post

আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ড. মাহফুুজুর রহমান আখন্দ

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
[শেষ কিস্তি] আরাকানের মুসলমানগণ ১৯৪২ সালের পূর্ব পর্যন্ত দু-একটি বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া ধর্মীয় স্বাধীনতা থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছিল এবং সেখানকার মগ সম্প্রদায়ের সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে, স্থানীয় মগরা ইয়োমা পাহাড়ের উচ্চ শৃঙ্গের অপর পাড়ের বৌদ্ধদের চেয়ে প্রতিবেশী রোহিঙ্গাদেরকে বেশি আপন মনে করতো। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে গোটা উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সুবাদে বার্মায় থাকিন পার্টির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে পার্টির নেতৃবৃন্দ আরাকানের মগ নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্ক গড়ে মুসলমান-মগদের মাঝে স্থায়ী বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাধীনতা-উত্তর আরাকানকে বর্মীভুক্ত রাখার পরিকল্পনা করে। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত থেকে ব্রিটিশ বার্মা আলাদা হওয়ার পর ব্রিটিশ প্রশাসন বার্মায় অভ্যন্তরীণ স্থানীয় সরকার গঠনের বিষয় অনুমোদনের মাধ্যমে বর্মী নেতৃবৃন্দের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেয়, ফলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উসকানি দিয়ে ১৯৩৮ সালে রেঙ্গুনসহ নিচু অংশে মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে ৩০,০০০ মুসলমানকে হত্যা করে। এ সূত্র ধরে ১৯৪০ সালে মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধ ধর্ম ও এর প্রচারক গৌতম বুদ্ধের অবমাননার অভিযোগ এনে থাকিন পার্টি নামে বর্মী জাতীয়তাবাদী চরমপন্থী দল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা করে; যার পরিণতি হিসেবেই ১৯৪২ সালে আরাকানে মুসলিম নিধনযজ্ঞ সংঘটিত হয়। স্বাধীনতার পর সাময়িক সঙ্কট কেটে বার্মা ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন কর্তৃক সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মোতাবেক জনপ্রতিনিধিত্বশীল, জবাবদিহিমূলক শাসনতন্ত্রের অধীনে শাসিত হয়েও মুসলমানরা পুরোপুরিভাবে মানবাধিকার ফিরে পায়নি; বরং জাতিগত রোষানলে পড়ে নির্বিচারে হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। বার্মা কর্তৃপক্ষ ১৯৪৭ সালে নতুন শাসনতান্ত্রিক পরিষদ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রণীত ভোটার তালিকায় ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ অজুহাতে আরাকানের মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলোকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়। এর প্রতিবাদের মোহাম্মদ জাফর হুসাইন কাওয়াল বা জাফর কাওয়াল নামে আকিয়াবের জনৈক যুবক মুক্তি আন্দোলনের সূচনা করেন। অতঃপর ১৯৪৭ সালের ২০ আগস্ট বুচিদংয়ের দাব্রুচং গ্রামে জাফর কাওয়ালের নেতৃত্বে মুজাহিদ পার্টি সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। নে উইনের শাসনামলে একদিকে অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, খাদ্যশস্য লুট, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ এবং মুদ্রা অচল ঘোষণায় অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখে যাত্রা; অন্য দিকে সাংগঠনিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিয়ে সরকারিভাবে নির্যাতন চালায়। এমতাবস্থায় মুসলমানদের মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। নির্যাতনের একপর্যায়ে রোহিঙ্গা মুজাহিদরা পুনরায় জড়যরহমুধ চধঃৎরড়ঃরপ ঋৎড়হঃ নামে নতুন করে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। বর্মী কর্তৃপক্ষ মুসলমান নির্মূলে আরো বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র মুসলমানদের কৃষি উৎপন্ন দ্রব্যাদির ওপর ব্যাপকভাবে উচ্চ হারে করারোপ করে এবং আরোপিত কর পরিশোধ করতে না পারলে তাদের বাড়িঘর ঘেরাও করে জীবিকার জন্য মজুদকৃত খাদ্য-শস্যাদি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে অনেক অস্থাবর সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেই সাথে বর্মী সরকার ওয়াক্্ফকৃত জমি ও সম্পত্তি বেআইনিভাবে ভিত্তিহীন অজুহাতে ছিনিয়ে নেয়। আরাকানে জনসংখ্যাগত অবস্থান পরিবর্তন এবং মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্য তাদের বাজেয়াপ্তকৃত ভূমিতে নতুন নতুন মগ বসতি স্থাপন করে। মুসলমানদের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের ক্ষেত্রে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সরকারি অনুমতি ব্যতীত তারা এক থানা থেকে অন্য থানায় যেতে পারে না। অপরদিকে বিনা মজুরিতে জবরদস্তিমূলক শ্রমের মাধ্যমে প্রতিদিন শত শত মুসলমান নারী, পুরুষ ও যুবকদেরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর কাজে দিনের পর দিন খাটানো হয়। শ্রমের মূল্য দাবি করলে কিংবা শ্রমদানে অস্বীকৃতি জানালে অমানবিক নির্যাতন অথবা মৃত্যুকেই সহজে মেনে নিতে হয়। মুসলমানদের ওপর সেনাবাহিনী ও আইনশৃংখলা রক্ষাকরী সংস্থার জন্য নিয়মিত খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করা অনেকটা বাধ্যতামূলক। সামরিক বাহিনী ও মগদের বর্বরোচিত নির্যাতন নিষ্পেষণে মুসলমানদের জীবনের শাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি শুরু হলে তাদের মধ্যকার কিছু বুদ্ধিজীবী বর্মী স্বৈরশাসনের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবার নিমিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট ও সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে ১৯৭০ সালে জড়যরহমুধ ওহফবঢ়বহফবহপব ঋৎড়হঃ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অচিরেই উত্তর আরাকানের শহর-গ্রামাঞ্চলসহ মুসলিম অধ্যুষিত বার্মায় এর কয়েকটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের গোড়ার দিকে মুসলমানরা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জড়যরহমুধ চধঃৎরড়ঃরপ ঋৎড়হঃ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। আরাকানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে তাদের কার্যাবলী সীমাবদ্ধ থাকে। নেতৃত্বের কোন্দলের ফলে ১৯৭৮ সালে উক্ত সংগঠনটি জড়যরহমুধ খরনবৎধঃরড়হ ঋৎড়হঃ নামে আরও একটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭৮ সালের ড্রাগন অপারেশনের কারণে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে উদ্বাস্তু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বিশ্বের সাথে গভীর যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগে অতীত দুর্বলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে, দুনিয়ার আধুনিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে, বার্মার উগ্র স্বাদেশিকতাবাদী শোষণ, জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে মজলুম জনগোষ্ঠীর মুক্তির লক্ষ্যে জেহাদ করে স্বাধীন সার্বভৌম শান্তিময় ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৮২ সালে জড়যরহমুধ ঝড়ষরফধৎরঃু ঙৎমধহরংধঃরড়হ প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্র যুবকদের মধ্যেও শিক্ষাসংক্রান্ত দাবি-দাওয়াসহ ইসলামি চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলাদাভাবে ১৯৮৮ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর ‘ইত্তেহাদ আত তুল্লাব আল মুসলিমিন’ নামক একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে অজওঋ ও জঝঙসহ বিভিন্ন দল ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার নিমিত্তে অৎধশধহ জধযরহমুধ ঘধঃরড়হধষ ঙৎমধহরংধঃরড়হ নামে এক মঞ্চে যোগ দিয়ে নুরুল ইসলাম ও ডা. মুহাম্মদ ইউনুছ এর নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনার চেষ্টা করলেও তা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। মুক্ত স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলেও আর্থিক সঙ্কট, সৈন্য ও অস্ত্রের অভাব, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন ও সহযোগিতার অভাব, অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলসহ বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে বর্মী জান্তার শক্তিশালী সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করতে অচিরেই ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। রোহিঙ্গাদের শরাণার্থী জীবন ও বাংলাদেশ অসহনীয় নির্যাতনের মুখে শুধুমাত্র জীবন বাঁচানোর তাগিদেই রোহিঙ্গারা স্বীয় পৈতৃক বসতবাড়ি, জমাজমি ও ধন স¤পদের মায়া ত্যাগ করে হাঁড়ি-পাতিল, পোটলা-পুঁটলি, বাক্স প্রভৃতি হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। এদের মধ্যে রয়েছে নারী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু, সব বয়সী মানুষ; যাদের চোখে মুখে ভয় আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা হতাশা আর অনিশ্চয়তার সুস্পষ্ট ছাপ। টেকনাফ, উখিয়া ও রামুর পথে প্রান্তরে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের আগমন ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হয়ে ’৯১ সালে এর ব্যাপকতা বেড়ে গণহারে দেশত্যাগ শুরু হয়। ২০১৬-১৭ সালে এটি জন¯্রােতে পরিণত হয়ে পড়ে। লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও সন্ত্রাস চালানো বন্ধ করার জন্য মিয়ানমার ক্ষমতাসীন সামরিক পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থার একটি তথ্যানুসন্ধানী দল বাংলাদেশে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সাথে কথা বলে এবং তাদের ওপর হত্যা-নির্যাতনের মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনের রিপোর্টের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে অ্যামনেস্টি মন্তব্য করে, এটা পরিষ্কার যে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় আরাকান প্রদেশের রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাদের লক্ষ্য। সেখানে গ্রাম ঘেরাও করে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছে এবং তাদের দিয়ে কুলিগিরি করানো হচ্ছে। তাদেরকে অনাহারে অর্ধাহারে রেখে নির্যাতন চালানো হচ্ছে; এমনকি শারীরিক দুর্বলতার কারণে বোঝা বহনে অক্ষম হওয়ার কারণে অনেককে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। বাড়িতে বাড়িতে রোহিঙ্গা মহিলাদের উপর গণধর্ষণ চলছে এবং কাউকে সেনাশিবিরে আটকে রেখে উপযুপরি ধর্ষণ করেছে। সৈন্যরা মুসলমান গ্রামে ঢুকে মসজিদ দখল করে ধর্মীয় গ্রন্থাদি পুড়িয়ে ফেলে এবং খাদ্য-শস্য লুট করে নিয়ে সেনাবাহিনী লিখিত আদেশ দিয়ে জমি-জমা অধিগ্রহণ করার পর গোটা গ্রামের লোকজনকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। অনুরূপ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে মার্কিন মানবাধিকার গ্রুপ, যা ‘এশিয়া ওয়াচ’ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও চাপের ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ সুগম করে। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে সম্প্রতি অভিবাসন প্রার্থীদের বেশ কিছু কবরের সন্ধান পাওয়ার পর সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। চোরাকারবারি তথা পাচারকারীরা মারধর করে তাদের সাথে থাকা টাকা-পয়সা লুট করে। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও অত্যাচারিত হয়ে সাগরের বুকে ভাসতে থাকা এসব অসহায় রোহিঙ্গার দুঃখের কাহিনী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে নতুন জীবনের আশায় একসময় ইউরোপে পাড়ি দেয়া আফ্রিকানদের দুঃখের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে অন্যায় আর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় বহু গুণ। শুরু হয় নানাভাবে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ অভিযান। একের পর এক হামলা হয় রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে শুরু করে নিরীহ রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ থাকায় নৌকায় চড়ে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে শুরু করে তারা। উদ্দেশ্য পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশে আশ্রয় নেয়া। জাতিসংঘের মতে, শুধু ২০১৫ সালে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের মধ্যেই ২৫ হাজার রোহিঙ্গা নৌকায় চড়ে দেশ ছাড়ে। সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা আর অজানায় পাড়ি দেয়া এসব মানুষের বড় একটি অংশ মাঝসমুদ্রেই খাদ্য আর পানির অভাবে মারা যায়। বেশ কিছু নৌকা কোথায় হারিয়ে গেছে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি। অসুস্থ অবস্থায় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী সমুদ্র থেকে উদ্ধার করেছে কয়েক হাজার লোককে। যাদের মধ্যে তিন শতাধিক চিকিৎসাধীন অবস্থায়ই মারা গেছেন। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলেও প্রাণ বাঁচাতে জন্মভূমি ছেড়ে পালানোর এই ধারা বন্ধ হয়নি রোহিঙ্গাদের। কারণ সংখ্যালঘুদের ওপর দমনপীড়নের জন্য কোনো প্রকার জবাবদিহিতাই করতে হচ্ছে না মিয়ানমারকে। সমুদ্র থেকে উদ্ধারকৃত রোহিঙ্গাদের বড় অংশটিকে আশ্রয় দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ২০১৫ সালে মিয়ানমারের বহুল প্রতীক্ষিত নির্বাচনের আগে বাতিল করা হয় রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ও পরিচয়পত্র, যা ছিল তাদের নাগরিকত্বের সর্বশেষ অবলম্বন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সুদীর্ঘকাল থেকে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গত ২০১৬ সালের ২৫ আগস্ট অতর্কিত জঙ্গি হামলার মিথ্যা অভিযোগ তুলে গণহত্যা শুরু করে। বস্তুত রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণের ১০ দিন আগেই মিয়ানমারের ২০টি রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে খোলা চিঠিতে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছিল। ওইসব দল ঐকমত্য পোষণ করে যে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাত করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক সেনাবাহিনী ২৫ আগস্ট গভীর রাতে গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে। বৌদ্ধ যুবকরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে গণহত্যায় যোগ দেয়। তাদের বর্বরতা মানব ইতিহাসের এক জঘন্য ঘটনা হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট। ৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা জঙ্গিদের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বিশ্লেষকদের দাবি, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে ইসলামি জঙ্গির ধুয়া তুলেছে, তা মিথ্যা কথা। দিনের পর দিন খুন, ধর্ষণ, উচ্ছেদ ও নির্যাতন চললেও তা প্রতিরোধ করার জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের কোনো সামরিক প্লাটফরম নেই। আবার ৯ অক্টোবরের পর থেকে আরাকানে কোনো বিদেশী বা সাংবাদিকদেরও যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার বাহিনী। এ ছাড়া জঙ্গিরা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে- সেনাবাহিনীর এই দাবি একেবারে ধোঁকা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর যারা হামলা চালায়, তারা বৌদ্ধদের সামরিক সংগঠন আরাকান আর্মি, মুসলমানেরা নয়। সেনাবাহিনী এই আর্মি তৈরি করেছিল আরাকান থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্যই। এখন সেটা বুমেরাং হয়েছে। এই আর্মির কমান্ডার ইন চিফ তোয়ান মার্ট নাইং এ কথা স্বীকার করেছেন। প্রতিবেশী বাংলাদেশ সরকারও এ পর্যন্ত মিয়ানমার সরকারের মানবাধিকার হত্যার কার্যকর কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। অথচ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। কোনো খাবার নেই। বাড়ির প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা সীমান্তরক্ষা বাহিনীর ভয়ে সব সময় পালিয়ে বেড়ায়। সরকারি বাহিনীর ধরপাকড় আর অত্যাচারের ভয় তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন আতঙ্ক। ধারালো অস্ত্রধারী একদল লোক বাড়ির পুরুষদের নিয়ে যাচ্ছে। যাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তারা জীবিত ফিরছে না। পক্ষান্তরে মিয়ানমার সরকার বলছে, ‘আত্মরক্ষার স্বার্থে আইন অনুযায়ী সব কিছু করার অধিকার’ তাদের আছে। জাতিসংঘ যদি রোহিঙ্গা নিপীড়নের অভিযোগ তদন্ত করে, তাহলে রাখাইন সঙ্কট ‘গুরুতর’ হবে, এমন মন্তব্যও করেছে সরকারপক্ষ। রাখাইনের উত্তরে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা অবরুদ্ধ করে ফেলে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে টানা সময় ধরে গণহত্যা, ধর্ষণসহ সব ধরনের নিপীড়ন চালিয়েছে সরকারি বাহিনী, এমন অভিযোগ থাকলেও সরকারপক্ষের দাবি, এসবই রং চড়ানো খবর। দীর্ঘদিন ওই এলাকায় সাংবাদিক বা মানবাধিকারকর্মীদের কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সরকারি পকিল্পপনার ভিত্তিতেই মগসেনা ও স্থানীয় মগ জনগোষ্ঠী প্রকাশ্যভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, মুক্তিপণ ও চাঁদা আদায়, ধর্মীয় কর্মকান্ডে বাধা প্রদান, ইতিহাস ঐতিহ্যের ধ্বংসসাধন এবং নিজস্ব বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদপূর্বক রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম মৌলিক অধিকার হরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। আরাকানে মুসলিম জাতিসত্তা বিনাশ করে এককভাবে মগ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য উচ্ছেদকৃত রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মগদের এনে প্রত্যাবাসন করা হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতেও রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। শত শত বছর ধরে তারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। নির্যাতনের চিত্রগুলো বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। নির্বিচারে হত্যা ও নারীদেরকে ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেয়াসহ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ দেয়া হয় না। তাদের সংখ্যা যাতে বাড়তে না পারে সে জন্য বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয় না। ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগি পালনেও বাধা দেয়া হয়। বৌদ্ধ রাখাইনদের টার্গেট হলো নিরস্ত্র রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের মাধ্যমে নির্মূল করা। সেই লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনী পরকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিতেই যত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। স্বাধিকার আন্দোলনের নিমিত্তে কিছু কিছু সংগঠন কাজ করলেও মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গানীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মত সাংগঠনিক ও বৈপ্লবিক শক্তি কোনটিই রোহিঙ্গাদের নেই। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের তিন লক্ষাধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নিয়মিত বাহিনী ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের সম্মুখে তাদের মুক্তিবাহিনী বা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করা যেমন কঠিন, তার চেয়েও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া কঠিনতর হয়ে পড়েছে। এ প্রেক্ষিতে অসহনীয় নির্যাতনের হাত থেকে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছাড়া কোন গত্যন্তর থাকে না। দুঃস্বপ্নময় ভয়াবহ অঞ্চল এখন আরাকান। মিয়ানমারের ‘রাখাইন স্টেট’ নামের এ রাজ্যে মুসলমানদের জীবন আজ মগ-বৌদ্ধ, সেনাবাহিনী এবং গণতন্ত্রের নতুন ফেরিওয়ালা অং সান সু চির হাতের মুঠোয়! মানুষের মাংসে বারবিকিউ বানানো কিংবা নোংরা যৌন-লালসা চরিতার্থ করার সব উপকরণ যেন এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ আরাকানি জোয়ানদের মরণস্থল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের পিতৃভূমি এ অঞ্চলটি আজ ইতিহাসের এক জঘন্যতম মৃত্যুপুরী। নানা অজুহাত এবং পুর্বপরিকল্পিত ইস্যু তৈরি করে সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দমন-পীড়ন শুধু নয়, সরাসরি গণহত্যায় মেতে উঠেছে দেশটির সেনাবাহিনীসহ স্থানীয় মগরা। তারা পুরো মুসলিম অধ্যুষিত আরাকানে আগুন জ্বালিয়ে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। নির্বিচারে হত্যা করছে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলমানকে। বাড়ি থেকে রোহিঙ্গা মহিলাদেরকে তুলে নিয়ে গিয়ে অমানবিকভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা সেখানকার নিত্যদিনের খবর। নিজেদের সৃষ্ট ইস্যুতে গণহত্যা চালিয়ে রোহিঙ্গা সমাজে অনেকাংশে পুরুষশূন্য করা হয়েছে। কেউ কেউ জীবন বাঁচানোর জন্য দেশের অভ্যন্তরে বনে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করলেও রেহাই নেই। পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দেখামাত্রই অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে দেশটির সেনাবাহিনী। কোন ধরনের মিডিয়াকর্মীকে সেসব এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। সরকার, মগ-বৌদ্ধ এবং সেনাবাহিনীর বানানো খবরই প্রচারিত হয় সারা বিশ্বমিডিয়ায়। ইতিহাস নির্মাণ হচ্ছে তাদেরই ইচ্ছে মতো। বৌদ্ধদের প্রাধান্য থাকায় দেশটির প্রচারমাধ্যম তাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে এ দাঙ্গার যে খবরাখবর গণমাধ্যমে এসেছে তা খানিকটা একপেশে ও তথ্য গোপনের অপচেষ্টায় দুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। কারণ প্রকাশিত খবরে এ দাঙ্গার মূল ঘটনা আড়ালে চলে গেছে এবং দাঙ্গার প্রকৃত উৎসকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনাটি কেউ কেউ অস্বীকার করেছে। যাদের বিরুদ্ধে সম্ভ্রমহরণের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার নেশায় উন্মাতাল হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালায় বৌদ্ধ রাখাইনরা। ধর্ষণের ঘটনাটি দুঃখজনক হলেও এর প্রতিশোধ এত নির্মম হতে হবে? আবার একই প্রশ্নে জর্জরিত রোহিঙ্গারাও। হামলার প্রতিবাদে তারা কেন সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বিশ্লেষক মহল মনে করেন, বহুদিনের জমানো ক্ষোভের বিস্ফোরণে জ্বলে উঠেছে রোহিঙ্গারা। প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বাস করছে বাংলাদেশে। কিন্তু এরা কোনভাবেই বাংলাদেশী নাগরিক নয়, তা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের চলে যেতে জোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতার ডিঙিয়ে তারা নিজ দেশে ফিরতে পারছে না। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় এসে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রহীন জাতিতে। তা ছাড়া আরাকান অঞ্চলে তারা এক সময় ক্ষমতার অংশীদারিত্বের ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করলেও তাদের জাতিসত্তা নির্মূলের কৌশল প্রণয়ন করেছে সরকার। নিজ দেশেই ফেরারি জীবনযাপন করে তারা। আর এ নির্মম অত্যাচার তাদের প্রতিশোধপরায়ণ করে তুলেছে। তারপরও রোহিঙ্গাদের আরো সহনশীল হওয়ার পরামর্শ অভিজ্ঞ মহলের। রোহিঙ্গারা কোনো দোষ করেনি। বাস্তবিক তাদের নিয়ে কোনো সমস্যাও ছিল না। কারণ তারা স্বাধীনতা দাবি করেনি, বিদ্রোহীও ছিল না। তবুও তারা রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। তারা সেখানে কোনো কথা বলতে পারছে না, শুধু শাসকের বশ্যতা স্বীকার করে যাচ্ছে তবুও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তাদের। এটাকে আমরা বলি গণহত্যা। এটা মানবতার একটা মারাত্মক নিষ্ঠুর দিক। চীন পুঁজিবাদের ভূমিকায় থেকে মিয়ানমারকে সমর্থন করছে। এমনকি রাশিয়া এবং আমাদের বড় বন্ধুদেশ ভারতও একইভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমিতে তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বিশ^বাসীর কাছে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার এদের ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে না, এটা পরিষ্কার। এটা পুঁজিবাদের ফ্যাসিবাদী রূপ। এটা বর্বরতা ও অমানবিকতা। রোহিঙ্গা ইস্যু কোনো দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয় বরং এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বিশে^র যারা মানবাধিকারে বিশ্বাস করেন তাদের মানতেই হবে যে এটা কোনো আঞ্চলিক সমস্যা নয় বরং বৈশি^ক সমস্যা। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসতর্কতায় অনেকেই উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রিয়াজ বলেন, মিয়ানমার থেকে শরণার্থী হিসেবে আগত শতকরা ৮৫ ভাগ শিশুই রোগাক্রান্ত। তাদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের পরে মাত্র কয়েক মাসে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অবস্থা পর্যবেক্ষণের পরে এ কথা সহজেই বলা যায় যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেও ভালো নেই। ২০১৭ সালে নবাগত রোহিঙ্গাদের প্রায় ৬০ শতাংশই শিশু, যার বিরাট একটা অংশ আবার মা-বাবাহীন বা এতিম। শিশুরা মারাত্মকভাবে ট্রমাটাইজড। এসব শিশুকে সাইকোলজিক্যাল ট্রমা থেকে উদ্ধার করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ সীমিত। শিশুদের শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ ও আত্মপরিচয় দেয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষাকার্যক্রম এবং একই সাথে বিনোদন প্রয়োজন। ক্যাম্পে অভিভাবকহীন শিশুদের অনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা হতাশা সৃষ্টি করে। তরুণীদের ইজ্জত-সম্ভ্রম সংরক্ষণের গ্যারান্টিও তেমন নেই। রাত হলে ক্যাম্পের অভ্যন্তরের জগৎ সবারই অজানা। শরণার্থী ক্যাম্প নিরাপত্তা ও সুরক্ষার কতগুলো আন্তর্জাতিক বহুলপরীক্ষিত নিয়মপদ্ধতি আছে। সেসব পদ্ধতির প্রয়োগ এখনো দৃশ্যমান করা যায়নি ক্যাম্পে। রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়ণে সরকারি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সাহায্য সহযোগিতার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহও এগিয়ে এসেছে। শুরু থেকে শতাধিক এনজিও সক্রিয় ছিল এগুলোর মধ্যে অক্সফার্ম, এমএসএফ ফ্রান্স, এমএসএফ হল্যান্ড, আইআইআরও কনসার্ন ও রাবেতা আলমে আল ইসলামীসহ বিভিন্ন এনজিও পানি-স্যানিটেশন, চিকিৎসা ও ইসলামি শিক্ষার উপর সহায়তা প্রদান করে। বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিকভাবে শরণার্থীদের ভরণ-পোষণের ব্যয়ভার বহন করে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিকট এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য আবেদন জানায়। ফলে অদ্যাবধি বিভিন্ন সংস্থা ও দাতা দেশের সহায়তায় শরণার্থীদের ভরণ-পোষণ ও প্রত্যাবাসনের ব্যয় নির্বাহ করে আসছে। ২০১৬-১৭ সালের ভয়াবহ গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ত্রাণতৎপরতায় বাংলাদেশের সর্বসাধারণ মানুষ এক অনবদ্য নজির স্থাপন করেছে। গ্রাম-গঞ্জ থেকে খেটে খাওয়া মানুষেরাও চাল, টাকা, গহনা সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছে রোহিঙ্গাদের পাশে। ছোটখাটো ক্লাব, সমিতি থেকে শুরু স্কুল-কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও তাদের টিফিনের পয়সা না খেয়ে দান করেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। মহিলারা তাদের ব্যবহৃত সোনার গহনা খুলে দিয়েছে রোহিঙ্গা ভাইবোনদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। মসজিদের খুতবাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মীয় আলোচনায় ইমাম ও ইসলামী চিন্তশীল ব্যক্তিগণ নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষর বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহযোগিতায় ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল মিয়ানমার তাদের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরত নেয়ার সম্মতি জ্ঞাপন করে এবং ঐদিন ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ অহন গিয়াও-এর মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিডোতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের মাধ্যমে রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় যৌথ কার্যকরী গ্রুপ (জেডব্লিউজি) গঠন করা হয়েছে। আর মাঠপর্যায়ে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে ১৬ জানুয়ারি নেইপিডোতে ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট সই করা হয়েছে। বার্মা-বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন এ পরিকল্পনা রোহিঙ্গাদের বিপন্ন করবে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পর তারা নির্যাতন, নিরাপত্তাহীনতা, খাদ্যাভাবে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে দ্বিপক্ষীয় এই চুক্তিও স্থগিত করা উচিত বলে মনে করছে সংস্থাটি। যদিও বাংলাদেশের শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম আজাদ বিবিসিকে বলেছেন, যারা প্রত্যাবাসিত হবেন তারা সেখানে গিয়ে কী অবস্থায় থাকবেন। প্রত্যাবাসনের পর তারা কেমন থাকবেন, তাদের নিরাপত্তা কতদূর থাকবে সেটাও আমাদের দেখতে হবে। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ এ কাজটা করবে। মিয়ানমারের দিক থেকেও তাদের প্রস্তুতির বিষয় আছে। উভয় দিক থেকে প্রস্তুতির বিষয়। তারা কিছু কাজ করেছে বলে জানিয়েছে। সেগুলোও দেখতে হবে আমাদের। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ২০১২ সালে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে ঘরছাড়া ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন প্রদেশে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে রয়েছে। ঘরছাড়া এসব মানুষদের জন্য মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে কোনও পদক্ষেপ কিংবা টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে অতীতের রেকর্ড খুবই খারাপ। এ সব লক্ষণই বলছে বার্মিজ ক্যাম্পের যে সব পরিকল্পনা করা হয়েছে- সেগুলো হবে রোহিঙ্গাদের জন্য খোলা আকাশের নিচে কারাগার। তিনি আরও বলেন, ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা যে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে ৫ বছর ধরে দিনাতিপাত করছে, তার চেয়ে নতুন ক্যাম্পগুলো খুব একটা দারুণ কিছু হবে তেমনটি বিশ্বাস করার মতো কারণ খুব কমই আছে। পরিশেষে বলা যায়, রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবন গ্রহণ করা একটি প্রচলিত রীতি হয়ে গেছে। ১৯৭৪, ১৯৭৮ এবং ১৯৯১-৯২ সালে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের পর আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার তাদের পুনরায় স্বদেশে পাঠিয়ে দিলেও মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে আরাকানে রোহিঙ্গা নির্যাতনের কোন অবসান হয়নি। তাই তারা আর শরণার্থী হিসেবে না এসে সুযোগ মত আত্মীয়তার সূত্র ধরে কিংবা শরণার্থী জীবনে বাংলাদেশের আগমনের সুবাদে সৃষ্ট পরিচয়ের ভিত্তিতে পরিবার পরিজন নিয়ে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী আবাসন গড়ে তুলছে। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের যে প্রেক্ষাপটে এবং যে প্রক্রিয়ায় আগমন ঘটেছে তাতে তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া ক্রমশ কঠিনতর হয়ে পড়ছে। তাই অতিসত্বর শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা নির্যাতন থেকে বিরতকরণ ও আরাকান থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রেবেশ বন্ধকরণের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহযোগিতা আরো জোরদার করা দরকার এবং বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে আরো বেশি তৎপর হওয়া বাঞ্ছনীয়। কফি আনানের নেতৃত্বাধীন প্রকাশিত প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিকত্বের ব্যবস্থা করা, তাদের অবাধ চলাচলের সুযোগ ও আইনের চোখে সমান অধিকার দেয়া, রোহিঙ্গাদের স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যার অভাবে স্থানীয় মুসলমানেরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; এবং নিজ ভূমিতে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সহায়তা কাজে লাগানো। আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গা সঙ্কটের অবসান ঘটবে। এ ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠক থেকে উত্থাপিত চারটি দাবির কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, অবিলম্বে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ করা হোক। দ্বিতীয়ত, আরাকানের যে অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসতি বেশি অর্থাৎ উত্তর আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য একটি ‘সেইফ জোন’ তৈরি করা। তৃতীয়ত, রোহিঙ্গাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতিপূরণসহ পূর্ণাঙ্গভাবে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে উচ্ছেদ হওয়া সকল রোহিঙ্গাকে আরাকানে ফিরিয়ে নেয়া। চতুর্থত, গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বিচার করার ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি। (বি. দ্র : রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে পড়–ন : ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ প্রণীত ‘রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের সোয়া তিনশো পৃষ্ঠার গবেষণা গ্রন্থটি। একুশে গ্রন্থমেলার ১৬৭ নং স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।) লেখক : রোহিঙ্গা গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির