post

বাংলাদেশে কেন এত বর্বরতা?

১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪

 ফিরোজ মাহবুব কামাল

Hortalকেন এ নৃশংস অসভ্যতা? যে দেশের সেনাবাহিনীর লোকেরা নিজ দেশের নাগরিকদের খুন করে লাশ নদীতে ফেলে অর্থ কামায় সে দেশকে কি সভ্য দেশ বলা যায়? সে সরকারও কি সভ্য সরকার, যে সরকার নিরস্ত্র মানুষের ওপর সশস্ত্র সেনা লেলিয়ে দিয়ে শতশত মানুষকে হতাহত করে এবং নিহতদের লাশ ময়লার গাড়িতে তুলে গায়েব করে দেয়? অথচ রাজধানীর শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে তারিখে তো সেটিই হয়েছিল। কোনো সভ্য সরকার কি নিজ দেশের নাগরিকদের ঘরবাড়ির ওপর বুলডোজার চালিয়ে দেয়? সারিবদ্ধ বালুবোঝাই ট্রাক দিয়ে অবরোধ করে কি বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসা? বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হত্যা করা, গুম করা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন সেলে নিয়ে দৈহিক অত্যাচার করাÑ কোন ধরনের সভ্যতা? বিরোধী দলের অফিসে ভাঙচুর করা, তাদের অফিসে তালা লাগিয়ে দেয়া, বিরোধী পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের রাজপথে সমাবেশ করতে না দেয়া, এমনকি তাদেরকে নিজ অফিসে মিটিং করতে না দেয়াও কি সভ্যতা? অথচ বিরোধী দল দমনে এরূপ নৃশংস বর্বরতাই হলো শেখ হাসিনা সরকারের নীতি। কোন সভ্য সরকার কি কখনো নির্বাচনের নামে ভোট ডাকাতি করে? সংসদের অর্ধেকের বেশি সিটে নির্বাচন ছাড়াই কি সংসদ গঠন করে? কোন সভ্যদেশের আদালত কি দলীয় ক্যাডারদের দাবিতে বিচারের রায় পাল্টায়? অথচ বাংলাদেশে এরূপ অসভ্যতা অহরহ হচ্ছে। এরূপ নানা অসভ্যতার পাশাপাশি দুর্বৃত্তিতে ৫ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটিও কি কম বর্বরতা? তা ছাড়া সরকারের অসভ্যতা শুধু ঘটে যাওয়া নৃশংস বর্বর অপরাধগুলোর বিচার না করা নয়, বরং এরূপ অসংখ্য অপরাধের সাথে তার নিজের সংশ্লিষ্টতাও। জাতীয় জীবনে কদর্যতা স্রেফ সরকারের ব্যর্থতার কারণে আসে না। সেটি অনিবার্য হয় সর্বসাধারণের ব্যর্থতায়। জাতির অর্জিত সফলতার কৃতিত্ব যেমন প্রতিটি নাগরিকের,  তেমনি ব্যর্থতার দায়ভারও প্রতিটি নাগরিকের। দেশগড়ার কাজে সমগ্র দেশবাসী একটি দলবদ্ধ টিম রূপে কাজ করে। টিম হারলে যেমন সে টিমের সবাই হারে, তেমনি জাতির বেলায়ও। দেশ গড়া, শান্তিপ্রতিষ্ঠা ও দেশের প্রতিরক্ষার দায়-দায়িত্ব তাই কিছু নিছক রাজনৈতিক নেতা, দেশের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের নয়। এ কাজ সমগ্র দেশবাসীর। এটি খেলার বিষয় নয় যে, মুষ্টিমেয় খেলোয়াড়গণ খেলবে এবং আমজনতা দর্শকরূপে তা দেখবে। বরং এ কাজ রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, আলেম-উলামা, ছাত্র-শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মচারী, সেনাসদস্য, কৃষক-শ্রমিকসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের। একটি জাতি যখন নিচে নামতে থাকে তখন সে নিচে নামার কারণ বহু। তবে মূল কারণটি হলো, দেশ গড়া ও দেশের প্রতিরক্ষার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কাজে জনগণের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন না করা। জাতির ঘাড়ে যখন দুর্বৃত্ত সরকার চেপে বসে তখন পাড়া থেকে চোর-ডাকাত তাড়ানোর মত ঘাড় থেকে সে দুর্বৃত্ত সরকার নামানোর  দায়িত্বটিকে জনগণকে নিজ হাতে নিতে হয়। সে জন্য প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে হয়। কিন্তু জাতি বিপদে পড়ে যখন সে কাজগুলি মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতে সীমাবদ্ধ হয় এবং বাকিরা দর্শকে পরিণত হয়। সকল বিফলতার জন্য তখন শুধু সেই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের দায়বদ্ধ করা হয়। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা যখন অস্তমিত হলো তখন শুধু সিরাজউদ্দৌলাহর পরাজয় হয়নি বরং পরাজিত হয়েছিল বাংলার সমগ্র মানুষ। এ পরাজয়ের জন্য শুধু মীর জাফরকে দায়ী করে অসুস্থ চেতনার মানুষই শুধু নিজের দায়ভার ও দুঃখ কমাতে পারে, বিবেকবান মানুষ তা পারে না। সে পরাজয়ের জন্য দায়ী ছিল বাংলার সমগ্র মানুষ। একটি দেশ কতটা সভ্য সে বিচারটি দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, গাছপালা, ক্ষেত-খামার দিয়ে হয় না। ইট-পাথর ও লোহালক্কড় দিয়ে নির্মিত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বা কলকারখানার সংখ্যা দিয়ে হয় না। বরং সে বিচারটি হয় সেদেশের মানুষের মান, শাসকের মান এবং আদালতের আইনের মান দিয়ে। হালাকু- চেঙ্গিসের ন্যায় চোর-ডাকাতের হাতে দেশ গেলে সেখানে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও প্রাসাদ নির্মিত হলেও সভ্যতা নির্মিত হয় না। ইসলাম তার প্রাথমিককালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা জন্ম দিয়েছে কোন তাজমহল, পিরামিড বা কোন বিস্ময়কর প্রাসাদ না গড়েই। তারা জন্ম দিয়েছিল এমন বিবেকবান শাসকের যারা চাকরকে উটের পিঠে চড়িয়ে নিজে উটের রশি ধরে সামনে চলাকে নিজের নৈতিক দায়িত্ব মনে করেছে। প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল এমন উন্নত আইনের যে আইনের স্রষ্টা কোন মানুষ ও পার্লামেন্ট ছিল না, ছিলেন খোদ মহান আল্লাহতায়ালা। সে শরিয়তি আইনে নারী-পুরুষ তার মৌলিক স্বাধীনতা ও অধিকার পেয়েছিল। বিলুপ্ত হয়েছিল আদি আমল থেকে চলে আসা দাসপ্রথা। নারী শিশুরা সেদিন জীবন্ত দাফন হওয়া থেকে বেঁচেছিল। সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল চোর-ডাকাতেরা। বিলুপ্ত হয়েছিল মদ্যপান, জুয়া ও ব্যভিচারের ন্যায় আদিম অপরাধ। নানা ধর্মের মানুষ সে সমাজে নিরাপদে বাস করতে পারতো। সে রাষ্ট্রে কোন কালেই কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেনি। অথচ বাংলাদেশ আজ হালাকু- চেঙ্গিসের ন্যায় বর্বর চোর-ডাকাত ও খুনিদের হাতে অধিকৃত। এদের হাতে যে শুধু ব্যাংক ডাকাতি হচ্ছে বা শেয়ারবাজার লুট হচ্ছে তা নয়, ডাকাতি হচ্ছে ভোটের বাক্সতেও। হাত পড়ছে মানুষের ইজ্জত-আবরু ও জানের ওপরও। সাধারণ মানুষ আজ পথেঘাটে লাশ হচ্ছে। মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র আজ আঁস্তাকুড়ে গিয়ে পড়েছে। স্বৈরাচার আজ মুজিব আমলের বাকশালী নিষ্ঠুরতার চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে। ডাকাতেরা যেমন গৃহকর্তার হাত-পা বেঁধে বা তাকে খুন করে লুণ্ঠন করে, তেমনি দেশবাসীকে বন্দি করে এবং তাদের ওপর অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে অতিশয় দুর্বৃত্তরা আজ দেশ শাসন করছে। দেশ অসভ্যতায় রেকর্ড গড়ছে তো এ কারণেই। তবে এরূপ ভয়াবহ অবস্থায় দেশ একদিনে পৌঁছেনি। রোগ ধীরে ধীরে বেড়ে অবশেষে একদিন শরীরের পতন ঘটায়। যে চোর-ডাকাত ও খুনিদের হাতে আজ বাংলাদেশ অধিকৃত তারা ইংরেজদের মতো বিদেশ থেকে আসেনি। আসমান থেকেও পড়েনি। তারা তো বেড়ে উঠেছে জনগণের মাঝেই। মানুষকে শুধু চাষাবাদ বা ব্যবসাবাণিজ্য জানলে চলে না। স্রেফ বিষাক্ত শাপ ও হিংস্র বাঘ-ভল্লুকদের চিনলেও চলে না। সেগুলি জানার পাশাপাশি সমাজের চোর-ডাকাত ও খুনিদেরও চিনতে হয়। তাদের ঘৃণা করার সামর্থ্যও থাকতে হয়। সেটিই তো বিবেকের সুস্থতা। সেটিই তো চেতনার বল। বাংলাদেশের মানুষ সে সুস্থতা নিয়ে তেমন বেড়ে ওঠেনি। চেতনায় সে বলও পায়নি। সে অসুস্থতা যে শুধু স্বল্পসংখ্যক মানুষের -তা নয়। বরং সে রোগ বিপুল সংখ্যক মানুষের। এবং সে রোগটি নিখুঁতভাবে ধরা পড়ে নির্বাচন কালে। এমন অসুস্থতা মানুষের আধিক্যের কারণে কোন বিবেকবান সৎ মানুষের পক্ষে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া অসম্ভব। বিলেতে কোন এমপি একবার মিথ্যুক প্রমাণিত হলে তার আর এমপি পদ থাকে না। অথচ বাংলাদেশে শুধু মিথ্যুক নয়, চোর-ডাকাত প্রমাণিত হলেও বিপুল ভোটে সে নির্বাচিত হয়। সেটি চেতনায় চরম অসুস্থতার কারণে। বস্তুত এমন এক অভিন্ন অসুস্থতার কারণে মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মহম্মদ (সা)কেও মক্কার কাফেরদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে রাতের আঁধারে গোপনে জন্মভূমি ছাড়তে হয়েছে। একই অবস্থা হয়েছিল হযরত ইবরাহিম (আ) ও হযরত মূসা (আ)-এর মতো মানবেতিহাসের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ মানবদের। যে আজাব নিজেদের অর্জিত অন্যায় ও অসত্যকে ঘৃণা, আর ন্যায় ও সত্যকে ভালোবাসার সামর্থ্যই মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সামর্থ্য। এমন সামর্থ্যরে বলেই মানব ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হয়। সে সামর্থ্যটি দৈহিক বলে আসে না, সে জন্য  নৈতিক বল লাগে। সে জন্য লাগে চেতনায় সুস্থতা। লাগে চিন্তা ও দর্শনের বল। বাংলাদেশের মানুষের সে নৈতিক বল অতি সামান্যই। তাদের মূল সমস্যাটি নৈতিক অসুস্থতার। সে অসুস্থতাটি ছড়িয়ে গেছে সমগ্র দেশজুড়ে। আওয়ামী লীগ কি আজ হঠাৎ করে চোর-ডাকাত ও খুনিদের দলে পরিণত হয়েছে? এ রোগটি তো দলটির জন্মলগ্ন থেকেই। পাকিস্তান আমলেও কি এ দলের লোকজন চুরি-ডাকাতি কম করেছে? সরকারি অর্থচুরির অপরাধে ঢাকার আদালতে খোদ শেখ মুজিবের শাস্তি হয়েছিল, যদিও পরে ঢাকার উচ্চ আদালত তাকে ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর বহু লক্ষ অপরাধী বহু খুনখারাবি ও চুরি-ডাকাতি করে। কিন্তু ঢাকার উচ্চ আদালত তাদের ক’জনকে শাস্তি দেয়? মুজিবকেও তারা দেয়নি। মুজিব ও তার অনুসারীরা কি পাকিস্তান আমলেও কোনো বিরোধী দলকে শান্তিপূর্ণ সভা করতে দিয়েছে? তারা তো সংসদের অভ্যন্তরে ডিপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হত্যা করেছে কয়েক শত সংসদ সদস্যের সামনে। কিন্তু সে হত্যাকাণ্ডের অপরাধে কোন আদালত কি কাউকে একদিনেরও জেল দিয়েছে? ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও নুরুল আমীন সাহেবের পাকিস্তান ডিমোক্র্যাটিক পার্টিসহ কোন দলকেই মুজিব শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনী জনসভা করতে দেয়নি। সর্বত্র গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগেই তারা রাজপথের রাজনীতির ওপর নিজেদের দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছিল। শাপলা চত্বরের নৃশংস ভয়াবহতা নিয়ে তারা হাজির হয়েছিল ১৯৭০ সালে ১৮ই জানুয়ারিতে ঢাকার পল্টন ময়দানে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী জনসভায়। সেদিন পল্টন ময়দানের পাশের রাস্তাগুলোর ওপর দাঁডিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের খুনিরা বৃষ্টির মতো পাথর নিক্ষেপ করে সমাগত জনতার ওপর। অবশেষে জনসভার অভ্যন্তরে ঢুকেও তারা মানুষ খুনে নেমেছিল। সেদিন জামায়াতের তিনজন নিরপরাধ কর্মীকে তারা শহীদ করেছিল এবং আহত করেছিল বহু শত মানুষকে। অথচ সে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দার সামর্থ্য যে কোন সাধারণ মানুষেরই থাকে। এমনকি শিশুদেরও থাকে। থাকে না শুধু অসভ্য খুনিদের। অথচ সে হত্যাকাণ্ডকে নিন্দা করে সে সময়ের বাঙালি বুদ্ধিজীবীগণ কোন বিবৃতি দেয়নি। কেউ রাজপথেও নামেনি। বরং পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ খবর ছেপেছিল জামায়াতের কর্মীরাই সমবেত শ্রোতাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এই হলো বিপুল সংখ্যক বাঙালির বিবেকের মান! বাংলাদেশের সে বিবেকশূন্য জনগণ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সে নৃশংস খুনিদেরই বিপুলভাবে বিজয়ী করেছিল। মুজিবের শাসনামলেও কি এসব চোর-ডাকাত ও খুনিরা কম অপরাধ করেছে? মুজিবের রক্ষীবাহিনীর হাতে ৩০ হাজারের বেশি রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছে। সিরাজ শিকদারকে খুন করে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে কোথায় আজ সিরাজ শিকদার বলে হুঙ্কার শুনিয়েছে। গণতন্ত্র কবরে পাঠিয়ে একদলীয় বাকশালী স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করাই যে মুজিবের শিক্ষা ও সে সাথে আওয়ামী লীগের গর্বের ঐতিহ্য সেটি কি এতই পুরনো বিষয়? তারপরও জনগণ এ খুনি ও স্বৈরাচারী বর্বরদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। সেটি যেমন ১৯৯৬ সালে, তেমনি ২০০৮ সালে। কোন সুস্থ মানুষের পা একই গর্তে বারবার পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশীরা জেনে বুঝে সে গর্তে বারবার পা দেয়। ফলে যে চোর-ডাকাত ও খুনিদের হাতে দেশ অধিকৃত তারা বেড়ে উঠেছে জনগণের সাহায্য-সমর্থন নিয়েই। বাংলাদেশের বুকে যে অসভ্য বর্বরতা আজ নেমে এসেছে সেটি জনগণের নিজস্ব অর্জন। কিন্তু জনগণের সে নীচুতা ও ব্যর্থতা নিয়ে কি কোনো কালেও কোনো হিসাব নিকাশ হয়েছে? স্বৈরাচারের নাশকতা নিজ ঘরে আগুন লাগলে সে আগুন থামানোর দায়িত্ব সে গৃহে বসবাসকারী সবার। সে সাথে পাড়ার লোকেরও। ঘর জ্বলতে দেখেও সে পরিবারের বা পাড়ার কেউ যদি সে আগুন নেভাতে উদ্যোগী না হয় তবে কি তাকে আদৌ সুস্থ বলা যায়? খন্দকের যুদ্ধে আরবের কাফেরদের সম্মিলিত হামলায় মদিনা নগরী যখন অবরুদ্ধ তখন প্রতিটি পুরুষই শুধু নয়, প্রতিটি নারীও মোকাবেলায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। শত্রুর সে হামলার মুখে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল শতকরা শতভাগ। আল্লাহতায়ালাও তাদের জানমালের বিনিয়োগ দেখে ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন। ফলে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র সেদিন আসন্ন বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেয়েছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ হামলার মুখে শতকরা ১ জন বাঙালি মুসলমান কি সেদিন ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিল? হয়নি। ফলে এমন জাতির স্বাধীনতা রক্ষা পায় কী করে? জাতির প্রতিরক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমাদের পূর্ব পুরুষরা সেদিন মুষ্টিমেয় ষড়যন্ত্রকারীর খেলায় পরিণত করেছিলেন। মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষাকে ইসলামে যেখানে জিহাদের ন্যায় পবিত্র বলা হয়েছে সেটিকে সংগঠিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। অথচ একই ব্রিটিশ বাহিনী যখন আফগানিস্তানে ঢুকেছিল তখন আফগান জনতা সে হামলা ঠেকাতে সরকারের মুখের দিকে চেয়ে থাকেনি। হাতে যা ছিল তা নিয়েই ময়দানে নেমেছিল। ফলে হামলাকারী বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর মাত্র একজন সৈনিক ছাড়া কেউই সেদিন জ্যান্ত ফিরতে পারেনি। সে লোমহর্ষক পরাজয়ের কথা ব্রিটিশ জাতি আজও ভুলতে পারেনি। তবে জনগণের সাথে সরকারের দায়িত্বও বিশাল। তাদের কাজ হলো জনগণকে প্রস্তুত করে যুদ্ধে নামানো। তাদের হাতে প্রশিক্ষণ ও ট্রেনিং তুলে দেয়া। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনে সে কাজটিই হয় না। দেশগড়া, দেশের প্রতিরক্ষা ও দেশ শাসনের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তখন মুষ্টিমেয় বেতনভুকের খেল-তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়। এ নিয়ে রচিত হয় নানা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। দেশের আপামর সর্বসাধারণ পরিণত হয় নীরব দর্শকে। স্বৈরাচারী শাসনকালে তাই যুদ্ধ হয় দু’টি প্রতিপক্ষ শাসকগোষ্ঠীর। দেশ গড়ার বিষয়টি গণ্য হয় তাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়রূপে। জনগণকেও তারা শত্রু বা প্রতিপক্ষ ভাবে। নিজেদের গদি বাঁচাতে তারা বরং জনগণকে অস্ত্রহীন ও শক্তিহীন করে। স্বৈরাচারের এটিই সবচেয়ে বড় নাশকতা। আজকের বিশ্বে ১৫০ কোটি মুসলমানের যে পতিত দশা তার কারণ মূলত এই স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। অথচ রাষ্ট্রের নির্মাণে, উন্নয়নে ও প্রতিরক্ষায় অংশ নেয়া ইসলামে কোন পেশাদারিত্ব নয়, চাকরিও নয়; এটি ইবাদত। শুধু শ্রম ও অর্থ দানই নয়, অনেক সময় সে কাজে প্রাণদানও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এরূপ চেতনাবলেই প্রাথমিক কালের মুষ্টিমেয় দরিদ্র মুসলমানেরা সে আমলের দু’টি বৃহৎ শক্তিকে পরাজিত করে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতার নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এ যুগের মুসলিম শাসকেরা নানা বাহানায় সে ইবাদত পালনকে অসম্ভব করেছে। রাজনীতিতে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণকে তারা ফৌজদারি অপরাধে পরিণত করেছে। অথচ রাজনীতি হলো রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের নীতি। ফলে প্রতিটি নাগরিকের এটি মৌলিক অধিকার। অথচ সৌদি আরবের ন্যায় মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশে এটি মৃত্যুদণ্ডনীয় অপরাধ। শেখ মুজিবও এটি নিষিদ্ধ করেছিলেন ইসলামপন্থীদের জন্য। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ অবধি দেশের ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক দলগুলোকে মুজিব বেআইনি ঘোষণা করেছিলেন এবং ১৯৭৪ এ এসে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজকে পরিণত করেছিলেন তার পরিবার ও দলের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একদলীয় বাকশালী শাসন। যে কোনো স্বৈরাচারীর ন্যায় মুজিবও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দর্শকে পরিণত করেছিলেন। কোন টিমের শতকরা নিরানব্বই ভাগ খেলোয়াড়কে দর্শকের গ্যালারিতে বসিয়ে কোন দলই বিজয়ী হতে পারে না। তেমনি পারেনি মুজিব আমলের বাংলাদেশও। তার হাতে রাজনীতি পরিণত হয়েছিল লুণ্ঠনের হাতিয়ারে। ফলে নিঃস্ব হয়েছিল সরকারি তহবিল ও জনগণ এবং তার কুশাসনে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল লজ্জাজনক তলাহীন ঝুড়ির খেতাবটি। তার শাসনামলে দরিদ্র মানুষ কাপড়ের অভাবে মাছধরা জাল পরে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। দেশগড়ার কাজকে সফল করতে হলে এ কাজে জনগণের ব্যাপকতর সম্পৃক্ততা জরুরি। কিন্তু মুজিব জনগণকে তা থেকে দূরে সরিয়েছিলেন। ব্যর্থতা শিক্ষাব্যবস্থার দেশগড়ার কাজ থেকে দূরে থাকাটি স্রেফ দায়িত্বহীনতা নয়, এটি অপরাধ। দেশের নাগরিকগণ সে ধারণাটি পায় শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। দেশগড়া নিছক রাজনীতি বা পেশাদারিত্ব নয় বরং পবিত্র ইবাদতÑ  সেটি প্রতিটি নাগরিকের চেতনায় দৃঢ়মূল করতে হয়। এ লক্ষ্যে ইসলামের হুকুম ও শিক্ষণীয় বিষয়গুলোকে জনগণের কাছে পৌঁছানোর কাজটি জরুরি। সে কাজটি করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। আল্লাহতায়ালা একটি সভ্য ও সুন্দর সমাজ নির্মাণের গুরুদায়িত্ব দিয়েই মানুষকে এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। সে নির্মাণকাজে রোডম্যাপটি হলো পবিত্র কুরআন। দেশগড়ার এ দায়িত্বটি খেলাফতের তথা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের। প্রতিটি মুসলমান তাই আল্লাহর খলিফা তথা প্রতিনিধি। দেশের প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী বা সচিব হওয়ার চেয়েও এ পদের মর্যাদা আল্লাহর দরবারে অধিক। প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী বা সচিব হওয়াতে মহান আল্লাহ থেকে পুরস্কার মেলবে না। কিন্তু খলিফার দায়িত্ব পালনে সফল হলে প্রতিশ্রুতি রয়েছে নিয়ামতভরা বিশাল জান্নাতের। খেলাফতের সে দায়িত্বপালনে কে কতটা নিষ্ঠাবান, রোজ হাশরের বিচার দিনে এ হিসাব প্রত্যেককেই দিতে হবে। প্রতিটি অফিসকর্মীকে তার কর্মশুরুর আগেই অফিসের করণীয় দায়ভারের বিষয়টি প্রথমেই জেনে নিতে হয়, নইলে তার দায়িত্ব পালন যথার্থ হয় না। তেমনি প্রতিটি ব্যক্তিকেও জেনে নিতে হয় এ পার্থিব জীবনে তার রোল বা ভূমিকাটি কী। মানজীবনের এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। তার জীবনের সকল কর্মকাণ্ড, দায়িত্ব-পালন ও তৎপরতা নির্ধারিত হয় এটুকু জানার পরই। তেমনি ইসলামের প্রথম পাঠটি হলো এ পৃথিবীতে ব্যক্তির ভূমিকাটি যে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের সেটি জানিয়ে দেয়া। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সে মৌলপাঠটিই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দেয়া হয় না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের বহুভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু বিষয় শেখালেও এ মৌলিক পাঠটি শেখায় না। ফলে দেশবাসীর কাছে দেশ ও সমাজ নির্মাণের ফরজ কাজটি ফরজরূপে গণ্য হয়নি। বরং রাজনীতি পরিণত হয়েছে গদি দখল, আরাম-আয়েশ ও নিজস্ব জৌলুস বৃদ্ধির হাতিয়ারে। দেশগড়ার এ পবিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে ধার্মিক ও সবচেয়ে নিষ্ঠাবান মানুষের আধিক্য অতি কাক্সিক্ষত ছিল। যেমনটি হয়েছিল খোলাফায়ে রাশেদার সময়। কারণ, অন্যরা না জানলেও যারা ধার্মিক তাদের জানা থাকার কথা, উচ্চচতর সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার অর্থ শুধু দায়িত্বহীনতাই নয়, আল্লাহতায়ালার কোরআনি হুকুমের বিরুদ্ধে সেটি বিদ্রোহ। বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার সর্বস্তরে যে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য - সে জন্য দায়ী তথাকথিত এ ধর্মপরায়নগণও। সমাজের আবু লাহাব, আবু জেহেলের বিরুদ্ধে নবী আমলের মুসলমানগণ যে আমৃত্যু যুদ্ধ করেছিলেন সেরূপ যুদ্ধ বাংলাদেশের ধর্মপরায়ণ মানুষদের দ্বারা কোনো কালেই সংঘটিতই হয়নি। ফলে সমাজের দুর্বৃত্তরা অনেকটা বিনা যুদ্ধেই সমাজ ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনগুলো দখল করে নিয়েছে। তা ছাড়া ময়দান কখনও খালি থাকে না। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষেরা ময়দান খালি করে দিলে দুর্বৃত্তরা তা অবশ্যই দখল  করে নেয়। রাষ্ট্রের সম্পদ এভাবেই দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মচারীদের অধীনস্থ হয়েছে। ফলে জনগণ নিঃস্ব হলেও ঐশ্বর্য বেড়েছে তাদের। যে দায়বদ্ধতা সবার দেশগড়ার ক্ষেত্রটি শুধু রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নয়। এ কাজটি হয় দেশের সর্বাঙ্গজুড়ে। শুধু রাজনীতি দিয়ে একটি সভ্যতার সমাজ নির্মিত হয় না। সে লক্ষ্যটি পূরণে রাজনীতিতে যেমন সৎ ও যোগ্য মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হয়, তেমনি যোগ্য মানুষের ভিড় বাড়াতে হয় দেশের শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজসেবা ও ব্যবসা বাণিজ্যেও। মানুষকে শুধু সৎ হলে চলে না, সাহসী ও সংগ্রামীও হতে হয়। নবীজীর (সা) সাহাবাগণ তাই শুধু অতি সৎই ছিলেন না, নির্ভীক ও অতিশয় লড়াকুও ছিলেন। এ যোগ্যতাবলেই দুর্বৃত্তদের রাজনীতি ও প্রশাসনের অঙ্গন থেকে হটিয়ে নিজেরা কাণ্ডারি হাতে নিয়েছিলেন। নবীজীবনের সে সুন্নত আজকের ধর্মপরায়ণ মানুষের জীবনেও আসতে হবে। নিছক বক্তৃতা বা উপদেশ খয়রাতে দেশ সমৃদ্ধতর হয় না। তাদেরকে দেশের এক্সিকিউটিভ ফোর্স বা পলিসি বাস্তবায়নকারী শক্তিতে পরিণত হতে  হবে। এটিই ইসলামের মৌল শিক্ষা। নবীজী (সা) ও সাহাবাদের জীবনের মূল শিক্ষা তো এটিই। ফলে ন্যায় কর্ম ও ধর্মপরায়ণতা শুধু মসজিদে নয় সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ইমারত নির্মাণের পূর্বে ভালো ইট তৈরির ন্যায় জাতি গঠনের পূর্বে উত্তম ব্যক্তি-গঠন অপরিহার্য। আর যোগ্য ব্যক্তি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শুধু জ্ঞান ও শারীরিক সুস্থতা নয়, বরং সবচেয়ে অপরিহার্য হলো তার ব্যক্তিত্ব। ঐ ব্যক্তিত্বই একজন মানুষকে মহত্ত্বর পরিচয় দেয়। এ বিশেষ গুণটির জন্যই সে প্রকৃত মানুষ। আর ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে মূল উপাদানটি হলো সত্যবাদিতা। হযরত আলী (রা) এ ক্ষেত্রে একটি অতিশয় মূল্যবান কথা বলেছিলেন। বলেছেন, ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তার জিহ্বায়। তথা তার সত্যবাদিতায়। যার জিহ্বা বা কথা বক্র তার চরিত্রও বক্র। সুদর্শন ও সুস্থ শরীরের অধিকারী হয়েও ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে সে পঙ্গু। এমন মিথ্যাবাদী মানুষ সমাজে ভালো মানুষ রূপে পরিচিতি পেতে পারে না। বাঁকা বা কাঁচা ইট দিয়ে যেমন প্রাসাদ নির্মাণের কাজ হয় না, তেমনি মিথ্যাচারী মানুষ দিয়ে একটি সভ্যতর ও উন্নততর সমাজ নির্মিত হয় না। বরং এরূপ অসৎ ও মিথ্যাচারী মানুষের আধিক্যে একটি জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়। অথচ কোন জাতির এমন ক্ষতি গরু-মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে হয় না। তাতে বরং বিপুল অর্থলাভ হয়। কিন্তু মিথ্যাচারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে দেশে অসভ্যতা, বর্বরতা ও ধ্বংস নেমে আসে। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ বা অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশও সে জাতির কোনো কল্যাণই করতে পারে না। সেটিরই প্রমাণ হলো আজকের বাংলাদেশ। দেশটির আজকের বিপন্নতা সম্পদের অপ্রতুলতায় নয়। ভুগোল, জলবায়ু বা জনসংখ্যাও নয়। বরং সেটি দুর্বৃত্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে। যে ব্যর্থতা বুদ্ধিজীবীদের দেশবাসীকে সদাচারী ও সত্যবাদী বানানোর গুরু দায়িত্বটি দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের। এ কাজটি ক্ষেত-খামার বা কোন কল-কারখানায় হয় না। রাজনীতি ও প্রশাসনিক দফতরেও হয় না। হয় দেশের জ্ঞানবান ব্যক্তিদের হাতে। তারাই দেশবাসীর শিক্ষক, তারাই সংস্কৃতির নির্মাতা। তারা সংস্কার আনে ব্যক্তির আচরণ, মূল্যবোধ ও রুচিবোধে। তাই একটি দেশ কতটা সভ্যতর পরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে সে বিচারে সে দেশের জ্ঞানবানদের সততা ও সৎ সাহসের দিকে তাকাতে হয়। প্রতিকুল অবস্থাতেও সত্য কথা বলার জন্য যে মনোবল দরকার সেটির জোগান তো তারাই দেয়। তারাই সমাজের মিথ্যুক ও দুশ্চরিত্রদের বাঁচাটা নিরানন্দ ও বহুক্ষেত্রে অসম্ভব করে দেয়। সম্পদের অধিকারী হয়েও দুর্বৃত্তরা সমাজে নন্দিত না হয়ে প্রচণ্ড নিন্দিত হয় বস্তুত এদের সৃষ্ট সামাজিক মূল্যবোধ ও বিচারবোধের কারণেই। নমরুদ, ফেরাউন, হালাকু বা হিটলারগণ ইতিহাসে যে আজও প্রচণ্ড ঘৃণিত তা এসব সত্যনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের কারণেই। ইসলামে এমন কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। নবীজী (সা)-এর হাদিসÑ “যে ব্যক্তি লোকদের কোন একটি ভাল বিষয় শিক্ষা দেয় তার জন্য খোদ মহান আল্লাহতায়ালা, তাঁর ফেরেশতাকুল, সমগ্র আসমান জমিনের বাসিন্দা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও সমুদ্রের মৎস্যকুলও তার জন্য দোয়া করতে থাকে।” –(তিরমিযি শরীফ)। ব্যক্তির জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী থাকতে পারে? মু’মিন ব্যক্তি তাই অর্থলাভের জন্য জ্ঞান বিতরণ করে না বা ওয়াজে নামে না। বরং এ কাজে নেমে গালি খাওয়া ও পাথর খাওয়াই হলো নবীজী (সা)-এর সুন্নত। সাহাবাগণ তাই পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র অতিক্রম করে বহু দেশে সত্য প্রচার করেছেন। বাংলাদেশের মানুষ মুসলমান হয়েছে তো তাদের সে মেহনতের বরকতেই। কিন্তু বাংলাদেশে সে কাজটিই হয়নি। আলেমগণ অর্থ লাভ বা বেতন লাভের প্রতিশ্রুতি না পেলে কোরআন শিক্ষা দেন না। ওয়াজে মুখ খোলেন না। তাদের পক্ষ থেকে সে কাজটি না হওয়ার কারণেই দেশে ইসলামের বিজয় আসেনি। সুস্থ মূল্যবোধ ও বিচারবোধও প্রতিষ্ঠা পায়নি। বরং মহা বিজয় এসেছে দুর্বৃত্তদের। ফলে গণতন্ত্র হত্যা, বাকশালী স্বৈরশাসনের প্রতিষ্ঠা, দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও তিরিশ হাজারের বেশি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে খুন করার পরও শেখ মুজিব নেতার মর্যাদা পায়। তার দলকেও জনগণ ভোট দেয় এবং দলটি দেশ শাসনেরও সুযোগ পায়। যে দেশে চোর-ডাকাত ও খুনিগণও নেতা এবং নির্বাচিত শাসকের মর্যাদা পায়, তখন কি বুঝতে বাকি থাকে সে দেশে নৈতিক পচনটি কত গভীর? এমন দেশে নির্বাচন শতবার হলেও কি কোন পরিবর্তন আসে? নৈতিক রোগ কি নির্বাচনে সারে? বরং প্রতি নির্বাচনে চোর-ডাকাতগণই যে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবে সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? দেশে ফসলের ফলন না বাড়লে বীজ, ভূমি, জলবায়ু বা কৃষকের দোষ হয়। মানুষের চরিত্রে ও মূল্যবোধে প্রচণ্ড অবক্ষয় দেখা দিলে দেশটির শিক্ষক, শিক্ষালয়, শিক্ষাব্যবস্থা ও বুদ্ধিজীবীরা কতটা ব্যর্থ সেটি ধরা পড়ে। শিক্ষা ও সাহিত্যের ময়দান থেকে মানুষ একটি সমৃদ্ধ চেতনা পাবে, উন্নত মূল্যবোধ নির্মিত হবে এবং তা থেকে সমাজ একটি সভ্যতর স্তরে পৌঁছবার সামর্থ্য পাবে সেটি কাক্সিক্ষত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বরং শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরাই মূলত জন্ম দিয়েছেন বর্তমান অবক্ষয়ের। মাছের পচন যেমন মাথা থেকে শুরু হয়, তেমনি জাতির পচনের শুরুও বুদ্ধিজীবীদের থেকে। তাদের কারণেই বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজই সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ। তাদের সাথে যাদেরই সাহচর্য বেড়েছে তারাই রোগাগ্রস্ত হয়েছে চৈতন্য, চরিত্রে ও মূল্যবোধে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের এ ব্যর্থতার বড় কারণ, তাদের অধিকাংশই কোন না কোন মিথ্যাচারী নেতার আশ্রিত ও গৃহপালিত রাজনৈতিক শ্রমিক। সমাজে মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠার চেয়ে এসব নেতাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাই তাদের মূল লক্ষ্য। নেতাদের মিথ্যাচার ও চারিত্রিক কদর্যতাকে চোখে আঙ্ুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সে মিথ্যাচারের প্রচারে তারা বরং স্বেচ্ছায় তাদের চাকর-বাকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাগণ যে কতটা মিথ্যাচারী এবং আমাদের শিক্ষক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা সে মিথ্যা প্রচারে যে কতটা বিবেকবর্জিত তার সবচেয়ে চোখধাঁধানো নজির হলো শেখ মুজিবের একাত্তরে ৩০ লাখের মৃত্যুর তথ্য। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচারিতা ও দুষ্কর্ম তুলে ধরার জন্য এই একটি মাত্র দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। যে কোন ধর্ম যে কোন মূল্যবোধই মানুষকে সত্যবাদী হতে শেখায়। সত্যবাদী হতে বলে এমনকি শত্রুর বিরুদ্ধেও। খুনের আসামির বিরুদ্ধেও তাই দুনিয়ার কোনো আদালতই মিথ্যা বলার অধিকার দেয় না। বন্ধুর সামনে ফেরেশতা সাজা তো মামুলি ব্যাপার। সত্যবাদিতার প্রমাণ হয় তো শত্রুর বিরুদ্ধে মিথ্যা না বলায়। মিথ্যার প্রতি আসক্তিই ব্যক্তির চেতনার ও চরিত্রের সঠিক পরিমাপ দেয়। এ পরিমাপে শেখ মুজিবই শুধু নয়, তার অনুগত বুদ্ধিজীবীরাও সত্যবাদী প্রমাণিত হননি। শেখ মুজিব কোনরূপ জরিপ না করেই বলেছেন, একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। সে সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। অর্থাৎ ৭৫ মিলিয়ন। ৭৫ মিলিয়নের মধ্যে ৩০ লাখ বা তিন মিলয়ন নিহত হলে প্রতি ২৫ জনে একজন নিহত হতে হয়। স্কুলের ছাত্ররা এ হিসাব বুঝে। যে গ্রামের প্রতি বাড়িতে গড়ে ৫ জনের বাস সে গ্রামে প্রতি ৫ বাড়িতে একজনকে নিহত হতে হয়। অতএব যে গ্রামে ১০০ ঘর আবাদি সেখানে কমপক্ষে ২০ জনকে প্রাণ দিতে হয়। সে গ্রামে যদি কেউই মারা না যান তবে পাশের সম বসতিপূর্ণ গ্রামে ১০০ ঘরে ৪০ জনকে নিহত হতে হবে। নইলে ৩০ লাখের হিসাব মিলবে না। বাংলাদেশে যাদের বাস তারা শেখ মুজিবের এ মিথ্যা তথ্য বুঝলেও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই সেটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, আদালতের উকিল বা পত্রিকার কলামিস্ট হয়েও এখনও সে কথা নির্দ্বিধায় বলেন। মিথ্যাচারী হওয়ার জন্য এটুকুই কি যথেষ্ট নয় যে, কোন কথা শুনা মাত্র তার সত্যাসত্য বিচার না করেই সে বলে বেড়াবে? বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচারিতা প্রমাণের জন্য এটিই কি সবচেয়ে বড় দলিল নয়? সবচেয়ে বড় দায়ভার সব পাপের জন্ম মিথ্যা থেকে। নবীজী (সা) ব্যভিচার, চৌর্যকর্ম ও মিথ্যাচারে লিপ্ত এক ব্যক্তিকে চারিত্রিক পরিশুদ্ধির জন্য প্রথমে যে পাপ কর্মটি পরিত্যাগ করতে উপদেশ দিয়েছিলেন সেটি হলো এই মিথ্যাচার। নানা পাপের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে হলে বাংলাদেশেও সে কাজটি শুরু করতে হবে মিথ্যাচারী রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে। মিথ্যা ও মিথ্যাচারীদের দূরে হঠাতে পারলে অন্য সব পাপাচার এমনিতেই দূর হবে। নইলে সমাজের দুর্বৃত্ত মিথ্যাচারীরা শুধু দেশের নেতা, মন্ত্রী বা বুদ্ধিজীবী নয়, জাতির পিতা হওয়ারও স্বপ্ন দেখবে। কারণ, কোন জাতি মিথ্যাচারিতায় ডুবলে সে জাতির ফেরাউনরা শুধু রাজা নয়, খোদা হওয়ারও স্বপ্ন দেখে। এটিই ইতিহাসের শিক্ষা। তাই সব যুগের ফেরাউনেরাই মিথ্যাকে প্রচণ্ড গণমুখিতা দিয়েছে। আর সে কাজে চাকর-বাকর রূপে ব্যবহার করেছে রাষ্ট্রের বুদ্ধিজীবীদের। কারণ, মিথ্যাচারের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের ন্যায় কার্যকর চাকর-বাকর আর নেই। এ জন্যই মধ্যযুগের স্বৈরাচারী রাজাদের দরবারে বহু গৃহপালিত সভাকবি থাকতো। তেমনি বাংলাদেশেও বুদ্ধিজীবীর বেশে এমন গৃহপালিত চাকর-বাকরের সংখ্যা বহু হাজার। তারা মুজিবের ন্যায় বাকশালী স্বৈরাচারী দুর্বৃত্তকে ফিরাউনের ন্যায় খোদা রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে না পারলেও অন্তত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে প্রচার করেছে। তবে এ মিথ্যার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বুকে দেশী পুঁজির পাশাপাশি বিদেশী শত্রুদের পুঁজি নিয়োগও হয়েছে বিস্তর। বিপুল অর্থ এসেছে ভারত থেকে। বাংলাদেশকে সত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে হলে বুদ্ধিবৃত্তির নামে পরিচালিত এমন মিথ্যাচারিতাকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে। কারণ, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মৃত্যু ঘটে শুধু দেহের জীবকোষের, কিন্তু মিথ্যাচারিতায় মৃত্যু ঘটে বিবেকের। ফলে মানুষ তখন অসভ্য অমানুষে পরিণত হয়। ফলে যক্ষ্মা, কলেরা, টাইফয়েডের মহামারীতে বাংলাদেশের যতটা ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হচ্ছে মিথ্যাচারিতার ব্যাপ্তিতে। দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম হওয়ার মূল কারণ এটিই। একই কারণে দেশবাসীর ঘাড়ের ওপর চেপেছে এক অসভ্য সরকার। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি অপেক্ষা করছে আখেরাতে। মিথ্যাচারিতার যে বীজ আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা অতীতে প্রোথিত হয়েছিল তা এখন পরিণত হয়েছে প্রকাণ্ড মহীরুহে। মিথ্যার অনিবার্য ফসল যে সীমাহীন দুর্নীতি ও দুর্বৃত্ত-শাসন, তা নিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্ববাসীর সামনে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। নৈতিকতার ক্ষেত্রে জাতিকে এ মিথ্যাচার বরং তলাশূন্য করে ফেলেছে। এ রোগ বিপন্ন করছে আমাদের ইজ্জত নিয়ে বাঁচাকে। মুসলমান হওয়ার অর্থই হলো আমৃত্যু সত্যের পক্ষে সাক্ষী দেয়া এবং মিথ্যার রূপকে উন্মোচিত করা। এটিই মুসলিম হওয়ার প্রধান ধর্মীয় দায়বদ্ধতা। কিন্তু সে কাজটিই মুসলিম সমাজে যথার্থভাবে হয়নি। ইসলাম ও সত্যের বিরুদ্ধে এখানেই হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। সে সাথে ঘটেছে ইসলামের সাথে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। ফলে দুর্বৃত্ত মিথ্যুকরা চেপে বসেছে তাদের মাথার ওপর। তাতে অসম্ভব হয়েছে শরিয়তের প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের বিজয়। মিথ্যার সামনে এরূপ নীরবতা ও সদাচারিতা থেকে এরূপ বিচ্যুতি কি একটি জাতিকে কখনো সাফল্য দিতে পারে? শুধু দেশ গড়া নয়, মুসলমান হওয়ার জন্যও সত্য-চর্চার বিকল্প নেই। আর মিথ্যা তো দূরীভূত হয় একমাত্র সত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়ার মধ্য দিয়ে। যেমন অন্ধকার অপসারিত হয় একমাত্র আলোর আগমনের পরই। আর সে আলো জ্বালানোর মূল দায়িত্বটি নেবে সত্যাচারী বুদ্ধিজীবী বা আলেমগণÑসেটিই তো নিয়ম। বনি ইসরাইলের আলেমগণ সে দায়ভার পালন করেননি বলেই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহতায়ালা তাদেরকে ভারবাহী গাধার সাথে তুলনা করেছেন। কারণ, গাধা শুধু আল্লাহর কিতাবের ভারই বহন করতে পারে, আল্লাহর দেয়া নির্দেশাবলিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। অথচ আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠার কাজে প্রতিটি মু’মিন হলো আল্লাহর খলিফা ও তাঁর রাসূলের (সা) প্রতিনিধি। তাই একাজ শুধু আলেম বা মাদ্রাসার শিক্ষকদের কাজ নয়, এ কাজ প্রতিটি মুসলমানের। মু’মিনের জীবনে দেশ গড়া এবং দেশের প্রতিরক্ষার লাগাতার প্রয়াস শুরু হয় তো এমন এক দায়বদ্ধতা থেকেই। একমাত্র তখনই দেশে ইসলামের বিজয় ও অসভ্য সরকারের নির্মূল অনিবার্য হয়। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এবং অসভ্যতা ও বর্বরতা নির্মূল করে মুসলমানরা যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে-একমাত্র তখনই সেটি প্রমাণিত হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির