post

ইসলামী আন্দোলন ও শহীদ আবদুল মালেক

১৫ আগস্ট ২০১১
অধ্যাপক গোলাম আযম ইসলামী ছাত্রশিবিরকে আমি ‘শহীদি কাফেলা’ বলে থাকি। এ দ্বীনি সংগঠনটি এ অভিধায়ই পরিচিত। বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ হিসেবে এখানে ইসলামের কাজ করতে গেলে শহীদ হবার কথা নয়। জনগণের ময়দানে যেসব ইসলামী দল আল্লাহর আইন কায়েমের আন্দোলন করছে তাদেরকে এমন ধরনের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয় না যেমন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে হতে হয়। এর কারণ এটাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ জনগণের পরিবেশ থেকে ভিন্ন। দু’শ বছরের ইংরেজ শাসন ও পরবর্তীকালে ইংরেজদের তৈরি শোষকদের শাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের অনেককেই ধর্মনিরপে বানিয়ে ছেড়েছে। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা বিশ্বাসী নয়। তাদের মধ্যে যারা উগ্র তারাই সংগঠিত হয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে শিক্ষাঙ্গন থেকে উৎখাত করতে চায়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের যুক্তির সামনে টিকতে না পেরে পেশি ও পশুশক্তির আশ্রয় না নিয়ে তারা শিবিরের মোকাবেলা করতে অক্ষম। ইসলামী ছাত্রশিবির জ্ঞানচর্চা ও চরিত্র গঠনের আন্দোলনে । ঐ ব্যাপারে এসব ছাত্র সংগঠন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবারই অযোগ্য। যেসব ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে মতার রাজনীতিতে লিপ্ত তাদের জ্ঞানচর্চা ও চরিত্র গঠনের কোনো প্রয়োজন হয় না। সন্ত্রাসী পদ্ধতিতে সিট দখল, হল দখল এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ দখল ইত্যাদি তাদের কর্মসূচি। আর ইসলামী ছাত্রশিবির নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগঠন, আন্দোলন ও নির্বাচনে বিশ্বাসী। তাই ঐ জাতীয় কোনো ছাত্র সংগঠনই শিবিরকে সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে ১৯৬৯ সালে সন্ত্রাসী ছাত্রদের কাপুরুষোচিত নৃশংস হামলার শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবদুল মালেক শহীদ হন। তিনিই এদেশের শহীদি কাফেলার প্রথম শহীদ। যারা ইসলামী আন্দোলনকে জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে তারা শহীদ হওয়াকেই সর্বোচ্চ সাফল্য মনে করেন। তাই আবদুল মালেকের শাহাদাত ঐ সময়েই শত শত নতুন কর্মীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে এ পর্যন্ত শতাধিক শহীদ হয়েছেন। এ শাহাদাতের পথ বেয়েই এ শহীদি কাফেলা মজবুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। এদেশের জনগণ এ পর্যন্ত যে কয়টি সরকারের শাসনামলের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তাতে তা হবারই কথা। চরিত্রবান ও নিঃস্বার্থ শাসকের অভাবে মানুষ পেরেশান। দুর্নীতিমুক্ত শাসক কোথায় পাওয়া যাবে এ প্রশ্ন সবার। শিাব্যবস্থার মাধ্যমে চরিত্র ও সৎ লোক তৈরি হচ্ছে না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর মাধ্যমে চরিত্রবান নেতৃত্ব সৃষ্টি করছে না। একমাত্র ইসলামী ছাত্রশিবিরই চরিত্র গঠনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তাই শিবিরের গড়া নেতৃত্বের ওপরই জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। শহীদ আবদুল মালেকের উত্তরসূরি হিসেবে শহীদি কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরের অগ্রগতি ও সাফল্যের ওপরই বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। এ ছাড়া আর কোনো আশার আলো দেখা যায় না। শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতের মূল্যায়ন আবদুল মালেক তরুণ বয়সেই এমন এক উজ্জ্বল নজির রেখে গেছেন যা এ দেশের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে চিরদিন প্রেরণা জোগাবে। এতগুলো গুণ একজন ছাত্রের মধ্যে এক সাথে থাকা অত্যন্ত বিরল। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক ও ছাত্র মহলে তার সুখ্যাতি সত্ত্বেও তার নিকট ছাত্রজীবন থেকে আন্দোলনের জীবনই বেশি প্রিয় ছিল। যথাসম্ভব নিয়মিত কাসে হাজির হওয়াই যেন তার জন্য যথেষ্ট ছিল। পরীক্ষায় ভাল করার জন্য তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা ছিল না। ওটা যেন অতি সহজ ব্যাপার ছিল। কাসের বাইরে তাকে ইসলামী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো চিন্তাধারা বা আলাপ আলোচনা করতে বড় একটা দেখা যেত না। তার সহপাঠী ও সহকর্মীরা তাকে পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে মৃদু হেসে বলতেন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয় রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম ল্য বানিয়ে নিতে চাই না। খুব ভাল রেজাল্টের ধান্ধা করলে ক্যারিয়ার গড়ে তুলবার নেশায় পেয়ে বসবার আশঙ্কা আছে। শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাত সম্বন্ধে যে কথাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, এমন একটি পরিবেশে তিনি শাহাদাতবরণ করলেন যেটা খুব রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিবেশ ছিল না। শিক্ষাব্যবস্থা পাকিস্তানের এ সময়ে কী হওয়া উচিত এ বিষয়ে টিএসসিতে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে বিতর্কে ইসলামের দুশমনেরা বিশেষ করে সমাজতন্ত্রীরা শিক্ষাব্যবস্থা সে আলোকেই করতে চেয়েছিল এবং মুসলমানদের এই দেশে বসে তারা এমন ধরনের কথা বলছিল যার প্রতিবাদ করা প্রত্যেকটা ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য ছিল। আবদুল মালেক সে সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা শহরের দায়িত্বশীল ছিলেন। সে হিসেবে আবদুল মালেক ও তার সাথীরা যেখানে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আলোচনায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পর্যন্ত তাদেরকে দেয়া হচ্ছিল না। উদ্যোক্তারা এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যে মনে হচ্ছিল এ দেশটা মুসলমানদের দেশ নয় বরং কমিউনিস্ট দেশ। মালেক ও তার সাথীরা বক্তব্য পেশ করার দাবি জানালেন। শেষ পর্যন্ত তাকে বক্তব্য পেশ করার জন্য অনুমতি দিতে বাধ্য হলো। কারণ, যুক্তির দিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিতর্কের জন্য ডেকে কথা বলার সুযোগ দেবে না এটা সাধারণ ছাত্ররা পছন্দ করতে পারে না। তাই শেষ পর্যন্ত কথা বলার সুযোগ দিলো। যে কথা সেখানে আবদুল মালেক বললেন তা এতটাই যুক্তিপূর্ণ ছিল যে তার বিরুদ্ধে কিছুই করা সম্ভব হলো না। সাধারণ ছাত্রদের সামনে তার বক্তব্য এতটা প্রভাব বিস্তার করল যে, তাদের ঐ উদ্দেশ্য সফল হল না, যে উদ্দেশ্যে তারা অনুষ্ঠান করেছিল। যতদূর মনে পড়ে ডাকসুর পক্ষ থেকে এ অনুষ্ঠানে করা হয়েছিল অথবা ভিন্ন কোনো সংস্থার পক্ষ থেকেও হতে পারে। তবে এটা আমার ভালো করেই মনে আছে যে এটার উদ্যোক্তা ও মঞ্চ নিয়ন্ত্রণ যারা করেছিল তারা ইসলামের দুশমন ছিল। সভা শেষে যে যার মতো চলে যাচ্ছে। সেখানে বিশেষ কোনো উত্তেজনাকর পরিবেশ ছিল না, যদি থাকত তাহলে নিশ্চয়ই আবদুল মালেকের সাথীরা তাকে একা যেতে দিত না বরং তারা একজোট হয়ে যেত। এই আলোচনার পর পরিবেশ এমন ছিল না যে সাধারণ ছেলেরা আবদুল মালেক বা তার সাথীদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়েছিল, এমনকি যারা ক্ষিপ্ত হয়েছিল তারা তা প্রকাশ করারও সাহস পায়নি। সভা শেষে একাকী পথ ফিরছিলেন আবদুল মালেক। একা পেয়ে ছাত্র নামধারী একদল গুণ্ডা গিয়ে আক্রমণ করলো আবদুল মালেককে সে সময়কার রেসকোর্স ময়দানে (যেটা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। নৃশংসভাবে তাকে তারা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করল। আরো কয়েজন ছাত্রকে একা পেয়ে আক্রমণ করা হলো। এ সময় কোনো উত্তপ্ত পরিবেশ ছিল না অথবা এমন কোনো সংগ্রাম বা সংঘর্ষের পরিবেশও ছিল না যে কারণে এমন বর্বরোচিত আক্রমণ করা যেতে পারে। নিতান্ত যুক্তির ভিত্তিতে শহীদ আবদুল মালেক ও তার সাথীরা সেখানে তাদের বক্তব্য পেশ করেছিলেন যেটা তাদের অধিকার ছিল দেশের নাগরিক হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে। কিন্তু যুক্তির মোকাবেলা করার মতো যুক্তি যাদের থাকে না তাদের শক্তি প্রয়োগ ছাড়া উপায় কী? তাই তারা শক্তি প্রয়োগ করে কাপুরুষের মতো একা পেয়ে তাকে হামলা করে মারাত্মকভাবে আহত করলো যার পরিণামে তাকে শাহাদাত বরণ করতে হলো। এর প্রতিক্রিয়া সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলনে যা হয়েছে তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। যে কোনো আন্দোলনের কোনো ব্যক্তিত্ব বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যক্তি যখন শহীদ হন তখন সে আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না বরং উল্টো সে আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে যারা ভীরু এবং কাপুরুষ তারা পিছিয়ে যায়। আর যারা এ আন্দোলনকে মনে প্রাণে গ্রহণ করে এবং ইসলামী আন্দোলনের স্পিরিটকে যারা বুঝে আগের চাইতে তারা আরো দ্রুত এগিয়ে যায়। তাছাড়া এ অবস্থায় আন্দোলনের নুতন নতুন লোকও এগিয়ে আসে। বাস্তবে এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। আমি ঐ সময়ও কয়েক জায়গায় মন্তব্য করেছিলাম যে, এক আবদুল মালেককে শহীদ করে শত্রুরা শত শত আবদুল মালেক সাপ্লাই করেছে আন্দোলনে। এক আবদুল মালেকের শাহাদাতের ফলে আন্দোলন শত শত আবদুল মালেককে পেয়েছে যারা তার মতো মনে প্রাণে শাহাদাত কামনা করে। এটা যে কোনো আন্দোলনের জন্য সত্য আর ইসলামী আন্দোলনের জন্য আরো বেশি সত্য। আমরা দেখেছি ওহুদের যুদ্ধে সত্তর জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেছেন। যদিও শাহাদাতের পেছনে তাদের একটি বড় ভুল ছিল। সে ভুল হলো নবী করীম (সা) যাদেরকে একটি বিশেষ জায়গায় আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অবস্থানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা জয় হয়ে গেছে মনে করে সে নির্দিষ্ট জায়গা ছেড়ে দিলেন। এ ভুলের পরিণামেই যে এটা হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, না হলে এত লোক হয়তো শহীদ হতো না। বস্তুত প্রথমে যুদ্ধে জয়ই হচ্ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হলো। আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা) এবং অন্যান্যদের হেফাজত করলেন। কিন্তু তাদের সত্তর জন শহীদ হয়ে গেলেন। এই শাহাতাদের পর থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত আর কোনো যুদ্ধে এতো লোকের শাহাদাত বরণ করতে হয়নি। কারণ ঐ এক শাহাদাতের সময় তাদের মধ্যে এমন এক জযবা সৃষ্টি হয়েছিলো যে আমাদের এতো লোক শহীদ হলো যখন, তখন আমরা সবাই জান দিয়ে দেবো। সবাই যখন জান দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় তখন জানের কুরবানি বেশি দিতে হয় না। আর সবাই যখন জান দেয়ার জন্য প্রস্তুত না হয় তখন অনেককেই জান দিতে হয় অথচ আন্দোলনের অগ্রগতি হয় না। ওহুদ যুদ্ধের উদাহরণ থেকে আর একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে হজরত হামজা (রা) ছিলেন নেতৃস্থানীয় লোক যার শাহাদাতের কারণে নবী করীম (সা) অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং আন্দোলনে এটা তীব্র প্রভাব সৃষ্টি করে। অনুরূপভাবে আবদুল মালেকের মতো একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব শহীদ হবার ফলে গোটা আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি না হলে এতটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো না। এরপরও ইসলামী আন্দোলনের ছাত্র সংগঠনকে আরো শাহাদাতের অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়েছে কিন্তু আবদুল মালেকের শাহাদাতের আর পরবর্তী শাহাদাতের তুলনা করলে এটাই দেখি- একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাতের পরে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, ঐ ধরনের প্রতিক্রিয়া পরবর্তীদের ক্ষেত্রে হয়নি। আন্দোলন যখন শক্তি সঞ্চয় করেছে মাত্র তখন একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শাহাদাত আন্দোলনের শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এটার সাথে তুলনা করা চলে হজরত হামজা (রা) এর শাহাদাত এবং এতে মুসলমানদের মধ্যে যে জযবা সৃষ্টি করেছিল, সে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার সাথে। ইসলামে শাহাদাত একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার, একটা কামনার ব্যাপার। অন্যান্য আন্দোলনে কেউ যদি আন্দোলনের কারণে জীবন বিসর্জন করতে বাধ্য হয় তাহলে এটাকে তি হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং যে মরে গেল, যে জীবন দান করলো তার জীবন দেয়ার কারণে আন্দোলন তিগ্রস্ত হলো এই মনোভাব থাকে। সে জীবিত থাকলে এট করতে পারতো, সেটা করতে পারতো সর্বোপরি আফসোসটাই সেখানে বড় হয়ে দেখা হয়। এটা যে তার সৌভাগ্যের ব্যাপার, আল্লাহ যে তার শাহাদাতকে কবুল করেছেন, সে জযবা সেখানে পাওয়া যায়নি। এই জযবা ইসলামী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। ইসলামী আন্দোলনে যিনি শহীদ হলেন তিনি অনেক উচ্চ মর্যাদা লাভ করলেন বলে মনে করেন আর অন্যরা মনে করে আমরা বঞ্চিত থেকে গেলাম, আমরা এই মর্যাদা পেলাম না, তিনি এ মর্যাদা পেলেন। ত্যাগ বা কুরবানি সব আন্দোলনের জন্য সাহায্যকারী এবং গতিদানকারী। কিন্তু এই কুরবানিতে প্রতিক্রিয়া সব ক্ষেত্রে সমান হয় না। ইসলামী আন্দোলনের কুরবানির প্রতিক্রিয়া এভাবে হয় যে, যারা বেঁচে রইলো তারা নিজেদেরকে মনে করে আমরা বঞ্চিত হলাম এবং এ সাথে তারা আরো বেশি শহীদ হবার জন্য প্রেরণা লাভ করে। আন্দোলন থেকে তারা পালাবার চিন্তা করে না বরং আরো বেশি অগ্রসর হবার চিন্তা করে। প্রসঙ্গক্রমে আর একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে, যারা শহীদ হতে পারলেন না তারা কি দুর্ভাগা? শহীদ হওয়াটা যদি সৌভাগ্য হয় আর শহীদ হতে না পারাটা যদি দুর্ভাগ্য হয় তা হলে এর ব্যাখ্যা কী? নবী করীম (সা) নিজেও শহীদ হলেন না ওদের যুদ্ধে এবং বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু বকর (রা), হযরত ওমর (রা), হযরত ওসমান (রা), হযরত আলী (রা) এর মতো লোকেরা যারা পরবর্তীকালে ইসলামের বিরাট খেদমত করে গেছেন এবং তাদের খেলাফত আমলে রাসূলের আদর্শে ইসলাম কায়েমের নমুনা স্থাপন করে গেলেন, নবুওয়তের মানে খেলাফত চালিয়ে এত বড় আদর্শ স্থাপন করে গেলেন তারাও ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হননি। তারা যদি শহীদ হয়ে যেতেন তাহলে এই আদর্শ কি কায়েম হতো? তাহলে আমরা কী করে এ কথা বলতে পারি হযরত হামজা (রা) সৌভাগ্য লাভ করলেন শহীদ হয়ে, আর প্রসিদ্ধ সাহাবী যারা পরবর্তীতে খলিফা হলেন, খোলাফায়ে রাশেদীন বলে যাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি তাঁরা সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হলেন? এ জন্য এই বিষয়টাকে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। কার ব্যাপারে তিনি শাহাদাতের ফয়সালা করেন আর কাকে গাজী বানিয়ে পরবর্তী সময়ে ইসলামী আন্দোলনের আরো বড় খেদমত নেবেন এটা আল্লাহতায়ালার এখতিয়ারে। এ ব্যাপারে এ ধারণা করা ঠিক হবে না, যিনি শহীদ হলেন তিনিই সৌভাগ্য লাভ করলেন আর অন্যরা বঞ্চিত হলেন। আল্লাহ যদি তাদেরকে শহীদ হিসেবে খেদমত নিতে চান তাহলে তাই নেবেন। আর শাহাদাতের জযবা তাদের থাকা উচিত। আর যদি গাজী বানিয়ে পরবর্তীকালে আরো বড় খেদমত নেবার জন্য আগ্রহ পোষণ করেন তাহলে তাই করতে পারেন। সে জন্য যারা শহীদ হলেন না তার জন্য হীনম্মন্যতা পোষণ করা ঠিক নয়, নিজেদেরকে দুর্ভাগা মনে করা ঠিক নয় তবে শাহাদাতের জযবা তাদের মধ্যে থাকা দরকার এবং নিজেকে আল্লাহর নিকট এভাবে সোপর্দ করা উচিত যে, ‘দ্বীনের জন্য আমরা তোমার কাছে নিজেকে সোপর্দ করলাম, তুমি শহীদ করে আমাদের থেকে খেদমত নিলে আমরা খুশি। আর যদি তুমি আমাদের শাহাদাতের সৌভাগ্য না দাও তাহলে বাঁচিয়ে রাখলে শুধু এই জন্য বাঁচিয়ে রাখ যে দুনিয়ায় দ্বীনের জন্য কাজ করতে পারি।’ এরপর প্রশ্ন হতে পারে শহীদ হবার জন্য কি কোনো শর্ত আছে যে এই গুণ যাদের থাকবে আল্লাহ তাদের শহীদ করবেন আর এই গুণ না থাকলে শহীদ করবেন না? এই ধরনের কোনো পূর্বশর্ত জানার উপায় আমাদের নেই। আর আগের যে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হলো তাতে এ কথা প্রমাণ হয় না যে, যিনি শহীদ হলেন তার মধ্যে কিছু এমন শর্ত পাওয়া গেল যা অন্যান্যদের মধ্যে পাওয়া গেলো না বলে তারা শহীদ হলেন না। ইসলামী আন্দোলনে নিজেদেরকে আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণ করে নিজের জানমালকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করার সবগুলো শর্ত সমভাবে পূরণ হবার পরও আল্লাহ কাউকে শহীদ করতেও পারেন নাও করতে পারেন। এর দ্বারা এ কথা প্রমাণ হয় না যে অমুকের মধ্যে এই শর্ত বেশি পাওয়া গেছে, অমুকের মধ্যে এই শর্ত কম পাওয়া গেছে এখন আমি শহীদ আবদুল মালেকের উত্তরসূরিদের ব্যাপারে এ কথা বলতে চাই যে শহীদ আবদুল মালেক এ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যে, যেখানে যে দায়িত্ব আন্দোলন এবং ইসলামী আদর্শের মর্যাদার জন্য পালন করা উচিত তা পালন করতে হবে, তার প্রতিক্রিয়ায় যদি জীবন যায় তো যাবে, জুলুম অত্যাচার হলে সহ্য করতে হবে। যে আদর্শ তিনি স্থাপন করলেন পরবর্তীতে আন্দোলনে যারা এসেছেন তাদের ওপর এর প্রভাব স্পষ্ট দেখা গেছে। আর তারই ফলে আরো কিছু ব্যক্তিকে শহীদ হতে আমরা দেখেছি। যদি এ প্রভাব তাদের ওপর না পড়তো তাহলে তারা বাতিলের জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে চলে যেতো এবং আন্দোলন বন্ধ করে কেটে পড়তো যদি এ ঘটনার পর আন্দোলন থেকে সবাই সরে যেত তাহলে বুঝা যেত যে এর কোনো ভালো প্রভাব আন্দোলনে পড়েনি অথচ এক্ষেত্রে আন্দোলনের গতি আরো বেড়েছে। নতুন নতুন লোক উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে, আবদুল মালেকের উত্তরসূরিদের মধ্যে খুবই কল্যাণকর প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে যার দ্বারা আন্দোলনে গতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার এ শাহাদাত থেকে এ শিাই কর্মীদের সামনে এসেছে যে, আবদুল মালেক জীবিত থেকে এই আন্দোলনের জন্য যে অবদান রাখতে পারতেন শহীদ হয়ে যেন তার চাইতে বেশি অবদান রেখে গেলেন। তার শাহাদাতের প্রেরণায় আন্দোলন যতদূর অগ্রসর হয়েছে, যত লোকের মধ্যে শাহাদাতের জযবা সৃষ্টি করেছে তার মতো যোগ্য কর্র্মী বেঁচে থাকলেও তিনি যতো যোগ্যই হোন না কেন তার একার জীবনে এত বড় প্রভাব ও আন্দোলনের এতটা গতি দিতে পারতেন কি না সন্দেহ। তাহলে আমরা তার শাহাদাত থেকে এটাই শিা পেলাম যে, আমাদের কেউ শহীদ হয়ে গেলে তা আন্দোলনের জন্য তির কারণ নয়, আন্দোলনের গতি স্তব্ধ করে দেবার কারণ এটা হতে পারে না। আবদুল মালেকের শাহাদাত থেকে আমরা এই শিক্ষাও পেয়েছি যে, একজন লোক শহীদ হয়ে অগণিত লোকের মধ্যে শাহাদাতের প্রেরণা সৃষ্টি করেন এবং একজন লোক জীবিত থাকলে আন্দোলনকে যতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন চার চাইতে বেশি এগিয়ে নিয়ে যায় তার শাহাদাত। একজন লোক সমস্ত প্রতিভা এবং কর্মমতাকে ব্যবহার করে আন্দোলনের জন্য যতটুক অবদান রাখতে পারেন তার শাহাদাত তার চাইতে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারে। এটা আবদুল মালেকের শাহাদাতে প্রমাণিত হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই তার শাহাদাতের এক যুগ পরও তার নাম ছাত্র অঙ্গনে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা এমন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, তার স্মৃতি রার প্রয়োজন মন করে এবং তার কথা স্মরণ করে বই-পুস্তক বের করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। আবদুল মালেক শহীদ হয়ে অমর হয়ে গেলেন। স্বাভাবিবক মৃত্যুবরণ করলে এভাবে জীবিত থাকতে পারতেন না। তিনি আন্দোলনের মধ্যে এতটা প্রভাব বিস্তার করেছেন যে এখনো তার জন্য লেখা তৈরি হচ্ছে, বক্তৃতা দেয়া হচ্ছে। কর্মীদের মধ্যে প্রেরণা দেয়ার জন্য তার কথাগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক যুগ পর কেন আরো অনেক যুগ পরেও দেখা যাবে তার শাহাদাত কত মূল্যবান ছিল এবং এই শাহাদাতের মূল্য আল্লাহ ছাড়া কেউ দিতে পারবেন না। এ দুনিয়ায় শাহাদাতের মূল্য এট্ইা যে আদর্শের জন্য তিনি শহীদ হলেন সে আদর্শের ধারক বলে যারা দাবিদার তারা শহীদ হবার জন্য প্রেরণা পাবে এবং এটা যতদিন অব্যাহত থাকবে ততদিন শাহাদাতের মূল্যায়ন সঠিক হবে। তার কথা যেভাবে স্মরণ করা হচ্ছে, তার আদর্শের সবটা যেভাবে চর্চা হচ্ছে, এর দ্বারা প্রমাণ হয় তার শাহাদাতের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে। আবদুল মালেক শহীদ হয়েছিলেন পাকিস্তান আমলে। এখন বাংলাদেশ আমল। যারা এই আন্দোলনের ইতিহাস ’৭৭ সাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে এবং ’৭৭ সালে সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে বলে মনে করে তারা দুর্ভাগা এবং তারা অতীতের ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে। প্রকৃতপে আবদুল মালেকের শাহাদাতের মূল্যায়ন তারাই করতে পারে যারা বর্তমানে ছাত্র অঙ্গনে আন্দোলন করতে গিয়ে আবদুল মালেককে তাদের পূর্বসূরি বলে বিশ্বাস করে। যারা তাকে পূর্বসূরি বলে বিশ্বাস করে তারাই তার উত্তরসূরি হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে। অতএব এই আন্দোলনকে যারা সে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা করে তাদের মন দুর্বল, তারা বিভ্রান্ত। তারা বাংলাদেশ পূর্ব আন্দোলনের ইতিহাস তালাস করে গৌরবজনক কিছু পায় না। তারা হীনম্মন্যতায় ভুগে। যারা ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাস ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করে তারা আন্দোলনের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং শাহাদাতের মূল্যবোধ থেকে বঞ্চিত। সে শাহাদাতকে অস্বীকার করা ছাড়া তাদের উপায় নেই। ছাত্র অঙ্গনে ইসলামকে এদেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পাকিস্তান আমলে যারা আন্দোলন করেছিল তারা গোটা পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল। আর বর্তমানে বাংলাদেশে যারা ইসলামী আন্দোলনের কাজ করছে তারা বাংলাদেশেই ইসলামী আদর্শকে কায়েম করতে চায়। ইসলামী আদর্শ কায়েমের দিক দিয়ে ঐ সময়ে বড় একটা রাষ্ট্র কায়েম করার চেষ্টা ছিল। আর দেশ ভাগ হবার পর এখনও চেষ্টা চলছে। তাই বলে কি এর অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলতে হবে? অতীত ইতিহাসকে অস্বীকার করতে হবে? এই আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে এ আন্দোলনের সূচনা। ১৯৬৯ সালে আবদুল মালেক শাহাদাত বরণ করেছেন সেই ’৬৯ সাল, ’৭৭ সাল থেকে ৮ বছর আগে। এই সময়ের ইতিহাস যারা ভুলে গেছেন তারা এই আন্দোলনের স্বাভাবিক স্রোত থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। আর যারা এ আন্দোলনের সঙ্গী, ঐ আন্দোলনের ঐতিহ্যকে ধরে এগিয়ে চলেছেন তারাই এই শাহাদাতের ধারক ও বাহক। তাই আজ শহীদ আবদুল মালেকের শাহাদাতের এতো বছর পরও আরো বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তার কথা স্মরণ করার। তার শিাকে, তার কুরবানিকে, তার আদর্শকে তার চরিত্রকে বর্তমানে ছাত্রদের সামনে তুলে ধরা আগের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে যে, এ আন্দোলন থেকে কিছুসংখ্যক বিভ্রান্ত হয়ে ভুল ধারণায় পড়ে ঐ মহান ঐতিহ্য থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করেছে। এ দেশের ছাত্রমহলে যারা ইসলামী আদর্শের দিকে এগোচ্ছে তারা এ মহান আদর্শ থেকে যাতে বিচ্যুত না হয়, ঐ ঐতিহ্য থেকে যাতে বঞ্চিত না হয় এবং শহীদ মালেক যেন তাদেরকে প্রেরণা জোগান তার জন্য আজ শহীদ আবদুল মালেক সম্পর্কে এ আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার। লেখক : বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির