post

উৎসব ও নববর্ষ । এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

উৎসব ও নববর্ষ । এইচ. এম. মুশফিকুর রহমানউৎসব আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম। উৎসব পরিবারকেন্দ্রিক হতে পারে, আবার ব্যাপকভাবে সমাজকেন্দ্রিকও হতে পারে। কালের বিবর্তনে উৎসবের রূপ বদলায়। কোনোটি বিলুপ্ত হয়, আবার কোনোটির নতুন সৃষ্টি হয়। উৎসবসমূহের কোনোটিতে থাকে সমাজ ও জাতীয়তার ছাপ, কোনোটিতে ধর্মের ছাপ, আবার কোনোটিতে থাকে রাজনীতির ছাপ। তবে সব অনুষ্ঠানের মূলেই রয়েছে আনন্দ লাভ।

ইসলাম ধর্মে উৎসবের রূপরেখা উৎসব সাধারণত একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়। উৎসবের উপলক্ষ্যগুলো খোঁজ করলে যে ধারণা পাওয়া যায়; তাতে রয়েছে উৎসব পালনকারী জাতির ধমনীতে প্রবাহিত ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুভূতি, ধর্মীয় সংস্কার ও ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া। উদাহরণস্বরূপ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড় দিন তাদের বিশ্বাসমতে স্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন। ইহুদিদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদিদের ধর্মীয় পবিত্র দিন ‘সাবাত’ হিসেবে পালিত হয়। এমনিভাবে প্রায় সকল জাতির উৎসবের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তাধারা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এজন্যই ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের উৎসবকে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে আর এটা আমাদের ঈদ।’ (বুখারি: ৯৫২ মুসলিম: ৮৯২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আগমন করলেন, তখন তাদের দু’টি দিন ছিল, যেখানে তারা খেলাধুলা করত। তিনি বললেন, এ দু’টি দিন কী? তারা বলল, আমরা এতে জাহিলি যুগে খেলাধুলা করতাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তার পরিবর্তে তার চেয়ে উত্তম দু’টি দিন দিয়েছেন, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।” (আবু দাউদ: ১১৩৪, আহমদ: ১৩২১০) বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) এ সম্পর্কে বলেন, ‘উৎসব অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধান, সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই একটি অংশ, যা সম্পর্কে আল্লাহপাক কুরআনে বলেন, “তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।” (সূরা আল মায়িদা: ৪৮) “প্রতিটি জাতির জন্য আমি অনুষ্ঠান (সময় ও স্থান) নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যা তাদেরকে পালন করতে হয়।” (সূরা আল হজ: ৬৭) ইসলাম আগমনের পর ইসলাম বহির্ভূত সকল উৎসবকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য দুটো দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। কোন জাতির জাতীয় উৎসব স্ব স্ব ধর্মের আলোকে পালন করা যেতে পারে। মুসলিমদের উৎসব হচ্ছে ইবাদাতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই বিষয়টি বুঝতে হলে ইসলামের সার্বিকতাকে বুঝতে হবে। ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং তা মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী হয়। তাই একজন মুসলিমের জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদাত, যেমনটি কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন, “আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদাত করা ছাড়া অন্য কোন কারণে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা আয যারিয়াত : ৫৬)

বাংলাদেশের উৎসব বাংলায় প্রচলিত লোকায়িত উৎসবের মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি, নবান্ন ও পৌষমেলা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বার্ষিক উৎসবের মধ্যে রয়েছে দুর্গাপূজা। বলতে গেলে বাংলাদেশের প্রতিটি জাতির নিজস্ব উৎসব রয়েছে।

নববর্ষের সূচনা সুনির্দিষ্ট কোনো দিবসকে স্মরণীয় করে রাখার গভীর বাসনা থেকে অথবা আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ, কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করা ইত্যাদি থেকে জন্ম নেয় বর্ষান্তরে উৎসব পালনের ঘটনা। ঐতিহাসিকদের মতে ভূমণ্ডলের ওপর মানবজাতির আধিক্য সমাজকে তারিখ ও বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তার দিকে ধাবিত করে। প্রত্যেক গোত্র, সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্ষগণনা শুরু করে। বর্ষগণনার উল্লিখিত প্রথা যেমনটা ছিল অনারবদের মধ্যে, তদ্রূপ প্রচলন ছিল আরব জাতির মধ্যেও। বাসুস যুদ্ধ যা বকর বিন ওয়ায়েল ও বনি যুহাল গোত্রের মধ্যে একটা উষ্ট্রীকে কেন্দ্র করে ৪০ বছর ধরে চলমান ছিল। ওই যুদ্ধকে মূল ভিত্তি বানিয়ে বর্ষগণনার সূত্রপাত করেন আরবরা। এর পরে দাইস যুদ্ধ ও আসহাবে ফিল তথা হস্তীবাহিনীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করা হয়। (উমদাতুল কারী ১৭/৬৬)

হিজরি নববর্ষ ইসলাম ধর্মের শেষ বাণীবাহক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার কুরাইশদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে মক্কা থেকে মদীনা চলে যান। তাঁর এই জন্মভূমি ত্যাগ করার ঘটনাকে ইসলামে ‘হিজরত’ আখ্যা দেয়া হয়। রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যেই হিজরি সাল গণনার সূচনা। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা)-এর শাসনামলে ১৭ হিজরি অর্থাৎ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের সাত বছর পর চন্দ্র মাসের হিসাবে এই পঞ্জিকা প্রবর্তন করা হয়। হিজরতের এই ঐতিহাসিক তাৎপর্যের ফলেই ওমর (রা)এর শাসনামলে যখন মুসলমানদের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র পঞ্জিকা প্রণয়নের কথা উঠে আসে তখন তারা সর্বসম্মতভাবে হিজরত থেকেই এই পঞ্জিকার গণনা শুরু করেন। যার ফলে চন্দ্রমাসের এই পঞ্জিকাকে বলা হয় ‘হিজরি সন’। (উইকিপিডিয়া)

ইংরেজি নববর্ষ আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর। তবে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ধারণাটি আসে খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে। তখন মেসোপটেমিয় সভ্যতার (বর্তমান ইরাক) লোকেরা নতুন বছর উদযাপন শুরু করে। তারা তাদের নিজস্ব গণনা বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করতো। তবে রোমে নতুন বছর পালনের প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ সালে। পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন, যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের অন্তর্গত বছরের প্রথম দিনটি জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। জানুস হলেন প্রবেশপথ বা সূচনার দেবতা। তার নাম অনুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম জানুয়ারি নামকরণ করা হয়। এতো গেলো যিশুর জন্মের আগের কথা। যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার করেন, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়। (আরটিভি, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৭)

বাংলা নববর্ষ বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে দুটি মত চালু আছে। প্রথম মত অনুযায়ী-প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক বঙ্গ, বিহার এলাকা তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল? অনুমান করা হয় যে, জুলীয় বর্ষপঞ্জীর বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪ বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল। দ্বিতীয় মত অনুসারে, ইসলামী শাসনামলে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১-১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর বঙ্গদেশে চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এ জন্য মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীকে হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতেউল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরি মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এ জন্য ৯৬৩ হিজরি সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরি সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। (উইকিপিডিয়া)

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে নববর্ষ পালন করা হয় যুক্তরাজ্য: লন্ডনে নববর্ষের আগ মুহূর্তে ট্রাফালগার স্কোয়ার এবং পিকাডেলি সার্কাসে বিশাল পরিসরে মানুষ সমবেত হয়। মধ্যরাতে বিগবেনের ধ্বনি শুনে এরা একত্রে নববর্ষকে বরণ করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রের নববর্ষ উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু হয় টাইমস স্কোয়ার। এখানে নতুন বছর শুরু হওয়ার ১০ সেকেন্ড আগে এক বিশালাকার ক্রিস্টাল বল নেমে নতুন বর্ষের আগমনের কাউন্টডাউন শুরু করে। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিউ-ইয়ার পার্টি। এতে প্রায় ৩০ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে। ভারত: ভারতে সম্রাট আকবরের সময় যে নওরোজ উৎসব হতো তা সর্বভারতীয় উৎসবের মর্যাদা পায়নি। অনেকে ভারতীয় বর্ষবরণ উৎসবকে দিওয়ালি উৎসব বলে অভিহিত করেন। তবে বর্তমানে ইংরেজি নববর্ষ পালন সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। বাংলাদেশ: বাংলাদেশে প্রধানত নববর্ষ হিসেবে পহেলা বৈশাখকে জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এতে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। ফ্রান্স: ফ্রান্সে বছরের শেষ দিনে ঘরে থাকা সব মদ শেষ করতেই হবে। নতুন বছরে ঘরে পুরনো মদ পড়ে থাকা অশুভ। সৌভাগ্য ঘরে আসবে না। তবে ঘরে-থাকা মদ ফেলে দিলে চলবে না। খেয়েই শেষ করতে হবে। আফ্রিকা: আফ্রিকার মাদাগাস্কারে নতুন বছর শুরুর সাতদিন আগে থেকে মাংস খাওয়া বন্ধ। বছরে প্রথম দিন বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না হবে। প্রথমে তা খেতে দেয়া হয় বাবা-মাকে। অস্ট্রেলিয়া: সিডনিতে নববর্ষ উপলক্ষে প্রায় ৮০ হাজার আতশবাজি ফোটানো হয় যা ১৫ লাখ লোক উপভোগ করে। স্কটল্যান্ড: স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় যে নববর্ষ উৎসব হয় তা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। চার দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে মানুষ আসে। রাশিয়া: গ্রান্ডাফাডার ফ্রস্ট, যে সান্টাক্লসের লালের পরিবর্তে নীল স্যুট পরে, এ দিন শিশুদের মধ্যে খেলনা বিতরণ করে। জার্মানি: এখানে মানুষ ঠাণ্ডা পানির মধ্যে তরল সিসার টুকরা ঠেলে দেয়। সিসার টুকরা যে রকম আকার বানায় তা দেখে ভবিষ্যৎ নির্ণয় করা হয়। চীন: পূর্ণিমার শুরুর দিন থেকে শুক্লপক্ষের পনেরো দিন উৎসব চলে নববর্ষ উপলক্ষে। চীনারা নববর্ষ পালন করে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী। নববর্ষের প্রথম দিনে তারা স্বর্গ ও পৃথিবীর দেবতাকে তুষ্ট করে নানা উপাসনা-উপাচারে, দ্বিতীয় দিন পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনা করে। ‘ওয়েইলু’ নামক বিশেষ ভোজনের আয়োজন করা হয় এ দিন। জাপান: জাপানে নববর্ষের সময় সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। খারাপ আত্মাকে দূরে রাখার জন্য এ সময় বাড়ির বাইরে দড়ি দিয়ে খড়ের টুকরো ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এটাকে তারা সুখ এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখে। ব্রাজিল: ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো সমুদ্রসৈকতে নববর্ষের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয়। এর অন্যতম আকর্ষণ চোখধাঁধানো আতশবাজির প্রদর্শনী। কোরিয়া: কোরিয়াতে নববর্ষ শুরুর সময় কেউ ঘুমায় না। এ সময় ঘুমালে নাকি চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়! রাত ১২টা বাজার সাথে সাথে টিভিতে ৩৩ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। কোরিয়ার ৩৩ বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটি করা হয়। মেক্সিকো: মেক্সিকোতেও ১২টা বাজার সাথে সাথে ১২ বার ঘণ্টা বাজানো হয়। এ সময় প্রতি ঘণ্টাধ্বনির সাথে একটি করে আঙুর খাওয়া হয়। তারা বিশ্বাস করে এ সময় যা কামনা করা হয়, তাই পূরণ হয়। (জাগো নিউজ ২৪ ডট কম: ১ জানুয়ারি ২০১৭) বাংলাদেশে নববর্ষের অনুষ্ঠানাদি বাংলাদেশে নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে বৈশাখী মেলা, যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, বিভিন্ন লোক সঙ্গীতের ব্যবস্থা, প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানো, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষকরণ, নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীদের সঙ্গীত, পান্তা-ইলিশ ভোজ, চারুশিল্পীদের শোভাযাত্রা, রমনার বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান “এসো হে বৈশাখ” এ ছাড়া রেডিও টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান ও পত্র-পত্রিকার বিশেষ কোড়পত্র।

নববর্ষ কি কল্যাণ বয়ে আনতে পারে? নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি এধরনের কোন তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পূজারি মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোনো স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখণ্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের প্রথম দিনের কোনো বিশেষ তাৎপর্য নেই। আর তাই তো ইসলামে হিজরি নববর্ষ পালনের কোন প্রকার নির্দেশ দেয়া হয়নি। না কুরআনে এর কোন নির্দেশ এসেছে, না হাদীসে এর প্রতি কোন উৎসাহ দেয়া হয়েছে, না সাহাবীগণ এরূপ কোন উপলক্ষ পালন করেছেন। এমনকি পয়লা মুহাররামকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবীজির (সা) মৃত্যুর বহু পরে, উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) আমলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, নববর্ষ ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যহীন, এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই। আর সে ক্ষেত্রে ইংরেজি বা অন্য কোন নববর্ষের কিবা তাৎপর্য থাকতে পারে ইসলামে। হানাফি মাযহাবের ইমাম আবু হানিফা (রহ)-এর দাদা তাঁর পিতাকে পারস্যের নওরোযের দিন (নববর্ষের দিন) আলী (রা) এর নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু হাদিয়াও পেশ করেছিলেন। (হাদিয়াটি ছিল নওরোয উপলক্ষে) আলী (রা) বললেন, ‘‘নওরোযুনা কুল্লা ইয়াওম’’ মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। (আখবারু আবু হানিফা) অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব নিকাশ করবে এবং নবোদ্যমে আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা)এর এ কথা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নববর্ষ উপলক্ষে পরস্পর উপহার আদান-প্রদান এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের কোন গুরুত্ব ইসলামে নেই।

মুসলিম হিসেবে আমাদের করণীয় ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে নববর্ষ সংক্রান্ত অধিকাংশ অনুষ্ঠান ইসলামী নির্দেশনা বহির্ভূত। যেমন, সূর্যকে স্বাগত জানানো ও বৈশাখকে সম্বোধন করে স্বাগত জানানোর মতো কর্মকাণ্ড মূলত সূর্য-পূজারি ও প্রকৃতি-পূজারি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুকরণ মাত্র। সূর্য ও প্রকৃতি পূজা বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জাতির লোকেরা করে আসছে। মানুষের ভক্তি ও ভালোবাসাকে প্রকৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির প্রতি আবদ্ধ করে তাদেরকে শিরক বা অংশীদারিত্বে লিপ্ত করানো শয়তানের কাজ। শয়তানের এই কূটচালের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন, “আমি তাঁকে ও তাঁর জাতিকে দেখেছি, তারা আল্লাহকে ছেড়ে সূর্যকে সিজদা করছে এবং শয়তান তাদের কার্যাবলিকে তাদের জন্য শোভনীয় করেছে।” (সূরা আল নামল: ২৪) নববর্ষে মুখোশ, নৃত্য, গম্ভীরা গান ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল হয়। জন্তু-পূজার উৎস পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতার কিছু ধর্মীয় মতবাদে, যেখানে দেবতাদের জন্তুর প্রতিকৃতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সকল প্রকার মিথ্যা দেবতার অবসান ঘটিয়ে একমাত্র প্রকৃত ইলাহ বা মানুষের স্রষ্টা আল্লাহর ইবাদাতকে প্রতিষ্ঠিত করা। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে (জীবন্ত বস্তুর) ছবি তৈরীকারীরা।” (বুখারি: ৫৯৫০ মুসলিম: ২১০৯) অন্য হাদীসে রাসূল (সা) বলেন, “যে কেউই ছবি তৈরি করলো, আল্লাহ তাকে (কিয়ামতের দিন) ততক্ষণ শাস্তি দিতে থাকবেন যতক্ষণ না সে এতে প্রাণ সঞ্চার করে, আর সে কখনোই তা করতে সমর্থ হবে না।” (বুখারি: ২২২৫, মুসলিম: ২১১০) নববর্ষের কাজগুলো করা মূলত কাফিরদের অনুসরণ করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য রাখল সে তাদের অন্তর্ভুক্ত।” (আবু দাউদ: ৩৫১৪) কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুশরিকদের উৎসব পালন করা, যেমন নববর্ষ ও অন্যান্য উৎসবসমূহ। মুসলমানদের উচিত ইসলামবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকা। মসজিদের ইমামগণ শিরক, বিদআতসহ সকল বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার সম্পর্কে মুসল্লিদের সচেতন করবেন। পরিবারের প্রধান নিশ্চিত করবেন যে, তার পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা অধীনস্থ অন্য কেউ যেন নববর্ষের অনুষ্ঠানে অনৈসলামিক কাজে লিপ্ত না হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে তার বন্ধুব-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী ও পরিবারের মানুষকে উপদেশ দিবেন এবং নববর্ষ পালনের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান যেন লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখবেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির