post

এত উন্নয়ন তবু কেন জলাবদ্ধতা?

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন

০৭ আগস্ট ২০১৭
আমরা বড্ড কঠিন সময়ের মধ্যে দিনপাত করছি। কোথাও যেন এতটুকু জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে বলা যায় আমরা ভালো আছি। প্রতিনিয়ত হত্যা, খুন, ধর্ষণ, গুম, অপহরণের বিভীষিকার সংবাদ পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হলেও পরিত্রাণের উপায় মেলছে না। শাসকগোষ্ঠীর মুখে উন্নয়নের স্লোগান যেভাবে মুখরিত হয় সেভাবে যদি জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে দেখা যেত তাহলে জলাবদ্ধতার মারণফাঁদে আটকে যেত না আমাদের নাগরিক জীবন। একটি দেশের সরকার যখন শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য লড়াই করে তখন আর সেখানে সুশাসন তথা আইনের শাসন কার্যকর থাকে না। আর তখনই সর্বত্র অন্যায়, অবিচার, জুলুম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, লুটপাটের মহড়ার চিত্র দেখা যায়। স্বৈরাচারী সরকার যতই উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে জনগণকে কাছে টানতে চায়, জনগণ কিন্তু ততই দূরে সরে যেতে চায়। সুসময় নদী ¯্রােতের চেয়ে বেগবান এটা ক্ষমতাসীনরা অনুধান করতে না পারলেও বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা কিন্তু সত্যিই টের পায়। এই সরকারের আমলে উন্নয়ন হয়নি এটা আমরা বলব না। উন্নয়ন হয়েছে তবে তা লুটপাটের। দেশের উন্নয়নের অগ্রগতি হচ্ছে ঐ পন্ডিতের মতো। এক পন্ডিত যাচ্ছিলেন ছাতা মাথায় দিয়ে। তাকে ঘোড়ার গাড়িতে তুলে নিয়ে কষ্টের কিছুটা লাঘব করতে চাইলেন এক সহৃদয়বান ব্যক্তি। কিন্তু বেচারা পন্ডিত এ সুযোগ প্রত্যাখ্যান করলেন এই বলে যে- আমার তাড়া আছে। হেঁটেই যাবো। সরকারের অবস্থাও তাই হয়েছে। সরকারের মুখে উন্নয়নের কথা শোনা গেলেও জলাবদ্ধতার মারণফাঁদে বন্দি রাজধানীবাসী। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪ হাজারের বেশি লোকের বসবাস। জীবন জীবিকার তাগিদে গাঁও-গেরামের মানুষ পানির ¯্রােতের মতো প্রবেশ করছে এই শহরে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও অর্থবহ স্বাধীনতাকে আজো খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। আধিপত্যবাদীদের শোষণ, লুণ্ঠন, নির্যাতন, দুর্নীতির আগ্রাসন থেকে জাতিকে মুক্তি দেয়ার প্রয়াসে লাখো জনতা সেই দিন স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকে ছিনিয়ে এনেছিল। কিন্তু সেই স্বাধীনতা আজ কোথায়? একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তুলতে জলাবদ্ধতা প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু কেন এবং কী কারণে রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতার সাগরে নগরবাসীকে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। নিকট অতীতে প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, টাকা থাকলে তিনি ঢাকাকে আরো কয়েক টুকরায় বিভক্ত করতেন। আমরা আরো মেয়র পেতাম। কিন্তু তাতে কি বিড়ম্বনা কমত? না, তবে উন্নয়ন বাড়ত, দুর্ভোগ কমত না। ঢাকার দুই নগরপিতাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে! তারা নিশ্চয়ই নানারকম উদ্যোগের কথা বলবেন। কিন্তু নাগরিকদের যদি এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়, তারা এক বাক্যে বলবে জলাবদ্ধতা আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে। শুধু ব্যবধান এতটুকু হয়েছে অতীতে হাঁটু পানি জমতো আর এখন কোমর পানি জমে। এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না যে একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার দায়িত্ব দুই নগরপিতার। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তারা জলাবদ্ধতা দূর করতে পারেননি। একটু বৃষ্টির পানিতে-ই রাজধানীর অধিকাংশ সড়ক বুড়িঙ্গার দূষিত পানিকেও হার মানায়। জলাবদ্ধতা দূরা যে কঠিন তা কিন্তু নয়! সরকার ইচ্ছে করলে এই জলাবদ্ধতা দূর করতে পারে। ঢাকার ছোট বড় অর্ধশত খাল কারা ভরাট করে সেখানে বাসা বানিয়েছে তা জাতির সামনে উন্মোচন করা হোক? তাহলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। রাজধানী উন্নয়ন প্রকল্প (রাজউক) অনেক জলাশয় ভরে সংসদ সদস্যদের জন্য আবাসন প্রকল্প করেছে। কিন্তু এসব প্রকল্পে ঢাকায় বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। খালের পানি কখনো ড্রেন দিয়ে নামতে পারে না। ড্রেন ভরাট হয়ে গেছে। বক্সকালভার্ট করলেও তা আবর্জনা জমে ভরাট থাকে। জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন করার জন্য দুই মেয়রকে খাল দখলদারদের হাত থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। দুই নগরপিতাকে বলব হিমঘরে সেমিনার অনেক হয়েছে এবার সন্তানতুল্য নাগরিকদের কথা একটু ভাবুন! রাজধানী ঢাকার যতগুলো সমস্যা পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে রাস্তার জলাবদ্ধতা। দিনের পর দিন যে হারে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, সে তুলনায় তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র। প্রতি বছরই দেখা যায় বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টিতেই রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতার মহামারী দুর্ভোগে স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার রাস্তাঘাট যতটা না ডুবে তারচেয়েও অনেক বেশি উন্নয়নের খানাখন্দে জলাবদ্ধতা আরো বিগড়ে যায়। দুই নগরপিতা হয়ত এখনও বলবেন ঢাকাকে বাসযোগ্য, গ্রিন ঢাকা, তিলোত্তমা করতে আরো সময় লাগবে। ধৈর্য ধরুন, হাতির ঝিল হয়েছে, ওয়াটার বাস নামানো হয়েছে। আরো হবে এবং হচ্ছে। জলাবদ্ধতা হওয়ার পেছনে অনেকগুলো অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে। যেমন অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খানাখন্দ, যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি ও ময়লার ভাগাড়। অন্য দিকে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ছোট-বড় গর্ত ভরে জলাবদ্ধতার পাশাপাশি অসহনীয় যানজট জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ঢাকা শহরের এমন কোন সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে উন্নয়নের নামে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে না। সিটি করপোরেশন, মেট্রোরেল স্থাপনের কাজ, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো সড়ক, অলিগলি ইচ্ছেমতো খুঁড়ছে। দেখা যায় যে এক সংস্থা একটি রাস্তা কেটে মাত্র মাটি ফেলেছে, পরদিন আরেক সংস্থা এসে আবার ওই রাস্তাই কাটছে। আবার এমনও দেখা যায় যে, একই রাস্তায় ওয়াসার পানি ও স্যুয়ারেজ লাইন, তিতাসের গ্যাসলাইন, পিডিসি ও বিটিসিএলের নতুন ক্যাবল লাইন বসানো বা মেয়ামতের কর্মযজ্ঞের কারণে প্রায় বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। যে কারণে দুই মিনিটের পথ পাড়ি দিতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে তীব্র যানজটে। কবে এই ভোগান্তি থেকে নগরবাসী রেহাই পাবে সেটা আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন। যানজট নিয়ে সবারই কমবেশি মাথা ব্যথা করে। কারো কারো তো রাতে ভালো ঘুমই হয় না টেনশনে। কোনো কারণে যদি একটু দেরি হয়ে যায় তাহলে অফিসের সময় চলে যায়। আর বসের কটু কথা শোনতে শোনতে তো সারাদিন এমনিতেই মাটি হয়ে যায়। দোষটা আসলে অফিসের বসের নয়! দোষটা হচ্ছে ভাগ্যের। তা না হলে রাজধানীর মতো জায়গাতে কেন কর্ণফুলীর ¯্রােত দেখতে হয়। গত ২৮ জুলাই ২০১৭ কেউ সঠিক সময়ে তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারেনি। কারণ ২৭ জুলাই ২০১৭ রাতে অবিরাম বৃষ্টি হওয়ার ফলে রাজধানীতে জলাবদ্ধতার সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে অফিসগামী হাজারো মানুষকে। ১০ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে সময় লেগেছে এক ঘন্টা। এক রুটের গাড়ি অন্য রুটে ঢুকে যানজটের দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। গলিপথে রিকশায় পানি পার হতে হয়েছে ৩০-৪০ টাকায়। ধানমন্ডির মতো জায়গাতেও পানির জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। ধানমন্ডি ১৫ নাম্বার স্টাফকোয়ার্টার থেকে ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পানিতে একাকার হয়ে গেছে। অথচ নির্বাচনের আগে ঢাকার দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, এ বছর ঢাকার রাস্তায় বর্ষার পানি আটকাবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে বর্ষা তার কথা রাখেনি। আরেক মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, পানির জন্য মূলত ওয়াসা দায়ী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ঢাকাকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছিল উন্নয়নের জোয়ার জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে। কিন্তু উন্নয়ন জনগণের হয়নি, হয়েছে কিছু মানুষের। উন্নয়নের ফিরিস্তি লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর একনেক ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্যে ৫ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার অনুমোদন দেয় তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নে। অথচ কাজের কাজ কিছুই দৃশ্যমান হয়নি। ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য নগরীগুলোর মধ্যে একটি। কেন আমাদের এই প্রিয় নগরী বসবাসের অযোগ্য নগরীর তালিকায় চলে গেল? কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে, জলাবদ্ধতার বিষয়টিও উঠে এসেছে। এটা আমাদের জন্য যেমন দুর্ভাগ্যের তেমনি রাষ্ট্রপরিচালনার নিয়োজিতদের জন্যও লজ্জার এই বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের অনুধান করা প্রয়োজন। ঢাকা শহরকে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া কিংবা কানাডা নগরী বানানোর দরকার নেই। আপনারা দয়া করে জলাবদ্ধতাটা নিরসন করার চেষ্টা করুন। ঢাকার রাজপথে এতদিন রিকশা, বাস, সিএনজি চলছে আগামীতেও রিকশা বাসই চলুক এমনটিই প্রত্যাশা নগরবাসীর। চট্টগ্রাম শহরের মতো যেন নৌকায় চড়তে না হয়। রাজধানীবাসীকে জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হলে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। লেখক : বিশিষ্ট পরিবেশবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির