post

চরমপন্থা এবং ইসলাম

আলী আহমাদ মাবরুর

০৬ মার্চ ২০২০

যুক্তিবিদগণের মতে কেউ যদি কোনো বিষয় সম্বন্ধে ভালোভাবে না জানেন, তাহলে সেই বিষয়ে তার মত না দেয়াটাই উত্তম। কেননা, অজানা কোনো বিষয় সম্বন্ধে ঢালাওভাবে মন্তব্য করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি আন্দাজে ও অনুমাননির্ভর মন্তব্য কখনোই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। এই কারণে, চরমপন্থা বিশেষ করে ধর্মীয় চরমপন্থাকে ভালো বা মন্দ বলার আগে আমাদেরকে আগে এই বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। আমরা আক্ষরিক অর্থে ধর্মীয় চরমপন্থাকে পর্যালোচনা করে কিংবা এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোকে মূল্যায়ন করার মাধ্যমে এই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। আক্ষরিক অর্থে, চরমপন্থা মানে হলো কোনো একটি বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরে গিয়ে একেবারে প্রান্তসীমায় অবস্থান করা। বাস্তবে চিন্তা করলে, ধর্ম, চিন্তাভাবনা বা আচরণের ক্ষেত্রে চরমপন্থা শব্দটি ব্যবহারও ভীষণরকম নেতিবাচক। চরমপন্থার কারণে বিপদের আশঙ্কা বেড়ে যায় এবং নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়। এই প্রেক্ষিতে, ইসলাম বরাবরই মধ্যমপন্থা এবং ভারসাম্য করার সুপারিশ করে। ইসলাম আমাদেরকে সকল কর্মকাণ্ডে বিশেষত ইবাততে, ব্যবহারে, আচার-আচরণে কিংবা আইন প্রণয়নে মধ্যমপন্থা অবলম্বনের তাগিদ দেয়। আর আল্লাহ এই মধ্যমপন্থাকেই সিরাতুল মুস্তাকিম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। আমরা সূরা ফাতিহাতে এই সিরাতুল মুস্তাকিম পাওয়ার জন্যই আল্লাহর কাছে আকুতি জানাই। কেননা, এই পথটিই নেয়ামতপ্রাপ্তদের পথ। বাকি যত পথ তার সবই আমাদেরকে বিপথগামী করবে। অভিশপ্ত রাস্তায় টেনে নিয়ে যাবে। মধ্যমপন্থা বা ভারসাম্য ইসলামের নিছক কোনো বৈশিষ্ট্য নয় বরং এটা ইসলামের মৌলিক অবস্থান। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, “এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্য এবং যাতে রসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।” (সূরা আল বাকারা : ১৪৩) মুসলিম উম্মাহর বৈশিষ্ট্যই হলো তারা আচরণগতভাবে ন্যায়নিষ্ঠ ও মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী হবে। এ সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে কেউ যদি চুল পরিমাণও সরে যায় তাহলেও তা এক ধরনের বিচ্যুতি। কুরআন ও সুন্নাহ বারবার আমাদেরকে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করার এবং সব ধরনের প্রান্তিক ও চরমপন্থা মানসিকতা পরিহার করার তাগিদ দেয়। সীমালঙ্ঘন, ধর্মান্ধতা, কৃপণতা এবং কঠোরতার স্থান ইসলামে নেই। রাসূল (সা.) বলেন, “তোমরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি এই বাড়াবাড়ির কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।” (আহমাদ)। এ হাদিসটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর আগে বিভিন্ন আহলে কিতাব সম্প্রদায় বিশেষত ইহুদি ও খ্রিষ্টানেরা এ ধরনের জুলুম করেছে। আর এর পরিণতিতে তাদেরকে শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “বলুন! হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা নিজ ধর্ম নিয়ে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না এবং এতে ঐ সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।” (সূরা আল মায়িদাহ : ৭৭) এ কারণে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি নিজের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সেই চূড়ান্তভাবে স্বস্তিকর জীবন উপভোগ করতে পারে। উপরোক্ত হাদিস আমাদেরকে এ মর্মে শিক্ষা দিচ্ছে যে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও সীমা লঙ্ঘন আমাদেরকে এমন সব কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে পারে যার ফলে পরিবেশ আরো বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। বিদায় হজের সময় রাসূল (সা.) মুজদালিফায় পৌঁছানোর পর ইবনে আব্বাসকে (রা) কিছু পাথর সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে বলেন। ইবনে আব্বাস (রা) কয়েকটি ছোট পাথর নিয়ে আসেন। তখন নবীজি (সা.) বলেন, “এই সাইজটি ঠিক আছে। এগুলো নিয়ে শয়তানকে প্রতীকী অর্থে আঘাত করা হবে। তাই এর চেয়ে বড়ো পাথরের প্রয়োজন নেই। ধর্মীয় কোনো আচারাদিতে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করাই উত্তম।” (আহমাদ) এই হাদিসটিতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানরা যেন এমনটা মনে না করে যে, বেশি বড়ো পাথর দিয়ে শয়তানের প্রতীকী অবস্থানে আঘাত করলে সওয়াব বেশি হবে। এরকম চিন্তাধারা একবার তৈরি হয়ে গেলে তা জীবনের অন্যান্য কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করতে পারে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, “বাড়াবাড়ি বা সীমালঙ্ঘন বিষয়ক এ নিষেধাজ্ঞা সব ধরনের বিশ্বাস, ঈমানের সব স্তর, ইবাদত এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।” আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, “হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলো না।” (সূরা আন নিসা : ১৭১) নিজের কোনো কাজ করার সময় বা কথা বলার সময় কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন কাম্য নয়। এর ফলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই বরবাদ হতে পারে। রাসূল (সা.) আরো বলেন, “তোমরা নিজেদের ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে নিও না।” এক ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্ত রোজা রাখতেন। আর এক ব্যক্তি জাগতিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে মসজিদে বসে ইবাদত করতেন, দুটোর কোনোটাই রাসূল (সা.) পছন্দ করেননি। তিনি সবসময় ভারসাম্য করে চলার পক্ষে ছিলেন। ইসলাম বেশ কিছু ইবাদতের পন্থা বলে দিয়েছে যার মাধ্যমে একজন মানুষ আধ্যাত্মিক ও বাস্তবিকভাবে, ব্যক্তিগতভাবে এবং সামষ্টিকভাবে নিজেদের উন্নত করতে পারে। ইসলাম এমনভাবে মানুষকে তার যাপিত জীবন পালন করার সুপারিশ করে যার মাধ্যমে সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সংহতি প্রতিষ্ঠা হয়। একইসঙ্গে সভ্যতা ও সমাজ বিনির্মাণে মুসলমানদের যে দায়িত্বও রয়েছে তাও সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব হয়। মনে রাখতে হবে, সভ্যতা বিনির্মাণে এবং জ্ঞানের প্রভূত উন্নয়নে মুসলমানদের সম্পৃক্ত হওয়াটিকে অনেকটা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। ইসলাম এমনভাবে ইবাদত পালন করার কথা বলে না যা করতে গিয়ে মানুষ তার পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উলটো মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনগুলো যেন মজবুত হয়, এটাই ইসলাম প্রত্যাশা করে। পৃথিবীতে যা কিছুকে আল্লাহ হারাম করেছেন তা উপভোগ করার বিষয়ে আল্লাহ কোনো ধরনের বিধি নিষেধ আরোপ করেননি। বরং এগুলোকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ও সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্যই ইসলাম সুপারিশ করে। ইসলাম দুনিয়াবি জীবনকে ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করার একটি মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করে। ইসলাম চায় এ পৃথিবীতে মানুষের যাবতীয় ইবাদত ও সব ধরনের প্রচেষ্টা হবে কেবলমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। সেই কারণে পৃথিবীকে বিসর্জন করে আধ্যাত্মিকতার সাধনা কিংবা শরীরকে কষ্ট দিয়ে আত্মার শুদ্ধতা অর্জনের মত বিষয়গুলো ততটা সমর্থনযোগ্য নয়। আল্লাহ তাই আমাদেরকে এভাবেই দোয়া করতে শিখিয়েছেন যে, হে আল্লাহ আপনি দুনিয়া ও আখেরাত- উভয় স্থানেই আমাদের জন্য কল্যাণ নির্ধারণ করে দিন। (সূরা আল বাকারা : ২০১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্দর এই দোয়াটা মুখস্থ করে আপনারা সহজেই নামাযে বা নামাযের বাইরে দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় জাহানের কল্যাণের জন্য দোয়া করতে পারবেন- ‘আল্লাহুম্মা আসলিহ-লি দ্বীনি-ল্লাজি হুয়া ইসমাতু আমরি, ওয়া আসলিহ-লি দুনিয়াবি-ল্লাতি ফি-হা মায়াশি, ওয়া আসলিহ-লি আখিরতি-ল্লাতি ফি-হা মায়াদি ওয়া-জাআলিল হায়াতি ঝিয়াদাতি-লি ফি কুল্লি খইরু ওয়া-জাআলিল মাউতি রাহাতি-লি মিন কুল্লি শাররি।’ অর্থ : “হে আল্লাহ্! তুমি আমার দ্বীনকে আমার জন্য সঠিক করে দাও, যা আমার সকল বিষয়ের প্রতিরক্ষা। তুমি আমার দুনিয়াকে আমার জন্য সংশোধন করে দাও, যার মধ্যে রয়েছে আমার জীবন-জীবিকা। তুমি আমার আখেরাতকে আমার জন্য সুন্দর করে দাও, যেখানে আমাকে ফিরে যেতে হবে। তুমি আমার প্রত্যেক পুণ্য কাজে আমার জীবনকে বৃদ্ধি করে দাও এবং প্রত্যেক মন্দ কাজ হতে মৃত্যুকে আমার জন্য শান্তির কারণে পরিণত কর।” (রিয়াদুস সালেহীন : ১৪৭২, সহীহ মুসলিম : ২৭২০) সূরা আল আরাফের ৩১-৩৩ নং আয়াত যদি আমরা পড়ি তাহলেই আমরা বুঝবো আল্লাহ কিসের ভিত্তিতে কিছু জিনিস হালাল করেছেন আবার কিছু বিষয়কে হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “হে বনি-আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও, খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না। আপনি বলুন! আল্লাহর সাজ-সজ্জাকে, যা তিনি বান্দাদের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং পবিত্র খাদ্যবস্তুসমূহকে কে হারাম করেছে? আপনি বলুন! এসব নেয়ামত আসলে পার্থিব জীবনে মুমিনদের জন্যে এবং কিয়ামতের দিন খাঁটিভাবে তাদেরই জন্যে। এমনিভাবে আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি তাদের জন্যে যারা বুঝে। আপনি বলে দিন! আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং হারাম করেছেন গোনাহ, অন্যায়-অত্যাচার আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোন, সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জান না।” (সূরা আল আরাফ) আল্লাহ আরো বলেন, “হে ঈমানদাররা, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা হালাল করেছেন তোমরা তাকে হারাম করো না। সীমা লঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা থেকেই তোমরা খাও। আর সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করো।” (সূরা মায়েদাহ : ৮৭-৮৮) এ আয়াতের প্রেক্ষাপট ও শানে নুযুল থেকে জানা যায়, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি যখনই গোশত খাই, তখনই আমার মধ্যে কামোত্তেজনা অনুভব করি। তাই নিজের জন্য গোশতকে হারাম করে নিয়েছি।’ যার ফলে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। (সহীহ তিরমিযী, আলবানি ৩/৪৬) অনুরূপভাবে অবতীর্ণের এই কারণ ব্যতীত বিভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কিছু সংখ্যক সাহাবা সংসার ত্যাগ এবং ইবাদতের উদ্দেশ্যে কিছু বৈধ জিনিস হতে (যেমন বিবাহ করা হতে, ঘুমিয়ে রাত্রিযাপন করা হতে, দিনে পানাহার করা হতে) নিজেদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। যখন নবী করীম (সা.) এ ব্যাপারে অবগত হলেন, তখন তাদেরকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করলেন। এমনকি উসমান বিন মাযউন (রা) তিনিও নিজের স্ত্রী থেকে দূরে থাকতেন। অতঃপর তার স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে তাকেও তিনি তা করতে নিষেধ করলেন। সুতরাং এই আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ কর্তৃক হালাল যে কোন বস্তুকে নিজের ওপর হারাম করে নেয়া অথবা তা এমনিই বর্জন করা বৈধ নয়। ইসলাম কোনোভাবেই নিজেকে হালাল জিনিস থেকে বঞ্চিত করা অনুমোদন করে না। পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ইসলাম সবসময়ই ভারসাম্য করার পক্ষে। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অনুবাদক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির