাক্তন জনপ্রতিনিধি আছেন যারা পুনরায় আলোচনায় আসতে কারো মনোরঞ্জনের জন্য বা নিজের প্রেস্টিজ ধরে রাখতে একাধিক বা বড় পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। এমন ক্ষেত্রেও কোরবানি কবুল হবে না। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এগুলোর (পশু) গোশত ও রক্ত আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। কিন্তু পৌঁছে তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সূরা আল-হজ : ৩৭) দ্বিতীয়ত: অন্যান্য মৌলিক ইবাদত (ইধংরপ ড়িৎংযরঢ়) : যিনি বা যারা বেশি দাম দিয়ে বাজারের সেরা পশুটি কোরবানি দিলেন তারা আল্লাহর অন্যান্য হুকুমাদি (যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, সত্যবাদিতা, হালাল উপার্জন, হালাল পথে ব্যয় ইত্যাদি) সঠিকভাবে পালন করেন কি-না তা দেখার বিষয়। ইসলামের মৌলিক ইবাদত যা প্রতিনিয়ত করতে হয় সেগুলোর ধারে-কাছে না গিয়ে শুধু এমন ইবাদতগুলোয় যদি গুরুত্ব দেয়া হয় যা মানুষ দেখতে পায়, তাহলে বুঝতে হবে নিয়তে সমস্যা আছে। এমন ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তৃতীয়ত: গোশত খাওয়া : পাড়া-প্রতিবেশী সবাই কোরবানি দিচ্ছে আমি না দিলে কেমন হয় এবং পরিবারের সদস্যগণ অন্তত ঈদের দিন গোশত দিয়ে ভাত খেতে পারবে না, বাচ্চারা অন্যদের দিকে তাকিয়ে থাকবে, স্ত্রী-পরিজনের কাছে ছোট-হেয় হতে হবে ইত্যাদি নিয়তে কেউ কোরবানি করলে তার কোরবানিও কবুল হবে না। ফ্রিজ থাকার কল্যাণে কেউ যদি ভাবেন- সারা বছর কোরবানির গোশত দিয়ে চালিয়ে দিবেন অন্তত এ জন্যও তো কোরবানিটা দেয়া দরকার! এ ধরনের নিয়তের কোরবানিও গ্রহণীয় হতে পারে না। আর্থিক পরিশুদ্ধতা এটি সর্বজনবিদিত যে অবৈধ অর্থ দান-খয়রাত করলে কোনো সওয়াব পাওয়া যায় না। কেউ যদি চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, সুদ-ঘুষ, আত্মসাৎ, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা, বা অন্য কোনো অবৈধ পন্থায় আয় করা কোটি টাকাও দান করেন তবে তাতে সামান্য নেকিও অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তাই অবৈধ আয় দিয়ে যত বড় পশুই কোরবানি দেয়া হোক না কেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং চুরিকৃত, বন্ধকী পশু, আত্মসাৎকৃত, কর্জ করা পশু বা কুড়িয়ে পাওয়া পশু, সাদকা, বেআইনি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে কেনা পশু, কেনার সময় ফাঁকি দিয়ে খাজনা না দেয়া বা ঠকানোর মাধ্যমে কেনা বা পাওয়া কোন পশু দিয়ে কোরবানি আদায় হবে না। কেবল হালাল বা বৈধ আয় দিয়ে ক্রয় করা পশু যদি শুধু আল্লাহর রাজি-খুশির জন্য জবেহ করা হয় তবেই তা কবুল হবে। অর্থাৎ পশুর মালিকানা হতে হবে বৈধ উপায়ে। হাদিস শরীফে এসেছে ‘আল্লাহ তায়ালা হালাল বস্তু ছাড়া আর কোনো কিছুই কবুল করেন না। (বুখারী)। কোরবানির পশুর শ্রেণি ও মান কোরবানির পশু সেই শ্রেণি ও মানের হতে হবে যা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারণ করেছে। মূলত নিজের গৃহে অতি যতেœ লালিত-পালিত পোষা প্রাণী কোরবানি দিতে পারাটা উত্তম। তবে বাজারের কেনা পশুও কোরবানির উপযুক্ত। সেগুলো হলো- গরু, ছাগল, মহিষ, উট, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় ‘বাহিমাতুল আনআম’ বলা হয়েছে। সুরা আল হজের ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “আমি প্রত্যেক সম্প্রদাযের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি এবং তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দেয়া হয়েছে, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।” সুতরাং চতুষ্পদ জন্তু যা অন্যান্য সময় খাওয়া হালাল তা দিয়ে কোরবানি করতে হবে। দ্বিতীয়ত: কোরবানির পশু হতে হবে দোষ-ত্রুটিমুক্ত, সুস্থ-সবল। হযরত বারা ইবনে আজেব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- “রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েয হবে না। অন্ধ- যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত- যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু- যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত- যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।” (তিরমিজি-১৫৪৬)। নাসাঈর বর্ণনায় আহত শব্দের স্থলে পাগল উল্লেখ আছে। কোরবানির পশুর বয়স ও ভাগ রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কোরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষশাবক কোরবানি করতে পার।” (মুসলিম) “একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কোরবানির জন্য শরিক হতে পারে”। (সহিহ মুসলিম) নবী (সা) আরো বলেন- “দাঁতালো ছাড়া জবেহ করো না। তবে তা দুর্বল হলে ছয় মাসের মেষ জবেহ কর। (সহিহ মুসলিম) ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে কোরবানির উট পাঁচ বছর, গরু বা মহিষ অন্তত দু’বছর, ছাগল-ভেড়া-দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কোরবানি করা যায়। উলামায়ে ক্বিরাম এ বিষয়ে একমত যে, ছ’মাস বয়সী মেষের কোরবানি বৈধ হবে; এক্ষেত্রে অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক। ভাগের ক্ষেত্রে একটি উট-গরু ও মহিষে সর্বোচ্চ ৭ জন ভাগী হতে পারেন। উটের ক্ষেত্রে ১০ জনের ভাগী হওয়ারও হাদীস আছে। ছাগল, ভেড়া জাতীয় প্রাণী একজনকেই কোরবানি করতে হবে। অন্যথায় কোরবানি শুদ্ধ হবে না। অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে- শরিকদের বিষয় খোঁজখবর নিতে হবে। কেননা, কোনো এক শরিকের ইনকামে ভেজাল থাকলে সবার কোরবানি বাতিল হয়ে যাবে। পশু কোরবানি করার পর অনুমান করে গোশত ভাগ করা চলবে না। সঠিক দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে নিতে হবে। যাতে কারো মনে সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কোরবানির গোশত খাওয়া ও বন্টন করা মুস্তাহাব হলো- কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনদের ও এক ভাগ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া। তবে কেউ যদি পুরোটাই নিজের জন্য রেখে দেয় তবেও কোরবানির কোন ক্ষতি হবে না। কোরবানির চামড়া বা তার নগদ অর্থ গরিব-মিসকিনদের মাঝে দান করতে হয়। তবে, গরিব-নিঃস্বরাও যাতে ঈদের আনন্দ করতে পারে সে লক্ষ্যে কেবল ভোগ নয়, ত্যাগের মনোভাব নিয়ে তাদের মধ্যে কোরবানির গোশত অকাতরে বিলিয়ে দেয়া এবং দান-সাদকা করা অতি উত্তম। ইসলামের কোরবানি শুধু পশু জবেহর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরের পাশবিকতা-চিন্তা-চেতনার যথাযথ কোরবানি। লোক দেখানো নিয়ত, প্রশংসা কুড়ানো, হাইলাইটেড হওয়া এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে পশু কোরবানি দিলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না হোক না তা যত দামি এবং বড়। মনের গভীরে আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং পূর্ণ একাগ্রতা নিয়ে কোরবানি করাই হচ্ছে ইবরাহিমি সুন্নাত। আল্লাহ হচ্ছেন ‘আলিমুম বিজাতিছ্ছুদুর’ অন্তর্যামী। সমাজের মানুষ না বুঝলেও তাঁর কাছে ফাঁকি দেয়া কোনো মতেই সম্ভব নয়। তাই আত্মত্যাগ ও মনের সব কুপ্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালানোই হোক কোরবানির একমাত্র উদ্দেশ্য। লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির