post

কারাগারে আলাপচারিতায় মুহতারাম আমীরে জামায়াত ‘চিন্তা করো না সাহস রাখ মেঘ কেটে যাবে’

১৩ জুলাই ২০১৪

 মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত

4দীর্ঘ চার বছর ধরে আওয়ামী জুলুমশাহির কারাগারে বন্দী মানবতার মুক্তি আন্দোলন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মুহতারাম আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। ২০১০ সালের ২৯ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের (!) বিস্ময়কর অভিযোগে আমীরে জামায়াতকে আটক করা হয়। একই দিন একই অভিযোগে শান্তিবাগের নিজ বাসা থেকে নায়েবে আমীর আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ও সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে নিজ এলাকায় যাওয়ার পথে সাভার থেকে আটক করা হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতারের পরবর্তীতে অন্যান্যদের মতো আমীরে জামায়াতকেও তথাকথিত মানবতাবিরোধী অভিযোগের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। একই প্রক্রিয়ায় একের পর এক অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে অভিযুক্ত করা হয় মানবতাবিরোধী অপরাধে। এ রকম অন্যায়ভাবে গ্রেফতারকৃত রাজবন্দী জাতীয় নেতৃবৃন্দের মুক্তি ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ইসলামের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে দেশের সর্বস্তরের জনগণ। এর মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দেশের ছাত্রসমাজ। ছাত্রসমাজের একজন নগণ্য প্রতিনিধি হিসেবে আমিও শামিল হওয়ার চেষ্টা করি সেই প্রতিবাদে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তীব্র গণ-আন্দোলন। শহর-নগর, গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়া রাজবন্দীদের মুক্তি, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও ইসলাম রক্ষার সেই আন্দোলন দমনে হত্যা, গুম, নির্যাতনে পঙ্গু করে দেয়ার পাশাপাশি গণগ্রেফতার অব্যাহত রাখার পথ বেছে নেয় শেখ হাসিনার আওয়ামী সরকার। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। আমিও গ্রেফতারের শিকার হয়ে বন্দী হই কারাগারে। ২০১১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রথমবার গ্রেফতার হয়ে ৬ মাস এবং ২০১৩ সালের ২৫ মে আবার গ্রেফতার হয়ে ১৩ মাস কারাগারে বন্দী থাকি। প্রথমবার কারা-অভ্যন্তরে মুহতারাম আমীরে জামায়াতের সাথে মাত্র একবার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। তাও ছিল কারাগার থেকে কোর্টে নেয়ার পথে। তখন শুধুমাত্র হ্যান্ডশ্যাক আর সালাম বিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল। তবে দ্বিতীয়বারে মুহতারাম আমীরে জামায়াতের সান্নিধ্য বেশি লাভ করি। কারণ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের চিত্রা বিল্ডিংয়ের ৪র্থ তলায় ৩৫নং কক্ষে থাকতেন তিনি, আর আমি থাকতাম একই বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার ১১নং কক্ষে। একই বিল্ডিংয়ে থাকার সুবাদে মাঝে মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ ছিল। গ্রেফতার হওয়া আমাদের অনেক নেতাকর্মীও চাইত আমীরে জামায়াতের সাথে দেখা করতে। যদিও আমীরে জামায়াত বন্দী অবস্থায়ও চাইতেন কারা কর্তৃপক্ষের সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলতে। তিনি ডিউটিরত কারারক্ষীদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার সাথে দেখা করতে আসতে বলতেন। কেউ যেন শৃঙ্খলা উপেক্ষা না করে এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ২১ অক্টোবর ’১৩ আমাকে চালানে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ এ পাঠানো হয়। পরদিন সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সেলিম উদ্দিন ভাই আমাকে চিত্রার বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় ১১নং কক্ষে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। তখন তিনিও কাশিমপুর-১ কারাগারে চিত্রা ১১নং কক্ষে ছিলেন। ঢাকায় আমীরে জামায়াতের নিয়মিত ট্রাইব্যুনালে হাজিরা থাকায় প্রথম সপ্তাহে দেখা করা সম্ভব হয়নি। এক সপ্তাহ পর আমি দেখা করতে ওনার কক্ষে যাই। তখন কেন্দ্রীয় ও শাখা পর্যায়ের কতজন নেতাকর্মী গ্রেফতার আছেন এবং আহতদের কী অবস্থা জানতে চান। পাশাপাশি আমার শারীরিক অবস্থা এবং আমার ওপর নির্যাতনের ঘটনা জানতে চাইলে আমি খুলে বলি। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন এবং বললেন, ‘চিন্তা করো না সাহস রাখ মেঘ কেটে যাবে।’ সেই দিন মুহতারাম আমীরে জামায়াতের কথায় সত্যিই উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। অনেক দিন পর তাঁর সাথে সাক্ষাৎ আমাকে আপ্লুত করে। ৯ ডিসেম্বর ’১৩ সকাল ১১টার দিকে তিনি আমাকে তার সেবককে দিয়ে ডেকে পাঠালেন। তখন শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির দণ্ড বাস্তবায়নের তোড়জোড় চলছিল (যা পরবর্তীতে ১২ ডিসেম্বর ’১৩ রাতে কার্যকর করা হয়)। সালাম দিয়ে ৩৫নং কক্ষে প্রবেশ করে দেখি তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি গিয়ে বিছানার পাশে বসি। তিনি কিছু দোয়া আরবিতে বললেন আর আমি কাগজে তা লিখে নিই। শহীদ মোল্লা ভাইয়ের ফাঁসির রায় বাস্তবায়নের তোড়জোড়ের প্রেক্ষিতে তিনি বললেন, ‘আল্লাহই জানেন তিনি তার বান্দাহর জন্য কী বরাদ্দ রেখেছেন। এই মুহূর্তে বন্দী হিসেবে দোয়াই আমাদের একমাত্র সম্বল।’ তিনি সবাইকে দোয়াগুলো লিখে দিতে বললেন এবং কুরআন তিলাওয়াতের পর দোয়াগুলো পড়ে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে বললেন। এর পাশাপাশি আমার পরবর্তী সাক্ষাতে যে আসবে তার কাছে দেশবাসীর কাছে দোয়া চাইতে বললেন। বিশেষ করে মক্কা ও মদিনায় আমাদের ভাই যারা আছেন তারাও যেন দেশ, জাতি ও নেতৃবৃন্দের জন্য দোয়া করেন। প্রসঙ্গক্রমে জানালাম আমাদের যারা কারাগারে আছেন তারা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, রোজা এবং নফল ইবাদত বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছেন। আমীরে জামায়াত বললেন, ‘বিপদের সময় ইবাদতের যে চর্চা হচ্ছে যখন সুসময় আসবে তখনও যেন আন্দোলনের জনশক্তিরা এমন ইবাদত ছেড়ে না দেয়। সে ব্যাপারে তোমাদের মোটিভেশন থাকা দরকার।’ ৫ জানুয়ারির একদলীয় ও পাতানো নির্বাচনের আগে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সর্বশেষ সফরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক চলছিল। ৮ ডিসেম্বর ’১৩ জামায়াতে ইসলামীর সাথেও বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোন কারণে জামায়াতের সাথে নির্ধারিত বৈঠকটি বাতিল হয়ে যায়। মিডিয়া জামায়াতের সাথে বৈঠক বাতিলের বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করে। ঐ সময় আমীরে জামায়াতের সাথে আলোপচারিতায় হতাশা ব্যক্ত করে বললাম, জামায়াতকে গুরুত্ব দেয়নি বলেই হয়তো বৈঠকটি বাতিল করেছে। তখন আমীরে জামায়াত সাথে সাথে দৃঢ়কণ্ঠেই বলেছিলেন, ‘দেখ হতাশ হয়ো না, জামায়াত এখন আর এমন কোন সংগঠন নয় যে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কেউ জামায়াতকে এড়িয়ে চলতে পারে। নিশ্চয়ই অন্য কোন ব্যস্ততার কারণে বৈঠকটি বাতিল হয়েছে। পরে অবশ্যই এটি অনুষ্ঠিত হবে।’ পরদিন খবর পেলাম স্থগিত হয়ে যাওয়া জামায়াত-তারানকো বৈঠকটি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের হলুদ মিডিয়া বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার খবরটি আর ন্যূনতম প্রচারও করেনি। ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২০১৪ সেশনের জন্য নতুন কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচন সম্পন্ন হয়। এ উপলক্ষে কারাবন্দী ভাইদের মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি। নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় সভাপতি ও নবমনোনীত সেক্রেটারি জেনারেল এবং সংগঠনের জন্য দোয়া চাইতে ২৯ জানুয়ারি সকালে মুহতারাম আমীরে জামায়াতের কাছে যাই। তখন তিনি নাশতা করছিলেন। পরদিন ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় ধার্য থাকায় চট্টগ্রাম যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। নতুন দায়িত্বশীল নির্বাচনের খবর জানিয়ে নতুন দায়িত্বশীলদের জন্য ও ছাত্রশিবিরের জন্য দোয়া চাইলাম। পাশাপাশি এটিও বললাম যে, যেখানে সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত সদস্য সম্মেলনে উপস্থিত থেকে আমীরে জামায়াত দোয়া করেন সেখানে আজ কয়েক বছর ধরে ছাত্রশিবির সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তিনি নতুন কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেল এবং ছাত্রশিবিরের জন্য দোয়া করলেন। আর আমি নিজ হাতে মুহতারাম আমীরে জামায়াতকে মিষ্টি খাইয়ে দিলাম। এর পর আর আমীরে জামায়াতের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ প্রহসনের এক রায়ে ১০ ট্রাক অস্ত্রের ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ওনাকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আজ আমি আওয়ামী বন্দিশালা থেকে মুক্ত। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের বীর সিপাহসালার মুহতারাম আমীরে জামায়াত এখনো কারারুদ্ধ। জেল-জুলুম নির্যাতন আর নিষ্পেষণে বাংলার আকাশে আজ যে কালো মেঘ জমাট বেঁধে রয়েছে মুহতারাম আমীরে জামায়াতের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিশ্চয়ই সেই মেঘ কেটে যাবে। উদিত হবে নতুন সূর্য। মুক্তি পাবে সমগ্র জাতি ও দেশ। সে জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও সাহসিকতা যা আমীরে জামায়াতের কথায় সেদিন প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, ‘চিন্তা করো না সাহস রাখ মেঘ কেটে যাবে।’ লেখক : সদ্য কারামুক্ত ও সাহিত্য সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির