post

আরবের ইসলামপন্থীরা কি ব্যর্থ হয়েছে?

০৭ ডিসেম্বর ২০১৩

তানভীর আহমেদ|

আরব বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো বিশ্বব্যাপী একটি খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে দিচ্ছে যে, সরকার পরিচালনায় ইসলামপন্থীরা ব্যর্থ হয়েছে। অনেকে কথাটা এমনভাবে বলছেন, এটা একটা জানা বিষয় যে ইসলামপন্থীরা ব্যর্থ হবেই। তাদের মতে, আরবের জনগণ ভোট দিয়ে ইসলামপন্থীদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়েছিল কিন্তু তারা রাষ্ট্র চালাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুতরাং তাদের জন্য উচিত কাজটি হবে সরে দাঁড়ানো এবং অন্যদের সুযোগ করে দেয়া। কিন্তু এই যুক্তি মূলত ‘রাজপথের বৈধতা’ নামক এক নতুন তত্ত্বের ন্যায্যতা উৎপাদন এবং ব্যালট বক্সের ন্যায্যতা অস্বীকার করার জন্যই হাজির করা হয়েছে। আসলে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের কোনো অভিজ্ঞতা এখনো শুরুই হয়নি। তারা মাত্র কয়েক মাসের জন্য ক্ষমতায় ছিল। আর এই সামান্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। অন্য দিকে সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী এবং বামপন্থীরা কয়েক দশক ধরেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে আসছে। তাদের এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সঙ্গে ইসলামপন্থীদের ওই স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতার তুলনা করে বিচার করাটা একদমই ন্যায্য হয়নি। এ ছাড়া সেক্যুলারদের এতো লম্বা অভিজ্ঞতার পরও এখনো নিজের জনগণকে হত্যার মধ্য দিয়েই তাদেরকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। তবে এটা বলাটাও ঠিক হবে না যে, ইসলামপন্থীরা কোনো ভুল করেনি। তাদের ভুল-ভ্রান্তি যেমন হয়েছে, তেমনি এতো অল্প মেয়াদে তাদের অর্জনও কম নয়। অথচ তাদের ভুলগুলোকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে। তাদের ছোট-খাটো ভুলগুলোকেও অনেক বড় করে দেখানো হচ্ছে। এ ছাড়া প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো ইসলামপন্থীদেরকে অনবরত ‘ভয়ানক দানব’ হিসেবে চিত্রায়িত করছে এবং তাদেরকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করার দাবি তুলছে। আরবের জনগণ ইসলামপন্থীদের কেন নির্বাচিত করেছিল? আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সূচনা থেকেই ইসলামপন্থীরা এর বিরোধিতা শুরু করে। ইসলামপন্থীরা ক্রমাগত সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে থাকলে তাদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু হয়। ইসলামপন্থীদের মোকাবেলা করার জন্য পশ্চিমারা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ নামক ধারণা আবিষ্কার করে। এর মাধ্যমে তারা মূলত ইসলামী আন্দোলনের বিশেষ কিছু উপাদান এবং এর নেতাদের সমাজে তাদের যে জনপ্রিয় এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনকে আরো বিভক্ত করার জন্য উদারবাদী, চরমপন্থী এবং ঐতিহ্যবাদী এসব ধারণারও প্রচলন করে পশ্চিমারা। উদারবাদীদেরকে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করানোর মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠীগুলোর বৈধতা উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। অন্য দিকে চরমপন্থীদেরকে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয়দিক থেকেই দমন করা হয়। আর ঐতিহ্যবাদীদের ব্যবহার করা হয় বিদ্যমান স্বৈরশাসক গোষ্ঠীগুলোকে টিকিয়ে রাখার পিলার হিসেবে। অন্য দিকে আরবের শাসক গোষ্ঠীগুলো পশ্চিমাদেরকে ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে আরও দূরে সরিয়ে রাখতে ইসলামভীতির ইস্যুটিকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করে। এর পাশাপাশি এই শাসকগোষ্ঠীগুলোর প্রতি অনুগত গণমাধ্যমগুলো স্বদেশে ইসলামপন্থীদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রকল্পকে দানবীয় রূপে চিত্রায়িত করে। এর মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি যে গণসমর্থন রয়েছে তা থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করাই ছিল গণমাধ্যমগুলোর মূল লক্ষ্য। কিন্তু এতো কিছুর পরও ইসলামপন্থীরা আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং সমগ্র আরবের সাংস্কৃতিক জগতে আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয়। অধিকন্তু আরব বসন্তের পর অনেক আরব দেশের জনগণই তাদেরকে স্বেচ্ছায় রাষ্ট্র চালানোর জন্য বেছে নেন। আরবের জনগণ তাদেরকে সমর্থন করার প্রধান কারণ ইসলামপন্থীরাই প্রধানত আরব দেশগুলোতে পশ্চিমা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং একমাত্র তারাই ফিলিস্তিনে ইহুদি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থীরাই আরবের স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়েও মূল নেতৃত্ব দিয়েছিল। এ কারণেই আরবের জেলখানাগুলো এখনো ইসলামপন্থী নেতা-কর্মীদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে রয়েছে। তৃতীয়ত, ইসলামপন্থীদের সাংস্কৃতিক প্রকল্পের সঙ্গেই আরব জনগণ সবচেয়ে বেশি আত্মীয়তা অনুভব করেছে। তারাই সাংস্কৃতিক দিক থেকে আরবের সাধারণ জনগণের কাছাকাছি যেতে পেরেছে। আর এ কারণেই সাধারণ আরবরা তাদেরকে রাজনৈতিকভাবেও সমর্থন করেছে। ইলামপন্থীরা কি ব্যর্থ হয়েছে বা তারা কি ব্যর্থ? ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে এ ধরনের ধারণার প্রচারণার ব্যাপকতা সত্ত্বেও কয়েকটি স্তরে এ ধারণার বিশ্বাসযোগ্যতায় দুর্বলতা রয়েছে। প্রথমত, ইসলামপন্থীদের বিরোধীরাই এ ধারণার প্রচার করছে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। আরব বসন্তের বিপ্লবী গণজাগরণের প্রেক্ষিতেই ইসলামপন্থীদের ঠেকাতে তারা এ প্রচারণা চালায়। আর ইসলামী প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে এ প্রচারণা তারা এমনভাবে চালায়, যেন এখন কর্তব্য হয়ে পড়েছে রাজনীতি থেকে ইসলামপন্থীদেরকে পুরোপুরি বিতাড়িত করা। দ্বিতীয়ত, মিসরের পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র মিলে এমন একটি নৈর্ব্যক্তিক পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে ইসলামপন্থীদের সফল হওয়ার কোনো শর্তই বিদ্যমান ছিল না। পুরনো শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অনুগত রাষ্ট্রযন্ত্রের হর্তাকর্তারা তাদেরকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ফাঁদে ফেলতে থাকে। দেশে-বিদেশে ইসলামপন্থীদের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে মিলে তারা ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। তৃতীয়ত, ইউরোপ-আমেরিকা কখনোই ইসলামপন্থীদেরকে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিল না। তারা বরং সাময়িকের জন্য তাদেরকে মেনে নিত এবং তারা জানতো যে অচিরেই তাদেরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় ইসলামপন্থীদেরকে সাময়িকের জন্য মেনা নেয়াটা আসলে একটা ফাঁদ। তাদেরকে অক্ষম প্রমাণিত করার ফাঁদ। এরপর এই ব্যর্থতার অজুহাত ব্যবহার করে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হবে। তবে ইসলামপন্থীদের ভুলের কারণেই শুধু মিসরের প্রতি বিপ্লব সফল হয়েছে তা বলা যাবে না। কারণ, সেক্যুলারদেরও অনেক ভুল ছিল। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বদলে রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে মিলে ইসলামপন্থীদের ব্যর্থ প্রমাণ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যার ফলে অবশেষে খোদ গণতান্ত্রিক বিপ্লবটিই ধ্বংস হয়। ইসলামপন্থীদের সবচেয় বড় ভুলগুলো প্রথমত, ইসলামপন্থীরা বিপ্লবের সমর্থক অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে জোট গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা শুধু নিজেদের সমর্থকদের সংগঠিত করতেই বেশি সময় ব্যয় করে। এর ফলে রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ইসলামপন্থীরা কোনো সমষ্টিগত জাদীয়তাবাদী বয়ান হাজির করতে ব্যর্থ হয়। তারা সবসময় নিজেদের সঙ্কীর্ণ আদর্শবাদিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল। দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক বয়ানের অতি বেশি ইসলামীকরণ। এর ফলে সেক্যুলার রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং পশ্চিমারা আরবের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অবশেষে স্বদেশী এবং আঞ্চলিক অগণতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীগুলো ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে জোট গড়ে তোলে। তৃতীয়ত, ইসলামপন্থীরা বিপ্লবের চাহিদা এবং রাষ্ট্রের চাহিদাগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি তারা বিপ্লবী স্তরটি সুচারুরূপে অতিক্রম করতেও ব্যর্থ হয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সবচেয়ে বড় ভুলগুলো প্রথমত, গণতন্ত্রায়নের ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঐক্য বোধ না করা। তারা ইসলামপন্থীদেরকে সহায়তা না করে, বরং তাদের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং শুধুমাত্র ইসলামপন্থীদেরকে ব্যর্থ করে দেয়ার চেষ্টায় রত থাকে। পাশাপাশি ইসলামপন্থীদেরকে উৎখাতে বিদেশী শক্তিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করে। দ্বিতীয়ত, বিরোধীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের পুরনো হর্তকর্তাদের একটা বিশাল গ্রুপ এবং প্রতিবিপ্লবী নেতাদেরকে ইসলামপন্থীদের বিরোধী রাজনৈতিক জোটের অন্তর্ভুক্ত করে তাদেরকে বৈধতা দান করেছে। ফলে গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি প্রগতিশীল সেক্যুলার বিরোধীরা নয়, বরং পুরনো প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী এবং প্রতিবিপ্লবীরাই পুনরায় ক্ষমতা দখল করে নিতে সক্ষম হয়। তৃতীয়ত, আর বিরোধীরা ইতিবাচক বিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারেনি। তারা বরং নেতিবাচক বিরোধী হিসেবে কাজ করে। ফলে একটা পর্যায়ে তারা ইসলামপন্থীদের হঠানোর জন্য গণতন্ত্রবিরোধী সামরিক শাসনকে মেন নেয়। এমনকি তারা নতুন ইসলামপন্থী সরকারকে একটি পূর্ণ মেয়াদের শাসনকালের অভিজ্ঞতা অর্জনেও সহায়তা করতে অস্বীকার করে। এভাবে তারা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারে। নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে গেলে দেখা যাবে যে আসলে ইসলামপন্থীরা ব্যর্থ হয়নি, বরং তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে ব্যর্থ করানো হয়েছে। তাদের অনেক ভুলভ্রান্তি ছিল তা সত্য। কিন্তু যারা তাদের এই ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে মারাত্মক পাপ হিসেবে প্রচার করেছে তারাই মূলত ইসলামপন্থীদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী। ইসলামপন্থীদের ভবিষ্যৎ সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামপন্থীদের এখনো কোনো পূর্ণ অভিজ্ঞতা হয়নি। মিসরের ইসলামপন্থীদেরকে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বল প্রয়োগে উৎখাত করা হয়। আর তিউনিসিয়া এবং অন্যান্য দেশে তাদেরকে এখনো প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। ইতিহাস আমাদেরকে এই শিক্ষাই দেয় যে, সভ্যতা এবং রাজনৈতিক প্রকল্পের দিক থেকে শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও যাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয় তারা পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। আর তারা বরং আগের চেয়ে আরও অনেক বেশি শক্তি নিয়ে ফিরে আসে। কারণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বর্বর শক্তি প্রয়োগ ক্ষমতার বৈধতা নির্মাণে বর্তমানে আর তেমন একটা কাজ করে না। বর্তমানে ক্ষমতার বৈধতার জন্য এর সঙ্গে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পও দরকার হয়, অন্তত কৌশলগত পর্যায়েও হলেও। ইসলামপন্থীরাই আরবের আঞ্চলিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে বিরাজ করবে। কারণ প্রথমত, যেসব কারণে আরবের জনগণ ইসলামপন্থীদেরকে নির্বাচিত করেছিল সেসব এখনও বলবৎ রয়েছে। আর ইসলামপন্থীরাই জনসমর্থনের দিকে থেকে এখনো পর্যন্ত আরবের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন। কারণ তারাই সাংস্কৃতিক দিক থেকে সাধারণ জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি। আর তাদের ওপর বর্তমানে যে বেইনসাফ করা হচ্ছে সে কারণেও তাদের প্রতি জনসমর্থন বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পও এখনো আরবের গণসংস্কৃতির সঙ্গে গভীর সঙ্গতিপূর্ণ। আর এ কারণেই সশস্ত্র সেনাবাহিনী ছাড়া আর কারোরই সামর্থ্য নেই তাদরেকে উৎখাত করার। যেমনটি ঘটেছে মিসরের ক্ষেত্রেও। মিসরের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যারা যুক্ত হয়েছে তারা শুধু এর শোভাবর্ধন এবং একে একটি বেসামরিক মুখোশ পরানোর কাজই শুধু করছে। তৃতীয়ত, আরবের কোনো দেশের ইসলামপন্থীরাই তাদের স্বল্পকালীন শাসনামলেও মানবাধিকার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করেনি। যেমন মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির এক বছর শাসনামলে মিসরে পদ্ধিতগতভাবে মানবাধিকার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের কোনো নজির নেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট মুরসি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এতটাই সচ্ছতা অবলম্বন করেছেন যে তিনি নিজেও রাষ্ট্র থেকে কোন বেতনভাতা নিতেন না। তা ছাড়া ইসলামপন্থীদের ওপর চলমান নির্মম নির্যাতন এবং দফায় দফায় গণহত্যার পরও তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা সশস্ত্র পন্থা অবলম্বন করছে না। চতুর্থত, প্রতিবিপ্লবীদের চালানো প্রপাগান্ডার মোহ অচিরেই কেটে যাবে এবং এই মোহ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই জনগণ আবারো জেগে উঠবে। আর এই জাগরণ হবে আরো অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জ্বলন্ত আগুনের মতো। ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। দিগন্তে ক্ষীণ আলোর রেখা আরব বসন্ত থেকে উদ্ভূত গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে রক্ষা করতে হলে প্রথম থেকেই যারা এর সমর্থক ছিল তাদের সবাইকে আবারো দলবাজির ঊর্ধ্বে ওঠে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আরব বসন্তকে প্রতিবিপ্লবীদের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবিপ্লবীরা এখন আরব বসন্তকে ভ-ুল করে দিতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং নতুন খোলসে পুরনো স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর মতোই একটি শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে। মিসরের তথাকথিত যে প্রগতিশীলরা শুধুমাত্র ঘৃণা থেকেই ইসলামপন্থীদের বিরোধিতা করছে তাদের উচিত প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ ত্যাগ করে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। কারণ এ ছাড়া আর অন্য কোনো উপায়ে তারা আরব বসন্তের গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে রক্ষা করতে পারবে না। ইসলামপন্থীদের বিরোধিতা করলে তাদের সামনে সেনাবাহিনী ছাড়া আর কোনো বিকল্প অবশিষ্ট থাকবে না। সেনাবাহিনী মূলত নতুন খোলসে পুরনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীকেই পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসাবে। মিসরের ঘটনাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এমনকি প্রগতিশীলরা যদি এখনই ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একটি অংশীদারিত্বমূলক এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে না তোলে তাহলে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিপ্লবী উত্থানের মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থীরা একাই ক্ষমতায় চলে আসবে। রাজনীতির মাঠ তখন অনেক সঙ্কীর্ণ হয়ে আসবে এবং তথাকথিত প্রগতিশীলদের সামনে বুক চাপড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির