post

বাংলাদেশের অবস্থান ভূরাজনীতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

১৯ আগস্ট ২০১৪

 কাজী মো: বরকত আলী

Bangladeshবাংলাদেশ তার সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই প্রতিনিয়ত কোন না কোন সমস্যা মোকাবেলা করেই চলেছে। কখনও ফারাক্কা সমস্যা, কখন সীমান্ত সমস্যা কখনও টিপাইমুখ সমস্যা আবার কখনও বা চলছে পার্বত্য এলাকার অশান্ত পরিবেশ এমনিভাবে অসংখ্য সমস্যা। দেশটি দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধ আর লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে কিন্তু স্বাধীনতা ছিল এক খণ্ডিত ভূখণ্ড নিয়ে। বঙ্গভঙ্গের যে বাংলা তার ৬৪ শতাংশ নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ অর্থাৎ বাংলার ৩৬ শতাংশ বঞ্চিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম। সুতরাং বাংলাদেশ সূচনালগ্ন থেকেই বঞ্চনার শিকার আর এখন দেশটির বিরুদ্ধে চলছে দেশীয় ও আন্তজার্তিক চক্রান্তের নগ্ন থাবা। ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো কিছু স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এ দেশকে গ্রাস করার জন্য মেতে উঠেছে উন্মাদ হলি খেলায়। তারা পদে পদে এদেশে অশান্তি সৃষ্টি করে ভূলুণ্ঠিত করতে চাচ্ছে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে। তারা আষ্টেপৃষ্ঠে খামছে ধরেছে এ দেশের লাল সবুজ পতাকাকে। ভৌগোলিকভাবে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত একটি জনবহুল দেশ। দেশটি ২০০ ৩র্৪ উত্তরাংশ থেকে ২৬০৩র্৮ উত্তরাংশ এবং ৮৮০ ০র্১ থেকে ৯২০৪র্১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত যা দেশটির পরম (Absolute) অবস্থান নির্দেশ করে। অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশের রয়েছে বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ। বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট ASEAN, SAARC এর মতো উদীয়মান আঞ্চলিক জোট, বর্তমান বিশ্বে আলোচিত দেশ ও Rising Country  চীনের মতো দেশ এবং দক্ষিণে বিশাল জলরাশি Bay of Bengal-এর মতো অবস্থানিক প্রপঞ্চকের মধ্যে অবস্থিত যা তাকে বিদেশনীতি গ্রহণ থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ দিয়েছে (চিত্র-১)। এই সকল অবস্থানিক প্রভাববলয়ের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, সৎ, যোগ্য দক্ষ জ্ঞানী ও জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার যার কোনো বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না। অন্য দিকে একটি রাষ্ট্রের পরম অবস্থান (অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাগত), সমুদ্রউপকূলবর্তী অবস্থান (Sea-Side Location) সামরিক কৌশলগত অবস্থান (Stratagic Location), সন্নিহিত অবস্থান (Relative Location) সুসংহত হলে সেই রাষ্ট্রের প্রভাববলয় বেড়ে যায় যা বাংলাদেশের অনুকূলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান ও ভূরাজনীতি সম্পদ সম্ভাবনা আর সমূহ সমস্যায় সমাকীর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের এক-দশমাংশ সার্বভৌম ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে বিস্তৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে হালকা জনসংখ্যা অধ্যুষিত অথচ বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। দেশটির তিনটি পার্বত্য প্রশাসনিক জেলার সমন্বয়ে গঠিত এ অঞ্চলটির অধিকাংশ ভূমিই পাহাড় ও বনভূমির অন্তর্ভুক্ত। উঁচু নিচু পাহাড় পর্বত, পার্বত্য নদ-নদী, উর্বর উপত্যকা, দুর্গম ঘন চিরহরিৎ বনভূমি বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী অঞ্চলটিকে দান করেছে এক অনন্য নিসর্গ ও বৈচিত্র্যময়তা। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে প্রায় ২১০ ২র্৫ থেকে ২৩০ ৪র্০ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১০ ৫র্৫ থেকে ৯২০৪র্১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ভৌগোলিক অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের পর্বতশঙ্কুল জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বা Chittagong Hill Tracts এর অবস্থান (চিত্র-২)। দেশের প্রশাসনিক তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের মোট ১৩১৪৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তর্ভুক্ত (B.B.S.1991)। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত বিভিন্ন জাতিসত্তার অসমসত্ব উপস্থিতি আর বর্তমান বিশ্বের দুই উদীয়মান পরা শক্তি চীন ও ভারতের বিশেষ কাছাকাছি অবস্থান এবং এখান থেকে অনায়াসে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের উন্মুক্ত নীল জলভাগে প্রবেশের সুবিধার সম্ভাব্যতা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে করে তুলেছে বিশেষ গুরুত্ববহ। অন্য দিকে এলাকাটির বিপুল ভূমিসম্পদ, প্রায় অব্যবহৃত পানিসম্পদ জনভারাক্রান্ত আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পশ্চাদপদ ক্ষুদ্রায়তন বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক অপরিহার্য মহামূল্যবান অঙ্গে পরিণত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশী জাতির জন্য ভবিষ্যৎ সম্পদ সম্ভাবনার এক অপরিমেয় এবং অফুরন্ত ভাণ্ডার, সম্ভাবনার প্রতিশ্রুত প্রান্তর বা Land of Promise  যেন নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় গড়ে তুলেছে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তনের বিশালতায় বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-দশমাংশ হলেও জনসংখ্যার হিসেবে ঐ অঞ্চলে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ লোক বসবাস করে। এ জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ মঙ্গোলীয় জাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত (যা প্রধানত মিয়ানমারের আরাকান থেকে আগত) এবং বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ বাংলা ভাষাভাষী নতুন বসতি স্থাপনকারী সমতল ভূমির লোক। পাহাড়ি জাতিভুক্ত মোট জসনসংখ্যার আবার ধর্ম ভাষা ও জাতিতাত্ত্বিক দিক দিয়ে প্রায় ডজনখানেক উপজাতিতে বিভক্ত, যাদের পরস্পরের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং আচরণিক দিক দিয়ে সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের বৃহত্তম পাহাড়ি এবং বনাবৃত অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত তিনটি প্রশাসনিক জেলার সমন্বয়ে গঠিত। ব্রিটিশ রাজত্বকালে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকারের ২২তম প্রশাসনিক অ্যাক্ট বলে বৃহত্তম চট্টগ্রাম জেলাকে বিভক্ত করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নামের একটি আলাদা প্রশাসনিক জেলা গঠন করা হয়। (Shelley,1992) ১৯৮২ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম একটিমাত্র বৃহত্তম জেলা ছিল। ১৯৮৩ সালে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই তিনটি প্রশাসনিক পার্বত্য জেলায় বিভক্ত হয়। যা বর্তমানে Chittagong Hill Tracts এলাকা নামে সমধিক পরিচিত (Shelley,1992 & Rob. 1997) পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনসংখ্যা নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস এবং জাতিতাত্ত্বিক ভিন্নতার মধ্যেই ঐ এলাকাটির বর্তমান অশান্তি এবং বিচ্ছিন্নবাদিতার কারণ নিহিত রয়েছে (যদিও ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তবুও এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি যেমন কতটুকু শান্তি স্থাপিত হয়েছে? আদৌ কি শান্তিচুক্তি কার্যকর হয়েছে? দলমত নির্বিশেষে দেশের মানুষ এই চুক্তি গ্রহণ করেছে কি না? ইত্যাদি) পার্বত্য চট্টগ্রামই বাংলাদেশের একমাত্র অঞ্চল যেখানকার মোট জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অবাঙালি এবং অমুসলিম, অঞ্চলটি মূলত একটি মিশ্র জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত, বিভিন্ন জাতি-উপজাতি, নানা গোত্র ও ভাষাভাষী এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও বহু সংস্কৃতি বিশিষ্ট জনসংখ্যার একটি এলাকা, নৃতাত্ত্বিক এবং জাতিতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে এ কথা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী কোনো জনগোষ্ঠীই এখানকার মূল আদিবাসী (Aboriginis) বা ভূমিপুত্রের (Son of the Soil) দাবিদার হতে পারে না (Lew in,1869, Khisha 1964, Bernol 1960 and Ahmed 1990) এসব গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল জনগোষ্ঠীই আগে বা পরে পার্শ্ববর্তী অথবা দূরবর্তী পার্বত্য অঞ্চল বা সমতল ভূমি থেকে দেশান্তরী হয়ে ঐ অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং নিবাস গড়ে তোলে। শতশত বছর ধরে পাশাপাশি অবস্থান করলেও এসব বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বহুলাংশে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে তবে তাদের মধ্যে কোনো কোনো উপজাতীয় সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্যাবলির কিছু কিছু গ্রহণ করে নিয়েছে। যেমন- চাকমারা বাঙালিদের ভাষা এবং খ্যাদাভ্যাস এবং টিপরারা হিন্দু ধর্ম এবং লুসাই বোমরা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। কালের বিবর্তনে এই সকল পরিবর্তন পাহাড়ি এলাকা নিয়ে ভাববার অবকাশ রেখেছে কিন্তু আমরা কতটুকু এটা নিয়ে ভাবছি সেটাই এখন ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য এলাকায় বর্তমানে প্রায় অর্ধেক জনগণই বাঙালি। সুতরাং বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে একদিকে নেই যেমন সখ্য অন্য দিকে বিদেশী চক্রান্ত পাহাড়ি এলাকার শান্তি স্থাপনে প্রধান অন্তরায বলে আমি মনে করি। নিম্নে তালিকার মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার জনগোষ্ঠীদের একটি তালিকা প্রদান করা হলো : পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ সম্পদ সম্ভাবনার এক অপরিমেয় এবং বিপুল ভাণ্ডার বা সম্ভাবনার প্রতিশ্রুত প্রান্তর, এতদসত্ত্বেও বাঙালি পাহাড়িদের মধ্যে সুন্দর/মধুর সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় সকল সম্ভাবনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। উপরের সারণি থেকে দেখা যায় যে, বাঙালি জনসংখ্যা ৫০% হওয়া সত্ত্বেও সেখানে বাঙালিরা মনে হয় নিজ দেশে বঞ্চনার শিকার, অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের ৩৬ এবং ৪২ ধারায় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দেশের মানুষের যে কোন জনকে বাংলাদেশের সার্বভৌম এলাকার যে কোন স্থানে যাতায়াত, বসতি স্থাপন, জমি খরিদ বা সম্পত্তি গড়ে তোলার মৌলিক অধিকার (ঋঁহফধসবহঃধষ জরমযঃং) প্রদান করেছে। (... every citizen shall have the right to move freely throughtout Bangladesh , to reside and settle in and place there in and to leave and re- enter Bangladesh” (36/3)” ... every citizen shall have the right to acquire, hold, transfer or otherwise dispose of property “(42/3)” বাংলাদেশের সংবিধানের এই ধারা দু’টির দ্বারা বাংলাদেশের সার্বভৌম অঞ্চলভুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সম্পদসহ যে কোন সম্পদের উন্নয়ন, আহরণ, ব্যবহার, বাণিজ্য এবং বিনিময়ের আইনানুগ অধিকার জাতি, ধর্ম বর্ণ ভাষা ভেদে, যে কোন বাংলাদেশীর জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও অতীতে বিশেষ করে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, দুর্গম পার্বত্য ভূমিরূপ, শিক্ষার অভাব, জনসংখ্যার অপ্রতুলতা আর তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর ঔদাসীন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়নে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে (Rob,1990) সুতরাং সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ এবং সরকার ও জনগণের সঠিক ও উন্নয়নমুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্পদবহুল পার্বত্য এলাকায় সুদূরপ্রসারী শান্তিস্থাপন সম্ভব। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দেশের সবচেয়ে অরক্ষিত অথচ আঞ্চলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক এলাকা। সমাজতান্ত্রিক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার (Uni-Polar Global System) অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপটে এশিয়ায় ভারত এবং চীন ভবিষ্যৎ নব্য পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। এমন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগরের প্রবেশপথে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশের সার্বভৌম অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম অত্যধিক তাৎপর্যময় ভৌগোলিক অবস্থান জুড়ে বিরাজ করছে। ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের অনুবর্তী পশ্চাদভূমি হিসেবে এবং চীন, ভারত ও দ: পূ: এশিয়ার আসিয়ান (ASEAN) ভুক্ত অর্থনৈতিক শক্তি প্রায় সমদূরবর্তী প্রভাব ভূমি (VICINAL lAND) এশিয়ার এই ত্রিভুজ ভূভাগটি বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও গুরুত্ব বহন করে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এই গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ভূ-ভাগের বিশেষ তাৎপর্যময় স্থানে অবস্থিত। আয়তনে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি লেবানন, সাইপ্রাস, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, নাউরু, কাতার, লুক্সেমবার্গ, মোনাকো কিংবা সিসিলি অপেক্ষা বড়। অঞ্চলটি সকল দিক দিয়ে ভূমি পরিবেষ্টিত। সবচেয়ে নিকটতম সমুদ্র উপকূল দক্ষিণে পার্বত্য চট্টগ্রামের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে মাত্র ১৩-১৪ কিলোমিটার পশ্চিমে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কাছে অবস্থিত। পার্বত্য রাঙ্গামাটির পশ্চিম প্রান্তের কাউখালী থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলার সঙ্কীর্ণ একফালি ভূ-ভাগ যা কোন স্থানেই পূর্ব পশ্চিমে ৫০-৫৫ কিলোমিটারের চাইতে বেশি প্রশন্ত নয় যা পার্বত্য চট্টগ্রামকে সমুদ্র থেকে পৃথক করে রেখেছে (যেখানে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার অবস্থিত)। চট্টগ্রামের বন্দর যা কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে তার নাব্যতা এবং সমস্ত চট্টগ্রামের বন্দর কলকারখানা এবং নগরীসহ সমস্ত জেলা, পার্শ্ববর্তী কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর এবং চাঁদপুর জেলার বিদ্যুতের সম্পূর্ণ সরবরাহ এই কর্ণফুলীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া নৌপরিবহন এবং কৃষির জন্য সেচব্যবস্থায় (কক্সবাজরার ও চট্টগ্রাম জেলায়) পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রবাহিত কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, হালদা, শঙ্খ ইত্যাদি নদীর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। সব দিক দিয়ে বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব সহজেই অনুভব করা যায়। অন্য দিকে দুর্গম এবং পার্বত্য ঘেরা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থান চট্টগ্রাম বন্দর, প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর সোনাদিয়া (কক্সবাজার) চট্টগ্রাম মহানগর ও অপেক্ষাকৃত অপ্রশস্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ভূ-ভাগকে ভূ-রাজনৈতিক ও অবস্থানগত দুর্ভেদ্যতা দান করেছে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতা চট্টগ্রাম অঞ্চল (যাকে দেশের প্রাণ বলা হয়) কৌশলগতভাবে অপেক্ষাকৃত বেশি সহজভেদ্য (Strategically) ঐ এলাকাকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত দুর্বল ও প্রতিকূল বৈশিষ্ট্য দান করবে, এমনকি বারবার নব্য উদীয়মান (প্রতিবেশী) রাষ্ট্র কর্তৃক ঐ এলাকার সার্বভৌমত্ব বিলীন হতে পারে। বাংলাদেশের সুন্দরী কন্যা নামে খ্যাত চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে সুরক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে যে কোন উপায়ে বাংলাদেশের অখণ্ড হিসেবে ধরে রাখা খুবই প্রয়োজন এটা না হলে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো মাতা চাড়া দিয়ে উঠতে দ্বিধা করবে না। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূ-রাজনৈতিক (Geo-Politics) গুরুত্ব বহন করে, সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলটির সন্নিহিত অবস্থান (Vicinal or relative location) অত্যন্ত প্রতিকূল। একমাত্র পশ্চিমের বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়া এলাকাটির উত্তর-পূর্ব কিংবা দক্ষিণ-পূর্বাংশের ভারত এবং মিয়ানমার অন্তর্ভুক্ত সকল প্রতিবেশী অঞ্চলসমূহ অত্যন্ত দুর্গম। পার্বত্য বনাবৃত এবং জনবিরল অনুন্নত ভূ-ভাগের সমষ্টি মাত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা (যা Seven Sister নামে পরিচিত) ছাড়িয়ে প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার দূরে চীনের উইনান প্রদেশের সীমান্ত অবস্থিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার প্রায় ১১০ কিলোমিটার সীমান্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সংলগ্ন পার্বত্য রাঙ্গামাটির ২৪০ কিলোমিটার সীমানা ভারতের মিজোরাম (Lusici Hills) ও ত্রিপুরা রাজ্যের বিভক্তি নির্দেশ করে এবং পার্বত্য বান্দরবান জেলার প্রায় ১১৫ কিলোমিটার সীমান্ত রেখা মিয়ানমারকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করেছে (Bangaldesh Administrative Map prepared by graph osman, Dhaka,1992) পার্বত্য চট্টগ্রামের আকৃতি অসংবদ্ধ (Non-Compact) এবং দীর্ঘায়তন (Elongate) প্রান্তের তুলনায় অঞ্চলটির কয়েক গুণ বেশি দীর্ঘ। এই সকল ভূ-পারিসরিক বৈশিষ্ট্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতার দিক বলে বিবেচ্য। চট্টগ্রামের উত্তর-দক্ষিণে সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কিলোমিটার এবং অপ্রশস্ত স্থানের বিস্তৃতি প্রায় ৪০ কিলোমিটার (চন্দ্রঘোনা থেকে মিজোরামের পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত)। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে (কাপ্তাই কিংবা চন্দ্রঘোনা) সড়ক পথে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব ৫০-৬০ কিলোমিটার কিন্তু বাস্তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় নাইক্ষ্যংছড়ি থানার শেষ প্রান্ত (পূর্বাংশ) থেকে নিকটতম সমুদ্র উপকূলের দূরত্ব মাত্র ১৪-১৫ কিলোমিটার (Rob,1997) সুতরাং চট্টগ্রামের পূর্ব সীমান্ত এলাকার অবস্থান থেকে সমুদ্রের এই নৈকট্য সমগ্র অঞ্চলটিকে দান করেছে বিশেষ ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানের কারণেই পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেই আজ এ অঞ্চলটি গ্রাসের পাঁয়তারা শুরু করেছে। অঞ্চলটির একদিকে যেমন রয়েছে বিশালাকৃতির পাহাড়ি অবস্থান অন্য দিকে (পশ্চিমে) রয়েছে বর্তমান বিশ্বের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু বিশাল জলরাশি। নৌশক্তি বর্তমান বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রধান ও অন্যতম প্রপঞ্চক। এমন হতদরিদ্র পিতার যদি কোন সুন্দরী কন্য থাকে সেই বাবা যেমন সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন, তেমনি বাংলাদেশের কতগুলো সুন্দরী কন্যা আছে যাদের কারণে বাংলাদেশ সর্বদা তটস্থ থাকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম তাদের মধ্যে অন্যতম, ভারতের Seven Sister  প্রদেশগুলোর উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ভারতের জন্য খুবই প্রয়োজন কেনন এসব প্রদেশ দূরে হওয়ায় কলকাতা বন্দরের সাথে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা খুবই কঠিন, অন্য দিকে উদীয়মান শক্তি চীন বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বিস্তার করতে চাইলে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল উত্তম জায়গা, কারণ এটার মাধ্যমে চীনের সাথে দূরত্ব যেমন কমবে তেমনিভাবে জাতিতাত্ত্বিক মিলও আছে। সুতরাং অঞ্চলটি মিশ্র জনসংখ্যা এবং বিপুল ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নানা আঞ্চলিক এবং দূরবর্তী আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহকে অঞ্চলটির ওপর নজর রাখতে উৎসাহিত করছে। এই কারণে ভারত মহাসাগরে এবং সংলগ্ন ভৌগোলিক এলাকায় নিজেদের প্রভাববলয় তৈরি করতে বা ধরে রাখতে ভারত, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন গোষ্ঠী তৎপর। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ শিক্ষা ক্ষেত্রে বৃত্তি প্রদানের নামে এক শ্রেণীর বিচ্ছিন্নতাবাদী জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদি তা সত্যই হয়ে থাকে তবে তা বাংলাদেশের জন্য মোটেই সুখকর খবর নয়। অন্য দিকে অস্ট্রেলিয়া ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ভারতের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা করতে এবং শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে প্রখর নজর রেখে চলেছে এবং ‘মানবাধিকার প্রশ্ন’ তুলে বাংলাদেশের ওপর চাপ ফেলতে চাচ্ছে। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের (বিশেষ করে পাকিস্তানে) কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির ওপর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং খণ্ডিত শক্তি রাশিয়া এবং উদীয়মান শক্তি চীন নতুন করে নজর রাখতে শুরু করেছে, চীনের অগ্রসরমান অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির কারণে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় নৌমহড়া মালাবার এক্সেরসাইজ গত ০৯.০৯.০৭ তারিখে ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হলো। সম্ভবত এর মূল কারণ হতে পারে বাংলাদেশকে বুঝিয়ে দেয়া যে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্যবহার করে চীন যাতে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশিতে প্রবেশ না করতে পারে। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার (নভেম্বর ২০০৮) তার তেল, গ্যাস ক্ষেত্রগুলো ভারত ও চীনের মাধ্যমে উন্নয়নের ও বিতরণের চুক্তি স্বাক্ষর করে। মিয়ানমার বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঠিক দক্ষিণে অবৈধভাবে বাংলাদেশের নাকের ডগায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করে যা বাংলাদেশের জন্য মোটেই সুখবর নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থ। জনসংখ্যার চাপে ভারাক্রান্ত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিপুল জনসংখ্যার পুনর্বাসনের জন্য এই অঞ্চলটি অতীব প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য। প্রাকৃতিক সম্পেেদ ভরপুর এই অঞ্চলটি এক সময় হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। প্রাচীন এই ভূভাগে সম্ভবত বিপুল পরিমাণ খনিজসম্পদ অনাবিষ্কৃত রয়েছে। ব্যাপক বনাঞ্চল, জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনাময় উৎস, মৎস্যসম্পদের উন্নয়ন, অবারিত পর্যটন সম্ভাবনা প্রভৃতি এই অঞ্চলকে বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত করেছে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে অঞ্চলটি বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম, বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এবং বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত চট্টগ্রাম অঞ্চলকে (কক্সবাজারসহ) কৌশলগত নিরাপত্তা (Strategic Security) বা ভূ-রাজনৈতিক আড়াল (Strategic defence) দান করেছে। অন্য দিকে চট্টগ্রামের প্রায় সকল নদী (কর্ণফুলীসহ) পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে এই অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতা বা অশান্ততা বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কৃষি জমির পানি সরবরাহ, নৌ যোগাযোগ, চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্যতা এবং কাপ্তাই থেকে সরবরাহকৃত জলবিদ্যুতের অস্তিত্ব, কর্ণফুলী কাগজ কলের টিকে থাকা প্রভৃতি সম্পূর্ণভাবে বিপন্ন করে তুলবে, সর্বোপরি এই এলাকার গরিব জনগণকে টিকিয়ে রাখার সাথে সাথে বাংলাদেশের সাবভৌমত্ব এই অঞ্চলের সাথে বহুলাংশে মিশে আছে। অন্য দিকে মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিসত্তা বিশেষ করে কারেন, রোহিঙ্গা, মণি, চিন, মগ ইত্যাদি উপজাতীয়রা বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধে লিপ্ত। এই প্রেক্ষিত মিয়ানমারকে নিজের স্বার্থে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার ওপর বিশেষ নজর রাখতে হচ্ছে। তবে দীর্ঘ দিন সামরিক শাসন, বহির্বিশ্বের সাথে খারাপ সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি কারণে অভাবগ্রস্ত মিয়ানমারের পক্ষে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে আধিপত্য ভূমিকা সম্ভব হবে না। হাঙ্গর আকৃতির প্রতিবেশী দেশ ভারত তার নিজ স্বার্থেই সদা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রেখেই চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে ভারতের ভীষণ রকমের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত স্বার্থ জড়িত। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় ভারতীয় কংগ্রেস পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতভুক্তির দাবি তুলেছিল (Tayeb 1966 and Ahmed 1958) বর্তমানে ভারত এশিয়ার অন্যতম শক্তি এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য পরাশক্তি, বঙ্গোপসাগর থেকে নিয়ে ভারত মহাসাগরে ভারত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সুস্পষ্টভাবে সক্ষম হয়েছে। (Bindra 1982 and Rob 1997) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে (Seven Sister of India) বর্তমানে ব্যাপক স্বাধীনতাকামী আন্দোলনে ভারত বিশেষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে ভারত চীনের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে ভারতের এই অঞ্চলটির কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতা বিশেষভাবে চোখে পড়ে, চীন মাত্র ২-৩ দিনের মধ্যে বৃহত্তর আসামের উত্তরাংশ (ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরাংশ) দখল করে নেয়। অন্য দিকে ভবিষ্যৎ শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী নেপাল কিংবা বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এ ধরনের সংঘাতে চীনের পক্ষ নিলে ভারতের ঐ অসুবিধাজনক ভূকৌশলগত অঞ্চলটির অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে বিপন্ন হতে পারে। (Rob,1997) সুতরাং ভারতকে তার এই সকল অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হয়। এমতাবস্থায় উঠতি নৌশক্তির দেশ ভারত বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল দিয়ে সামান্য পথ (পার্বত্য) অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারে সাতবোন রাজ্যগুলোতে, তাই সাতবোন রাজ্যগুলিকে ধরে রাখার জন্য ভারতের যে বাসনা তা বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামই হচ্ছে তাদের একমাত্র ক্ষেত্র, এই কারণে ভারত সর্বশক্তি দিয়ে কৌশলে তার ভূকৌশলগত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে চায়। এই কারণেই হয়ত ভারত বারবার কোন জাতীয়তাবাদী সরকারকে চাপের মধ্যে রাখতে জঙ্গি সমস্যা, ফারাক্কা ইস্যু, টিপাইমুখ সমস্যা এবং চাকমা সমস্যাকে চাবি হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে, সুতরাং অবস্থানগত কারণেই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। অন্য দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর চীন ধীরে ধীরে বর্তমান বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজকে প্রস্তুত করছে। এমতাবস্থায় চীনকে যদি ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে সবচেয়ে যোগ্যতম স্থান হচ্ছে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা কেননা এখানে চীনের সাথে আছে জনসংখ্যার মধ্যে জাতিতাত্ত্বিক মিল এবং কম দূরত্ব। এমতাবস্থায় চীন এই এলাকার ওপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এটা কোন দিক থেকে গ্রহণ করবে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশের সরকারযন্ত্রের, সামান্য ভুলে কারণে হয়তো এই সম্ভাব্য এলাকাটি এক সময় সমগ্র জাতির দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির