post

উত্তপ্ত ইরান হিমঘরে ফিলিস্তিন

১৩ জুন ২০১২
হাসান শরীফ গত বছর এই সময়ের দিকে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তারা সদস্য হতে পারেনি, কিন্তু বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে সমাদৃত হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ না করলে প্রয়োজনীয় সমর্থন পেতে পারত। কিন্তু এক বছর পরে অবস্থা কী? ফিলিস্তিন ইস্যুটির কথা কারো মনে নেই। সবার নজর এখন ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্প ছেড়ে দেবে কি না সেদিকে। গাজার লোকেরা না খেয়ে মারা গেল কি না, আরবদের উচ্ছেদ করে নতুন নতুন ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপন করা হলো কি না, আরো কোনো ইসলামি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হলো কি না সেদিকে কারোই এখন দৃষ্টি নেই। ওবামার মুখেও ফিলিস্তিন শব্দটা শোনা যায় না। হিলারি ক্লিনটনকে চীন, ভারত, পাকিস্তানে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কার্যক্রমে তিনি অদৃশ্য। এখানেই বলা যায়, ইসরাইলের সাফল্য! ফিলিস্তিন ইস্যুটিকে তারা সফলভাবে চাপা দিতে সক্ষম হয়েছে। বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পরে বেশ আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশ্বে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মিসরে গিয়ে তিনি মুসলিম বিশ্বকে কাছে টানার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার ওইসব প্রতিশ্র“তিতে লোকজন বিশ্বাসও স্থাপন করেছিল। তার জের ধরে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। মনে হচ্ছিল নতুন দিনের সূচনা হতে যাচ্ছে। তার কথামালা যে একেবারে ফাঁকা বুলি ছিল না সেটা প্রমাণ করতে ইসরাইলকে নতুন বসতি স্থাপন স্থগিত রাখতে বাধ্যও করেছিলেন। কিন্তু তারপর? ইসরাইল আবারো জোরেশোরে নতুন নতুন বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে। গাজা ও হামাসের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে পাত্তাই দিচ্ছে না। শান্তি আলোচনা হিমঘরের গভীরতম কোনে ঘুমিয়ে আছে। তাকে জাগানোর কোনো চেষ্টা পর্যন্ত নেই। আর ইরানের ওপর একের পর এক অবরোধ আরোপ করা হচ্ছে। ইরান এখন পর্যন্ত পরমাণু বোমা তৈরি করেনি, এটা সবাই মেনে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল যা বলতে চাচ্ছে তা হলো ইরান অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বোমাটি তৈরি করতে পারবে। সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্ব অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। এ জন্য আগেই ইরানকে দমন করা প্রয়োজন। ইসরাইল আগাম হামলা চালাতে চায়। আর যুক্তরাষ্ট্র এখন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়। ইরানে হামলা চালানো হলে সেটা খুব সহজেই যুদ্ধ থামবে, তেমনটা যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে না। সেক্ষেত্রে বিশাল এলাকায় তার বাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন পড়বে। সেই ব্যয়ভার তার পক্ষে মেটানো সম্ভব না-ও হতে পারে। এ কারণেই সে যুদ্ধের ঝুঁকিতে যাচ্ছে না। তবে ইসরাইলের হিসাব ভিন্ন। ইরানের ওপর হামলা হলে ফিলিস্তিন ইস্যুটি আরো কয়েক বছরের জন্য ধামাচাপা পড়ে থাকবে। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে ইচ্ছামতো কাজ করা সম্ভব হবে। অথচ ফিলিস্তিন ইস্যুটি গত বছরও বেশ আলোচিত বিষয় ছিল। পশ্চিমা অনেক দেশও ইসরাইলের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করে অবিলম্বে অর্থবহ আলোচনা শুরুর ওপর জোর দিচ্ছিল। ইসরাইলের পক্ষে এসব চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ক্রমাগত বিশ্ব জনমত ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল। তারা যে বঞ্চিত এবং নির্যাতিতÑ সেটা সবাই স্বীকার করে নিচ্ছিল। এর মধ্যে তুরস্কের মাধ্যমে নৌ-কাফেলা গাজায় ত্রাণ নিয়ে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। গাজা যে একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে, সেখানকার মানুষ যে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, সেদিকে তুরস্ক বিশ্ববাসীর নজর ফেরাতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এক ইরান ইস্যুকে কেন্দ্র করে সবকিছুই হারিয়ে গেছে। বসন্তের পর আরব দেশগুলো মিসর : আরব বসন্তের জের ধরে মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল। এই লেখা পর্যন্ত ফলাফল পাওয়া যায়নি। হয়তো দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটগ্রহণের প্রয়োজন পড়বে। ১৮ মাস আগে ৬৪ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছিল মিসরবাসী। ওই সময়ে তাহরির স্কয়ার হয়ে পড়েছিল মুক্তিকামী বিশ্বের প্রতীক। তবে স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ যতটা সহজ মনে হয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। অনেক বাধা এসেছে। তবে এটাই স্বাভাবিক। একটা স্তর নয়, তাদেরকে অনেকগুলো স্তর অতিক্রম করতে হবে। সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সম্ভবত মিসরবাসী ও মুসলিম ব্রাদারহুডের। ব্রাদারহুডকে অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হবে, সফল হলে পুরো বিশ্বের অবস্থাই নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে পারে, আবার ব্যর্থতায় বড় ধরনের সমস্যা হবে। তিউনিসিয়া : ২০১১ সালে এই দেশেই জাইন আল আবেদিন বেন আলীকে উৎখাত করে আরব বসন্ত বাতাস বইয়ে দিয়েছিল। শুধু আরব বসন্তের কারণেই নয়, এই দেশটিতে গণতন্ত্র উত্তরণপ্রক্রিয়াও অন্য সব দেশের থেকে সবচেয়ে সাবলীলভাবে হচ্ছে। নির্বাচনে জয়ী ইসলামপন্থী আন-নাহদা পার্টি অত্যন্ত প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়া : সিরিয়ায় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বাশারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। আরব দেশগুলোর মধ্যে এখানেই সবচেয়ে বেশি রক্তপাত হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার লোক মারা গেছে। অবশ্য এখন শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাশার আল আসাদকে রেখেই সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। রাশিয়া ও চীনের চাপে যুক্তরাষ্ট্র এখানে তাদের ইচ্ছামতো পরিবর্তন সাধন করতে পারেনি। লিবিয়া : মোয়াম্মার গাদ্দাফির ৪০ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। আরব বসন্তে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে এখানেই সবচেয়ে করুণ ঘটনা ঘটেছে। গাদ্দাফি ও তার কয়েক সন্তান নিহত হয়েছেন। কিন্তু তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিতে এখনো স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা হয়নি। গোত্রগত সঙ্ঘাতে ক্ষমতাসীন পরিষদ কিছুই করতে পারছে না। দেশটি বিভক্ত হয়ে যায় কি না সেই প্রশ্নও এখন দেখা দিচ্ছে। ইয়েমেন : ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর ৩৩ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। সালেহ গত ফেব্র“য়ারিতে বিদায় নিলেও তার ছেলে ও ভাইপো এখনো সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন। অনেকে অভিযোগ করছেন, সালেহ এদের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। পারস্য উপসাগরীয় এলাকা : বাহরাইনে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরা বিক্ষোভ করলেও সুন্নি প্রাধান্যবিশিষ্ট সরকার সেটা দমন করতে অনেকাংশেই সফল হয়েছে। এই দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-ঘাঁটি আছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখানে খুব একটা পরিবর্তনে আগ্রহী নয়। খুব সম্ভবত আরব বসন্তের বাতাস এই পর্যন্তই বইবে। নতুন কোনো দেশে তা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। এমনকি আলজেরিয়া ও মরক্কোতে কিছুটা বাতাস বইলেও সেখানকার পরিস্থিতি এখন অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। হয়তো আরেকটি বসন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির