post

বিপথগামী কিশোরসমাজ : বিপন্ন জাতি

সাদেকুর রহমান

১৫ মার্চ ২০১৭
রাজধানীর উত্তরায় উঠতি তরুণদের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের  জের ধরে গত ৬ জানুয়ারি হত্যার শিকার হয় কিশোর আদনান নামে ১৪ বছরের এক কিশোর। সে উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ঘটনার দিন আদনান কবিরকে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের খেলার মাঠে হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। চিকিৎসার জন্য তাকে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আদনানের বাবা কবির হোসেন বাদি হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় ৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, নাঈমুর রহমান অনিক, সাদাফ জাকির, রায়হান আহম্মেদ সেতু, রবিউল ইসলাম, আক্তারুজ্জামান ছোটন, আহম্মেদ জিয়ান, নাজমুস সাকিব, নাফিজ মো. আলম ওরফে ডনের নামসহ আরও ১২ জনকে আসামি করে মামলা করে আদনানের বাবা। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারও করেছে, ওরা কেউ কারাগারে, কেউ কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে রয়েছে। আলোচিত এ ঘটনার সূত্র ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য। লোকসমাজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কিশোর অপরাধের ভয়াবহ প্রবণতা। উদ্বেগাকুল হয়ে পড়ে সুধীসমাজ, অভিভাবকশ্রেণি। পেশাদার সন্ত্রাসী-গডফাদার চক্রের মতো নাকি কিশোরদেরও রয়েছে গ্যাং! ডিসকো-বিজে পার্টি থেকে শুরু করে মাদক ব্যবহার ও বাণিজ্য, অবৈধ অস্ত্র বহন ও ব্যবহার, গাড়ি চুরি, পকেটমার, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, হত্যাপ্রচেষ্টা ও বোমাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে জাতিসংঘের বয়স হিসেবে ‘শিশু’ বিবেচিত কিশোররা। ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ওরা আধিপত্য বিস্তারের নামে এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করছে। ওরা এতটাই বেপরোয়া যে কারো কথা শুনতে চায় না। ওরা বিকট শব্দে বাইক চালায়, পার্টি করে, মাদকের আড্ডা দেয় এবং স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের নিয়মিত উত্ত্যক্ত করে। শুধু রাজধানীতেই নয়, বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরেও অনুরূপ কিশোর সন্ত্রাসী চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে খবর আছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কিশোর সন্ত্রাস নতুন একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভয়ঙ্কর সামাজিক ও  নৈতিক অবক্ষয়ের এই গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, ‘উত্তরা আমরা চালাবো’- এমন মনোভাব নিয়ে ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার’ নামের দু’টি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে উত্তরার কয়েকটি সেক্টর। এই দুই গ্রুপের নেতারা মাত্র উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেছে। আর গ্রুপের বেশির ভাগ সদস্যই উত্তরার মাইলস্টোন, ক্যামব্রিয়ান, উত্তরা হাইস্কুল, রাজউক, ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম, নবম, দশম এবং উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। আদনান ছিল ‘নাইন স্টার’ গ্রুপের সদস্য আর অভিযুক্তরা ‘ডিসকো বয়েজ’ গ্রুপের সদস্য। আদনান ঘটনার আগে ৩ জানুয়ারি রাতে উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন বাবুলের ভাতিজা দীপু সিকদারকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গেও ডিসকো বয়েজ গ্রুপ এবং নাইন স্টার গ্রুপ জড়িত থাকার অভিযোগ মেলে। গত মাসে উত্তরার ৯/এ নম্বর রোডে ব্যাডমিন্টন খেলার সময় ডিসকো গ্রুপের ছোটন খান ও সাকিব নাইন স্টার গ্রুপের তালাচাবি রাজুর ওপর হামলা চালিয়ে আহত করে। ওই ঘটনায় পুলিশ সাবেক জেলা জজের ছেলে নাফিস মোহাম্মদ আলম নামে এক কিশোরকে গ্রেফতার করে। পরে আলম মুক্তি পায়। শুধু কি উত্তরাতেই বেড়েছে টিনএজার বা কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। জবাব, না। এলাকার আধিপত্য ও চাঁদা আদায় করা নিয়ে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর কদমতলীতে বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র রিয়াদুল, মেহেদি হাসান ও আহাদকে ছুরি মেরে আহত করা হয়। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর কামরাঙ্গীরচরে দুই কিশোরের হাতে খুন হয় আলিফ নামের এক কিশোর। ৪ ডিসেম্বর রাতে লালবাগে রবিন নামে এক কিশোরের ছুরিকাঘাতে আবু সালেহ রাব্বী নামে আরেক কিশোর খুন হয়। গোয়েন্দা সূত্র মতে, গত ১০ বছরে রাজধানীর আলোচিত হত্যাকান্ডের বেশির ভাগই কিশোর অপরাধীদের হাতে ঘটেছে। এটি খুবই ভয়ঙ্কর তথ্য। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কিশোর অপরাধীদের মধ্যে বেশির ভাগই ধনাঢ্য পরিবারের সদস্য। তারা পরিবার থেকে বখে গিয়ে অপরাধ কর্মকান্ড চালাচ্ছে। মাঝে মধ্যে তাদের পুলিশ আটক করলেও তদবির করে ছাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে বলেও শোনা যায়। মুক্ত হয়ে ওরা ফের অপকর্মে লিপ্ত হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোর অপরাধের জন্য বহুবিধ কারণ দায়ী। কোনো নির্দিষ্ট কারণে অপরাধ সৃষ্টি হয় না। এক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয়Ñ ইন্টারনেট, ফেসবুক, টেলিভিশন, বিদেশি অনুষ্ঠান দেখে আমরা ভিনদেশি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছি। বিভিন্ন ভয়ঙ্কর ভিডিও গেমস এবং অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র কিশোরদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলছে। স্কুলগুলো অতিমাত্রার বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না। কিশোরদের জন্য কাউন্সেলিং জরুরি হলেও তাদের তা করানো হচ্ছে না। কিশোররা যত দ্রুত প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, তত দ্রুত মূল্যবোধ গ্রহণ করছে না। তাছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারকালে তারা বুঝতে পারছে না দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু গ্রহণ করা উচিত। ফলে হিতে বিপরীত ঘটছে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশুদের ৯০ শতাংশ মাদকসেবী। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনের মতো মরণনেশায় আসক্ত তারা। আর এ নেশার খরচ জোগাতেই তারা যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। অপরাধ জগৎ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাদের পক্ষে তা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। তারা শিশু-কিশোরদের দিয়ে খুন-রাহাজানির মতো বড় অপরাধ করিয়ে থাকে। কারণ অপ্রাপ্ত বয়স্করা আইনগতভাবে কিছুটা ছাড় পেয়ে থাকে এবং পুলিশও তাদের তেমন একটা সন্দেহ করে না ও নজরদারির মধ্যে রাখে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে পাড়া-মহল্লায় সক্রিয় কিশোর সন্ত্রাসীদের একটি তালিকা তৈরি করেছিল পুলিশ। তাতে ৫১৬ জনের নাম আছে। তালিকা অনুযায়ী ওয়ারী অঞ্চলে ১৪৪, মিরপুর অঞ্চলে ১০৬, মতিঝিল অঞ্চলে ৭৫, রমনা অঞ্চলে ৫১, লালবাগ অঞ্চলে ৩৬, তেজগাঁও অঞ্চলে ৪৬, গুলশান অঞ্চলে ৪৮ এবং উত্তরা অঞ্চলে ১০ কিশোর অপরাধী রয়েছে। বর্তমানে শুধু রাজধানীতেই কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়াবে বলে ধারণা করছেন মাঠ পুলিশের সদস্যরা। আদনান হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসলেও তালিকা হালনাগাদ করা সম্ভব হয়নি। শুধু নতুনভাবে এলাকা বিন্যাস করা হয়েছে। পুরনো তালিকা বহাল রেখে পুলিশ বলছে, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নানা কারণে ‘বিলুপ্ত’ হলেও সে শূন্যতা পূরণ করছে বখে যাওয়া কিশোর-যুবকরা। রাজধানী অপরাধজগৎ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে কিশোর অপরাধীরা। নগরীর বিভিন্ন এলাকা এই অপরাধীদের ২০টি গ্রুপ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছে। ডিএমপি পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজধানীর ৪১টি থানা এলাকায় ৫১৬ কিশোর অপরাধীর পুনর্বিন্যাসকৃত তালিকা অনুযায়ী রমনা থানায় ২৫, শাহবাগ থানায় ১০, হাজারীবাগে ৭, কলাবাগানে ৯, কোতোয়ালি থানায় ২০, চকবাজারে ৬, বংশালে ১০, মতিঝিলে ৫, পল্টন থানায় ৬, সবুজবাগে ১৫, খিলগাঁও থানায় ১৩, রামপুরায় ৩৬, ডেমরায় ৮, যাত্রাবাড়ীতে ১৫, শ্যামপুরে ১৪, সূত্রাপুরে ৫০, কদমতলীতে ৫৭, তেজগাঁও থানায় ১২, মোহাম্মদপুরে ১১, আদাবরে ১৯, শেরেবাংলা নগরে ৪, মিরপুরে ১০, পল্লবীতে ৬০, কাফরুলে ৮, শাহ আলীতে ১১, দারুস সালামে ১৭, গুলশানে ১১, বাড্ডায় ১৯, ক্যান্টনমেন্টে ৩, খিলক্ষেতে ১৫, বিমানবন্দরে ৭ ও তুরাগ থানায় ৩ জন কিশোর সন্ত্রাসীর নাম রয়েছে। তবে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, উত্তরা, উত্তরখান ও দক্ষিণখান থানার তালিকায় কোনো কিশোর সন্ত্রাসীর নাম নেই। বিভিন্ন থানা সূত্রে জানা গেছে, এদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন মামলায় একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে। অধিকাংশই ছিন্নমূল টোকাই, হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। এরা ৫ শ’ থেকে এক হাজার টাকার জন্য একজন মানুষ খুনও করে বলে জানা যায়। মিরপুর, পল্লবী, শাহ আলী, কাফরুল এলাকায় সব থেকে বেশি কিশোর অপরাধী রয়েছে। এসব কিশোর অপরাধীর হাতে সাম্প্রতিক সময়ে এই চার থানা এলাকায় চাঁদা না দেয়ায় ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। একই অবস্থা পুরনো ঢাকার। উঠতি বয়সী কিশোর সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত জনপদেও কিশোর অপরাধীর সংখ্যা ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে চলেছে। বিপথগামী কিশোরসমাজের সঙ্গে গোটা জাতিও বিপন্ন হয়ে পড়ছে। দেশের ভবিষ্যৎ চালকরা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ওরা বরং রাশ টেনে ধরছে যেন! কিশোর অপরাধের গোড়ার কথা পত্রিকান্তরে জানা যায়, ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে পুরান ঢাকার কায়েতটুলী এলাকায় বন্ধু কর্তৃক খুন হয় স্কুলছাত্র আশা। এ ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সামনে চলে আসে কিশোর অপরাধের ব্যাপারটি। প্রায় আড়াই দশকের ব্যবধানে  দেশে কিশোর কর্তৃক হিংস্ অপরাধের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে বহুবিধ মাত্রা। কখনো কখনো বড় কোনো কারণ, আবার কখনো বা নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবেগের বশবর্তী হয়ে হত্যাকান্ডগুলো সংঘটিত হচ্ছে। কিশোর অপরাধের কারণ বিশ্লেষণে মনোবিজ্ঞানীরা ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে দায়ী করেন। আর সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি ত্রুটিপূর্ণ সামাজিকীকরণ এবং বিদ্যমান সমাজকাঠামোর দিকে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সমাজকাঠামোই মানুষকে অস্বাভাবিক আচরণ করতে বাধ্য করে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এর জন্য  দায়ী। অপরদিকে অপরাধবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কিশোর অপরাধ তৈরি হয় সংঘ থেকে। সংঘবদ্ধ এই দলগুলোকে উৎসাহ প্রদানের জন্য ঠিক তাদের চেয়ে বড় এক  গোষ্ঠী বসে থাকে, যারা নিজেদের স্বার্থে শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, কিশোর অপরাধের জন্য বহুবিধ কারণ দায়ী। কোনো নির্দিষ্ট কারণে অপরাধ সৃষ্টি হয় না। এক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয়Ñ ইন্টারনেট, ফেসবুক, টেলিভিশন, বিদেশি অনুষ্ঠান দেখে আমরা ভিনদেশি সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছি। বিভিন্ন ভয়ঙ্কর ভিডিও গেমস এবং অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র কিশোরদের চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলছে। স্কুলগুলো অতিমাত্রার বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না। কিশোরদের জন্য কাউন্সেলিং জরুরি হলেও তাদের তা করানো হচ্ছে না। কিশোররা যত দ্রুত প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, তত দ্রুত মূল্যবোধ গ্রহণ করছে না। তা ছাড়া প্রযুক্তি ব্যবহারকালে তারা বুঝতে পারছে না দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে কতটুকু গ্রহণ করা উচিত। ফলে হিতে বিপরীত ঘটছে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে, অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশুদের ৯০ শতাংশ মাদকসেবী। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনের মতো মরণনেশায় আসক্ত তারা। আর এ নেশার খরচ জোগাতেই তারা যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। অপরাধ জগৎ থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে চাইলেও তাদের পক্ষে তা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। তারা শিশু-কিশোরদের দিয়ে খুন-রাহাজানির মতো বড় অপরাধ করিয়ে থাকে। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্করা আইনগতভাবে কিছুটা ছাড় পেয়ে থাকে এবং পুলিশও তাদের তেমন একটা সন্দেহ করে না ও নজরদারির মধ্যে রাখে না। রাষ্ট্রের চোখে ‘কিশোর’ বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বিদ্যমান আইন রয়েছে যেগুলোর এক একটিতে একেকভাবে কিশোর-কিশোরী চিহ্নিত করা হয়েছে। চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর দ্বিতীয় ধারা অনুসারে অনূর্ধ্ব ১৬ বছরের ব্যক্তিকে কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে সাবালকত্ব আইন, ১৮৭৫-এর তৃতীয়  ধারা অনুযায়ী ১৮ বছর পূর্ণ হলে নাবালকত্বের অবসান ঘটে। অপরদিকে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯৩৯ অনুসারে ২১ বছরের কম পুরুষকে এবং ১৮ বছরের নিচের নারীকে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। লেবার কোড, ২০০৬-এর ধারা মতে যার বয়স ১৬ বছর পূর্ণ হয়নি তাকে শিশু বা কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আর দন্ডবিধির ৮২ ধারা অনুসারে ৯ বছরের কম বয়স্ক শিশু কর্তৃক কোনো কিছুই অপরাধ নয়। কিশোর অপরাধ কী সহজ কথায় অপরাধের সংজ্ঞা হলো, যে ব্যক্তি বা সমাজের দৃষ্টিতে অনাকাক্সিক্ষত ও অগ্রহণযোগ্য আচরণ। অপরাধ হচ্ছে কোনো সমাজের বিশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিনষ্ট হওয়ার ফল। সাধারণত ৭ থেকে ১৯ বছরের বালক বালিকাদের বলা হয় কিশোর-কিশোরী। এদের দ্বারা সংঘটিত কোনো অন্যায় বা নীতিবর্জিত আচরণই হচ্ছে কিশোর অপরাধ। কিশোর অপরাধের বয়স নিয়ে দেশভেদে বিভিন্ন মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। কোন কোন দেশে ১৩-২২ বছর, আবার কোন কোন দেশে ১৬-২১ বছর বালক-বালিকা অপরাধ করলে তার নাম কিশোর অপরাধ। জাপানে অনূর্ধ্ব ১৪ বয়সী কোন কিশোর অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। ফিলিপাইনে ৯ এবং বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ৭ বছরের কম বয়সী বালক-বালিকা বা শিশুর অপরাধ শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। আইন ও বিচার বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ বিচারে দু’টি আইন রয়েছে। শিশু আইন-১৯৭৪ এবং অপরাধী অবেক্ষণ আইন-১৯৬০ (১৯৬৪ সালে সংশোধিত)। ১৯৭৬ সালে শিশু বিধিমালা প্রবর্তন করে এই আইনকে আরো কার্যকর করে তোলা হয়। শিশু আইন এবং সংশোধনীর মাধ্যমে মূলত বিচার, তত্ত্বাবধান, প্রতিরক্ষা ও শিশুদের প্রতি আচরণ এবং কিশোর অপরাধীদের শাস্তি-সংক্রান্ত পুরনো আইনগুলোকে আরো বেশি প্রয়োগ-উপযোগী করা হয়। এই আইন অনুযায়ী, ১৬ বছরের কম বয়সীরা শিশু হিসেবে গণ্য। এই আইনের অধীনে শিশুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এমন কিছু মৌলিক নিয়মবিধি আছে। আইনে বলা হয়েছে, গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটির বয়স সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে। গ্রেফতারকৃত শিশুকে বড়দের থেকে আলাদা তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। শিশুদের বিচার কিশোর আদালতের মাধ্যমে করতে হবে। যদি কোনো শিশুর জন্য স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে অবেক্ষণ আইন অনুসারে, একজন আইন লঙ্ঘনকারীকে প্রথম ও সামান্য অপরাধের জন্য কিছু শর্ত সাপেক্ষে এক থেকে তিন বছরের জন্য অবেক্ষণ দেয়া যাবে। অবেক্ষণাধীন অপরাধীকে বিচারকারী আদালতের সঙ্গে সংযুক্ত এমন একজন অবেক্ষণ কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে নিজ বাড়ি ও এলাকায় রেখে দেখাশোনা এবং সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু আইনে বিচারের আগে ও পরে শিশুদের জন্য কারাদন্ডকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। শিশুদের বিচারাধীন সময়ে মুক্ত করার একমাত্র ব্যবস্থা হচ্ছে জামিন। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৪৯৭(১) অনুযায়ী ১৬ বছরের নিচে যে কোনো ছেলে বা মেয়েকে আদালত জামিন দিতে পারবেন। এমনকি সে যদি জামিন অযোগ্য অপরাধের অপরাধীও হয়। অন্য যে কোনো আইনের চেয়ে শিশু আইন এগিয়ে রয়েছে। আইনের ৪৮ ধারায় বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম বয়সী কেউ কোনো জামিন অযোগ্য অপরাধের কারণে গ্রেফতার হয়েছে এবং যদি সে মুহূর্তেই শিশুটিকে আদালতে পাঠানো সম্ভব না হয়, তবে সে ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা তাকে জামিন দিতে পারেন। তবে আমাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আদালত কিংবা পুলিশ কর্মকর্তা কেউই শিশুদের জামিনে মুক্ত করার ক্ষমতা প্রয়োগ করেন না। হুমকির মুখে ৬ লাখ পথশিশু সরকারি হিসাব অনুসারেই দেশে ভাসমান পথশিশুর সংখ্যা ৫ লাখ। এর মধ্যে ৪ লাখ রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এসব শিশুর কোনো ঠিকানা নেই। ফলে এ শিশুরা যে কোনো সময় অপরাধের শিকার হওয়ার এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ার গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী ইউএনডিপির অর্থায়নে পরিচালিত সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি জরিপ মতে, সারাদেশে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। আর শুধু ঢাকায় রয়েছে প্রায় ৩ লাখ। জরিপে বলা হয়, ২০১৪ সাল নাগাদ পথশিশুর সংখ্যা হবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪ জন। রাজধানীর প্রায় সব কয়টি ওয়ার্ডেই এদের বিচরণ রয়েছে। ১৯৪৩ সালের ভবঘুরে আইনের ৬ ধারা প্রয়োগ থাকলেও কিশোর অপরাধীদের তার আওতায় আনা যাচ্ছে না। জানা যায়, সারাদেশে মাত্র ৬টি ভবঘুরে কেন্দ্রে মাত্র ১৯০০ ভবঘুরে মানুষ থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সমাজচিন্তকরা কী বলছেন সমাজচিন্তক-শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, শুধু কিশোর অপরাধ নয়, সমাজের সকল ধরনের অপরাধের মূল কারণ সমাজের মধ্যেই রয়েছে। যেসব শিশু-কিশোর অপরাধের দিকে হাঁটছে তাদের সামনে কোনো লক্ষ্য বা ভবিষ্যৎ নেই। সমাজ এই ভবিষ্যৎ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজকে আমরা তাদের সামনে কোনো দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারিনি। যে চেতনা দিয়ে এক সময় কিশোররা মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেটা আর সমাজে বিদ্যমান নেই। সে কারণেই কিশোর অপরাধ বাড়ছে। কিশোররা লক্ষ্যহীন হয়ে পড়ছে। এর থেকে বের হয়ে আসতে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, আইনে শিশু অপরাধীদের বিচারের চেয়ে তাদের সংশোধনের বিষয়টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই তাদের বিচারের প্রক্রিয়াটিও হতে হবে সংশোধনমূলক যেন কিশোর হৃদয়ে তা কোনোভাবেই বিরূপ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে না পারে। তিনি আরো বলেন, সবার আগে মা-বাবাকে সচেতন হতে হবে। তার কিশোর সন্তানটি কোথায় যাচ্ছে- কাদের সঙ্গে মিশছে। কোনো মাদকে বা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিনা সেটা অভিভাককেই সবার আগে নজর দিতে হবে। তা ছাড়াও মাদক এবং অপরাধে জড়ানোর কুফল সম্পর্কে তাদেরকে জানাতে হবে। এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা শিশু-কিশোররা যাতে অপরাধপ্রবণতায় জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৯ জানুয়ারি রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৭ উদযাপনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণদানকালে তিনি এ আহবান জানান। এ সময় তিনি বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্ম বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ধারণ করে বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে চায় বলেও শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও রাজধানীতে কিশোরদের বিপথগামী হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, আসলে এখন আমাদের চিন্তার বিষয় হচ্ছে কিশোরেরা কেন বিপথগামী হচ্ছে। এ জন্য কিশোর অপরাধ রোধে আইন সংস্কার ও নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেন তিনি। এছাড়াও অভিভাবকদেরকে নিজেদের সন্তানদের প্রতি আরো সজাগ দৃষ্টি রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্বেগের যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত। মূল্যবোধসম্পন্ন সকল মানুষের মতো আমরাও শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। যে শিশু-কিশোরদের মাঝেই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকর্তা কিংবা ত্রাতা লুকিয়ে থাকার কথা, তাদের মাঝে যদি আত্মক্ষয়ী তথা জাতিবিনাশী এমন সব দোষ লুকিয়ে থাকে তাহলে আমরা যাবো কোথায়। তাইতো, সরকারপ্রধানের সার্বজনীন আহ্বানের সাথে আমরা সহমত পোষণ করছি। আকুল আহ্বান আমাদের পক্ষ থেকেও- ‘হে কিশোর ভাই-বন্ধুরা, নষ্ট-ভ্রষ্ট পথ থেকে ফিরে এসো আলোর পথে। নিজে হও আলোকিত মানুষ, জাতিকে দেখাও আলোর পথ।’ তমশাচ্ছন্ন জীবনের চৌকাঠে লাথি মেরে আলোকময় নতুন দিনের যাত্রা শুরু হবে- এই আমাদের প্রত্যাশা।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির