post

ঈদ সংস্কৃতির স্বরূপ ও মূল্যায়ন

০৪ জুলাই ২০১৫
শাহ আব্দুল হান্নান# ঈদ  ইসলামের দু’টি প্রধান অনুষ্ঠানÑ এটা আমরা সবাই জানি। ঈদের শুরু কিভাবে হয়েছিল সেটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দু’টি ঈদের শুরু হলো এভাবে- যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় গেলেন তখন তিনি দেখলেন যে তারা দু’টি অনুষ্ঠান পালন করে। সেই দু’টি অনুষ্ঠান বদলে দিয়ে তিনি এই দু’টি ঈদের ব্যবস্থা করলেন। একটি হলো সফলভাবে রোজা শেষ করার আনন্দ। আরেকটি হচ্ছে হজের যে অনুষ্ঠান, যাতে বিশ্বমুসলিম শরিক হচ্ছে মক্কায় তারই পাশাপাশি সারা বিশ্বের মুসলিমদের যুগপৎভাবে ঈদ পালন। অর্থাৎ মক্কায় হজ হচ্ছে এবং সারা দুনিয়ায় ঈদ উৎসব হচ্ছে। আবার এর সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হজরত ইবরাহিম আ: কে তাঁর  ছেলে কোরবানি করতে বলে আল্লাহ তাআলা যে মহা পরীক্ষা করেছিলেন সেই পরীক্ষায় তাঁর যে বিজয়, সেটাকে সামনে রেখে এ ঈদের ও হজের অনুষ্ঠান করা হলো। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিক যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ দু’টি অনুষ্ঠান বদলে দিলেন কেন? আগের অনুষ্ঠানগুলোর ভিত্তি ছিল পারস্যের অনুকরণে। পারস্য তৎকালীন অন্যতম সুপার পাওয়ার ছিল। তাদের জাতির মধ্যে ঐ অনুষ্ঠানগুলো ছিল। এসব অনুষ্ঠান মূলত কিছুটা প্রকৃতিভিত্তিক ছিল। সেই কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয় সাল্লাম এসব অনুষ্ঠান তেমন পছন্দ করেননি। এ অনুষ্ঠানগুলোতে প্রকৃতিকে বেশি সম্মান দেখানো হচ্ছিল। সে জন্য তিনি এ পরিবর্তনটি করলেন। এর থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে যে মুসলিমদের যে অনুষ্ঠানমালা হবে তাতে এ মূলনীতিই খেয়াল রাখা উচিত। ইসলাম আনন্দ উৎসবকে স্বীকার করেছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে নতুন কোনো অনুষ্ঠান চালু নাও করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা না করে তাদের ঐ দু’টি অনুষ্ঠানের পরিবর্তে বিকল্প দু’টি নতুন অনুষ্ঠান দিয়েছেন। এ থেকে আরেকটি নীতি পাওয়া যায়, তা হলো- মানুষের যে সত্যিকার প্রয়োজন সে প্রয়োজনকে উপলব্ধি করতে হবে। স্বীকার করতে হবে, মানতে হবে। সেটা করতে গিয়ে যদি দেখা যায়, প্রচলিত পদ্ধতিগুলো ভালো নয়, তাহলে তার বিকল্প দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কার্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে তার বিকল্পও দিতে হবে। এ বিষয়ে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে। আজকে মানুষের মধ্যে আনন্দের যে প্রয়োজন রয়েছে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীকার করেছিলেন। স্বীকার করেই তিনি এ দু’টি অনুষ্ঠান দেন এবং তার নাম রেখেছেন ‘ঈদ’ তথা আনন্দ, উৎসব। তিনি অন্য নাম রাখতে পারতেন। অথচ তিনি ঈদ নাম রাখলেন কেন? একে আনন্দ উৎসবের সঙ্গে সম্পর্ক করলেন কেন? এটা আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক। এটা প্রমাণ করে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিখ্যাত হাদিস হচ্ছে, ইসলামে কোনো বৈরাগ্যবাদ নেই। এ ছাড়াও কুরআন মজিদে বৈরাগ্যবাদকে নিন্দা করা হয়েছে। এবং ইসলাম  বৈরাগ্যবাদের ধর্ম নয়। বৈরাগ্যবাদ কোনো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নয়। এ থেকে আমরা বলতে পারি ইসলামি সংস্কৃতির শুরুটা কী রকম হবে তা আমরা ঈদ থেকে পাই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ঈদের ব্যবস্থা করলেন তাতে তিনি ঈদের দিনটি শুরু করলেন নামাজ দিয়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন খাওয়া দাওয়া করতে বললেন, নতুন কাপড় চোপড় পরতে বললেন, বেড়াতে উৎসাহিত করলেন। বেড়ানোকে, দাওয়াত দেয়াকে উৎসাহিত করলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি  ঈদের দিনটি শুরু করতে হবে সালাত দিয়ে এ ব্যবস্থা রাখলেন। আগের দিনে আরব দেশের আমাদের মতো এতো দেরিতে ঈদ হতো না। সেখানে ঈদ হয়ে যেতো খুব ভোরে। তখন সূর্য ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে ঈদের নামাজ পড়া হয়ে যেত। নামাজ পড়েই বাকি কাজে লেগে যেত। এটাও ইসলামি সংস্কৃতির একটি  বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে। এর বৈশিষ্ট্য হলো আমাদের আনন্দ অনুষ্ঠানের ভিত্তি হতে হবে আল্লাহকে স্মরণ করা সেটা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা সালাত দিয়ে শুরু করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। অন্যান্য অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে আল্লাহর স্মরণে। তাই যে কোনো সুন্দর অনুষ্ঠান যদি আমরা করি তার শুরু হওয়া উচিত আল্লাহকে মনে করার মধ্য দিয়ে। eid1 এ বৈশিষ্ট্য আরো প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন তাতে কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। এর মধ্যে কোনো অপসাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের অবকাশ নেই। সেখানে সবকিছুই সুন্দর। এর মধ্যে স্থান নেই কোনো ধরনের পূজার। তা মানুষেরই হোক বা প্রকৃতিরেই। আমাদের দেশের ঈদ যেভাবে পালিত হচ্ছে সে বিষয়ে কিছু বলা দরকার। প্রথমত, ঈদে বেড়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। খাওয়া দাওয়া, পোশাক আশাকে এসব ব্যাপার ঠিক আছে। কিন্তু যেটুকু ঠিক নেই তা হলো, পাশ্চাত্যেরই প্রভাবে আমাদের মধ্যে অনেক অশালীন পোশাকের প্রচলন হয়েছে। এটা দূর করা সহজ ব্যাপার নয়। এ প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন যে, দুনিয়াতে যেকোনা সংশোধন দাওয়াত দ্বারাই সম্ভব। মানুষের মনকে জয় করতে হবে। মনকে জয় করেই সংশোধন আনতে হবে। কারণ, একটি ইসলামি রাষ্ট্র হবে, সেই রাষ্ট্র আইন করে এগুলো করবে, সেটা যথেষ্ট জটিল প্রক্রিয়া। তা কতটা করতে পারবে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। সেটা করতে পারলে ভালো। সংবিধান মোতাবেক একটি দল ক্ষমতায় এসে সংসদে আইনের মাধ্যমে এগুলো করতে পারলে ভালো। কিন্তু সেটাই করা কতটা সম্ভব হবে তা জানি না এবং এর জন্য অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই। মূল জিনিস হলো সমাজের সংশোধন। কল্যাণ করতে হবে দাওয়াতের মাধ্যমে। যদি মুসলিম জাতির ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা সকলে দাওয়াতে বেশি সময় দেন, ইসলামের মূল ধারা, মূল্যবোধকে যদি তারা বুদ্ধিমানের মতো জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেন বন্ধু-বান্ধবদের কাছে, নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তাহলে এই সংস্কার সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। এ ধরনের আরো কিছু বিষয় আছে। আজকাল চ্যানেলগুলোর ওপর অনেকে নির্ভর করেছেন। ঘরের অনেকেই চ্যানেলগুলো  দেখে সময় ব্যয় করছেন। নারীরা করছেন বেশি। যদি সেসব অনুষ্ঠান আরো ভালো হতো, শালীন হতো, সুস্থ ও কল্যাণকর হতো তাহলে জাতির জন্য ভালো হতো। এগুলো পরিবর্তনও আবার দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার; কঠিন ব্যাপার মানতে হবে। এক্ষেত্রে দাওয়াত ছাড়া মানুষের সংশোধনের কোনো পথ দেখছি না। মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করা, তাকে বোঝানো, ইসলমাকে মানতে বলা ছাড়া কোনো পথ দেখছি না। আমাদের এ কথাও মনে রাখা উচিত। যে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করবো। তারপর যারা মানবে না বা ইসলামকে অনুসরণ করবে না, তার জন্য আল্লাহ তো বিচারক রয়েছেনই। সেটা আল্লাহ দেখবেন। আমাদের হাতে সবকিছু নয়। আকেরটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন। আমাদের আনন্দ উৎসব কি এ দু’টি ঈদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, এর বাইরে কি কিছু করা যাবে না? যাবে। যেমন একটি স্বাধীনতা দিবস পালন করা উচিত। আর ইতিহাসের বড় বড় ঘটনা, যেমন  বঙ্গভঙ্গ শতবর্ষ পালন করা, পলাশী দিবস ইত্যাদি। সেটা আমরা পালন করতেই পারি। আমাদের ভাষা নিয়ে একটা সংগ্রাম হয়েছিল, সেই দিবস তো আমরা পালন করতেই পারি। এ রকম অন্যান্য বড় ঘটনা বা দিবসকে আমরা অবশ্যই পালন করতে পারি। তবে ইসলামের মূলনীতিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেটা হতে হবে আল্লাহকে স্মরণ রেখে করা এবং ইসলামে যা কিছু অবৈধ বলা হয়েছে তা না করা। তবে অনুষ্ঠান অনেক করা বা বাড়ানো ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুষ্ঠান কেন মাত্র দু’টি করলেন, এটাও তো  একটা চিন্তার বিষয়। তিনি কেন ইবরাহিম আ:-এর জন্মদিবস পালন করলেন না, তিনি কেন আদম আ:-এর জন্মদিবস পালন করলেন না- এ প্রশ্ন তো আসে। কেন দু’টি করলেন? এ থেকে এটাও প্রমাণিত হয় যে অনেক বেশি অনুষ্ঠান করাও ঠিক নয়। কেননা, তাতে মানুষের জীবন ভারী হয়ে যায়। যেমন আমাদের প্রতিবেশী সমাজের বারো চাঁদে তেরো পার্বণ, তার মানে এতো অনুষ্ঠান যে জীবন অনেকটা ভারী হয়ে যায়- এসব অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হওয়া, এর জন্য খরচ করা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। এতে ব্যয়, সময় খরচ বেড়ে যায়। সে জন্য মনে হয় খুব বেশি বেশি অনুষ্ঠান করা, জীবনকে ভারী করে ফেলার শামিল। কুরআনের সূরা আরাফের একটা আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি পিঠের বোঝা নামিয়ে দেন এবং পায়ের শিকল কেটে দেন। এর মানে তিনি অহেতুক অনুষ্ঠান কমিয়ে দেন। অহেতুক সামাজিক বিধিবিধান কমিয়ে দেন। তিনি মানুষের জীবনকে সহজ করে দেন। এ বিষয়ে আমাদের এই সংস্কৃতিকে মনে রাখতে হবে। লেখক : সাবেক সচিব

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির