post

মহানবী (সা) এর শিক্ষাব্যবস্থা প্রকরণ ও পদ্ধতি

১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২
ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ মানবজীবনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষার ওপর ভিত্তি করেই গোটা জাতিসত্তার অবকাঠামো নির্মিত হয়। কোন জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির নিয়ামকই শিক্ষা। জ্ঞান বা শিক্ষাই মানুষকে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, সুন্দর-অসুন্দর, কল্যাণ-অকল্যাণ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে; অশান্তির পথ পরিহার করে শান্তির পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করে। জাতীয় আশাআকাক্সক্ষা পূরণ, জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে চরিত্র গঠন ও জীবনের সকল ক্ষেত্র এবং বিভাগে নেতৃত্ব দানের উপযোগী ব্যক্তিত্ব তৈরি উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রধান উপকরণই শিক্ষা। ইসলামী সমাজব্যবস্থার মূলভিত্তিও ইসলামী শিক্ষা। জ্ঞান বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং শিক্ষা ও সাহিত্যের বিস্তারে মুসলমানদের রয়েছে এক সোনালি অতীত। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সূচনা মুসলমানদের হাতেই হয়েছিল। অথচ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তার যথাযথ ভূমিকা পালনে অনেকাংশে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি বিশ্বাসের এ ধারাকে একেবারে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর শিক্ষাপদ্ধতি প্রকৃতি ও বিকাশ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। শিক্ষার নির্দেশ প্রদানে আল্লাহর বাণী ও মহানবীর (সা) প্রতিক্রিয়া “পাঠ কর তোমার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাটবদ্ধ রক্ত থেকে। পাঠ কর তোমার পালনকর্তা মহাদয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না;” বস্তুত সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত দ্বারাই মহানবী (সা) এর শিক্ষাব্যবস্থার যাত্রা সূচিত হয়। পরবর্তীতে পবিত্র কুরআনের আরও অনেক আয়াত এবং হাদিস শরীফে আল্লাহর সৃষ্টি বিশ্বজগতের প্রত্যেকটি জিনিসের গুণ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষা-গবেষণা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেনÑ নিশ্চয়ই আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত্রী ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য; যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সকল পবিত্রতা তোমারই, আমাদিগকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও। (আল কুরআন, ৩:১৯০-১৯১) আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা এবং সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সম্মানিত ও গৌরবান্বিত করেছেন। তিনি আদমকে (আ) সকল সৃষ্টি বিষয়ের জ্ঞান দান করলেন। পরে ফেরেস্তাদের সামনে উপস্থিত করলেন এবং বললেনÑ তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে বল, যেসব জিনিস দেখছো, তন্মধ্যে কার কী নাম, কার কী গুণ? তখন ফেরেস্তাগণ জবাব দিলেন, হে মাবুদ! তুমি দয়া করে যেটুকু আমাদের শিক্ষা দিয়েছো তার বেশি আমরা জানি না। তখন আল্লাহ আদম (আ) কে প্রতিটি বিষয়ের বর্ণনা দিতে বলেন, আদম (আ) সব প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম হলেন (সংক্ষিপ্ত)। (আল কুরআন, ২:৩১-৩৩) আল্লাহ মানুষের জ্ঞান সম্পর্কে আরও বলেন, নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দিবা-রাত্রির বিবর্তনের মধ্যে আর সমুদ্রে মানুষের উপকারার্থে নৌযান চলাচলের মধ্যে এবং আল্লাহ তায়ালা যে আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন যা দ্বারা মৃত জমিন আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং সব রকম জীবজন্তু ছড়িয়ে পড়ে, আর আবহাওয়া পরিবর্তনের মধ্যে আসমান ও জমিনের মাঝে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালার মধ্যে সমঝদার ও জ্ঞানী লোকদের জন্য উত্তম নিদর্শন রয়েছে। (আল কুরআন, ২:১৬৪) আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, হে রাসূল আপনি বলুন যারা জ্ঞানী ও যারা অজ্ঞ, তারা কি সমান হতে পারে? সেই লোকেরাই অসিয়ত গ্রহণ করে যারা বুদ্ধিমান। (আল কুরআন, ৩৯:৯) মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মহানবী (সা) জ্ঞানচর্চাকে ফরজ হিসেবে বাধ্যতামূলক করেছেন। তিনি বলেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান পুরুষ ও নারীর জন্য ফরজ। যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়, সে আল্লাহর পথে রয়েছে যে পর্যন্ত না সে প্রত্যাবর্তন করে। (তিরমিজি ও দারেম, মেশকাত শরীফ) তিনি আরো বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষা দাও, এটি মানুষকে আল্লাহ ভীতি শিক্ষা দেয়, যে জ্ঞানার্জন করে, সে আল্লাহকে সম্মান করে, যে তা দান করে সে যেন শিক্ষা দেয়, এ জ্ঞান যে ধারণ করে সে সম্মানযোগ্য ও শ্রদ্ধেয়। কারণ বিজ্ঞান মানুষকে ভুল ও পাপ থেকে রক্ষা করে এবং বেহেস্তের পথ আলোকিত করে। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা আমার নিকট অহি পাঠিয়েছেন, যে ব্যক্তি ইলম তলবের উদ্দেশ্যে কোন পথ অবলম্বন করবে, তার জন্য আমি জান্নাতের পথ সহজ করে দেব এবং যে ব্যক্তির দুই চক্ষু আমি নিয়েছি তাকে তার পরিবর্তে আমি জান্নাত দান করব। ইবাদত অধিক হওয়া অপেক্ষা ইলম অধিক হওয়া উত্তম। দীনের তথা ইলম ও আমলের আসল হচ্ছে শোবা-সন্দেহের জিনিস হতে বেঁচে থাকা (বায়হাকী শো’ আবুল ঈমান)। হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মুমিনের মৃত্যুর পরও তার আমল ও নেক কাজসমূহের মধ্যে যার সওয়াব তার নিকট পৌঁছতে থাকবে তা হচ্ছে ইলম, নেক সন্তান এবং সদকায়ে যারিয়াহ্। (মেশকাত শরীফ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) তার মসজিদে (সাহাবীদের) দু’টি মজলিসের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলেন (এক মজলিস দু’আর এবং অপর মজলিস ইল্মের)। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, উভয় মজলিসই ভালো কাজে আছে, তবে এক মজলিস অপর মজলিস হতে উত্তম; যারা দু’আর মজলিসে আছে তারা অবশ্য আল্লাহকে ডাকছে এবং আল্লাহর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের আশা পূর্ণও করতে পারেন আর ইচ্ছা করলে তাদের তা বারণও রাখতে পারেন। কিন্তু অপর দলটি যারা ফিকহ্ বা ইলম শিক্ষা করছে এবং যারা জানে না তাদের শিক্ষা দিচ্ছে; এরাই উত্তম। আর আমিও মু‘আল্লিম বা শিক্ষাদাতা রূপেই প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) এ দলের সাথেই বসে গেলেন। সহীহ-আল বুখারী শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি জ্ঞান আহরণ করে সে প্রচুর লাভ করে, আর যে ব্যক্তি কোন পথচলাকালে জ্ঞান লাভ করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’ আল কুরআনে এ ধরনের অসংখ্য আয়াত ও মহানবী (সা) এর অগণিত হাদিস মুসলিম নর-নারীকে যে শিক্ষা গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে মূলত তারই বাস্তবায়ন মহানবীর শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা সম্প্রসারণে মহানবীর (সা) প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ রিসালাতের দায়িত্ব অর্পিত হবার পর মহানবীর (সা) ওপর দ্বীন প্রচারের অংশ হিসেবে শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা এবং পৃষ্ঠপোষকতাকে বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। ফলে তিনি শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতি-সভ্যতার উন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। হিজরত পরবর্তী জীবনে মহানবী (সা) মসজিদকে মূল শিক্ষায়তন হিসেবে গ্রহণ করে সকল মুসলমানের জন্য শিক্ষা গ্রহণ আবশ্যকীয় করে দিলেও মূলত মক্কায় অবস্থানকালেই নওমুসলিম কিংবা যারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এমন অমুসলিমদের শিক্ষা প্রদানের জন্য সাফা পাহাড়ের পাদদেশে বিশিষ্ট সাহাবী আরকাম বিন আবুল আরকামের বাড়িকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেন। সে হিসেবে দারুল আরকামই ইসলামের প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাসূলুল্লাহ (সা) স্বয়ং এখানে শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত ছিলেন এবং হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা), হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা), হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রা), হযরত আলী ইবনে আবি তালিবসহ (রা) প্রথম শ্রেণীর সাহাবীগণ এখানকার উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন। মদিনায় হিজরতের পূর্বে আকাবার শপথের মাধ্যমে যারা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তাদের প্রশিক্ষিত করতে তিনি হযরত মুসআব ইবনে উমাইরকে মদিনায় প্রেরণ করেছিলেন। মহানবী (সা) এর হিজরতের সময় দারুল আরকামে শিক্ষাদানের জন্য হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম ও মাসআব বিন উমাইরের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। হিজরতের পর মক্কায় অবশিষ্ট মুসলমানদের মধ্যে দারুল আরকামের মাধ্যমেই দাওয়াতে ইসলামের কর্মকাণ্ড জারি রাখা হয়। নবুওয়তের প্রথমদিকে বিশেষত মাক্কী জীবনে ইসলামের বুনিয়াদি জ্ঞান ও ইবাদতের নিয়মকানুন শিক্ষাগ্রহণই পাঠ্যভুক্ত ছিল। এ সময়কার পাঠ্যসূচিতে আল কুরআনকেই প্রধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তা ছাড়া কিছুসংখ্যক সাহাবীকে তিনি পবিত্র কুরআনের লিপিকার হিসেবে দায়িত্ব দেয়ার জন্য তাদেরকে হস্তলিপিবিশারদ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। হজরত উমর (রা) ইসলাম গ্রহণকালে তার বোন ফাতিমার নিকট সূরা ত্ব-হার লিখিত হস্তলিপি পাওয়া গিয়েছিল। হিজরত-উত্তরকালে মহানবী (সা) মসজিদে নববীতে সাহাবীদেরকে শিক্ষা দান করতেন; যা ইতিহাসে ‘মাদ্রাসাতুস সুফফা’ নামে অভিহিত ছিল। দূরদূরান্ত থেকে মুসলমানগণ এখানে এসে শিক্ষা গ্রহণ করে ফিরে গিয়ে স্বগোত্রের লোকদের শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালন করতেন। হাতের লেখা অত্যন্ত সুন্দর হওয়ায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সাঈদকে (রা) মসজিদে নববীর প্রথম শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে উবাদা ইবনে সামিত (রা) শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বদরের যুদ্ধের যুদ্ধবন্দীদের ‘প্রতিজন যুদ্ধবন্দীর মুক্তির জন্য ১০ জন মুসলমানকে শিক্ষা দেয়ার শর্তে মুক্তি’ দিয়ে তাদেরকেও শিক্ষক হিসেবে কাজে লাগান। তারা মূলত অক্ষর জ্ঞান তথা ভাষাজ্ঞান তৈরিতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতো। প্রথম দিকে এখানকার ছাত্রসংখ্যা ছিল মাত্র কুড়ি থেকে পঁচিশজন। পরবর্তীতে এ সংখ্যা অনেকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। মহানবীর (সা) যুগের যে কয়জন ক্বারী, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, মুফতি, ফকিহর সন্ধান পাওয়া যায় তারা এ শিক্ষায়তনেরই ছাত্র ছিলেন। মাদ্রাসাতুস সুফফার সঠিক নিয়মে পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানের জন্য মহানবী (সা) একজন আরিফ বা তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। হযরত আবু বকর (রা) এ মহান দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন সময়ে তার অনুপস্থিতিতে হযরত ওয়াছেলা ইবনে আশফা (রা) ও মুয়াজ ইবনে জাবালকে (রা) এ দায়িত্ব দেয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের খাওয়া-পরার জন্য শহরের সচ্ছল ব্যক্তিদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হতো। তবে সেখানকার শিক্ষার্থীরা অনেকেই অন্যের সাহায্য নিতে পছন্দ করতেন না। তারা কাঠ কেটে, পানি সরবরাহ করে এবং ছোটখাটো ব্যবসায় নিয়োজিত থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে লেখাপড়া করতেন। এমনকি তারা অন্যজনের খরচ নির্বাহের ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করতেন। মসজিদে নববী ছাড়াও সেই সময় মদিনায় কয়েকটি স্থানে মসজিদভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ইসলামের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদানের ইতিহাস পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ মসজিদ-ই-বনি যুরায়েখ, মোকামে কুবা মসজিদ, নকিমুল খাজামাত এবং মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থানের গামীমের তালিমি মাদ্রাসা। মহানবী (সা) স্বয়ং এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতেন। মসজিদে কুবায় তিনি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই গমন করতেন। শিক্ষার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পাঠ্যসূচির প্রয়োজন। এ দিক বিবেচনায় মহানবী (সা) একটি সমন্বিত সিলেবাস নির্ধারণ করেন। তিনি ইসলামী শিক্ষার জন্য মহাগ্রন্থ আল কুরআন শিক্ষার সাথে সাথে আকাইদ ও ইবাদতের নিয়ম-কানুন, স্বাস্থ্যশিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শিক্ষা, রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মনীতি, জীববিদ্যা, প্রকৃতিবিদ্যা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র আকাশ বাতাস প্রভৃতির সমন্বয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক বিষয়ক নানা ধরনের শিক্ষা প্রদান করতেন। সাহাবীগণ শিক্ষাকে অত্যাবশ্যকীয় বা ফরজ ইবাদত জ্ঞান করে এর প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দিতেন। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যে আগ্রহ উদ্দীপনা এবং মধুর সম্পর্ক বিরাজ করতো। তারা অল্প সময়ের মধ্যে পবিত্র কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি সাহিত্য, উত্তরাধিকারী আইন, চিকিৎসা বিদ্যা, ফিকহ, তাজবিদ, দর্শনসহ সময়োপযোগী পণ্য বিপণনপ্রক্রিয়াও রপ্ত করতে পারতো। যুদ্ধবিদ্যা ও সমরাস্ত্র তৈরিতেও তারা পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। সাহাবীগণের মধ্যে কয়েকজন সাহাবী বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক পাণ্ডিত্য লাভ করেন। বিশেষকরে হযরত যায়িদ বিন সাবিত (রা) ফারায়িজ শাস্ত্র বা উত্তরাধিকারী আইন, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) তাফসির শাস্ত্র, হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা) সাহিত্য ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। গ্রিক, কিবতি, ফারসি, হিব্র“, ইথিওপীয় প্রভৃতি বিদেশী ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রেও মহানবী (সা) ব্যাপক গুরুত্ব প্রদান করতেন। নারী শিক্ষাকে মহানবী (সা) সমভাবে গুরুত্ব প্রদান করতেন। পুরুষদের মতো মহিলাদেরও জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছেন। হিজরতের পরে তিনি সপ্তাহে একদিন শুধুমাত্র মহিলাদের শিক্ষা-দীক্ষার জন্য সময় দিতেন। মহিলাদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি নানা প্রশ্নের জবাবও দিতেন তিনি। উম্মুল মুমিনীন আয়শা (রা), হাফসা (রা), উম্মে সালমাসহ (রা) অনেক মহিলা সাহাবীকে তিনি উঁচুমানের শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন। তারা পবিত্র কুরআন হিফযসহ মানব জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। মহানবীর (সা) ওফাতের পরেও তারা শিক্ষা-সংস্কৃতির সম্প্রসারণে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। পরিশেষে বলা যায়, মহানবী (সা) এর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল একটি মৌলিক রেখাচিত্র। সেই চিত্রের সীমারেখা ছুঁয়ে খোলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে তা আরো সময়োপযোগী হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) এর অনুকরণে মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা আরও সম্প্রসারিত করেন। আল কুরআনের বিশুদ্ধ চর্চার জন্য তিনি পাথর, কাপড়, কাঠ, চামড়া ও গাছের পাতায় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় লিপিবদ্ধ আল কুরআনের পাণ্ডুলিপিসমূহকে যায়েদ বিন সাবিতের মাধ্যমে সুবিন্যস্ত করে একটি মাসহাফ তৈরির ব্যবস্থা করেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) আল কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সহযোগী হিসেবে আরবি কবিতা পাঠের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। আল কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার প্রসারকল্পে তিনি মক্কা ও মদিনা ছাড়াও বসরা, কুফা, দামেস্ক, ফুসতাত, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি অঞ্চলে অসংখ্য শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। তার শাসনামলেই শিক্ষকগণকে বায়তুলমাল থেকে ভাতা প্রদান করা হয়। হযরত ওসমান (রাা) মক্কা, মদিনা, কুফা, বসরা, আলেপ্পো, হিম্স প্রভৃতি স্থানে র্দাস প্রদানের জন্য নতুন নতুন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। এ সময় বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে সাম্রাজ্যের জ্ঞানী ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতো। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা) মহানবী (সা) এর অহি লেখক, ব্যক্তিগত সেক্রেটারি এবং একজন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী শিক্ষা গ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করেন। হযরত আলীর (রা) আমলেই বসরা ও কুফাতে ব্যাপকভাবে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। তখন মক্কা ও মদিনার র্দাসগাহসমূহে কেবল কুরআন ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা) এর শিক্ষাই দেয়া হতো। কিন্তু কুফা ও বসরাতে আরবি ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব ও দর্শনের চর্চাসহ হস্তলিপি, আবৃত্তি ও কাব্যচর্চার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগে সাধারণ সাহাবী থেকে শুরু করে সরকারি কর্মচারী, এমনকি ইসলামী সাম্রাজ্যের খলিফা পর্যন্ত যখন যেখানে গিয়েছিলেন, সেখানেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষার জন্য তারা রাজকোষ থেকে প্রচুর অর্থও ব্যয় করেছেন। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতকালে আল কুরআন, হাদিস, আরবি কাব্য, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, ফিকহ, তাসাউফ, মানতিক, ভূগোল, রসায়ন, জোতির্বিদ্যা, গণিত, প্রাণিতত্ত্ব, স্থাপত্য শিল্প, চিকিৎসাশাস্ত্র ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ব্যাপক উৎকর্ষ সাধিত হয়। সুতরাং মহানবীর (সা) শিক্ষাপদ্ধতি ছিল যুগোপযুগী একটি মডেল। সময়ের সাথে সাথে তা বিকশিত হয়ে শুধু ইউরোপ নয় গোটা বিশ্বকেই আলোকিত করেছিল। কিন্তু আজ দুর্ভাগা মুসলিম জাতি সে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আধুনিকতার মোড়কে জাহিলিয়াতকেই বরণ করে নিচ্ছে। তাই আবারো আহ্বান, পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির