post

কোটা হোক অনুপ্রেরণার পরাজয় হোক বঞ্চনার

সালাহউদ্দিন আইউবী

০৩ মে ২০১৮
কোটা কী? দেশের নারী ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী যাতে সমান সুবিধা নিতে পারে এই লক্ষ্যে সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দেশের অর্থাৎ উপজাতি, প্রতিবন্ধী, নারীসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি সকল চাকরিতে নির্দিষ্ট হারে সংরক্ষিত অংশকে কোটা হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। সংবিধানের ২৯ (১) ও (২) অনুচ্ছেদ বলে, ১. প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে ২. কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেইক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না । সংবিধানের ২৮ (৪) অনুচ্ছেদ বলে, নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না। অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে কোটা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন। কোটার ধরন ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সন্তানদের সুবিধা দেয়ার জন্য প্রথমে এ কোটা চালু করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে প্রথম এই কোটাব্যবস্থা চালু করা হয়। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এই কোটার পরিধি বেড়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের জন্য এ কোটা প্রযোজ্য হচ্ছে। ৬৪টি জেলার জন্য কোটা আছে। মূলত দেশের অনগ্রসর মানুষকে সুবিধা দেয়ার জন্যই কোটাব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে এখন ২৫৮ ধরনের কোটা আছে। বাংলাদেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সূত্র মতে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে মোট পাঁচটা ক্যাটাগরিতে কোটার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা: মুক্তিযোদ্ধা কোটা : ৩০ শতাংশ জেলা কোটা : ১০ শতাংশ নারী কোটা : ১০ শতাংশ উপজাতি কোটা : ৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা : ১ শতাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোটাপদ্ধতি বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত বিষয় হচ্ছে কোটাপদ্ধতি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনগ্রসর গোষ্ঠীর অগ্রসরতার জন্য উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে কিছু সংরক্ষিত আসন থাকে। বাংলাদেশেও রয়েছে তেমন কিছু সংরক্ষিত আসন বা কোটা। বাংলাদেশের কোটাপদ্ধতি নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা তাহলে জানা যাক বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো কোটাপদ্ধতি কত শতাংশ ও কিভাবে সেটি প্রয়োগ হয়। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা রয়েছে। ভারতে মোট ৪ ধরনের কোটা রয়েছে; উপজাতি কোটা, বিভিন্ন জাতভিত্তিক কোটা, অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য কোটা এবং বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু কোটা। উপজাতি কোটা ৭.৫ শতাংশ, জাতভিত্তিক কোটা ১৫ শতাংশ এবং সংখ্যালঘু ও অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য ২৭ শতাংশ কোটা ভারতে সরকারি চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় বিদ্যমান। তবে মোট ৪৯.৫ শতাংশ কোটা থাকলেও ভারতে কোটার জন্য রয়েছে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা। একটি পরিবারের মাত্র একজনই কোটা সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে এবং যদি কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্য কোটা গ্রহণ করে তবে সে চাকরিতে কোটাসুবিধা পাবে না। পাকিস্তান পাকিস্তানের কোটাপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলের জনসংখ্যার ভিত্তিতে। বিভিন্ন অঞ্চলে জনসংখ্যা ওপর নির্ভর করে সেই অনুপাতে কোটাসুবিধা প্রদান করা হয় পাকিস্তানে। পাকিস্তানের কোটাপদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যৌক্তিক পরিমাণ মানুষ যেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। পাকিস্তানে সরকারি চাকরিতে সমগ্র দেশ থেকে মাত্র ৭.৫ শতাংশ চাকরি মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। বাকি ৯২.৫ শতাংশ চাকরি বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য সংরক্ষিত। সরকারি চাকরি সবচেয়ে বেশি কোটা বরাদ্দ রয়েছে পাঞ্জাব প্রদেশের জন্য। পাঞ্জাবের ৫০ শতাংশ, সিন্ধু প্রদেশের জন্য ১৯ শতাংশ, খাইবার-পাখতুনওয়ার জন্য রয়েছে ১১.৫ শতাংশ, বালুচিস্তানের জন্য ৬ শতাংশ আর গিলটের জন্য রয়েছে ৪% আর আজাদ কাশ্মিরের জন্য ২ শতাংশ। মালয়েশিয়া মালয়েশিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ৩ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার। মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৫০.১ শতাংশ মালয়, ২২.৬ শতাংশ চাইনিজ, ৬.৭ শতাংশ ভারতীয়, ১১.৮ শতাংশ স্বদেশজাত এবং ৮.৮ শতাংশ অন্যান্য। ধর্মীয় দিক থেকে মোট ৬০.১ শতাংশ মুসলিম, ১৯.৮ শতাংশ বৌদ্ধ, ৯.২ শতাংশ খ্রিস্টান, ৬.২ শতাংশ হিন্দু এবং ৩.৪ শতাংশ অন্যান্য। মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকে মালয় জনগোষ্ঠী। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, স্বল্পমূল্যে বাসস্থানসহ সকল ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ ভোগ করে মালয় জনগোষ্ঠী, বাকি ৪০% সুবিধা ভোগ করে অন্যান্য জনগোষ্ঠী। তবে চাকরির ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত সুবিধা মিললেও মেধার পরিচয় দিয়েই প্রবেশ করতে হয়। সরকারি অর্থায়নে যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত সেখানে মোট সিটের মোট ১৯ শতাংশ পায় চাইনিজরা এবং ৪ শতাংশ ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী। বাদ বাকি সকল সিট পায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় জনগোষ্ঠী, যারা ভূমিপুত্র নামেও পরিচিত। কানাডা উন্নত রাষ্ট্র কানাডায়ও রয়েছে কোটা তবে সে কোটা প্রয়োগ হয় প্রকৃত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীদের জন্য। কানাডায় মূলত চারটি শ্রেণীর জন্য কোটা প্রযোজ্য। চারটি শ্রেণী হচ্ছে নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘু। চারটি শ্রেণীর মোট কত শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা সুস্পষ্ট ভাবে কানাডার এমপ্লয়মেন্ট ইকুইটি অ্যাক্টে নির্দিষ্টভাবে বলা না হলেও সেটা কখনোই মেধার চেয়ে বেশি নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্তদেশগুলো ২০১২ সালে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে যার মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে নন-এক্সিকিউটিভ চাকরিগুলোতে যেন ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। কোটা বিতর্ক কেন? দীর্ঘদিনের চলমান কোটাপদ্ধতি নিয়ে হঠাৎ কেন এত অসন্তোষ, কেন এত বিতর্ক, কোটাপদ্ধতি বাতিলের দাবিতে লাখো ছাত্র-জনতা কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায়? সবার মনে প্রশ্ন। আসলে কি এ বিতর্কের কোনো যৌক্তিকতা আছে? বিগত দশ বছরের বিসিএস নিয়োগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মেধাতালিকায় ২০০-৩০০ এর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও অনেক মেধাবী পরীক্ষার্থী ক্যাডার পাননি, যেখানে ২০০০, ৩০০০ বা তদূর্ধ্ব তালিকায় থেকেও শুধুমাত্র কোটার জোরে অনেক কম মেধাবীরা চাকরি জুটিয়ে ফেলেছেন । এটা অনেকটা স্পষ্ট যে ২২০তম হয়েও অনেকের বিসিএস জোটে না অথচ ৫৬৩২তম হয়েও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অন্য একজন এএসপি হয়ে যায়। প্রায়ই দেখা যাবে ৫০-৫২% মার্কস নিয়ে উত্তীর্ণ এইসব কোটায় চাকরি প্রাপ্তদের কারণে ৬০-৮০% প্রাপ্ত মেধাবীরা বেকার বসে আছে। এ তো শুধু বিসিএসের চিত্র এছাড়াও সরকারি অন্যান্য চাকরিতে ৫৬% কোটা থাকায় ১০টি পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে ৬টি পদেই মেধাবীরা অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হন। বিষয়টা কিছুটা এমন, আপনার কেরোসিন মজুদ করা আছে কিন্তু কেরোসিনের দাম ক্রমাগত কমছে। ঠিক তখন আপনি নিজের বাড়ি বানানো শুরু করলেন এবং শোবার ঘর ছাড়া কোন ঘরেই বৈদ্যুতিক বাতি লাগালেন না। আপনি কিছু হারিকেন কিনে এনে রান্নাঘরসহ বাকি চারটি ঘরকে আলোকিত করলেন। আলোকিত হয়নি এমন না। তবে আপনার বেশিরভাগ ঘরের কার্যক্ষমতাই কমে গেল। মজুদ করা কেরোসিন কাজে লাগাতে গিয়ে আপনি নিজের ঘরকে ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলেন না। সেই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলার আছে। আপনার শোবার ঘরের বাতি চমৎকার কাজ করবে এমন গ্যারান্টিও নেই। যে ৪৫% প্রার্থী সরকার মেধার ভিত্তিতে নিলো সেই ৪৫% এর মধ্যে আবার ঢুকবে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু কি কোটা সিস্টেমের সমস্যা? কোটাপদ্ধতি কি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্র? এটি কি সত্যিকার অর্থেই নারী, উপজাতি ও অনগ্রসর জেলাগুলির উন্নয়নের স্বার্থে? টিআইবির ২০০৭ সালের রিপোর্টের নিরিখে আসুন, আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবার চেষ্টা করি। রিপোর্টের নবম পৃষ্ঠায় ‘Irregularities in BCS examination’ শিরোনামে কঠিন ভাষায় যেসব কথা লেখা আছে তা নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক । ১.ঘুষের লেনদেন ও চুক্তিভিত্তিক ‘মেধা’ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে ক্রমেই বর্ধিষ্ণুতার হার বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ জরিপে দেখানো হয়েছে : ক. মেরিট লিস্টে থাকা প্রার্থীদের পছন্দসই ক্যাডার প্রদানে যেসব চুক্তি করা হয় তার অর্থের পরিমাণ : # প্রশাসন / পুলিশ ক্যাডার - ৫-৭ লাখ # কাস্টমস্ / ট্যাক্স - ৮-১০ লাখ # প্রফেশনাল ক্যাডার - ২-৩ লাখ খ.মেরিট লিস্টে না থাকা প্রার্থীদের পছন্দসই ক্যাডার প্রদানে যেসব চুক্তি করা হয় তার অর্থের পরিমাণ : # প্রশাসন / পুলিশ ক্যাডার - ৮-১০ লাখ # কাস্টমস্ / ট্যাক্স - ১০-১২ লাখ # প্রফেশনাল ক্যাডার - ৩-৫ লাখ ২.২৪তম বিসিএস থেকে প্রায় প্রতিবার ক্রমাগত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর পাওয়া গেছে। ৩৩তম বিসিএসের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে। ৩.পরীক্ষার হলে সিট নির্ধারণও ঘুষের বিনিময়ে করা হয়ে থাকে। ৪.পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত প্রার্থীকে উপস্থিত দেখিয়ে উত্তরপত্র দেয়া হয় এবং চুক্তির মাধ্যমে পরে উত্তরপত্র বদলানোর সুযোগ থাকে। ৫.মেরিট লিস্ট ও ফলাফল নির্ধারণেও দুর্নীতির ঢালাও ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে ঘুষ এবং রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে। ৬.ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষায় পূর্বে করা অর্থচুক্তির মাধ্যমে প্রার্থীর অধিক নম্বর আদায় করার সুযোগ আছে। ৭.মৌখিক পরীক্ষায় ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ প্রশ্ন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যেমন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক কে? ৮.ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রায় প্রতিবারই প্রার্থীদের চাকরিদান করা হয়েছে। ৯.প্রার্থীর সাথে নেগোসিয়েশনের জন্য পিএসসি সদস্যরা প্রার্থীদের কমিশনে তলব পর্যন্ত করে। ১০.২০তম বিসিএস পরীক্ষা থেকেই পিএসসি থেকে ভুয়া সার্টিফিকেটধারীদেরকে সুবিধা প্রদান প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১১.বিসিএস পরীক্ষার যাবতীয় নথি কোন রকম পদ্ধতি অনুসরণ না করেই নষ্ট করে ফেলা হয়। (সেক্রেটারিয়েট রেগুলেশন ১৯৭৪)। সবচে বড় কথা, পিএসসি নির্দিষ্ট কোন কোঠায় কোন প্রার্থী চাকরিপ্রাপ্ত হয়েছে এই বিষয়ক কোন ধরনের নথিপত্র আজ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করেনি? এবং কাদের স্বার্থে? মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের প্রতি সহানুভূতির স্বার্থে, নারী জাগরণের স্বার্থে, বৈষম্য দূরীকরণের স্বার্থে? এই প্রশ্নগুলির উত্তর না লেখাই সঙ্গত বোধ করছি। কারণ, কিছু কিছু প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে থাকে। বাগধারায় এগুলিকে বলা হয় ‘Open Secret’। কোটাপদ্ধতি সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের অভিমত কোটাপদ্ধতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “আমরা কোটা করার পরও মহিলারা পিছিয়ে আছেন। আমি তো মনে করি মহিলাদের জন্য কোটা আরো বৃদ্ধি করা উচিত। আর পার্বত্য অঞ্চলে যারা আছেন গারো, মারমা, ত্রিপুরা অন্যান্য যারা আছেন এদেরকেও তো উঠিয়ে আনতে হবে। এটাতো অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। অন্যান্য দেশেও আছে। সবই যদি মেধার ভিত্তিতে হয় তাহলে পিছিয়ে যারা, অবহেলিত যারা আছেন তারাতো কোনদিনই আসতে পারবেন না। জনগণের মধ্যে যে একটা বৈষম্য, যেটা আগে ছিল সে বৈষম্যটা দূর করাই সরকারের উদ্দেশ্য। সাম্য নয় সমতামূলক কোন একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য এটা রাখা হয়েছে। আমি কোটার সম্পূর্ণ পক্ষে।” প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা কোটাপ্রথাকে পূর্ণ সমর্থন করলেও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান ২০০৮ সালের একটি গবেষণায় ৫৫% কোটাকে অমানবিক উল্লেখ করে এর যৌক্তিকীকরণের কথা বলেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, The recruitment under quota must not be higher than that of merit তিনি আরও বলেন, “It gives people an impression that less efficient people get appointments through the quota system and thus the quality of public administration drops.” মানবজমিন পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে পিএসসির চেয়ারম্যান এ টি আহমেদুল হক চৌধুরী বলেন, বর্তমানে প্রচলিত কোটা প্রয়োগপদ্ধতি সরলীকরণ করা প্রয়োজন। পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এস এম ফায়েজ বলেন, সরকারি চাকরিতে মেধাকে সবচে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কেননা, মেধাবীরাই একসময় দেশের নেতৃত্ব দেবে। মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে এলে গতিশীল নেতৃত্ব তৈরি হবে। যেভাবেই হোক না কেন, মেধার কোন বিকল্প নেই। মেধাকে যত প্রাধান্য দেয়া হবে তত বেশি আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এদেশে এক ধরনের গোষ্ঠী আছে যারা চায় যে সরকারি নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে কোটা থাকুক। আমি মনে করি না যে সব ধরনের কোটা এখন দরকার আছে। কিছু কোটা থাকবে কিন্তু সেসব কোটার সময় উল্লেখ করা যেতে পারে যে তা কত বছর বহাল থাকবে। ড আকবর আলি খানের রিপোর্টেও permanently or for an indefinite period কথাটি জোরালোভাবে এসেছে । ছাত্রসমাজের প্রত্যাশা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ কোটাপদ্ধতি সময়ের পরিবর্তনে সংস্কার বা পরিবর্তন না হওয়ায় সর্বপর্যায়ের ছাত্রসমাজের কাছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। আধুনিক বিশ্বে মেধাবীদের চেয়ে শুধুমাত্র অনগ্রসর বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে তুলনামূলক কম মেধাবীদের প্রাধান্য দিয়ে কোটাপদ্ধতি চলমান রাখা অনেকটাই দৈন্যতা। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর পরিকল্পিত পরিচালনা অত্যন্ত জরুরি। যুবসমাজের মেধাবীরা আজ হতাশায় নিমজ্জিত। তারা ভাবছে কোটাপদ্ধতি তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়নে একমাত্র বাধা। এ বাধা দূর করতে বর্তমান সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমান ছাত্রসমাজ কোটা বাতিলের দাবি করছে না তবে এর যৌক্তিক সংস্কার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরেই নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। কয়েক মাস যাবৎ বিরতিহীন আন্দোলন করছে, এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ সকলের ধারণা ছাড়িয়ে যায়। ছাত্রদের সাথে একমত হতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা নেমে আসে রাস্তায়। সরকারের নির্দেশে পুলিশ ও ছাত্রলীগ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় সাধারণ ছাত্রদের বিপক্ষে। পুলিশ প্রকাশ্যে ও কৌশলে ছাত্রলীগ হামলা চালিয়ে আহত করে শতাধিক ছাত্রছাত্রীকে। বিশেষ করে আলোচিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ সভাপতি ইফফাত জাহান এশা কর্তৃক মোর্শেদা বেগমের পায়ের রগ কাটার ঘটনা। এ ঘটনায় উত্তেজিত সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এশাকে জুতার মালা পরিয়ে ব্যতিক্রমী উপায়ে প্রতিবাদ করে যা পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচিত হয়। এশাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান থেকে ও ছাত্রলীগ দল থেকে বহিষ্কার করে। এ ঘটনায় উত্তেজিত সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা গভীর রাতে হল থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঘটনার তীব্রতা উপলব্ধি করে পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। এ ঘোষণায় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে আশার সঞ্চার হয়। আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। তবে থেমে থাকেনি সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। হয়রানি করতে থাকে কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা অনেককে। অজ্ঞাত নামা ব্যক্তিদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে কোটা আন্দোলনকারী অনেক শিক্ষার্থীকে। ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন অনেকেই। আন্দোলনে আহত সহপাঠীদের দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটে গেলে অপহরণের চেষ্টা করা হয় কোটা আন্দোলনের তিন নেতাকে। চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে। পরে যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। সরকারের কাছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যাশা হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কোটাপদ্ধতি বাতিল করে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে এ বিতর্কের অবসান করুন। সরকারি বিভিন্ন চাকরি বিশেষ করে বিসিএস পরীক্ষা প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পরীক্ষাপদ্ধতি। এই পরীক্ষায় মেধার অবমূল্যায়ন কখনোই কাম্য নয়। দেশের স্বার্থে, সর্বোচ্চ এ প্রক্রিয়াটির পদ্ধতিগত সমীকরণ তৈরির ক্ষেত্রে কোন ধরনের ভুল হওয়া উচিত নয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। সময় এসেছে পরিবর্তনের। দেশ-জাতি-আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা-রাষ্ট্রব্যবস্থা সব কিছুকেই পরিবর্তিত করবে এইসব মেধাবীরা। তাই ‘মেধাবী’ নির্বাচনে কোনো আপস করা কি উচিত? কোটা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে নতুন চিন্তা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত সময়ের দাবি। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক প্রেরণা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির