post

চেতনায় অম্লান শহীদ হাসান হাসিবুর রহমান মহসিন

০৮ মে ২০১১
মাহমুদুর রহমান দিলওয়ার ‘আম্মি, আপনি চিন্তা করেন কেন? আপনার কিসের অভাব? আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার চারটা সন্তানই চরিত্রবান। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, আল্লাহকে ভয় করে চলে। আপনার কথা শুনে মনে হয় আজ যদি আমরা এই পথে (ইসলামী আন্দোলন) না থাকতাম কী যে হতাম জানি না।’ কত ছেলে-মেয়ে কত রকম আপনি তো জানেন না। সে সমাজের সব মানুষকে ভালবাসত। ওর বন্ধুরা  বলেছে, বন্ধের পর হোস্টেলে গেলে সে সুইপার, দারোয়ান, ডাইনিং বয় সবার সাথে কোলাকুলি করত। তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করত। সে তার সাপ্তাহিক পরীক্ষা রেখে অসুস্থ ছাত্রদেরকে সিলেট থেকে এখানে নিয়ে আসত। তারপর পিজি হাসপাতাল,  ঢাকা মেডিক্যাল, মিটফোর্ড হাসপাতালে নিজে সাথে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করত। সদালাপী উৎফুল্ল, হাসিখুশি ছেলেটাকে কী যাতনা বিষে, কোন জালিম, কোন হাতে গুলি করল? আমি শহীদ মহসিনের মা, শিবিরের কর্মী হিসেবে আমার ছেলে ইসলামবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে বাধা দিতে গিয়ে হায়েনাদের হাতে শহীদ হয়েছে, আর এভাবে শহীদ হয়ে আমাদেরকে শিখিয়ে গেছে, ইসলামী ছাত্রশিবির হলো  অন্যায়, অত্যাচার, মিথ্যা, অপসংস্কৃতি, বেহায়াপনা, ব্যভিচার সবকিছুর বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড দ্রোহ। আমার মনে হয় আমার ছেলের মত পূত-পবিত্র সুন্দর মনের অধিকারী প্রত্যেকটা শিবির কর্মী। এ সরকারের বিবেকের কাছে আমার বিচার রইল, জিজ্ঞাসা রইল, কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? ছোটবেলা থেকে যে ছেলে খোদাকে এত ভয় পেত, খোদার হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করত এমন একজন মেধাবী ছাত্রকে অকালে বিদায় করে দেয়ার তাৎপর্য কী? স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেধাবী ছাত্র ও শিবির কর্মী শহীদ আবু নাসের হাসান হাসিবুর রহমান মহসিনের গর্বিত জননী মরহুমা মিসেস খাদিজা রহমান। আল্লাহতায়ালার অমিয় বাণী : ‘প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু একদিন সবাইকে মরতে হবে-সে বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোন মতপার্থক্য নেই। ‘মৃত্যু’ পৃথিবীর মায়ামোহ ধন-দৌলত থেকে সবাইকে বিচ্ছিন্ন করে। ভাই-বোন, পিতা-মাতা কিংবা বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কের মাঝে ফারাক তৈরি করে। প্রেম-ভালোবাসার বন্ধনকে ছিন্ন করে। এমনকি এক পর্যায়ে মৃত ব্যক্তিকে তাদের স্বজন কিংবা পরিচিত জনের হৃদয় থেকে ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু মৃতকে বাঁচিয়ে রাখে একটি মৃত্যু। সেই মৃত্যু সৌভাগ্যের, সেই মৃত্যু শাহাদাতের। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না। এসব লোক প্রকৃতপক্ষে জীবিত, কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না।’ হযরত আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, ‘দু’টি ফোঁটা আল্লাহ তায়ালার কাছে সবকিছুর চেয়ে প্রিয়। এক. আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ক্রন্দনশীল বান্দার  এক ফোঁটা চোখের পানি, দুই. শহীদের রক্তের প্রথম ফোঁটা খুন।’  (তিরমিজি) কবির ভাষায় : ‘জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনি জানি/শহীদি রক্তে হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানি।’ ১৯৭৩ সালের ৬ জুলাই চাঁদপুর জেলার মতলব থানার অন্তর্গত নলুয়া গ্রামের বিশিষ্ট প্রকৌশলী জনাব খলিলুর রহমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন মহসিন। ছোটবেলা থেকেই আব্বা-আম্মা ও ভাইবোনের সাথে ঢাকার গ্রীন রোডের ক্রিসেন্ট রোডস্থ বাসায় বড় হতে থাকেন। ৩ ভাই, ১ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। শহীদ মহসিনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় তেজগাঁও সরকারি পলিটেকনিক উচ্চবিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণীতে। এ স্কুল থেকেই  কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়ে চিকিৎসক হওয়ার বুকভরা আশা নিয়ে চলে আসেন শাহজালাল (রহ) এর পুণ্যভূমি সিলেটে। শাহাদাতকালে তিনি এমবিবিএস 1st Part পরীক্ষার্থী ছিলেন। লিখিত পরীক্ষা শেষ হলেও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ আর মহসিনকে দেয়নি সত্য ও সুন্দরের চির শত্রুরা। ব্রাশ ফায়ারে নিথর হয়ে গেল একটি সম্ভাবনাময় আদর্শ জীবনের অগ্রযাত্রা। শহীদ মহসিন একটি প্রেরণাময় জীবনের নাম। যার অসাধারণ মেধা, অতুলনীয় চরিত্র, অনুপম কথামালা, অমায়িক ব্যবহার, পরোপকারী মনোভাব আর আল্লাহভীরু মানসিকতা ভোলার নয়। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা আন্দোলনের সহযাত্রীরা সবাই ছিলেন বিমোহিত। সদালাপী আর বিনম্র শহীদ মহসিনের স্মৃতিগুলো তাই আজও অম্লান। তাইতো ঈমানী নূরের আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হৃদয়ের সৌন্দর্যমণ্ডিত আদর্শ যেন চিরভাস্বর। ‘সত্য মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের/খোদার রাহে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের।’ কী অপরাধ ছিলো শহীদ মহসিন ভাইয়ের? কেন সন্তানের কফিন পিতার কাঁধে বহন করতে হলো? কেন মা আর বোনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছিল? কেন স্বজন আর দ্বীনি ভাইদের বুকফাটা আর্তনাদ শুনতে হলো? অপরাধ একটাই! ‘তাদের (ঈমানদারদের) থেকে তারা কেবল একটি কারণেই প্রতিশোধ নিয়েছে। আর তা হচ্ছে তারা সেই মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল, যিনি প্রশংসিত, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সাম্রাজ্যের অধিকারী।’ (সূরা আল-বুরুজ : ৮-৯)। কবির ভাষায় : ‘ঈমানের দাবি সেতো বসে থাকা নয়/ ঈমানের দাবি হলো কিছু বিনিময়।’ ঈমানের দাবি পূরণার্থেই শহীদ মহসিন অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছিলেন। ডিশলাইন সংযোগের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। সত্য ও সুন্দরের অনুসারী শহীদ মহসিন ও তার সঙ্গীদের ওপর তাইতো নরপিশাচেরা হামলা করে। ১৯৯৮ সালের ২৩ মে গভীর রজনীতে যখন শহীদি কাফেলার অগ্রসেনানী শহীদ মহসিন ও তার সঙ্গীরা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করছিলেন, তখনই হায়েনারা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রাশ ফায়ারে বুক ঝাঁজরা হয়ে যায় শহীদ মহসিনের। দুনিয়ার মায়া ছিন্ন করে মহান রবের সান্নিধ্যে চলে যান আদর্শের নির্ভীক সেই অভিযাত্রী। আহত হন তার একান্ত সাথী ডা. নজরুলসহ আরো অনেকে। শহীদের গর্বিত পিতা প্রকৌশলী মরহুম খলিলুর রহমান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন- ‘২৪ মে ভোরবেলায় ফজরের নামাজান্তে অন্যান্য দিনের মত রুটিন মোতাবেক প্রাতঃভ্রমণে বের হলাম কিন্তু ভ্রমণ শেষে বাসায় এসে দেখি, জামায়াতের কর্মীসহ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। ওনারা বললেন, আমরা সিলেট থেকে এসেছি।  আমি সঙ্গে সঙ্গেই স্নেহের মহসিনের কুশল জানতে চাইলে তথায় সবাই ছিল নিরুত্তর। বাসায় এ সময়ের মধ্যে কোন নাশতা তৈরি হয়নি বলে স্থানীয় কাঁঠালবাগান বাজারে গিয়ে ওনাদের সকলের নাশতার জন্য বড় বড় ২৪টি কলা, ২৫টি ডিম ও কয়েকটি পাউরুটি ক্রয় করে এনে সবাইকে খেতে দিলাম এবং স্নেহের মহসিন সম্বন্ধে নানাবিধ প্রশ্ন করা শুরু করে দিলাম কিন্তু সবাই নিরুত্তর, কারও মুখে কোন কথা নেই-কেউ নাশতা স্পর্শও করছেন না। আমি তখন আমার রুম হতে উঠে বৈঠকখানায় বিচরণ করতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর বড় ছেলে ডা. হাসান আমাকে জানালেন আব্বু আমাকে এখনই সিলেট রওয়ানা দিতে হবে-সিলেট মেডিক্যাল কলেজে নাকি মারামারি হয়েছে, কিন্তু তবুও বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও কেউ আমাকে কোন কিছু বলেনি। এমনিভাবে চলে গেল সমস্ত দিন। আমাকে তখন পর্যন্ত কোন কিছু জানতে দেয়নি। ডা. হাসান সিলেটে গিয়ে সমস্ত কিছু দেখে জেনে বাসায় ফোন করলো। কিন্তু সেই ফোন সম্বন্ধেও আমাকে জানানো হয়নি।  ইতোমধ্যে সিলেটে ডা. হাসান পৌঁছে শহীদের লাশ গ্রহণ করে। গত ২৪ মে ১৯৯৮ রোববার রাত ১১ ঘটিকার সময় যখন শহীদের লাশবাহী গাড়িসহ অন্যান্য যানবাহনগুলো ঢাকার ১৬২ নং ক্রিসেন্ট রোডস্থ শহীদের নিজ ক্ষণস্থায়ী বাসভূমিতে এসে হাজির হয় তখন এক কল্পনাতীত হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। শহীদের আত্মীয়-স্বজনসহ সমস্ত এলাকাবাসী কান্নায় শোকে মুহ্যমান, কারও মুখে কোন শব্দ নেই। সে সময় উপস্থিত সবাই শহীদের কফিনের দিকে তাকিয়ে হায়! মহসিন, হায়! মহসিন বলছিল। সকলের আহাজারিতে এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী করে তুলেছিল। অন্যদিকে শহীদের কফিনটি পৌঁছার কথা শোনামাত্রই সন্তান হারা হতভাগ্য পিতামাতা আমরা দু’জনেই তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আমরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ছিলাম সংজ্ঞাহীন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরত ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী শহীদের একমাত্র বোনও এ সংবাদের সময় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। শহীদের বড় দুই ভাই ডা. হাসান ও ডা. হোসেন বহু চেষ্টা করে বিভিন্ন ইনজেকশন দিয়ে পিতামাতা ও বোনের জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিল। সে সময় দু’ভাই অসীম সাহস ও দুঃসাহসিক কাজও ধৈর্যের জন্য উপস্থিত সবাই সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিল যে, ‘ডাক্তারী জীবন আজ তাদের সার্থক, তারা উভয়েই ধৈর্য না হারিয়ে অসীম সাহসিকতায় নিজ সংজ্ঞাহীন পিতা ও বোনের জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।’ শহীদের লাশ পৌঁছা মাত্রই শহীদের কফিনের চতুর্দিকে আগরবাতি জ্বালিয়ে সকলেই ভোর পর্যন্ত পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। ফজরের নামাজান্তে গ্রীনরোড স্টাফ  কোয়ার্টার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মুসল্লির উপস্থিতিতে শহীদের দ্বিতীয় বৃহত্তর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মসজিদের স্বনামধন্য ইমাম জনাব মাওলানা মো: আয়ূব।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, শহীদের বাবা হিসেবে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আল্লাহ যদি আমার প্রাণাধিক প্রিয় কনিষ্ঠপুত্রকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন, তবে কিয়ামতের দিন শহীদের পিতা হিসেবে আমি সম্মানিত হবো। দুনিয়ায় তার সাথে আর দেখা হবে না। তবে আমি দৃঢ় আশাবাদী জান্নাতের সিঁড়িতে পিতা-পুত্র  আবার মিলিত হবো। সেই মিলনই হবে প্রকৃত সার্থকতা। তাই মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে আমাদের একমাত্র প্রার্থনা, আমার ছেলেকে তুমি শহীদ হিসেবে কবুল করে নাও, শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করে আমাদের জান্নাতের মেহমান বানিয়ে দাও।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শহীদের জননী বলেছিলেন, ‘আমার মহসিন অত্যন্ত সৌখিন ও সৌন্দর্যপ্রিয় ছিল। শৈশবে পুকুর, লেক থেকে ছোট-ছোট রঙবেরঙের মাছ ধরে কাচের বোতলে রেখে সকলকে দেখাতো, কোন কোন সময় বাজার থেকে জীবিত চিংড়ি মাছ কিনে বোতলে রাখতো। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর রেটিনা ও শুভেচ্ছা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে যে টাকা পেয়েছে তা দিয়ে আমাদের বাসায় একটা অ্যাকুরিয়াম কিনেছে। সুন্দর সুন্দর রঙ, বেরঙের মাছ ও কৃত্রিম শ্যাওলা দিয়ে অ্যাকুরিয়ামকে সাজিয়েছে। জাফলং থেকে আনা পাথরে কালেমা তাইয়্যেবা লিখে অ্যাকুরিয়ামে রেখে আমাকে বলল, ‘আম্মি, মানুষ এটার সৌন্দর্য দেখতে এসে একবার অন্তত কালেমা পড়বে।’ শহীদের একমাত্র বোন ডা. হাসিনা মাহমুদ ফেরদৌসী (মমতা) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘যখন সে আমাদের সব ভাইবোনদেরকে কুরআন আর হাদিসের কথা শোনাতো তখন বুঝতাম সে বড় হয়েছে। কারো প্রতি দায়িত্ব পালনে ছিলো সে অনড়। তার এই দায়িত্ব পালন থেকে বাদ পড়ত না কোন আত্মীয়-স্বজন। যখন সে সিলেট থেকে বাসায় আসতো। আমিও চট্টগ্রাম থেকে বাসায় আসতাম, তখন শুরু হতো আমাদের মিশন। যে ক’দিন ঢাকায় থাকতাম এমন কোন আত্মীয়-স্বজন বাদ পড়ত না, যাদের সাথে আমরা দেখা করতাম না। মহসিন প্রচণ্ড একটা শক্তি ছিলো আমার।’ শহীদ মহসিনের অতিপ্রিয় জীবন্ত শহীদ ডা. নজরুল তার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেন, ‘যে মহসিন প্রতিটি মিছিলে হাত ধরে থাকত, সে মহসিন আমাকে ছেড়ে একাই শহীদদের মিছিলে শরিক হলো? তাহলে-আর কোন দিন মহসিনের সাথে দেখা হবে না। আর কোন দিন ফজরের নামাজের সময় মহসিনের ‘সালাত! সালাত’ ডাক শোনা যাবে না।’ মহসিনের শাহাদাতের সংবাদ শোনার পর কয়েকদিন শুধুই  কেঁদেছি। এক সময় বুঝতে পারলাম মহসিন আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে যে আবদারটি এতদিন করেছিল, আল্লাহ তা কবুল করেছেন, চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো-বিগত স্মৃতিমুখর দিনগুলোর ছবি। যে রাতে মহসিন শহীদ হলো সেদিন বিকেলেও দু’জন এক বিছানায় শুয়ে গল্প করছিলাম। মহসিন বলছিলো-‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ও আলাউদ্দিন ভাই মিছিলে এক সাথে থাকতাম। যেদিন তারা ওকে শহীদ করল, আমি সেখানে থাকলে হয়তো শহীদ হতাম। কিন্তু আল্লাহতো আমার কপালে সেটা রাখেনি।’ তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম মহসিন শুধু আমাকে শোনানোর জন্য এ কথা বলেনি। এরপর বললো সেই কথা যা সব সময় সে বলতো ‘নজরুল ভাই! দোয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে শাহাদাতের মৃত্যু দান করেন।’ আল্লাহতো মহসিনের সেই গান শুনেছেন, যা হোস্টেলের বারান্দা দিয়ে হাঁটার সময় প্রায় গাইতো। ‘আমাকে শহীদ করে সেই মিছিলে সামিল করে নিও/যেই মিছিলের নেতা আমীর হামযা, খুবায়েব, খাব্বাব/খোদার ছিল যারা অতিপ্রিয়।’ এভাবে শহীদ মহসিনকে নিয়ে অনেকের অনেক স্মৃতি আছে, যা লিখে শেষ করা যাবে না। যে স্মৃতিগুলো এই পথের যাত্রীদের উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে। ২০০৯ সালের ২৩ মে। শহীদ মহসিনের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে ডা. খালেদ ভাই, আলামীন ভাই, ফখর ভাই ও আমি তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন তৎকালীন চাঁদপুর জেলা সভাপতি কাওছার আলম ভাই এবং সেক্রেটারি নিয়ামত উল্লাহ ভাইসহ অন্যান্য দায়িত্বশীল ভাইয়েরা। কাওছার ভাই আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক সময় দিয়ে উপকৃত করেছেন। শহীদের বাড়িতে সেই আবেগঘন সফরের  স্মৃতি আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে। গ্রামের বাড়িতেই শহীদ জননীর সাথে আমাদের প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎ। কেননা তিনি গত বছর ইন্তেকাল করেছেন। শহীদ জননীরা সন্তান হারিয়ে কিভাবে জীবন-যাপন করছেন, তা উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমাদের। শহীদ জননীদের হৃদয়ের আবেগ, অনুভূতি আর কষ্ট অনুভব করার সুযোগ আন্দোলনের পথচলায় বিরাট সহায়ক। আমরা কবর জিয়ারত শেষ করে বাড়িতে প্রবেশ করি। শহীদ জননী, শহীদের বড় ভাইয়ের সাথে আমাদের কথাবার্তা হয়। মনে পড়ছেÑশহীদ জননীর সাথে অনেক কথা বলেছি। সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা আমাদের কাছে ছিলো না। তবে তিনি স্বাভাবিকই ছিলেন। আমাদের সাথে অনেকক্ষণ কথা বললেন। সবার খোঁজখবরও নিলেন। বিশেষ করে ডা. নজরুল ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন। সে  কোথায় আছে? কী করছে? অনেক দিন থেকে তাকে  দেখিনি! এরকম নানা কথাবার্তা হলো। শেষ পর্যায়ে যখন তাকে সিলেটে বেড়ানোর দাওয়াত দিলাম, মেডিক্যালে আসার দাওয়াত দিলাম। ঠিক তখনই তার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। তিনি আর কথা বলতে পারলেন না। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। নিশ্চয়ই তখন তার কলিজার টুকরো প্রিয় মহসিনের কথা মনে পড়েছিল। প্রিয় সন্তানকে ভীষণভাবে তিনি অনুভব করছিলেন। গত বছর প্রিয় মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে খুবই কষ্ট লেগেছে। মেডিক্যাল কলেজ শাখার উদ্যোগে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে অংশগ্রহণ করেছি। গত বছরও শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে চাঁদপুরে শহীদের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু রাব্বুল আলামীন কবুল করেননি। কেননা শাহাদাতবার্ষিকীর একদিন পর তথা ২৪ মে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম। যার কারণে শহীদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে মুনাজাত করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। শহীদেরা সত্যের পথে অকুতোভয় অগ্রসেনানী। ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের পথে তারা অনুপ্রেরণার উৎস। তাইতো মুমিনদের কাক্সিক্ষত মৃত্যু; শাহাদাতের মৃত্যু। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় : ‘উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই/ নিত্য মৃত্যু ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই।’ আসুন, শহীদের উত্তরসূরি হিসেবে আল্লাহর এই জমিনে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠা তথা এ দেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও সোনার দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করি। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সেই লক্ষ্যে যথাযথ ভূমিকা পালনের তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক : সেক্রেটারি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, সিলেট মহানগরী।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির