post

বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা যখন মানবসম্পদ উন্নয়ন

১৪ জুন ২০১৫
economic আরাফাত হোসাইন # অনেকদিন আগের কথা পূর্ববঙ্গের কোনো এক রাজা ঠিক করলেন রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেবেন। অর্থমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিলেন। অর্থনীতিবিদদের সাথে আলোচনার পর মন্ত্রী মহোদয় রাজদরবারে এলেন। মন্ত্রী বললেন, ‘অর্থনীতিবিদরা দুই ভাগ হয়ে গেছেন, এক ভাগ আশাবাদী আরেক ভাগ হতাশাবাদী।’ রাজা বললেন, ‘হতাশাবাদীদের কথা বাদ দেন আশাবাদীদের কথা বলেন।’ মন্ত্রী বললেন, ‘আগামী দশ বছর রাজ্যের মানুষ ঘাস খেয়ে বাঁচবে।’ রাজা হতবাক হয়ে বললেন, ‘তাহলে হতাশাবাদীরা কী বললো?’ মন্ত্রী বললেন, ‘আগামী দশ বছর আমরা খাওয়ার জন্য ঘাসও পাবো না।’ অর্থনীতিবিদদের নিয়ে বাজারে এমন রসালো কৌতুক চালু আছে। তাই অর্থনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে কলম ধরলে লেখা বেরোতে চায় না। এরপরও এই অর্বাচীন ভুল করে লেখাটি লিখে ফেলেছে। জুন মাসে সংসদে বাজেট পাস হওয়ার কথা আছে। ‘কেমন বাজেট চাই’ এমন একটা রব উঠিয়ে পত্রিকাগুলো কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক বিশেষজ্ঞ এই বিষয়ে কথা বলাকে উলুবনে মুক্তো ছড়ানো মনে করেন। আবার অনেকে মিড়িয়ায় মুখ দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক বলে মনে হচ্ছে। তবে আমি কেবল শিক্ষানবিস। প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে। বিরোধী দলগুলো এবং কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ সরকারের ভাষায় ষড়যন্ত্রকারীরা অবাস্তবায়নযোগ্য, অদূরদর্শী বাজেট বলে প্রতি বছর স্বর উচ্চকিত করেন। অন্য দিকে দেশপ্রেমিক (!) সরকার তাদের রূপকল্প বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যাখ্যা করে বাজেটকে। উন্নয়নশীল দেশে ঘাটতি বাজেটকে কাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ভালো মনে করা হয়। তবে প্রকৃতপক্ষে বাজেট ঘাটতি উন্নয়নের স্বার্থে নাকি অন্য উদ্দেশ্যে হচ্ছে খতিয়ে দেখলে না জানি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হয়ে যায়। ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে কঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। দশ বছর আগের ঢাকা আর আজকের ঢাকাকে মূল্যায়ন করলে সাদা চোখে এই উন্নয়ন ধরা পড়ে। অসংখ্য উড়াল সড়ক হয়েছে, শিল্পায়ন হচ্ছে দ্রুত হারে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন হওয়ার কাজ প্রায় শেষ হয়েছে, একই লাইনের রেলপথও চার লেন হয়ে গেছে। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে অবশেষে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে, ঢাকা শহরে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজও হাঁটিহাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যের হার এখন ২৫.৬% (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জুলাই ২০১৪) যা একটি মাইলফলক। যদিও প্রবৃদ্ধি ৬% (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জুলাই ২০১৪) এর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সমস্যা বেসরকারি বিনিয়োগে। স্পষ্ট ভাষায় বললে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যক্তিগত বিনিয়োগের লাগাম টেনে ধরেছে। বেসরকারি বিনিয়োগ মিশ্র অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এখানে প্রবৃদ্ধি না বাড়লে কাঠামোগত উন্নয়ন কাজে আসবে না। অর্থনীতির নানামাত্রিক নীতিমালা, বিভিন্ন তত্ত্ব, বাজেট সর্বোপরি সার্বিক উন্নয়নের মূল কেন্দ্র মানুষ, মানবসম্পদ। এই মানবসম্পদের উন্নয়নের কতটা হচ্ছে? শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯তম (দ্য হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট ২০১৫)। দারিদ্র্য কমছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, সেই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কি দেশের উন্নয়নে যথার্থ অবদান রাখতে পারছে? দরিদ্র দেশে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য কর্মসংস্থান। কিন্তু সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও চাকরি পেতে কয়েক বছর লেগে যায়। তবে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান অনেকেই করতে পারেন না। সমস্যার কথা হলো সনদপত্র অর্জন আর কর্মসংস্থান হওয়ার মধ্যবর্তী ব্যবধান দীর্ঘায়িত হচ্ছে। প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারের সাথে এ প্লাসের হারও বাড়ছে। এই ছাত্রছাত্রীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় অংশ নেয় তখন সিংহ ভাগ যোগত্যা অর্জন দূরে থাক উত্তীর্ণই হতে পারে না। শিক্ষাকাঠামো ২০১২ সাল থেকে সৃজনশীল করা হয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতির চমৎকারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই কিন্তু যে শিক্ষকরা পড়াচ্ছেন তারা শিক্ষাদানের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছেন কিনা ব্যাপকভাবে ভাবা দরকার। যে মুখস্থ বিদ্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে সৃজনশীল পদ্ধতি সেই মুখস্থ বিদ্যার প্রতি শিক্ষার্থীরা ঝুঁকে পড়ছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে। পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর আগে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এ যেন নকলের নতুন ধারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বিষয়টিকে অস্বীকার করা হচ্ছে। ভুল সংশোধনের জন্য প্রথম পদক্ষেপ ভুলের স্বীকৃতি দেয়া, ভুল স্বীকার না করলে কেউ সমাধানের পথ খুঁজে বের করবে না। পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়া ছাত্রদের যোগ্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে কী উত্তর দিতে হবে সেটি মনে হয় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা মুখস্থ করে রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা গৎবাঁধা। এখানে সৃজনশীলতার যায়গা রাখা হয়নি, নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার যায়গা তো সুদূর পরাহত। ছয় মাসের সেমিস্টার তড়িঘড়ি করে চার-পাঁচ মাসে শেষ করলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে কর্তৃপক্ষ। নেতৃত্ব নির্মাণ, বিতর্ক, আবৃত্তি, চলচ্চিত্র, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের ক্ষেত্র সঙ্কুচিত করে দিয়েছে সেমিস্টার পদ্ধতি। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীলতার ওপর জোর দিলেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একই পদ্ধতিকে ছুড়ে ফেলার রহস্য আজো অনুন্মোচিত। সৃজনশীলতা কেবল পরীক্ষার খাতায় নয় সামাজিক সাংস্কৃতিক বিকাশেও প্রয়োজন এটা ভুলে গেলে চলবে না। সবাই কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষা প্রত্যাশা করে অথচ সরকারি বা ব্যক্তিপর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেয়া হয় না। কারিগরি শিক্ষা শতভাগ কর্মসংস্থানমুখী। অজানা কারণে এই শিক্ষাব্যবস্থা অবহেলিত। এর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা তো আছেই। দেশে আজো কোন কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় নেই। কারিগরি পর্যায়ে অধিক শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করলে এবং মানসম্মত শিক্ষা প্রদান করলে বেকারত্বের হার সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। বাজেটের ২১% বরাদ্দ হয় শিক্ষা খাতে। (বাজেট ২০১৪-২০১৫, অর্থ মন্ত্রণালয়) বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বরাদ্দকৃত অর্থের যথার্থ ব্যবহার হয় কি না সন্দেহ আছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রদের অমানবিক জীবণ যাপন করতে হয়। এই নিয়ে টিভিতে, পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে। উন্নতি হয়নি কিছুই। রাষ্ট্র যদি সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জনের নিমিত্তে আসা ছাত্রদের পর্যাপ্ত সুযোগ নিশ্চিত করতে না পারে তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন কিভাবে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সিট সঙ্কট, গণরুম, খাবারের নিম্নমান প্রকট আকার ধারণ করেছে আর রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি তো আছেই। মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যম নামে আরো দু’টি শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশে চালু আছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা একসময় দেশের বাইরে চলে যাবে এই স্বপ্নে বিভোর থাকে। অথচ রাষ্ট্র এদেরও শিক্ষার সুবিধা নিশ্চিত করছে। দেশপ্রেম ও নৈতিকতার শিক্ষা যদি তাদের জন্য নিশ্চিত করা যায় তবে এমন ধারণার পরিবর্তন সম্ভব। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে বাংলা মাধ্যমের চেয়ে বেশি তফাত নেই। বাড়তি হিসেবে ধর্মীয় বিষয়গুলো পড়ানো হয়। একজন মানুষকে নৈতিকভাবে গড়ে তুলতে ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কেউ কখনো অস্বীকার করেনি। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। তবে শিক্ষাপদ্ধতির আধুনিকায়ন দরকার। বিজ্ঞান, মানবিকের পাশাপাশি ব্যবসায় শিক্ষাও যুগের চাহিদা। ইসলামে তো ব্যবসায়কে নানাভাবে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। নৈতিকতা, ইসলামী মূল্যবোধের শিক্ষা তো তারা পাচ্ছে বাড়তি হিসেবে দেশপ্রেম, আধুনিক কর্মোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করলে তারাই দেশের সর্বোচ্চ সুনাগরিকের চাহিদা পূরণ করতে পারবে। কওমি মাদ্রাসাগুলো এ দেশে দেওবন্দি শিক্ষাব্যবস্থার একটি ধারা হিসেবে আজো টিকে আছে। স্বাধীনচেতা এই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলোকে এরা ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অনুকূল মনে করে না, অন্য দিকে সরকারগুলোও এদের জন্য আস্থার যায়গা তৈরি করতে পারেনি। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল ধারায় আনার সুযোগ আছে। প্রান্তিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠী কওমি মাদ্রাসার মূল জনশক্তি। এরাও দেশের নাগরিক। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়া এদের অধিকার। যতদিন রাষ্ট্র এদের আস্থায় আনতে পারবে না ততদিন রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের প্রতি সুবিচার করেছে বললে ভুল হবে। প্রতি বছর বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে, সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীর সংখ্যাও বাড়ছে আনুপাতিক হারে। এরপরও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঘুষসহ নানারকম অন্যায় কর্মকান্ড ঘটে চলেছে রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে। মূল্যবোধের অবক্ষয়, দেশপ্রেমের ঘাটতি এসবের উল্লেখযোগ্য কারণ। ধর্ম মানুষকে টেকসই মূল্যবোধ শেখায়, সৎকাজের আদেশ আর অসৎ কাজের প্রতিরোধে উৎসাহ দেয়, ন্যায়ভিত্তিক সমাজগঠনে অনুপ্রেরণা জোগায়। অথচ আমরা ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে দূরে ঠেলে দিয়েছি। বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করলে শিক্ষিত হওয়া যায়, মানুষ হওয়া যায় কিনা প্রশ্নসাপেক্ষ। টেকসই মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে হলে আমাদেরকে ধর্মের কাছে ফিরে যেতেই হবে। কর্মোপযোগী, দেশপ্রেমসমৃদ্ধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশীলনমূলক নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষাই মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল হাতিয়ার। এর জন্য যেমন পর্যাপ্ত পরিমাণ বাজেটকৃত অর্থ দরকার তেমনি বাস্তবায়নযোগ্য কর্মীবাহিনীও দরকার। কাঠামোগত উন্নয়ন, দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন অর্জনই কেবল বাজেটের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় বরং মানবসম্পদের টেকসই উন্নয়ন বাজেটের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়economic

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির