post

মহানবী সা. ও বিশ্বসংস্কৃতি

শেখ আবুল কাশেম মিঠুন

৩১ ডিসেম্বর ২০১৫
আমরা জানি অজ্ঞতা এবং অশিক্ষা মানুষকে প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ও ক্ষমতাধরদের আজ্ঞাবহ করে রাখে। অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার ফলে মানুষের মানসিক বিকাশ সাধিত হয় না, চিন্তাধারা প্রসারিত হয় না এবং নৈতিক বলবীর্য হারিয়ে মানুষ নিজেকেই বস্তুসদৃশ করে তোলে। অর্থবিত্তের লোভ, চোখরাঙানি, দাপট অথবা আদর-ভালোবাসা, মমতা দিয়ে তাকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। অজ্ঞ ও অশিক্ষিত মানুষের বহুবিধ পাওয়া না পাওয়ার অতি আবেগগ্রস্ত মনস্তাত্ত্বিকতাই ব্যক্তি পূজার জন্ম দেয়। অর্থ, দাপট অথবা ভালোবাসা প্রেম দিয়েও যা পাওয়া যায় না- সেই ‘পূজা’ পাওয়ার জন্য ধুরন্ধর ক্ষমতাধররা পূজারির অন্তরাত্মায় বসবাসের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এবং দয়া-দাক্ষিণ্য ও অতিমানবিক আবেদনের বিভিন্ন আঙ্গিকের অভিনয় দিয়ে একটা দেবত্বের স্বরূপ তার অন্তরে মুদ্রিত করে রাখতে প্রয়াস পায়। অতি কাছের তোষামোদি চক্র তাতে বাতাস করে নরমকে শক্ত অথবা গরমকে ঠান্ডা করে তোলে। অন্যদিকে হিংস্র বর্বর খুনপিয়াসী মানুষকেও অশিক্ষিত অজ্ঞ লোক পূজা করে প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার শক্তি সরবরাহের অস্ত্র হিসেবে। এরূপভাবে অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তি এবং ধুরন্ধর ক্ষমতাধরদের সমন্বয়েই মূর্তিপূজার উদ্ভব হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ ও গবেষক আল বিরুনী মূর্তিপূজার উদ্ভব সম্পর্কে তার বিশ্ববিখ্যাত ‘ভারত-তত্ত্ব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমাদের পয়গম্বর ও কাবাগৃহের যদি একটি ছবি বানানো হয় এবং কোন অশিক্ষিত নারী এবং পুরুষের সামনে তা পেশ করা হয় তাহলে তা দেখে তো তারা আহ্লাদিত হবেই। সেই সাথে সেই ছবিতে তারা চুমু খাবে, তাকে গালে গলায় সব জায়গায় রেখে আদর করবে এবং সমানে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, যেন তারা কোন ছবি দেখছে না বরং মূল ব্যক্তিকেই দর্শন করছে এবং এমন অনুভব করবে যেন মক্কা-মদিনায় হজের ছোট-বড় হুকুম-আহকামগুলো পালন করছে। ...এটাই তাকে মূর্তি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে আর কিছু অত্যধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি পয়গম্বর, মুনি-ঋষি, ফেরেশতা ইত্যাদির সম্মানে স্মারক (ভাস্কর্য) নির্মাণ করে, যার উদ্দেশ্য অনুপস্থিতির সময়ে বা মরণের পরে তাদের স্মৃতি নিয়ে মানুষের মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে দেয়া। ...এভাবে তাদের চিত্র ও স্মৃতি চিহ্নগুলিকে (ভাস্কর্য) সম্মান করাটা তাদের ধর্মবিশ্বাসের অনিবার্য অঙ্গ বানিয়ে দেয়া হয়।” আল-বিরুনী আরো লিখেছেন; ‘‘...এ ধরনের ধ্যাণ-ধারণা কেবল অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে। ...যারা মুক্তি পথের পথিক বা যারা দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে এবং যারা বিমূর্ত সত্যকে লাভ করতে ইচ্ছুক যাকে তারা ‘সারসত্তা’ বলে, তারা ইশ্বর ছাড়া আর কারোরই উপাসনা করে না। আর তারা ঐ ইশ্বরকে মূর্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করে তার উপাসনা করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।” হিন্দুরা বলে যে নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে মূর্তি নির্মাণ ও পূজা শুরু হয়েছে- ‘ইন্দ্র রাজা অম্বরীশকে বলেছিলেন, যখন মানবসুলভ বিস্মরণশীলতা তোমাকে অভিভূত করে তখন তোমাকে নিজের জন্য এমন একটি প্রতিমা বানিয়ে নেয়া উচিত যেমনটি আমি তোমার ওপর প্রকাশ করেছিলাম, মূর্তিবেদির ওপর সুগন্ধ ও ফুল ছড়িয়ে তেমনই তুমি আমাকে আরাধনা করবে। এভাবে তুমি আমাকে স্মরণ করবে।” উপরোক্ত বিবরণগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় অজ্ঞতা ও অশিক্ষার ফলে মানুষ অন্তর্নিহিত সত্যের দিকে ধাবিত না হয়ে প্রকাশমান রূপে ঝলক ও চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা অনুসরণ ও অনুকরণ করে। সত্যের দিকে অগ্রসর না হওয়ার কারণে মানুষ অত্যধিক কল্পনাপ্রবণ, সঙ্কীর্ণ মানসিকতা এবং স্বার্থান্ধ হয়ে ওঠে। আর এই দোষগুলোর ভিত্তি হলো অহঙ্কার। অহঙ্কার মানুষকে স্বার্থ উদ্ধারকারী ব্যক্তিকে পূজা করতে শেখায় এবং যে স্বার্থ উদ্ধারকারী নয় সে যতই সত্যপথের পথিক হোক বা মহামানব হোক তাকে তারা সহ্য করতে পারে না। অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার কারণে মানুষ যাতে পথভ্রষ্ট না হয়, হানাহানি না করে, ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী না হয় সে জন্য আল্লাহ তাআলা প্রথম সৃষ্ট মানুষকে নবী হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন। নবীর মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর করে করণীয় কাজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অবহিত করেন। প্রথম মানুষ আল্লাহর নবী হজরত আদম (আ) কে দুনিয়াতে পাঠাবার সময়েই আল্লাহ বলেছিলেন- “আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও, তবে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে (আইন ব্যবস্থা সম্পর্কিত) হেদায়াত আসবে, অতঃপর যে আমার বিধান মেনে চলবে তার কোন ভয় নেই, তাদের কোনো প্রকার উৎকণ্ঠিত হতে হবে না। আর যারা (আমার আইন কানুন) অস্বীকার করবে এবং আমার আয়াতসমূহ মিথ্যা প্রতিপন্ন (করে লাগামহীন জীবন যাপন) করবে তারা অবশ্যই জাহান্নামের বাসিন্দা হবে, তারা সেখানে চিরদিন থাকবে।” (সূরা আল-বাকারাহ : ৩৮-৩৯) এইভাবে আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে মানুষ পাঠিয়ে তাঁর হেদায়েত দিয়ে মানুষের অজ্ঞতা দূর করেছেন। অজ্ঞতা ও অশিক্ষা একটি অভিশাপ-একটি ভয়াবহ মারাত্মক অপরাধ। এখানে অজ্ঞতা ও অশিক্ষা বলতে এটা নয় যে, ‘আমি ডাক্তারি বিদ্যা জানি না তাই আমি অভিশপ্ত বা অপরাধী। অথবা আমি দীর্ঘ জীবন একজন পারিবারিক সদস্য হয়েও রন্ধনপ্রণালী জানি না তাই আমি অভিশপ্ত বা অপরাধী।’ বিষয়টি মোটেই তা নয়। অজ্ঞতা ও অশিক্ষা হচ্ছে এমন বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও জ্ঞান থাকলে মানুষ আর অজ্ঞ থাকে না। তার অন্তর্লোক কষ্টিপাথরের মতো সঠিক স্বর্ণ চিনে নিতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত বস্তুগত সমাহারে সে নিজের চিন্তা ও কর্মকে কিভাবে পরিচালিত করবে সে বিষয়ে জ্ঞান। সেই জ্ঞানই মানুষকে সঠিক পথে চলার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়। সঠিক মানুষ চেনার মনশ্চক্ষু খুলে দেয়। হযরত আলী (রা) বলেছেন ‘‘কোন বস্তু বা মানুষকে দিয়ে সত্য বিচার করো না, আগে সত্যকে জানো সঠিক বস্তু বা সঠিক মানুষ আপনাতেই তোমার চোখে ভাস্বর হয়ে উঠবে।’’ সেই জ্ঞান হচ্ছে (ক) মানুষের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক কি! অর্থাৎ তৌহিদ সম্পর্কে জ্ঞান। (খ) পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা কি, সৃষ্টিকর্তা কি কি কাজের জন্য তাকে সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা, এসব জ্ঞান নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা শিক্ষা দিয়েছেন, অর্থাৎ রিসালাত সম্পর্কে জ্ঞান। (গ) এই পৃথিবীতে মানুষ যে সব চিন্তাপদ্ধতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে এবং তারই আলোকে কর্ম সম্পাদন করবে মৃত্যুর পর স্রষ্টা তারই আলোকে বিচার ফয়সালা করবেন। মানুষ তখন ভালো কাজের ভালো ফল, খারাপ কাজের খারাপ ফল পাবে। অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে জ্ঞান। তৌহিদ, রিসালাত ও আখেরাত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা মানুষের জন্য ফরজে আইন। পৃথিবীর বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষকে আল্লাহতায়ালা উক্ত জ্ঞান অর্জন করার কঠোর তাগাদা দিয়েছেন। এই জ্ঞান অর্জন না করলে মানুষ তার কাজ কর্মে ভুল করবে, ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে, স্বার্থান্ধ হবে, অন্য মানুষকে অমানবিক ভাবে ব্যবহার করবে, বস্তুর অকল্যাণকর ব্যবহার করবে এবং নৈতিক চরিত্র হারিয়ে অপরাধী কর্মে লিপ্ত হবে। তাই ফরজে আইনবিষয়ক উক্ত জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। নবী-রাসূলদের উম্মতগণ উত্তরাধিকার সূত্রে উক্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ। তাই অন্যের কাছে এই জ্ঞান কথার মাধ্যমে লেখনীর মাধ্যমে এবং আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া মুসলমানদের জন্য ফরজে আইন। যাদের কাছে উক্ত জ্ঞান আছে এবং সরল বিশ্বাসে খুশিমনে যারা তা মান্য করে ও পালন করে তারাই মুসলমান নামে অভিহিত। আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছেন- “এখন দুনিয়ার সেই সর্বোত্তম দল তোমরা যাহাদিগকে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কার বিধানের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে, তোমরা ন্যায় ও সৎকাজের আদেশ করো, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখিয়া চলো।’’- মুসলমানরাই আল্লাহর দেয়া আইন বিধান প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়াতে কল্যাণ স্থাপন করতে পারে। অন্য মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা অথবা তৌহিদ রিসালাত ও আখেরাতের খবর পৌঁছে দেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজে আইন। যাতে কেয়ামতে অপরাধী ব্যক্তি বলতে না পারে যে উক্ত জ্ঞান তো আমাদের কাছে ছিল না তাই আমরা অপরাধ করেছি।” (সূরা আলে ইমরান-১১০) আল্লাহতাআলা এ বিষয়টিও পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন- “আল্লাহ তায়ালা নবীদেরকে সুসংবাদ প্রদানকারী এবং পরিণতির ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছেন, যাতে করে মানুষ তার কাছে এরূপ বিতর্ক তোলার সুযোগ না পায় যে আমরা তো বেখবর ছিলাম। আর আল্লাহ সর্বাবস্থায়ই প্রবল পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন-নিসা-১৬৫) এখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে মানুষকে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে অন্ধকারে আল্লাহ ছেড়ে দেননি বা ফেলে রাখেননি। তাকে সঠিক পথ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তার মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেছেন, তার করণীয় সম্পর্কে জ্ঞাত করেছেন। প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী সা. পর্যন্ত যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা নবী পাঠিয়ে মানুষকে সম্পূর্ণভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ সা. শেষ নবী হওয়ার তাৎপর্য তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন-“পূর্ববর্তী নবীগণের  মধ্যে আমার উপমা সেই ব্যক্তির ন্যায় যে একটি সুরম্য পূর্ণাঙ্গ ও সুশোভিত প্রাসাদ নির্মাণ করলো কিন্তু একটি ইটের স্থান পরিত্যক্ত (অসম্পূর্ণ রেখে) দিল। জনতা প্রাসাদটি প্রদক্ষিণ করতো এবং তাতে বিস্মিত হয়ে বলতো তার নির্মাতা যদি ঐ ইটের স্থানটি পূর্ণ করতো। অতএব আমি নবীগণের মধ্যে সেই ইটের স্থান সমতুল্য।’’-উবাই ইবনে কাব (রা) বর্ণিত। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার উন্মেষ ঘটে গেছে, আবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতিক স্বরূপ একটা নির্দিষ্ট অবয়ব পেয়েছে। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতি নিয়মের অধীনে একটি কল্যাণময় পৃথিবী তৈরি করতে হলে হযরত মুহাম্মদ সা. আনীত কুরআন এবং তার দেখানো পথ অনুসরণ করলেই তা সম্ভব। আর নতুন কোন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদ্ভব হবে না সেটা নয় তবে যা-ই ঘটুক তা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতেই সঠিক পথে চালনা করা সম্ভব। বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির স্বরূপ বিচার করতে হলে নবীর সা. আগমনের প্রাক্কালে পৃথিবীর রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির রূপ কেমন ছিল তা আমাদের সামনে থাকা দরকার। স্মরণ রাখা দরকার যে আল্লাহ তাআলার পাঠানো নবী ও রাসূলরা যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন তা মানুষ এক সময় বিকৃত করে ফেলেছে, জনপদ আবার অকল্যাণের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, তখনই আল্লাহ তাআলা নবী পাঠিয়েছেন, এইভাবে লক্ষ লক্ষ নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে। আর তাদের আনীত আইন ব্যবস্থাও বিলুপ্ত হয়েছে। শেষ নবী সা. যখন আগমন করেন তখন সমস্ত পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ছিল এব বিকৃতির শিকার। পরিবার সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থব্যবস্থা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সংস্কৃতি ছিল অমানবিক ও অশ্লীল পন্থার অনুসারী। আজকের  পৃথিবীতে যত জনগোষ্ঠী বিদ্যমান তাদের মধ্যে যতটুকু কল্যাণ ও মানবিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করা যায় তা একমাত্র ইসলামেরই অবদান এটা অকাট্যভাবে সত্য। শেষ নবী সা. আনীত জ্ঞান উপযুক্ত মানুষের মাধ্যমে সার্বিকভাবে অর্থাৎ সত্যিকার মুসলমানদের ছাড়া কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পৌঁছানোর অব্যাহত চেষ্টা থাকবে বলেই নতুন করে নবী পাঠানোর কোন যুক্তি থাকে না, আর তাই কোন নবীর আগমন ঘটবে না। নবী সা. আগমনের প্রাক্কালে ভারতবর্ষ, আফ্রিকা, এশিয়া  ও ইউরোপের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ অবস্থান নির্ণয় এবং বিশ্লেষণ করার সুযোগ আলোচ্য প্রবন্ধে নেই তবে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের খোদ মক্কানগরীতে রাসূলের সা. একটি ঘটনা তাবৎ মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরে। মদিনার খাযরাজ গোত্রের একজন নেতা নাম আসআদ বিন যুরারাহ মক্কায় গেল কুরাইশদের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য নেবার জন্য, যাতে মদিনায় তাদের দুশমন আওস গোত্রকে পদানত করতে পারে। আসআদ কুরাইশ নেতা উতবাহ বিন রাবিয়ার বাড়িতে গেল। উতবাহ বললো, আমরা তোমাকে কোন সাহায্য আপাতত করতে পারবো না, কারণ এক কঠিন সমস্যায় পড়েছি আমরা। আমাদেরই এক ব্যক্তি (রাসূল সা) আমাদের উপাস্যদের সম্পর্কে কটূক্তি করছে। মিষ্টি মধুর ব্যবহার আর ভাষা দিয়ে আমাদের একদল যুবককে তার দলে ভিড়িয়েছে। এভাবে সে আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। হজের মৌসুমে আগত লোকদেরকে সে তার ধর্মের দিকে আহ্বান জানায়। এসব নিয়ে আমরা খুব বিপদে আছি। আসআদ অগত্যা মদিনায় ফিরে যাবার মনস্থ করে। কিন্তু কাবা তাওয়াফ ও জিয়ারত না করে মদিনায় ফিরে যাওয়া শোভনীয় নয়। যদিও উতবাহ বলেছে কাবাঘর জিয়ারত করতে গেলে লোকটির (রাসূল সা) কথা শুনে তুমি কিন্তু বদলে যেতে পার। তাই কাবা জিয়ারত করতে গেলে কানের ভেতর তুলো দিয়ে রেখো। আসআদ মসজিদুল হারামে যায়- তাওয়াফ করার সময় মহানবীকে সা. দেখেন যে তিনি হুজরতে ইসমাঈলে বসে আছেন। সে তাঁর সামনে গেল না। কিন্তু শেষে কৌতূহল দমন করতে না পেরে মহানবী সা. এর সামনে গিয়ে-আরবদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সম্ভাষণ জানালো- ‘‘আপনার প্রাতঃকাল মঙ্গলময় হোক”।- সম্ভাষণটি যদি আমাদের রেডিও, টিভি ও চ্যানেলের সম্ভাষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় তবে আমাদের বর্তমান সময়ের সংস্কৃতি ও সে সময়ের আরবদের সংস্কৃতির একটা সেতুবন্ধ আমরা খুঁজে পাই। আমাদের সংস্কৃতির এখন যারা বাহক বলে দাবি করেন তাদের বিশ্বাস, তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি বুদ্ধিবৃত্তিও এ সবের সংস্কৃতির স্বরূপ জাহিলি সংস্কৃতির আধুনিক সংস্করণ ছাড়া কিছুই নয়। সুদ, জুয়া, মদ, অশ্লীলতা, বর্ণপ্রথা, শোষণ-শাসন পদ্ধতি সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ তাদের সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। যাই হোক-আসআদের সম্ভাষণের জবাবে মহানবী সা. বললেন, ‘‘আমার মহান প্রভু আল্লাহ এর চেয়ে উত্তম সম্ভাষণ ও সালাম অবতীর্ণ করেছেন। আর তা হচ্ছে, ‘‘আসসালামু আলাইকুম”- আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আসআদ আকৃষ্ট হলো। সে মহানবীর সা. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। মহানবী সা. সূরা আনআমের ১৫১ ও ১৫২ নম্বর আয়াত পড়ে শোনালেন। আসআদের অন্তরে তা গভীর প্রভাব বিস্তার করলো এবং তিনি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন। আসআদ (রা) কেন ইসলাম গ্রহণ করলেন? কি ছিল দু’টি আয়াতের মধ্যে? তাঁর নিজের জীবন, মন-মস্তিষ্ক, তাঁর রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি কোনখাতে প্রবাহিত হচ্ছিল? হঠাৎ তার গতি পরিবর্তন হলো কেন? এসবের জবাব হয়তো ব্যাপক বিস্তৃত। কিন্তু সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে প্রবেশ করা। উক্ত আয়াতে ছিল- ‘‘তোমার সবকিছুর মালিক, রব, প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ- তাঁর কোন শরিক নেই, তোমরা শিরক করো না।’’ অর্থাৎ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীর জনবসতি তখন শিরকে লিপ্ত ছিল। আর এর একমাত্র কারণ ছিল অজ্ঞতা ও অশিক্ষা। আয়াতের মধ্যে আরো ছিল, ‘‘তোমাদের পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। আমাদের জেনে রাখতে  হবে-যখন একটা বিষয়ের অনুপস্থিতি থাকে তখনই বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়।’’ অর্থাৎ পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ তখনকার পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল। উক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন, ‘‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমরা তোমাদেরকে এবং তাদেরকে জীবিকা দান করি। তোমরা গোপন ও প্রকাশ্য পাপাচারের নিকটবর্তী হয়ো না।’’ এ ছাড়াও রয়েছে অন্যায় হত্যা নিষিদ্ধকরণ, অনাথের সম্পত্তি হস্তগত না করা, ন্যায়পরায়ণতার সাথে ওজন করা, নিকটাত্মীয় হলেও ন্যায্য কথা বলা, আল্লাহর সাথে যে অঙ্গীকার (অর্থাৎ আল্লাহর আইন বিধান মেনে চলা) পূর্ণ করা ইত্যাদি। একটি সূর্যই সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করে। তেমনি আল্লাহতায়ালার হেদায়াত বাণী সূর্যের আলোর চেয়েও চিরন্তন চিরভাস্বর-সমস্ত জনগোষ্ঠীর অন্ধকার জীবনে আলোস্বরূপ। তাই অন্ধকারের বাসিন্দা আসআদ (রা) আলোর সন্ধান পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ত্যাগ করলেন। মহানবীর সা. আগমনের পূর্ব থেকেই সমস্ত পৃথিবীর অবস্থা তৎকালীন আরবদের চেয়ে কোন অংশে কম জাহিলি ছিল না। বরং কোন কোন জনপদে আরো বীভৎস ভয়ঙ্কর অবস্থা বিদ্যমান ছিল। যেমন সমগ্র আফ্রিকার মানুষ মানুষের গোশত খেত। দাস ব্যবসা ছিল অবারিত। বেশিরভাগ এলাকার মানুষ উলঙ্গ থাকতো। তাদের আচার আচরণ ছিল অসভ্য বর্বরসুলভ। নোংরামি ছিল তাদের সহজাত। মাত্র তিনশত বছর পূর্বেও তাদের অবস্থা এমন ছিল কিন্তু ইসলাম প্রবেশের পর তাদের জীবনধারা বদলে যায়। জনৈক ইউরোপীয় পর্যটকের উদ্বৃতি মাওলানা মওদূদী (রহ) উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমি (পর্যটক) যখন মধ্য সুদানের নিকট পৌঁছলাম তখন উপজাতীয় গোত্রগুলোর জীবনে আমি প্রগতির নিদর্শনাবলি দেখতে পেলাম, যা দেখে আমার ধারণা পাল্টে যেতে লাগলো। আমি দেখলাম, সেখানে মানুষ খাওয়ার প্রবণতা নেই, মুর্তিপূজারও অস্তিত্ব নেই, মদখোরি নেশাখোরিও বিলুপ্ত প্রায়। সকল গোত্রের লোক কাপড় পরে। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার ও পবিত্র রাখে এবং আচার আচরণে ভদ্রতা রক্ষা করে। ... নিগ্রো প্রকৃতি যেন কোন উন্নততর প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে আর এ সবই হচ্ছে ইসলামের কল্যাণে। ‘লোকোজা’ নামক জায়গাটা অতিক্রম করার পর আমি ইসলামী প্রচার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছলাম এবং সেখানে এক অতি উচ্চাঙ্গের শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রশাসন সক্রিয় দেখলাম। চারদিকের লোকবসতিতে সর্বত্র সভ্যতার নিদর্শন পরিস্ফুট। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কারিগরির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে এবং আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন একটি সুসভ্য দেশে এসে উপস্থিত হয়েছি। শুধু সুদান নয়, সমগ্র আফ্রিকার সেনেগাল, গায়েনা, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, লাগোস, ঘানা, নাইজেরিয়া ইত্যাদি এলাকার জনবসতি ইসলামের আইনের আলোয় আলোকিত হয়েছে।’’ সমগ্র চীনে ছিল প্রকৃতি পূজা, পুরোহিত পূজা, পূর্বপুরুষ পূজা। পরবর্তীদের বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে চীনের জনসমষ্টি নাস্তিক হয়ে পড়ে। বুদ্ধের মূর্তি পূজাই ছিল তাদের সারধর্ম। বনু উমাইয়ার যুগে চীনে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। ১৩ শতকে মার্কোপেলো লিখেছেন, ‘প্রায় সমগ্র উনান প্রদেশে মুসলমান হয়ে গেছে।’ দক্ষিণ চীন সম্পর্কে ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘সব শহরগুলোতে মুসলিম মহল্লা রয়েছে’। ১৫শ শতকে আলী আকবর নামক জনৈক মুসলিম বণিক লিখেছেন যে, পিকিং এ (বেইজিং) প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলিম পরিবার বাস করে। মালয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে পৌত্তলিকতা ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। জাভা দ্বীপ, সুমাত্রা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মরক্কো দীপপুঞ্জ, বোর্নিও দ্বীপ, ফিলিপাইন, নিউগিনি- এ সব এলাকায় পৌত্তলিকতার অভিশপ্ত জনপদ ছিল, কোথাও ছিল হিন্দু পৌত্তলিকতা, কোথাও ছিল ‘যিশু ও মেরি’ পৌত্তলিকতা। আর শিরকউদ্ভূত যাবতীয় সঙ্কীর্ণতা, বর্ণপ্রথা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অশ্লীলতা, অবিচার অনাচার তার শিকড় বিস্তার করেছিল সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভারতবর্ষে কথা তো সবার জানা-অসভ্যতা আর অপসংস্কৃতি ভারতীয় জনপদকে অমানবিকতার নিকৃষ্ট স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। চুরির অপরাধে এক এক জাতিগোষ্ঠীর এক এক শাস্তির বিধান ছিল। এখানেও বর্ণবাদ মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়েছিল। হত্যার অপরাধেও বর্ণভেদে শাস্তির বিধান ছিল। ব্রাহ্মণের শাস্তি ছিল-তাকে অন্ধ করে দেয়া হতো। ক্ষত্রিয়দেরকে অন্ধ করা হতো না, তাদেরকে বিকলাঙ্গ করা হতো। শূদ্র, বৈশ্য এবং অন্য জাতিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। ব্যভিচারিণীকে দেশ ছাড়া করা হতো। যুদ্ধবন্দীরা দেশে ফিরলে তাদেরকে কয়েকদিন উপবাস রাখা হতো, তারপর গোবর, গোমূত্র ও গো-দুগ্ধ খাওয়ানো হতো। এতেই অনেকে বমি করতে করতে মারা যেত। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং প্রজাদের বশীভূত করার জন্য রাজানার প্রচলন করেন। বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধকরণও সহমরণ প্রচলিত ছিল। সন্তানের জাত বিচার হতো মায়ের দিক থেকে। ধর্মগ্রন্থ পাঠ বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কেউ পাঠ করলে তার জিহ্বা কেটে দেয়া হতো, কেউ শুনলে তার কানে গরম সীসা ঢেলে হত্যা করা হতো। তারা শরীরে কোন অংশের কেশ মুন্ডন করতো না। স্ত্রী সহবাসের পূর্বে গোসল করতো। তারা ঘরে প্রবেশের অনুমতি নিত না, কিন্তু বেরোনোর সময় অনুমতি নিত। থুথু ফেলা বা নাক ঝাড়ার সময় আশপাশের লোকদের পরোয়া করতো না। তারা তাদের পুস্তকের শিরোনাম গ্রন্থের শুরুতে দেয় না নিচে দেয়। মৃতের ব্যাপারে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতো তারাও ধারণা করে যে মৃত্যুর আত্মা মৃতের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। নারীকে তারা দাসী হিসেবে গণ্য করত। হিন্দুশাস্ত্রকার মনু বলেন, “মন্ত্র দ্বারা স্ত্রীলোকের সংস্কার হয় না এ কারণে তাদের অন্তঃকরণ নির্মল হতে পারে না।” তৎকালীন পৃথিবীতে পারস্য (ইরান-ইরাক) বিবেচিত ছিল সভ্যতার উচ্চভূমি হিসেবে। তাদের ধর্ম ছিল অগ্নিপূজা, মূর্তি পূজা, প্রকৃতি পূজা ইত্যাদি। সমাজ ছিল নিষ্ঠুর শ্রেণীবৈষম্যের শিকার। সম্পদের মালিকানা এবং স্বত্বাধিকার সাতটি পরিবার বা বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ জনগণ ছিল বঞ্চিত। অভিজাত সাতটি পরিবার শিক্ষাগ্রহণের অধিকার রাখত। সাধারণ জনগণ শিক্ষালাভের অধিকার থেকে ছিল বঞ্চিত। সম্রাট খসরু পারভেজের ছিল তিন হাজার স্ত্রী, বারো হাজার গায়িকা দাসী। এ ছাড়াও তার হেরেমে কয়েক হাজার নারী, দাসী ও নর্তকী ছিল। পারস্য এবং রোম বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। এ ছাড়াও ছিল অভ্যন্তরীণ কোন্দল, যার পরিণতিতে চার বছরের মধ্যে চৌদ্দ বার ক্ষমতা বদল হবার ইতিহাসেও রয়েছে। প্রশাসনের ইতিহাস হত্যার ইতিহাস। পুত্র পিতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসে। সম্রাট খসরুর চল্লিশ জন পুত্রসন্তানকে হত্যা করে শীরাভেই নামক সম্রাট। তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। ইহুদিরা ছিল রোমের ঘোর শত্রু। রোমে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড সংঘটিত হতো। ইহুদিরা একবার ইরান থেকে আশি হাজার খ্রিষ্টানকে ক্রয় করে দুম্বার মতো জবাই করেছিল। রোম সাম্রাজ্য খ্রিষ্টে বিশ্বাসী হলেও তারা মূলত যিশুর মূর্তি পূজা করতো। তাদের সমাজবন্ধন একেবারেই শিথিল হয়ে গিয়েছিল, দুর্নীতি ও কুসংস্কারে ডুবে গিয়েছিল। অশ্লীলতা ও পাপপঙ্কিলতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল রোম সাম্রাজ্য। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে শাসকবৃন্দ সিংহের খাঁচায় ফেলে দিয়ে তার নারকীয় বীভৎস মৃত্যু দর্শন করে তৃপ্ত হতো। সে সময়ে ইউরোপের অবস্থা শুধুমাত্র একটি উদাহরণেই যথেষ্ট মনে হবে। প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ফ্লামারিয়োন ইউরোপের একটি পুস্তকের কথা উল্লেখ করেছেন যেটি চারশ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ইউরোপে পঠিত হতো। উক্ত পুস্তকে আলোচনা হয়েছে- “একটি সুইয়ের অগ্রভাগের সরু ছিদ্রের মধ্যে কতজন ফেরেস্তা অবস্থান করতে পারে।” আর একটি আলোচনা এসেছে, “চিরন্তন পিতার বাম চোখের পুতুলি থেকে ডান চোখের পুতুলি পর্যন্ত দূরত্ব কত ফারসাখ।” (১ ফারসাখ= প্রায় ৬ কিলোমিটার)। এখন অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে তখনকার ইউরোপীয় সমাজে পুরোহিতরা কী দাপটের সাথে তাদের প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। তাদের গির্জাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা কি নিষ্পেষণ, নির্যাতন এবং অশ্লীল সংস্কৃতির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছিল সাধারণ মানুষকে। অজ্ঞতা, মূর্খতা, সংকীর্ণ জীবনযাত্রা, হিংস্রতা, পাশবিকতা, স্বার্থান্ধতা, অবিচার, বর্ণপ্রথা এবং আরো অন্যান্য চারিত্রিক ও নৈতিক দোষ-ত্রুটির ন্যায় বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান সমগ্র পৃথিবীর জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যা অন্যায় তা ছিল ন্যায়, যা ছিল লজ্জাজনক এমন স্বাভাবিক ও বৈধ হয়ে যায় যে সেসব কাজ মানুষ প্রকাশ্যে সমাধা করতো। মক্কা ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় ভিন্ন কিছু ছিল না। তাদেরও দাসব্যবস্থা ছিল তবে ইউরোপের মত অত্যাচার নির্যাতন এবং ভারতের মতো শোষণ আরবরা করতো না। দাসমুক্তির ব্যবস্থা তারা রেখেছিল। তারা নরখাদক ছিল না। কিন্তু অবুঝ কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দিত। আরব সমাজে অন্যান্য দেশের মতো নারীদেরকে পণ্যের মত কেনাবেচা করা হতো। নারীরা সমস্ত সামাজিক অধিকার ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তাদের জঘন্য কু-অভ্যাস ছিল মদ্যপান। পানশালা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকতো। পানশালার ছাদের ওপর বিশেষ ধরনের পতাকা উড়াতো। তাদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মদ। লটতরাজ, জুয়া, সুদ ও মানুষকে বন্দী করে দাস হিসেবে কেনাবেচা করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আরবরা সহাস্য ছিল, দানশীল ছিল, অতিথিপরায়ণতা, আমানতদারি, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করা, আকিদা বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করা, স্পষ্টভাষী, অশ্বচালনা, তীর নিক্ষেপে সিদ্ধহস্ত- এসব ছিল তাদের সহজাত গুণ, পলায়ন শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা তারা গর্হিত কাজ বলে মনে করতো। তবে বর্তমান যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্র এমনকি বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতো ঐ সব সদগুণের ভিন্ন ব্যাখ্যা ছিল আরবদের। যেমন সাহসের অর্থ ছিল ব্যাপক হত্যাকান্ড ও রক্তপাত ঘটানো। আত্মসম্ভ্রমবোধ বলতে তারা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করা বুঝাতো। তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বস্ততা ও সংহতি ছিল নিজ গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ মিত্রদেরকে সমর্থন করা, তা সত্যই হোক অন্যায়ই হোক। মদ, নারী ও যুদ্ধের প্রতি তারা তীব্রভাবে আকৃষ্ট ছিল। তারা কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিল। তারা উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করতো। এতসব সত্ত্বেও তারা সাহিত্যচর্চায় ছিল উন্নত। বৈদেশিক বাণিজ্যে ছিল অগ্রসর। তারা রোমান জাতির আবির্ভাবের আগে উন্নত শহর ও নগর স্থাপন করেছিল যা অবস্থিত ছিল ইয়েমেনে। তারা ছিল তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ভাষা “আরবি ভাষার” অধিকারী। তাদের ছিল ৩৬০টি মূর্তি। তারা মনে করতো প্রতিদিনের ঘটনা ঐ ৩৬০টি মূর্তির যে কোন একটির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া বিভিন্ন গোত্র বিভিন্ন বস্তুর পূজা করতো। চিন্তাশীলরা চাঁদের পূজা করতো, কিনানাহ্ গোত্র চাঁদ; তাই গোত্র শুকতারা; লাখম গোত্র “বৃহস্পতি”, হিময়ার গোত্র “সূর্য” আসাদ গোত্র “বুধ গ্রহের” পূজা করতো। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বুঝা গেলা যে জীবনের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছাড়া শুধুমাত্র ভোগবিলাস আর স্বার্থ-উদ্ধারের মানসিকতা মানবসমাজকে কী  গভীর পঙ্কিল আবর্তে নিক্ষেপ করতে পারে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এমন নিষ্পেষণ, হানাহানি, অবিচার, শোষণ নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা আর অরাজকতার কারণ ছিল মানুষের অজ্ঞতা। আর অজ্ঞতার কারণেই মানুষ ছিল সঙ্কীর্ণ চিন্তার অধিকারী, সঠিক কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। হতাশা দুর্বলতা, হীনতার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে তারা নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করে তারই মধ্যে আরোধ্য বস্তুর সন্ধান করতো। এই পৌত্তলিকতা এবং শিরকবাদিতা মানুষের অন্তরে নিকৃষ্টতম দোষ ‘অহঙ্কারের’ ভিত্তি স্থাপন করে। আর অহঙ্কার মানুষকে তার অন্তর্দৃষ্টি সত্যের দিকে ধাবিত হতে দেয় না। এই নিকৃষ্ট দোষ “অহঙ্কারকে” ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করার একমাত্র অস্ত্র হলো কালেমা তৈয়্যবা-“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।” রাসূল সা. সেই কালেমা তৈয়্যবা নিয়েই এলেন। যার অর্থ আমরা হয়তো সংক্ষিপ্ত আকারে বুঝি, কিন্তু আবু জেহেল, আবু লাহাব তার যথাযথ মর্মার্থ বুঝতো বলেই চরম বিরোধিতা করেছিল। কালেমা তৈয়্যবার যথার্থ অর্থ মাওলানা মওদূদী (রহ) বর্ণনা করেছেন- “মানুষ আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও নিজের পৃষ্ঠপোষক, কার্যসম্পাদনকারী প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ দূরকারী, ফরিয়াদ শ্রবণকারী ও গ্রহণকারী এবং সাহায্যদাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করিবে না। কেননা তিনি ব্যতীত আর কাহারো নিকট ক্ষমতা নাই।” “আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও কল্যাণকারী মনে করিবে না, কাহারও সম্পর্কে অন্তরে ভীতি অনুভব করিবে না, কাহার ওপর নির্ভর করিবে না, কাহার প্রতি কোন আশা পোষণ করিবে না এবং এই কথা বিশ্বাস করিবে না যে, আল্লাহর অনুমোদন ব্যতীত কাহারও ওপর কোন বিপদ মুসিবত আপতিত হইতে পারে। কেননা সকল প্রকার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার একমাত্র আল্লাহরই। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও নিকট দোয়া প্রার্থনা করিবে না, কাহারও নিকট আশ্রয় খুঁজিবে না, কাহাকেও সাহায্যের জন্য ডাকিবে না এবং আল্লাহর ব্যবস্থপনায় কাহাকেও এতখানি প্রভাবশালী বা শক্তিমান মনে করিবে না যে তাহার সুপারিশে আল্লাহর ফয়সালা পরিবর্তিত হইতে পারে। কেননা তাহার রাজ্যে সকলেই ক্ষমতাহীন প্রজামাত্র। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও সম্মুখে মাথা নত করিবে না এবং কাহারও উদ্দেশ্য মানত মানিবে না। কেননা এক আল্লাহ ব্যতীত ইবাদাত (দাসত্ব আনুগত্য ও উপাসনা) পাইবার অধিকারী আর কেহই নাই। আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তার দেয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারও আসলেই নাই।” কলেমা তাইয়্যেবার উক্ত অর্থই নির্ধারণ করে দেয় ক্ষমতাধররা নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য মনগড়া আইন তৈরি করে তার প্রচলন করে  এবং তার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। আর মানুষের মনগড়া নীতিনিয়ম, আইন-কানুন, রসম-রেওয়াজই সমস্ত অনিষ্টের মূল। হতে পারে তা  একজন সংসারের কর্তারূপী ক্ষমতাধর অথবা ছোট্ট মুদি দোকানের কর্তারূপী ক্ষমতাধর অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর। আসলে সমস্ত ক্ষমতার উৎস এবং সমস্ত আইন বিধানের উৎস একমাত্র এক আল্লাহতায়ালা। কারণ তিনিই স্রষ্টা। যারা এই সত্যকে মেনে নিল তারা কল্যাণময় এক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিবাসী হলো। এই সত্যকে যারা মেনে নিতে পারে না তারাই অহঙ্কারী। হযরত সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শামমাস (রা) আরজ করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি স্বভাবগতভাবে রূপ সৌন্দর্য পছন্দ করি এবং নিজে সাজ-সজ্জা গ্রহণ করে থাকি এটা কি অহঙ্কার? মহানবী সা. বললেন, “না এটা অহঙ্কার নয় বরং অহঙ্কার হচ্ছে হক ও সত্যকে অপছন্দ করা, অঙ্গীকার করা এবং লোকদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা অথচ তারা তোমারই মত আল্লাহর বান্দা অথবা তারা তোমার তুলনায় শ্রেষ্ঠও হতে পারে।” আজ আমাদের দেশেই শুধু নয়, সারা পৃথিবীতে যে সংস্কৃতির প্রচলন, যাকে অপসংস্কৃতি বলা হয় তা সেই সত্য অস্বীকারকারী অহঙ্কারীদের সৃষ্ট। যা রসূল সা. এর আগমনের  প্রাক্কালে সার পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ছিল। আমাদের দেশে রাম ও বামপন্থী এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাম ও জড়বাদীরা হয়তো বই পড়ে লেখাপড়া শিখেছে, হয়তো বস্তুর ব্যবহারে ধনী ও চাকচিক্যময় জীবনের অধিকারী হয়েছে কিন্তু আসলে তারা অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। তাদেরই অজ্ঞতা ও অশিক্ষার ফসল হিসেবে বর্তমান পৃথিবীর যে জাহিলিরূপ আমরা দেখছি যা পনেরশত বছর পূর্বে সমস্ত পৃথিবীতে বিরাজ করেছিল। পৃথিবীর সমস্ত দেশে সমস্ত লোকালয়ে যে কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত আছে তা মহানবী সা. আনীত সত্যজ্ঞান থেকে উ™ভূত। মহানবীর সা. নবুওয়ত প্রাপ্তির সূচনা থেকে আজ অবধি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে কলেমা তৈয়্যবা এবং ঈমান থেকে  উ™ভূত সংস্কৃতিক রূপরেখা। যে খ্রিস্ট ধর্ম বিকৃত হয়ে গেছে, পুরোহিতদের গির্জাকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা যা সমস্ত ইউরোপকে দোজখ সমতুল্য করে ফেলেছিল সে বিকৃত কর্মও সংশোধিত হয়েছে ইসলামের পরশে। গির্জাকেন্দ্রিক অত্যাচার তিরোহিত হয়েছে। বাথরুম ব্যবহার, ঘরে প্রবেশের অনুমতি এবং সেচব্যবস্থা, হাসপাতাল ইত্যাদি থেকে শুরু করে মানুষের জীবনের সমস্ত দিকগুলিতে যে কল্যাণময়তার স্বরূপ সমস্ত পৃথিবীতে আমরা দেখেছি তা ইসলামেরই অবদান। আর যত অকল্যাণ তা সবই পৌত্তলিক, শিরক উদ্ভূত এবং নাস্তিকতা থেকে সৃষ্ট। পরিবার ব্যবস্থা, পিতামাতার অধিকার, স্ত্রীর অধিকার, সন্তানের অধিকার, এতিম ও বৃদ্ধদের প্রেমময় নিরাপত্তা- তথা দুর্নীতির উচ্ছেদ, মানব-সেবা, বৈধ-অবৈধ পন্থার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, ভালো মন্দের স্বরূপ, এ সবই ইসলামের দেখানো- মহানবী সা. আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে আরবদের কাছে সাহস, আত্মমর্যাদা ইত্যাদি কি অর্থ বহন করতো। সমস্ত দুনিয়াবাসীর কাছে প্রত্যেকটি সদগুণের অর্থ এভাবে কদর্য পন্থায় ব্যবহৃত হতো। আজ যেমন আমাদের দেশের মিডিয়া বা চলচ্চিত্রে যে অশ্লীলতা তা বাম ও রামদের কাছে শ্লীল। যা গোপন ব্যবহারে সুন্দর  রাম-বামরা তা প্রকাশ্যে ব্যবহার করে। যা সাধারণভাবে লজ্জার বিষয় তা বাম ও রামদের কাছে লজ্জাই নয়। লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্যে হত্যাযজ্ঞ তারা সমর্থন করে। তিল তিল করে গড়ে তোলা কোন সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান কলমের কয়েকটি খোঁচায় তারা কলঙ্কিত করে দিচ্ছে। তারা অপরাধীর শাস্তির কথা বলেছে কিন্তু যে আইন ব্যবস্থা অপরাধী তৈরি করে সেই আইনব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলছে না। কারণ তারা জানে কোন আইন-ব্যবস্থা অপরাধ ও অপরাধী নির্মূল করে। আর জানে বলেই  তারা ইসলামের আইন ব্যবস্থাকে ব্যান্ড করার পাঁয়তারা করেছে। কারণ তারা চায় অপরাধী তৈরির কারখানাটি থাকুক, তবেই তাদের রাজত্ব স্থায়ী থাকবে। এসবই পনের শত বছরের পূর্বেকার পৌত্তলিক ও জাহিলি সমাজের চিন্তধারা। তারাই ‘ভাস্কর্য’ নামের মূর্তি ব্যবস্থা জারি রেখেছে। ইন্দ্র যেমন রাজা অশ্বরীশকে তার মূর্তির বেদিতে ফুল ছড়াতে বলেছিল রাম ও বামরা সে ব্যবস্থা চালু রেখেছে। এসব কিছুই অজ্ঞতা থেকেই সৃষ্ট। এর ফলে হচ্ছে শিরকবাদিতা। মূর্তি পূজা থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার পূজা, ব্যক্তি পূজা, নফসের পূজা, ক্ষমতাধর ব্যক্তির পূজা (যা থেকে ঘুষ প্রথার সৃষ্টি) নিজস্ব স্বার্থের পূজা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আজকের বিশ্বসংস্কৃতির যত কল্যাণময় রূপ তা মহানবীর সা. দেখানো পথ ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্রুসেডের যুদ্ধ্ এসে ইউরোপীয়রা ইসলামের অনেক কিছুই গ্রহণ করে নিজেদের দেশে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই বলা হয় ইউরোপে ইসলাম আছে কিন্তু মুসলমান নেই। অর্থাৎ তাদের আইনব্যবস্থার বেশির ভাগই ইসলাম থেকে নেয়া। বিশ্বসংস্কৃতির যে কল্যাণময় উজ্জ্বল দিকগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মহানবীর সা. সাহাবী (রা), পরবর্তীকালের তাবেঈ, তাবে-তাবেঈন ও আলেম-উলামা এবং মুসলিম সৈনিকরাই তার বাহক। মহানবীর সা. উম্মত হিসেবে আল্লাহ ঘোষিত শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে আজ আমাদেরকে আমাদের সমস্ত তৌহিদী জ্ঞান নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে হবে- শুধুমাত্র পরকালে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়- আল্লাহ সেই তৌফিক আমাদের দান করুন। লেখক : মরহুম আবুল কাশেম মিঠুন সাবেক চলচ্চিত্র অভিনেতা,  সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমরা জানি অজ্ঞতা এবং অশিক্ষা মানুষকে প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ও ক্ষমতাধরদের আজ্ঞাবহ করে রাখে। অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার ফলে মানুষের মানসিক বিকাশ সাধিত হয় না, চিন্তাধারা প্রসারিত হয় না এবং নৈতিক বলবীর্য হারিয়ে মানুষ নিজেকেই বস্তুসদৃশ করে তোলে। অর্থবিত্তের লোভ, চোখরাঙানি, দাপট অথবা আদর-ভালোবাসা, মমতা দিয়ে তাকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। অজ্ঞ ও অশিক্ষিত মানুষের বহুবিধ পাওয়া না পাওয়ার অতি আবেগগ্রস্ত মনস্তাত্ত্বিকতাই ব্যক্তি পূজার জন্ম দেয়। অর্থ, দাপট অথবা ভালোবাসা প্রেম দিয়েও যা পাওয়া যায় না- সেই ‘পূজা’ পাওয়ার জন্য ধুরন্ধর ক্ষমতাধররা পূজারির অন্তরাত্মায় বসবাসের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এবং দয়া-দাক্ষিণ্য ও অতিমানবিক আবেদনের বিভিন্ন আঙ্গিকের অভিনয় দিয়ে একটা দেবত্বের স্বরূপ তার অন্তরে মুদ্রিত করে রাখতে প্রয়াস পায়। অতি কাছের তোষামোদি চক্র তাতে বাতাস করে নরমকে শক্ত অথবা গরমকে ঠান্ডা করে তোলে। অন্যদিকে হিংস্র বর্বর খুনপিয়াসী মানুষকেও অশিক্ষিত অজ্ঞ লোক পূজা করে প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার শক্তি সরবরাহের অস্ত্র হিসেবে। এরূপভাবে অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তি এবং ধুরন্ধর ক্ষমতাধরদের সমন্বয়েই মূর্তিপূজার উদ্ভব হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ ও গবেষক আল বিরুনী মূর্তিপূজার উদ্ভব সম্পর্কে তার বিশ্ববিখ্যাত ‘ভারত-তত্ত্ব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমাদের পয়গম্বর ও কাবাগৃহের যদি একটি ছবি বানানো হয় এবং কোন অশিক্ষিত নারী এবং পুরুষের সামনে তা পেশ করা হয় তাহলে তা দেখে তো তারা আহ্লাদিত হবেই। সেই সাথে সেই ছবিতে তারা চুমু খাবে, তাকে গালে গলায় সব জায়গায় রেখে আদর করবে এবং সমানে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, যেন তারা কোন ছবি দেখছে না বরং মূল ব্যক্তিকেই দর্শন করছে এবং এমন অনুভব করবে যেন মক্কা-মদিনায় হজের ছোট-বড় হুকুম-আহকামগুলো পালন করছে। ...এটাই তাকে মূর্তি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে আর কিছু অত্যধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি পয়গম্বর, মুনি-ঋষি, ফেরেশতা ইত্যাদির সম্মানে স্মারক (ভাস্কর্য) নির্মাণ করে, যার উদ্দেশ্য অনুপস্থিতির সময়ে বা মরণের পরে তাদের স্মৃতি নিয়ে মানুষের মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে দেয়া। ...এভাবে তাদের চিত্র ও স্মৃতি চিহ্নগুলিকে (ভাস্কর্য) সম্মান করাটা তাদের ধর্মবিশ্বাসের অনিবার্য অঙ্গ বানিয়ে দেয়া হয়।” আল-বিরুনী আরো লিখেছেন; ‘‘...এ ধরনের ধ্যাণ-ধারণা কেবল অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে। ...যারা মুক্তি পথের পথিক বা যারা দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে এবং যারা বিমূর্ত সত্যকে লাভ করতে ইচ্ছুক যাকে তারা ‘সারসত্তা’ বলে, তারা ইশ্বর ছাড়া আর কারোরই উপাসনা করে না। আর তারা ঐ ইশ্বরকে মূর্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করে তার উপাসনা করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।” হিন্দুরা বলে যে নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে মূর্তি নির্মাণ ও পূজা শুরু হয়েছে- ‘ইন্দ্র রাজা অম্বরীশকে বলেছিলেন, যখন মানবসুলভ বিস্মরণশীলতা তোমাকে অভিভূত করে তখন তোমাকে নিজের জন্য এমন একটি প্রতিমা বানিয়ে নেয়া উচিত যেমনটি আমি তোমার ওপর প্রকাশ করেছিলাম, মূর্তিবেদির ওপর সুগন্ধ ও ফুল ছড়িয়ে তেমনই তুমি আমাকে আরাধনা করবে। এভাবে তুমি আমাকে স্মরণ করবে।” উপরোক্ত বিবরণগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় অজ্ঞতা ও অশিক্ষার ফলে মানুষ অন্তর্নিহিত সত্যের দিকে ধাবিত না হয়ে প্রকাশমান রূপে ঝলক ও চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা অনুসরণ ও অনুকরণ করে। সত্যের দিকে অগ্রসর না হওয়ার কারণে মানুষ অত্যধিক কল্পনাপ্রবণ, সঙ্কীর্ণ মানসিকতা এবং স্বার্থান্ধ হয়ে ওঠে। আর এই দোষগুলোর ভিত্তি হলো অহঙ্কার। অহঙ্কার মানুষকে স্বার্থ উদ্ধারকারী ব্যক্তিকে পূজা করতে শেখায় এবং যে স্বার্থ উদ্ধারকারী নয় সে যতই সত্যপথের পথিক হোক বা মহামানব হোক তাকে তারা সহ্য করতে পারে না। অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার কারণে মানুষ যাতে পথভ্রষ্ট না হয়, হানাহানি না করে, ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী না হয় সে জন্য আল্লাহ তাআলা প্রথম সৃষ্ট মানুষকে নবী হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন। নবীর মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর করে করণীয় কাজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অবহিত করেন। প্রথম মানুষ আল্লাহর নবী হজরত আদম (আ) কে দুনিয়াতে পাঠাবার সময়েই আল্লাহ বলেছিলেন- “আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও, তবে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে (আইন ব্যবস্থা সম্পর্কিত) হেদায়াত আসবে, অতঃপর যে আমার বিধান মেনে চলবে তার কোন ভয় নেই, তাদের কোনো প্রকার উৎকণ্ঠিত হতে হবে না। আর যারা (আমার আইন কানুন) অস্বীকার করবে এবং আমার আয়াতসমূহ মিথ্যা প্রতিপন্ন (করে লাগামহীন জীবন যাপন) করবে তারা অবশ্যই জাহান্নামের বাসিন্দা হবে, তারা সেখানে চিরদিন থাকবে।” (সূরা আল-বাকারাহ : ৩৮-৩৯) এইভাবে আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে মানুষ পাঠিয়ে তাঁর হেদায়েত দিয়ে মানুষের অজ্ঞতা দূর করেছেন। অজ্ঞতা ও অশিক্ষা একটি অভিশাপ-একটি ভয়াবহ মারাত্মক অপরাধ। এখানে অজ্ঞতা ও অশিক্ষা বলতে এটা নয় যে, ‘আমি ডাক্তারি বিদ্যা জানি না তাই আমি অভিশপ্ত বা অপরাধী। অথবা আমি দীর্ঘ জীবন একজন পারিবারিক সদস্য হয়েও রন্ধনপ্রণালী জানি না তাই আমি অভিশপ্ত বা অপরাধী।’ বিষয়টি মোটেই তা নয়। অজ্ঞতা ও অশিক্ষা হচ্ছে এমন বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও জ্ঞান থাকলে মানুষ আর অজ্ঞ থাকে না। তার অন্তর্লোক কষ্টিপাথরের মতো সঠিক স্বর্ণ চিনে নিতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত বস্তুগত সমাহারে সে নিজের চিন্তা ও কর্মকে কিভাবে পরিচালিত করবে সে বিষয়ে জ্ঞান। সেই জ্ঞানই মানুষকে সঠিক পথে চলার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়। সঠিক মানুষ চেনার মনশ্চক্ষু খুলে দেয়। হযরত আলী (রা) বলেছেন ‘‘কোন বস্তু বা মানুষকে দিয়ে সত্য বিচার করো না, আগে সত্যকে জানো সঠিক বস্তু বা সঠিক মানুষ আপনাতেই তোমার চোখে ভাস্বর হয়ে উঠবে।’’ সেই জ্ঞান হচ্ছে (ক) মানুষের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক কি! অর্থাৎ তৌহিদ সম্পর্কে জ্ঞান। (খ) পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা কি, সৃষ্টিকর্তা কি কি কাজের জন্য তাকে সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা, এসব জ্ঞান নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা শিক্ষা দিয়েছেন, অর্থাৎ রিসালাত সম্পর্কে জ্ঞান। (গ) এই পৃথিবীতে মানুষ যে সব চিন্তাপদ্ধতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে এবং তারই আলোকে কর্ম সম্পাদন করবে মৃত্যুর পর স্রষ্টা তারই আলোকে বিচার ফয়সালা করবেন। মানুষ তখন ভালো কাজের ভালো ফল, খারাপ কাজের খারাপ ফল পাবে। অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে জ্ঞান। তৌহিদ, রিসালাত ও আখেরাত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা মানুষের জন্য ফরজে আইন। পৃথিবীর বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষকে আল্লাহতায়ালা উক্ত জ্ঞান অর্জন করার কঠোর তাগাদা দিয়েছেন। এই জ্ঞান অর্জন না করলে মানুষ তার কাজ কর্মে ভুল করবে, ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে, স্বার্থান্ধ হবে, অন্য মানুষকে অমানবিক ভাবে ব্যবহার করবে, বস্তুর অকল্যাণকর ব্যবহার করবে এবং নৈতিক চরিত্র হারিয়ে অপরাধী কর্মে লিপ্ত হবে। তাই ফরজে আইনবিষয়ক উক্ত জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। নবী-রাসূলদের উম্মতগণ উত্তরাধিকার সূত্রে উক্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ। তাই অন্যের কাছে এই জ্ঞান কথার মাধ্যমে লেখনীর মাধ্যমে এবং আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া মুসলমানদের জন্য ফরজে আইন। যাদের কাছে উক্ত জ্ঞান আছে এবং সরল বিশ্বাসে খুশিমনে যারা তা মান্য করে ও পালন করে তারাই মুসলমান নামে অভিহিত। আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছেন- “এখন দুনিয়ার সেই সর্বোত্তম দল তোমরা যাহাদিগকে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কার বিধানের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে, তোমরা ন্যায় ও সৎকাজের আদেশ করো, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখিয়া চলো।’’- মুসলমানরাই আল্লাহর দেয়া আইন বিধান প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়াতে কল্যাণ স্থাপন করতে পারে। অন্য মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা অথবা তৌহিদ রিসালাত ও আখেরাতের খবর পৌঁছে দেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজে আইন। যাতে কেয়ামতে অপরাধী ব্যক্তি বলতে না পারে যে উক্ত জ্ঞান তো আমাদের কাছে ছিল না তাই আমরা অপরাধ করেছি।” (সূরা আলে ইমরান-১১০) আল্লাহতাআলা এ বিষয়টিও পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন- “আল্লাহ তায়ালা নবীদেরকে সুসংবাদ প্রদানকারী এবং পরিণতির ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছেন, যাতে করে মানুষ তার কাছে এরূপ বিতর্ক তোলার সুযোগ না পায় যে আমরা তো বেখবর ছিলাম। আর আল্লাহ সর্বাবস্থায়ই প্রবল পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন-নিসা-১৬৫) এখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে মানুষকে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে অন্ধকারে আল্লাহ ছেড়ে দেননি বা ফেলে রাখেননি। তাকে সঠিক পথ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তার মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেছেন, তার করণীয় সম্পর্কে জ্ঞাত করেছেন। প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী সা. পর্যন্ত যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা নবী পাঠিয়ে মানুষকে সম্পূর্ণভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ সা. শেষ নবী হওয়ার তাৎপর্য তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন-“পূর্ববর্তী নবীগণের  মধ্যে আমার উপমা সেই ব্যক্তির ন্যায় যে একটি সুরম্য পূর্ণাঙ্গ ও সুশোভিত প্রাসাদ নির্মাণ করলো কিন্তু একটি ইটের স্থান পরিত্যক্ত (অসম্পূর্ণ রেখে) দিল। জনতা প্রাসাদটি প্রদক্ষিণ করতো এবং তাতে বিস্মিত হয়ে বলতো তার নির্মাতা যদি ঐ ইটের স্থানটি পূর্ণ করতো। অতএব আমি নবীগণের মধ্যে সেই ইটের স্থান সমতুল্য।’’-উবাই ইবনে কাব (রা) বর্ণিত। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার উন্মেষ ঘটে গেছে, আবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতিক স্বরূপ একটা নির্দিষ্ট অবয়ব পেয়েছে। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতি নিয়মের অধীনে একটি কল্যাণময় পৃথিবী তৈরি করতে হলে হযরত মুহাম্মদ সা. আনীত কুরআন এবং তার দেখানো পথ অনুসরণ করলেই তা সম্ভব। আর নতুন কোন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদ্ভব হবে না সেটা নয় তবে যা-ই ঘটুক তা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতেই সঠিক পথে চালনা করা সম্ভব। বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির স্বরূপ বিচার করতে হলে নবীর সা. আগমনের প্রাক্কালে পৃথিবীর রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির রূপ কেমন ছিল তা আমাদের সামনে থাকা দরকার। স্মরণ রাখা দরকার যে আল্লাহ তাআলার পাঠানো নবী ও রাসূলরা যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন তা মানুষ এক সময় বিকৃত করে ফেলেছে, জনপদ আবার অকল্যাণের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, তখনই আল্লাহ তাআলা নবী পাঠিয়েছেন, এইভাবে লক্ষ লক্ষ নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে। আর তাদের আনীত আইন ব্যবস্থাও বিলুপ্ত হয়েছে। শেষ নবী সা. যখন আগমন করেন তখন সমস্ত পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ছিল এব বিকৃতির শিকার। পরিবার সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থব্যবস্থা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সংস্কৃতি ছিল অমানবিক ও অশ্লীল পন্থার অনুসারী। আজকের  পৃথিবীতে যত জনগোষ্ঠী বিদ্যমান তাদের মধ্যে যতটুকু কল্যাণ ও মানবিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করা যায় তা একমাত্র ইসলামেরই অবদান এটা অকাট্যভাবে সত্য। শেষ নবী সা. আনীত জ্ঞান উপযুক্ত মানুষের মাধ্যমে সার্বিকভাবে অর্থাৎ সত্যিকার মুসলমানদের ছাড়া কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পৌঁছানোর অব্যাহত চেষ্টা থাকবে বলেই নতুন করে নবী পাঠানোর কোন যুক্তি থাকে না, আর তাই কোন নবীর আগমন ঘটবে না। নবী সা. আগমনের প্রাক্কালে ভারতবর্ষ, আফ্রিকা, এশিয়া  ও ইউরোপের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ অবস্থান নির্ণয় এবং বিশ্লেষণ করার সুযোগ আলোচ্য প্রবন্ধে নেই তবে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের খোদ মক্কানগরীতে রাসূলের সা. একটি ঘটনা তাবৎ মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরে। মদিনার খাযরাজ গোত্রের একজন নেতা নাম আসআদ বিন যুরারাহ মক্কায় গেল কুরাইশদের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য নেবার জন্য, যাতে মদিনায় তাদের দুশমন আওস গোত্রকে পদানত করতে পারে। আসআদ কুরাইশ নেতা উতবাহ বিন রাবিয়ার বাড়িতে গেল। উতবাহ বললো, আমরা তোমাকে কোন সাহায্য আপাতত করতে পারবো না, কারণ এক কঠিন সমস্যায় পড়েছি আমরা। আমাদেরই এক ব্যক্তি (রাসূল সা) আমাদের উপাস্যদের সম্পর্কে কটূক্তি করছে। মিষ্টি মধুর ব্যবহার আর ভাষা দিয়ে আমাদের একদল যুবককে তার দলে ভিড়িয়েছে। এভাবে সে আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। হজের মৌসুমে আগত লোকদেরকে সে তার ধর্মের দিকে আহ্বান জানায়। এসব নিয়ে আমরা খুব বিপদে আছি। আসআদ অগত্যা মদিনায় ফিরে যাবার মনস্থ করে। কিন্তু কাবা তাওয়াফ ও জিয়ারত না করে মদিনায় ফিরে যাওয়া শোভনীয় নয়। যদিও উতবাহ বলেছে কাবাঘর জিয়ারত করতে গেলে লোকটির (রাসূল সা) কথা শুনে তুমি কিন্তু বদলে যেতে পার। তাই কাবা জিয়ারত করতে গেলে কানের ভেতর তুলো দিয়ে রেখো। আসআদ মসজিদুল হারামে যায়- তাওয়াফ করার সময় মহানবীকে সা. দেখেন যে তিনি হুজরতে ইসমাঈলে বসে আছেন। সে তাঁর সামনে গেল না। কিন্তু শেষে কৌতূহল দমন করতে না পেরে মহানবী সা. এর সামনে গিয়ে-আরবদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সম্ভাষণ জানালো- ‘‘আপনার প্রাতঃকাল মঙ্গলময় হোক”।- সম্ভাষণটি যদি আমাদের রেডিও, টিভি ও চ্যানেলের সম্ভাষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় তবে আমাদের বর্তমান সময়ের সংস্কৃতি ও সে সময়ের আরবদের সংস্কৃতির একটা সেতুবন্ধ আমরা খুঁজে পাই। আমাদের সংস্কৃতির এখন যারা বাহক বলে দাবি করেন তাদের বিশ্বাস, তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি বুদ্ধিবৃত্তিও এ সবের সংস্কৃতির স্বরূপ জাহিলি সংস্কৃতির আধুনিক সংস্করণ ছাড়া কিছুই নয়। সুদ, জুয়া, মদ, অশ্লীলতা, বর্ণপ্রথা, শোষণ-শাসন পদ্ধতি সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ তাদের সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। যাই হোক-আসআদের সম্ভাষণের জবাবে মহানবী সা. বললেন, ‘‘আমার মহান প্রভু আল্লাহ এর চেয়ে উত্তম সম্ভাষণ ও সালাম অবতীর্ণ করেছেন। আর তা হচ্ছে, ‘‘আসসালামু আলাইকুম”- আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আসআদ আকৃষ্ট হলো। সে মহানবীর সা. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। মহানবী সা. সূরা আনআমের ১৫১ ও ১৫২ নম্বর আয়াত পড়ে শোনালেন। আসআদের অন্তরে তা গভীর প্রভাব বিস্তার করলো এবং তিনি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন। আসআদ (রা) কেন ইসলাম গ্রহণ করলেন? কি ছিল দু’টি আয়াতের মধ্যে? তাঁর নিজের জীবন, মন-মস্তিষ্ক, তাঁর রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি কোনখাতে প্রবাহিত হচ্ছিল? হঠাৎ তার গতি পরিবর্তন হলো কেন? এসবের জবাব হয়তো ব্যাপক বিস্তৃত। কিন্তু সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে প্রবেশ করা। উক্ত আয়াতে ছিল- ‘‘তোমার সবকিছুর মালিক, রব, প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ- তাঁর কোন শরিক নেই, তোমরা শিরক করো না।’’ অর্থাৎ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীর জনবসতি তখন শিরকে লিপ্ত ছিল। আর এর একমাত্র কারণ ছিল অজ্ঞতা ও অশিক্ষা। আয়াতের মধ্যে আরো ছিল, ‘‘তোমাদের পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। আমাদের জেনে রাখতে  হবে-যখন একটা বিষয়ের অনুপস্থিতি থাকে তখনই বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়।’’ অর্থাৎ পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ তখনকার পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল। উক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন, ‘‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমরা তোমাদেরকে এবং তাদেরকে জীবিকা দান করি। তোমরা গোপন ও প্রকাশ্য পাপাচারের নিকটবর্তী হয়ো না।’’ এ ছাড়াও রয়েছে অন্যায় হত্যা নিষিদ্ধকরণ, অনাথের সম্পত্তি হস্তগত না করা, ন্যায়পরায়ণতার সাথে ওজন করা, নিকটাত্মীয় হলেও ন্যায্য কথা বলা, আল্লাহর সাথে যে অঙ্গীকার (অর্থাৎ আল্লাহর আইন বিধান মেনে চলা) পূর্ণ করা ইত্যাদি। একটি সূর্যই সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করে। তেমনি আল্লাহতায়ালার হেদায়াত বাণী সূর্যের আলোর চেয়েও চিরন্তন চিরভাস্বর-সমস্ত জনগোষ্ঠীর অন্ধকার জীবনে আলোস্বরূপ। তাই অন্ধকারের বাসিন্দা আসআদ (রা) আলোর সন্ধান পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ত্যাগ করলেন। মহানবীর সা. আগমনের পূর্ব থেকেই সমস্ত পৃথিবীর অবস্থা তৎকালীন আরবদের চেয়ে কোন অংশে কম জাহিলি ছিল না। বরং কোন কোন জনপদে আরো বীভৎস ভয়ঙ্কর অবস্থা বিদ্যমান ছিল। যেমন সমগ্র আফ্রিকার মানুষ মানুষের গোশত খেত। দাস ব্যবসা ছিল অবারিত। বেশিরভাগ এলাকার মানুষ উলঙ্গ থাকতো। তাদের আচার আচরণ ছিল অসভ্য বর্বরসুলভ। নোংরামি ছিল তাদের সহজাত। মাত্র তিনশত বছর পূর্বেও তাদের অবস্থা এমন ছিল কিন্তু ইসলাম প্রবেশের পর তাদের জীবনধারা বদলে যায়। জনৈক ইউরোপীয় পর্যটকের উদ্বৃতি মাওলানা মওদূদী (রহ) উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমি (পর্যটক) যখন মধ্য সুদানের নিকট পৌঁছলাম তখন উপজাতীয় গোত্রগুলোর জীবনে আমি প্রগতির নিদর্শনাবলি দেখতে পেলাম, যা দেখে আমার ধারণা পাল্টে যেতে লাগলো। আমি দেখলাম, সেখানে মানুষ খাওয়ার প্রবণতা নেই, মুর্তিপূজারও অস্তিত্ব নেই, মদখোরি নেশাখোরিও বিলুপ্ত প্রায়। সকল গোত্রের লোক কাপড় পরে। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার ও পবিত্র রাখে এবং আচার আচরণে ভদ্রতা রক্ষা করে। ... নিগ্রো প্রকৃতি যেন কোন উন্নততর প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে আর এ সবই হচ্ছে ইসলামের কল্যাণে। ‘লোকোজা’ নামক জায়গাটা অতিক্রম করার পর আমি ইসলামী প্রচার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছলাম এবং সেখানে এক অতি উচ্চাঙ্গের শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রশাসন সক্রিয় দেখলাম। চারদিকের লোকবসতিতে সর্বত্র সভ্যতার নিদর্শন পরিস্ফুট। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কারিগরির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে এবং আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন একটি সুসভ্য দেশে এসে উপস্থিত হয়েছি। শুধু সুদান নয়, সমগ্র আফ্রিকার সেনেগাল, গায়েনা, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, লাগোস, ঘানা, নাইজেরিয়া ইত্যাদি এলাকার জনবসতি ইসলামের আইনের আলোয় আলোকিত হয়েছে।’’ সমগ্র চীনে ছিল প্রকৃতি পূজা, পুরোহিত পূজা, পূর্বপুরুষ পূজা। পরবর্তীদের বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে চীনের জনসমষ্টি নাস্তিক হয়ে পড়ে। বুদ্ধের মূর্তি পূজাই ছিল তাদের সারধর্ম। বনু উমাইয়ার যুগে চীনে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। ১৩ শতকে মার্কোপেলো লিখেছেন, ‘প্রায় সমগ্র উনান প্রদেশে মুসলমান হয়ে গেছে।’ দক্ষিণ চীন সম্পর্কে ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘সব শহরগুলোতে মুসলিম মহল্লা রয়েছে’। ১৫শ শতকে আলী আকবর নামক জনৈক মুসলিম বণিক লিখেছেন যে, পিকিং এ (বেইজিং) প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলিম পরিবার বাস করে। মালয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে পৌত্তলিকতা ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। জাভা দ্বীপ, সুমাত্রা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মরক্কো দীপপুঞ্জ, বোর্নিও দ্বীপ, ফিলিপাইন, নিউগিনিÑ এ সব এলাকায় পৌত্তলিকতার অভিশপ্ত জনপদ ছিল, কোথাও ছিল হিন্দু পৌত্তলিকতা, কোথাও ছিল ‘যিশু ও মেরি’ পৌত্তলিকতা। আর শিরকউদ্ভূত যাবতীয় সঙ্কীর্ণতা, বর্ণপ্রথা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অশ্লীলতা, অবিচার অনাচার তার শিকড় বিস্তার করেছিল সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভারতবর্ষে কথা তো সবার জানা-অসভ্যতা আর অপসংস্কৃতি ভারতীয় জনপদকে অমানবিকতার নিকৃষ্ট স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। চুরির অপরাধে এক এক জাতিগোষ্ঠীর এক এক শাস্তির বিধান ছিল। এখানেও বর্ণবাদ মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়েছিল। হত্যার অপরাধেও বর্ণভেদে শাস্তির বিধান ছিল। ব্রাহ্মণের শাস্তি ছিল-তাকে অন্ধ করে দেয়া হতো। ক্ষত্রিয়দেরকে অন্ধ করা হতো না, তাদেরকে বিকলাঙ্গ করা হতো। শূদ্র, বৈশ্য এবং অন্য জাতিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। ব্যভিচারিণীকে দেশ ছাড়া করা হতো। যুদ্ধবন্দীরা দেশে ফিরলে তাদেরকে কয়েকদিন উপবাস রাখা হতো, তারপর গোবর, গোমূত্র ও গো-দুগ্ধ খাওয়ানো হতো। এতেই অনেকে বমি করতে করতে মারা যেত। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং প্রজাদের বশীভূত করার জন্য রাজানার প্রচলন করেন। বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধকরণও সহমরণ প্রচলিত ছিল। সন্তানের জাত বিচার হতো মায়ের দিক থেকে। ধর্মগ্রন্থ পাঠ বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কেউ পাঠ করলে তার জিহ্বা কেটে দেয়া হতো, কেউ শুনলে তার কানে গরম সীসা ঢেলে হত্যা করা হতো। তারা শরীরে কোন অংশের কেশ মুন্ডন করতো না। স্ত্রী সহবাসের পূর্বে গোসল করতো। তারা ঘরে প্রবেশের অনুমতি নিত না, কিন্তু বেরোনোর সময় অনুমতি নিত। থুথু ফেলা বা নাক ঝাড়ার সময় আশপাশের লোকদের পরোয়া করতো না। তারা তাদের পুস্তকের শিরোনাম গ্রন্থের শুরুতে দেয় না নিচে দেয়। মৃতের ব্যাপারে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতো তারাও ধারণা করে যে মৃত্যুর আত্মা মৃতের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। নারীকে তারা দাসী হিসেবে গণ্য করত। হিন্দুশাস্ত্রকার মনু বলেন, “মন্ত্র দ্বারা স্ত্রীলোকের সংস্কার হয় না এ কারণে তাদের অন্তঃকরণ নির্মল হতে পারে না।” তৎকালীন পৃথিবীতে পারস্য (ইরান-ইরাক) বিবেচিত ছিল সভ্যতার উচ্চভূমি হিসেবে। তাদের ধর্ম ছিল অগ্নিপূজা, মূর্তি পূজা, প্রকৃতি পূজা ইত্যাদি। সমাজ ছিল নিষ্ঠুর শ্রেণীবৈষম্যের শিকার। সম্পদের মালিকানা এবং স্বত্বাধিকার সাতটি পরিবার বা বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ জনগণ ছিল বঞ্চিত। অভিজাত সাতটি পরিবার শিক্ষাগ্রহণের অধিকার রাখত। সাধারণ জনগণ শিক্ষালাভের অধিকার থেকে ছিল বঞ্চিত। সম্রাট খসরু পারভেজের ছিল তিন হাজার স্ত্রী, বারো হাজার গায়িকা দাসী। এ ছাড়াও তার হেরেমে কয়েক হাজার নারী, দাসী ও নর্তকী ছিল। পারস্য এবং রোম বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। এ ছাড়াও ছিল অভ্যন্তরীণ কোন্দল, যার পরিণতিতে চার বছরের মধ্যে চৌদ্দ বার ক্ষমতা বদল হবার ইতিহাসেও রয়েছে। প্রশাসনের ইতিহাস হত্যার ইতিহাস। পুত্র পিতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসে। সম্রাট খসরুর চল্লিশ জন পুত্রসন্তানকে হত্যা করে শীরাভেই নামক সম্রাট। তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। ইহুদিরা ছিল রোমের ঘোর শত্রু। রোমে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড সংঘটিত হতো। ইহুদিরা একবার ইরান থেকে আশি হাজার খ্রিষ্টানকে ক্রয় করে দুম্বার মতো জবাই করেছিল। রোম সাম্রাজ্য খ্রিষ্টে বিশ্বাসী হলেও তারা মূলত যিশুর মূর্তি পূজা করতো। তাদের সমাজবন্ধন একেবারেই শিথিল হয়ে গিয়েছিল, দুর্নীতি ও কুসংস্কারে ডুবে গিয়েছিল। অশ্লীলতা ও পাপপঙ্কিলতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল রোম সাম্রাজ্য। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে শাসকবৃন্দ সিংহের খাঁচায় ফেলে দিয়ে তার নারকীয় বীভৎস মৃত্যু দর্শন করে তৃপ্ত হতো। সে সময়ে ইউরোপের অবস্থা শুধুমাত্র একটি উদাহরণেই যথেষ্ট মনে হবে। প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ফ্লামারিয়োন ইউরোপের একটি পুস্তকের কথা উল্লেখ করেছেন যেটি চারশ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ইউরোপে পঠিত হতো। উক্ত পুস্তকে আলোচনা হয়েছে- “একটি সুইয়ের অগ্রভাগের সরু ছিদ্রের মধ্যে কতজন ফেরেস্তা অবস্থান করতে পারে।” আর একটি আলোচনা এসেছে, “চিরন্তন পিতার বাম চোখের পুতুলি থেকে ডান চোখের পুতুলি পর্যন্ত দূরত্ব কত ফারসাখ।” (১ ফারসাখ= প্রায় ৬ কিলোমিটার)। এখন অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে তখনকার ইউরোপীয় সমাজে পুরোহিতরা কী দাপটের সাথে তাদের প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। তাদের গির্জাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা কি নিষ্পেষণ, নির্যাতন এবং অশ্লীল সংস্কৃতির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছিল সাধারণ মানুষকে। অজ্ঞতা, মূর্খতা, সংকীর্ণ জীবনযাত্রা, হিংস্রতা, পাশবিকতা, স্বার্থান্ধতা, অবিচার, বর্ণপ্রথা এবং আরো অন্যান্য চারিত্রিক ও নৈতিক দোষ-ত্রুটির ন্যায় বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান সমগ্র পৃথিবীর জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যা অন্যায় তা ছিল ন্যায়, যা ছিল লজ্জাজনক এমন স্বাভাবিক ও বৈধ হয়ে যায় যে সেসব কাজ মানুষ প্রকাশ্যে সমাধা করতো। মক্কা ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় ভিন্ন কিছু ছিল না। তাদেরও দাসব্যবস্থা ছিল তবে ইউরোপের মত অত্যাচার নির্যাতন এবং ভারতের মতো শোষণ আরবরা করতো না। দাসমুক্তির ব্যবস্থা তারা রেখেছিল। তারা নরখাদক ছিল না। কিন্তু অবুঝ কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দিত। আরব সমাজে অন্যান্য দেশের মতো নারীদেরকে পণ্যের মত কেনাবেচা করা হতো। নারীরা সমস্ত সামাজিক অধিকার ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তাদের জঘন্য কু-অভ্যাস ছিল মদ্যপান। পানশালা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকতো। পানশালার ছাদের ওপর বিশেষ ধরনের পতাকা উড়াতো। তাদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মদ। লটতরাজ, জুয়া, সুদ ও মানুষকে বন্দী করে দাস হিসেবে কেনাবেচা করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আরবরা সহাস্য ছিল, দানশীল ছিল, অতিথিপরায়ণতা, আমানতদারি, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করা, আকিদা বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করা, স্পষ্টভাষী, অশ্বচালনা, তীর নিক্ষেপে সিদ্ধহস্তÑ এসব ছিল তাদের সহজাত গুণ, পলায়ন শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা তারা গর্হিত কাজ বলে মনে করতো। তবে বর্তমান যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্র এমনকি বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতো ঐ সব সদগুণের ভিন্ন ব্যাখ্যা ছিল আরবদের। যেমন সাহসের অর্থ ছিল ব্যাপক হত্যাকান্ড ও রক্তপাত ঘটানো। আত্মসম্ভ্রমবোধ বলতে তারা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করা বুঝাতো। তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বস্ততা ও সংহতি ছিল নিজ গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ মিত্রদেরকে সমর্থন করা, তা সত্যই হোক অন্যায়ই হোক। মদ, নারী ও যুদ্ধের প্রতি তারা তীব্রভাবে আকৃষ্ট ছিল। তারা কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিল। তারা উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করতো। এতসব সত্ত্বেও তারা সাহিত্যচর্চায় ছিল উন্নত। বৈদেশিক বাণিজ্যে ছিল অগ্রসর। তারা রোমান জাতির আবির্ভাবের আগে উন্নত শহর ও নগর স্থাপন করেছিল যা অবস্থিত ছিল ইয়েমেনে। তারা ছিল তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ভাষা “আরবি ভাষার” অধিকারী। তাদের ছিল ৩৬০টি মূর্তি। তারা মনে করতো প্রতিদিনের ঘটনা ঐ ৩৬০টি মূর্তির যে কোন একটির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া বিভিন্ন গোত্র বিভিন্ন বস্তুর পূজা করতো। চিন্তাশীলরা চাঁদের পূজা করতো, কিনানাহ্ গোত্র চাঁদ; তাই গোত্র শুকতারা; লাখম গোত্র “বৃহস্পতি”, হিময়ার গোত্র “সূর্য” আসাদ গোত্র “বুধ গ্রহের” পূজা করতো। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বুঝা গেলা যে জীবনের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছাড়া শুধুমাত্র ভোগবিলাস আর স্বার্থ-উদ্ধারের মানসিকতা মানবসমাজকে কী  গভীর পঙ্কিল আবর্তে নিক্ষেপ করতে পারে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এমন নিষ্পেষণ, হানাহানি, অবিচার, শোষণ নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা আর অরাজকতার কারণ ছিল মানুষের অজ্ঞতা। আর অজ্ঞতার কারণেই মানুষ ছিল সঙ্কীর্ণ চিন্তার অধিকারী, সঠিক কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। হতাশা দুর্বলতা, হীনতার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে তারা নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করে তারই মধ্যে আরোধ্য বস্তুর সন্ধান করতো। এই পৌত্তলিকতা এবং শিরকবাদিতা মানুষের অন্তরে নিকৃষ্টতম দোষ ‘অহঙ্কারের’ ভিত্তি স্থাপন করে। আর অহঙ্কার মানুষকে তার অন্তর্দৃষ্টি সত্যের দিকে ধাবিত হতে দেয় না। এই নিকৃষ্ট দোষ “অহঙ্কারকে” ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করার একমাত্র অস্ত্র হলো কালেমা তৈয়্যবা-“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।” রাসূল সা. সেই কালেমা তৈয়্যবা নিয়েই এলেন। যার অর্থ আমরা হয়তো সংক্ষিপ্ত আকারে বুঝি, কিন্তু আবু জেহেল, আবু লাহাব তার যথাযথ মর্মার্থ বুঝতো বলেই চরম বিরোধিতা করেছিল। কালেমা তৈয়্যবার যথার্থ অর্থ মাওলানা মওদূদী (রহ) বর্ণনা করেছেন - “মানুষ আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও নিজের পৃষ্ঠপোষক, কার্যসম্পাদনকারী প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ দূরকারী, ফরিয়াদ শ্রবণকারী ও গ্রহণকারী এবং সাহায্যদাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করিবে না। কেননা তিনি ব্যতীত আর কাহারো নিকট ক্ষমতা নাই।” “আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও কল্যাণকারী মনে করিবে না, কাহারও সম্পর্কে অন্তরে ভীতি অনুভব করিবে না, কাহার ওপর নির্ভর করিবে না, কাহার প্রতি কোন আশা পোষণ করিবে না এবং এই কথা বিশ্বাস করিবে না যে, আল্লাহর অনুমোদন ব্যতীত কাহারও ওপর কোন বিপদ মুসিবত আপতিত হইতে পারে। কেননা সকল প্রকার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার একমাত্র আল্লাহরই। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও নিকট দোয়া প্রার্থনা করিবে না, কাহারও নিকট আশ্রয় খুঁজিবে না, কাহাকেও সাহায্যের জন্য ডাকিবে না এবং আল্লাহর ব্যবস্থপনায় কাহাকেও এতখানি প্রভাবশালী বা শক্তিমান মনে করিবে না যে তাহার সুপারিশে আল্লাহর ফয়সালা পরিবর্তিত হইতে পারে। কেননা তাহার রাজ্যে সকলেই ক্ষমতাহীন প্রজামাত্র। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও সম্মুখে মাথা নত করিবে না এবং কাহারও উদ্দেশ্য মানত মানিবে না। কেননা এক আল্লাহ ব্যতীত ইবাদাত (দাসত্ব আনুগত্য ও উপাসনা) পাইবার অধিকারী আর কেহই নাই। আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তার দেয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারও আসলেই নাই।” কলেমা তাইয়্যেবার উক্ত অর্থই নির্ধারণ করে দেয় ক্ষমতাধররা নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য মনগড়া আইন তৈরি করে তার প্রচলন করে  এবং তার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। আর মানুষের মনগড়া নীতিনিয়ম, আইন-কানুন, রসম-রেওয়াজই সমস্ত অনিষ্টের মূল। হতে পারে তা  একজন সংসারের কর্তারূপী ক্ষমতাধর অথবা ছোট্ট মুদি দোকানের কর্তারূপী ক্ষমতাধর অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর। আসলে সমস্ত ক্ষমতার উৎস এবং সমস্ত আইন বিধানের উৎস একমাত্র এক আল্লাহতায়ালা। কারণ তিনিই স্রষ্টা। যারা এই সত্যকে মেনে নিল তারা কল্যাণময় এক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিবাসী হলো। এই সত্যকে যারা মেনে নিতে পারে না তারাই অহঙ্কারী। হযরত সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শামমাস (রা) আরজ করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি স্বভাবগতভাবে রূপ সৌন্দর্য পছন্দ করি এবং নিজে সাজ-সজ্জা গ্রহণ করে থাকি এটা কি অহঙ্কার? মহানবী সা. বললেন, “না এটা অহঙ্কার নয় বরং অহঙ্কার হচ্ছে হক ও সত্যকে অপছন্দ করা, অঙ্গীকার করা এবং লোকদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা অথচ তারা তোমারই মত আল্লাহর বান্দা অথবা তারা তোমার তুলনায় শ্রেষ্ঠও হতে পারে।” আজ আমাদের দেশেই শুধু নয়, সারা পৃথিবীতে যে সংস্কৃতির প্রচলন, যাকে অপসংস্কৃতি বলা হয় তা সেই সত্য অস্বীকারকারী অহঙ্কারীদের সৃষ্ট। যা রসূল সা. এর আগমনের  প্রাক্কালে সার পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ছিল। আমাদের দেশে রাম ও বামপন্থী এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাম ও জড়বাদীরা হয়তো বই পড়ে লেখাপড়া শিখেছে, হয়তো বস্তুর ব্যবহারে ধনী ও চাকচিক্যময় জীবনের অধিকারী হয়েছে কিন্তু আসলে তারা অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। তাদেরই অজ্ঞতা ও অশিক্ষার ফসল হিসেবে বর্তমান পৃথিবীর যে জাহিলিরূপ আমরা দেখছি যা পনেরশত বছর পূর্বে সমস্ত পৃথিবীতে বিরাজ করেছিল। পৃথিবীর সমস্ত দেশে সমস্ত লোকালয়ে যে কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত আছে তা মহানবী সা. আনীত সত্যজ্ঞান থেকে উ™ভূত। মহানবীর সা. নবুওয়ত প্রাপ্তির সূচনা থেকে আজ অবধি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে কলেমা তৈয়্যবা এবং ঈমান থেকে  উ™ভূত সংস্কৃতিক রূপরেখা। যে খ্রিস্ট ধর্ম বিকৃত হয়ে গেছে, পুরোহিতদের গির্জাকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা যা সমস্ত ইউরোপকে দোজখ সমতুল্য করে ফেলেছিল সে বিকৃত কর্মও সংশোধিত হয়েছে ইসলামের পরশে। গির্জাকেন্দ্রিক অত্যাচার তিরোহিত হয়েছে। বাথরুম ব্যবহার, ঘরে প্রবেশের অনুমতি এবং সেচব্যবস্থা, হাসপাতাল ইত্যাদি থেকে শুরু করে মানুষের জীবনের সমস্ত দিকগুলিতে যে কল্যাণময়তার স্বরূপ সমস্ত পৃথিবীতে আমরা দেখেছি তা ইসলামেরই অবদান। আর যত অকল্যাণ তা সবই পৌত্তলিক, শিরক উদ্ভূত এবং নাস্তিকতা থেকে সৃষ্ট। পরিবার ব্যবস্থা, পিতামাতার অধিকার, স্ত্রীর অধিকার, সন্তানের অধিকার, এতিম ও বৃদ্ধদের প্রেমময় নিরাপত্তা- তথা দুর্নীতির উচ্ছেদ, মানব-সেবা, বৈধ-অবৈধ পন্থার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, ভালো মন্দের স্বরূপ, এ সবই ইসলামের দেখানো- মহানবী সা. আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে আরবদের কাছে সাহস, আত্মমর্যাদা ইত্যাদি কি অর্থ বহন করতো। সমস্ত দুনিয়াবাসীর কাছে প্রত্যেকটি সদগুণের অর্থ এভাবে কদর্য পন্থায় ব্যবহৃত হতো। আজ যেমন আমাদের দেশের মিডিয়া বা চলচ্চিত্রে যে অশ্লীলতা তা বাম ও রামদের কাছে শ্লীল। যা গোপন ব্যবহারে সুন্দর  রাম-বামরা তা প্রকাশ্যে ব্যবহার করে। যা সাধারণভাবে লজ্জার বিষয় তা বাম ও রামদের কাছে লজ্জাই নয়। লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্যে হত্যাযজ্ঞ তারা সমর্থন করে। তিল তিল করে গড়ে তোলা কোন সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান কলমের কয়েকটি খোঁচায় তারা কলঙ্কিত করে দিচ্ছে। তারা অপরাধীর শাস্তির কথা বলেছে কিন্তু যে আইন ব্যবস্থা অপরাধী তৈরি করে সেই আইনব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলছে না। কারণ তারা জানে কোন আইন-ব্যবস্থা অপরাধ ও অপরাধী নির্মূল করে। আর জানে বলেই  তারা ইসলামের আইন ব্যবস্থাকে ব্যান্ড করার পাঁয়তারা করেছে। কারণ তারা চায় অপরাধী তৈরির কারখানাটি থাকুক, তবেই তাদের রাজত্ব স্থায়ী থাকবে। এসবই পনের শত বছরের পূর্বেকার পৌত্তলিক ও জাহিলি সমাজের চিন্তধারা। তারাই ‘ভাস্কর্য’ নামের মূর্তি ব্যবস্থা জারি রেখেছে। ইন্দ্র যেমন রাজা অশ্বরীশকে তার মূর্তির বেদিতে ফুল ছড়াতে বলেছিল রাম ও বামরা সে ব্যবস্থা চালু রেখেছে। এসব কিছুই অজ্ঞতা থেকেই সৃষ্ট। এর ফলে হচ্ছে শিরকবাদিতা। মূর্তি পূজা থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার পূজা, ব্যক্তি পূজা, নফসের পূজা, ক্ষমতাধর ব্যক্তির পূজা (যা থেকে ঘুষ প্রথার সৃষ্টি) নিজস্ব স্বার্থের পূজা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আজকের বিশ্বসংস্কৃতির যত কল্যাণময় রূপ তা মহানবীর সা. দেখানো পথ ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্রুসেডের যুদ্ধ্ এসে ইউরোপীয়রা ইসলামের অনেক কিছুই গ্রহণ করে নিজেদের দেশে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই বলা হয় ইউরোপে ইসলাম আছে কিন্তু মুসলমান নেই। অর্থাৎ তাদের আইনব্যবস্থার বেশির ভাগই ইসলাম থেকে নেয়া। বিশ্বসংস্কৃতির যে কল্যাণময় উজ্জ্বল দিকগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মহানবীর সা. সাহাবী (রা), পরবর্তীকালের তাবেঈ, তাবে-তাবেঈন ও আলেম-উলামা এবং মুসলিম সৈনিকরাই তার বাহক। মহানবীর সা. উম্মত হিসেবে আল্লাহ ঘোষিত শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে আজ আমাদেরকে আমাদের সমস্ত তৌহিদী জ্ঞান নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে হবে- শুধুমাত্র পরকালে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়- আল্লাহ সেই তৌফিক আমাদের দান করুন। লেখক : মরহুম আবুল কাশেম মিঠুন সাবেক চলচ্চিত্র অভিনেতা,  সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন আমরা জানি অজ্ঞতা এবং অশিক্ষা মানুষকে প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ও ক্ষমতাধরদের আজ্ঞাবহ করে রাখে। অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার ফলে মানুষের মানসিক বিকাশ সাধিত হয় না, চিন্তাধারা প্রসারিত হয় না এবং নৈতিক বলবীর্য হারিয়ে মানুষ নিজেকেই বস্তুসদৃশ করে তোলে। অর্থবিত্তের লোভ, চোখরাঙানি, দাপট অথবা আদর-ভালোবাসা, মমতা দিয়ে তাকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। অজ্ঞ ও অশিক্ষিত মানুষের বহুবিধ পাওয়া না পাওয়ার অতি আবেগগ্রস্ত মনস্তাত্ত্বিকতাই ব্যক্তি পূজার জন্ম দেয়। অর্থ, দাপট অথবা ভালোবাসা প্রেম দিয়েও যা পাওয়া যায় না- সেই ‘পূজা’ পাওয়ার জন্য ধুরন্ধর ক্ষমতাধররা পূজারির অন্তরাত্মায় বসবাসের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এবং দয়া-দাক্ষিণ্য ও অতিমানবিক আবেদনের বিভিন্ন আঙ্গিকের অভিনয় দিয়ে একটা দেবত্বের স্বরূপ তার অন্তরে মুদ্রিত করে রাখতে প্রয়াস পায়। অতি কাছের তোষামোদি চক্র তাতে বাতাস করে নরমকে শক্ত অথবা গরমকে ঠান্ডা করে তোলে। অন্যদিকে হিংস্র বর্বর খুনপিয়াসী মানুষকেও অশিক্ষিত অজ্ঞ লোক পূজা করে প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার শক্তি সরবরাহের অস্ত্র হিসেবে। এরূপভাবে অজ্ঞ অশিক্ষিত ব্যক্তি এবং ধুরন্ধর ক্ষমতাধরদের সমন্বয়েই মূর্তিপূজার উদ্ভব হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ ও গবেষক আল বিরুনী মূর্তিপূজার উদ্ভব সম্পর্কে তার বিশ্ববিখ্যাত ‘ভারত-তত্ত্ব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমাদের পয়গম্বর ও কাবাগৃহের যদি একটি ছবি বানানো হয় এবং কোন অশিক্ষিত নারী এবং পুরুষের সামনে তা পেশ করা হয় তাহলে তা দেখে তো তারা আহ্লাদিত হবেই। সেই সাথে সেই ছবিতে তারা চুমু খাবে, তাকে গালে গলায় সব জায়গায় রেখে আদর করবে এবং সমানে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, যেন তারা কোন ছবি দেখছে না বরং মূল ব্যক্তিকেই দর্শন করছে এবং এমন অনুভব করবে যেন মক্কা-মদিনায় হজের ছোট-বড় হুকুম-আহকামগুলো পালন করছে। ...এটাই তাকে মূর্তি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করে আর কিছু অত্যধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি পয়গম্বর, মুনি-ঋষি, ফেরেশতা ইত্যাদির সম্মানে স্মারক (ভাস্কর্য) নির্মাণ করে, যার উদ্দেশ্য অনুপস্থিতির সময়ে বা মরণের পরে তাদের স্মৃতি নিয়ে মানুষের মনে শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়ে দেয়া। ...এভাবে তাদের চিত্র ও স্মৃতি চিহ্নগুলিকে (ভাস্কর্য) সম্মান করাটা তাদের ধর্মবিশ্বাসের অনিবার্য অঙ্গ বানিয়ে দেয়া হয়।” আল-বিরুনী আরো লিখেছেন; ‘‘...এ ধরনের ধ্যাণ-ধারণা কেবল অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে। ...যারা মুক্তি পথের পথিক বা যারা দর্শনশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করে এবং যারা বিমূর্ত সত্যকে লাভ করতে ইচ্ছুক যাকে তারা ‘সারসত্তা’ বলে, তারা ইশ্বর ছাড়া আর কারোরই উপাসনা করে না। আর তারা ঐ ইশ্বরকে মূর্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করে তার উপাসনা করার কথা কল্পনাও করতে পারে না।” হিন্দুরা বলে যে নিম্নোক্ত ঘটনা থেকে মূর্তি নির্মাণ ও পূজা শুরু হয়েছে- ‘ইন্দ্র রাজা অম্বরীশকে বলেছিলেন, যখন মানবসুলভ বিস্মরণশীলতা তোমাকে অভিভূত করে তখন তোমাকে নিজের জন্য এমন একটি প্রতিমা বানিয়ে নেয়া উচিত যেমনটি আমি তোমার ওপর প্রকাশ করেছিলাম, মূর্তিবেদির ওপর সুগন্ধ ও ফুল ছড়িয়ে তেমনই তুমি আমাকে আরাধনা করবে। এভাবে তুমি আমাকে স্মরণ করবে।” উপরোক্ত বিবরণগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় অজ্ঞতা ও অশিক্ষার ফলে মানুষ অন্তর্নিহিত সত্যের দিকে ধাবিত না হয়ে প্রকাশমান রূপে ঝলক ও চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা অনুসরণ ও অনুকরণ করে। সত্যের দিকে অগ্রসর না হওয়ার কারণে মানুষ অত্যধিক কল্পনাপ্রবণ, সঙ্কীর্ণ মানসিকতা এবং স্বার্থান্ধ হয়ে ওঠে। আর এই দোষগুলোর ভিত্তি হলো অহঙ্কার। অহঙ্কার মানুষকে স্বার্থ উদ্ধারকারী ব্যক্তিকে পূজা করতে শেখায় এবং যে স্বার্থ উদ্ধারকারী নয় সে যতই সত্যপথের পথিক হোক বা মহামানব হোক তাকে তারা সহ্য করতে পারে না। অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার কারণে মানুষ যাতে পথভ্রষ্ট না হয়, হানাহানি না করে, ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী না হয় সে জন্য আল্লাহ তাআলা প্রথম সৃষ্ট মানুষকে নবী হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন। নবীর মাধ্যমে অজ্ঞতা দূর করে করণীয় কাজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অবহিত করেন। প্রথম মানুষ আল্লাহর নবী হজরত আদম (আ) কে দুনিয়াতে পাঠাবার সময়েই আল্লাহ বলেছিলেন- “আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও, তবে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে (আইন ব্যবস্থা সম্পর্কিত) হেদায়াত আসবে, অতঃপর যে আমার বিধান মেনে চলবে তার কোন ভয় নেই, তাদের কোনো প্রকার উৎকণ্ঠিত হতে হবে না। আর যারা (আমার আইন কানুন) অস্বীকার করবে এবং আমার আয়াতসমূহ মিথ্যা প্রতিপন্ন (করে লাগামহীন জীবন যাপন) করবে তারা অবশ্যই জাহান্নামের বাসিন্দা হবে, তারা সেখানে চিরদিন থাকবে।” (সূরা আল-বাকারাহ : ৩৮-৩৯) এইভাবে আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতে মানুষ পাঠিয়ে তাঁর হেদায়েত দিয়ে মানুষের অজ্ঞতা দূর করেছেন। অজ্ঞতা ও অশিক্ষা একটি অভিশাপ-একটি ভয়াবহ মারাত্মক অপরাধ। এখানে অজ্ঞতা ও অশিক্ষা বলতে এটা নয় যে, ‘আমি ডাক্তারি বিদ্যা জানি না তাই আমি অভিশপ্ত বা অপরাধী। অথবা আমি দীর্ঘ জীবন একজন পারিবারিক সদস্য হয়েও রন্ধনপ্রণালী জানি না তাই আমি অভিশপ্ত বা অপরাধী।’ বিষয়টি মোটেই তা নয়। অজ্ঞতা ও অশিক্ষা হচ্ছে এমন বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও জ্ঞান থাকলে মানুষ আর অজ্ঞ থাকে না। তার অন্তর্লোক কষ্টিপাথরের মতো সঠিক স্বর্ণ চিনে নিতে পারে। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত বস্তুগত সমাহারে সে নিজের চিন্তা ও কর্মকে কিভাবে পরিচালিত করবে সে বিষয়ে জ্ঞান। সেই জ্ঞানই মানুষকে সঠিক পথে চলার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়। সঠিক মানুষ চেনার মনশ্চক্ষু খুলে দেয়। হযরত আলী (রা) বলেছেন ‘‘কোন বস্তু বা মানুষকে দিয়ে সত্য বিচার করো না, আগে সত্যকে জানো সঠিক বস্তু বা সঠিক মানুষ আপনাতেই তোমার চোখে ভাস্বর হয়ে উঠবে।’’ সেই জ্ঞান হচ্ছে (ক) মানুষের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক কি! অর্থাৎ তৌহিদ সম্পর্কে জ্ঞান। (খ) পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা কি, সৃষ্টিকর্তা কি কি কাজের জন্য তাকে সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা, এসব জ্ঞান নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা শিক্ষা দিয়েছেন, অর্থাৎ রিসালাত সম্পর্কে জ্ঞান। (গ) এই পৃথিবীতে মানুষ যে সব চিন্তাপদ্ধতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে এবং তারই আলোকে কর্ম সম্পাদন করবে মৃত্যুর পর স্রষ্টা তারই আলোকে বিচার ফয়সালা করবেন। মানুষ তখন ভালো কাজের ভালো ফল, খারাপ কাজের খারাপ ফল পাবে। অর্থাৎ আখেরাত সম্পর্কে জ্ঞান। তৌহিদ, রিসালাত ও আখেরাত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা মানুষের জন্য ফরজে আইন। পৃথিবীর বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল মানুষকে আল্লাহতায়ালা উক্ত জ্ঞান অর্জন করার কঠোর তাগাদা দিয়েছেন। এই জ্ঞান অর্জন না করলে মানুষ তার কাজ কর্মে ভুল করবে, ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে, স্বার্থান্ধ হবে, অন্য মানুষকে অমানবিক ভাবে ব্যবহার করবে, বস্তুর অকল্যাণকর ব্যবহার করবে এবং নৈতিক চরিত্র হারিয়ে অপরাধী কর্মে লিপ্ত হবে। তাই ফরজে আইনবিষয়ক উক্ত জ্ঞান অর্জন করতেই হবে। নবী-রাসূলদের উম্মতগণ উত্তরাধিকার সূত্রে উক্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ। তাই অন্যের কাছে এই জ্ঞান কথার মাধ্যমে লেখনীর মাধ্যমে এবং আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া মুসলমানদের জন্য ফরজে আইন। যাদের কাছে উক্ত জ্ঞান আছে এবং সরল বিশ্বাসে খুশিমনে যারা তা মান্য করে ও পালন করে তারাই মুসলমান নামে অভিহিত। আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছেনÑ “এখন দুনিয়ার সেই সর্বোত্তম দল তোমরা যাহাদিগকে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কার বিধানের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে, তোমরা ন্যায় ও সৎকাজের আদেশ করো, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখিয়া চলো।’’Ñ মুসলমানরাই আল্লাহর দেয়া আইন বিধান প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়াতে কল্যাণ স্থাপন করতে পারে। অন্য মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা অথবা তৌহিদ রিসালাত ও আখেরাতের খবর পৌঁছে দেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজে আইন। যাতে কেয়ামতে অপরাধী ব্যক্তি বলতে না পারে যে উক্ত জ্ঞান তো আমাদের কাছে ছিল না তাই আমরা অপরাধ করেছি।” (সূরা আলে ইমরান-১১০) আল্লাহতাআলা এ বিষয়টিও পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেনÑ “আল্লাহ তায়ালা নবীদেরকে সুসংবাদ প্রদানকারী এবং পরিণতির ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছেন, যাতে করে মানুষ তার কাছে এরূপ বিতর্ক তোলার সুযোগ না পায় যে আমরা তো বেখবর ছিলাম। আর আল্লাহ সর্বাবস্থায়ই প্রবল পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন-নিসা-১৬৫) এখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে মানুষকে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে অন্ধকারে আল্লাহ ছেড়ে দেননি বা ফেলে রাখেননি। তাকে সঠিক পথ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তার মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেছেন, তার করণীয় সম্পর্কে জ্ঞাত করেছেন। প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে শেষ নবী সা. পর্যন্ত যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা নবী পাঠিয়ে মানুষকে সম্পূর্ণভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। হযরত মুহাম্মদ সা. শেষ নবী হওয়ার তাৎপর্য তিনি নিজেই বলে দিয়েছেন-“পূর্ববর্তী নবীগণের  মধ্যে আমার উপমা সেই ব্যক্তির ন্যায় যে একটি সুরম্য পূর্ণাঙ্গ ও সুশোভিত প্রাসাদ নির্মাণ করলো কিন্তু একটি ইটের স্থান পরিত্যক্ত (অসম্পূর্ণ রেখে) দিল। জনতা প্রাসাদটি প্রদক্ষিণ করতো এবং তাতে বিস্মিত হয়ে বলতো তার নির্মাতা যদি ঐ ইটের স্থানটি পূর্ণ করতো। অতএব আমি নবীগণের মধ্যে সেই ইটের স্থান সমতুল্য।’’-উবাই ইবনে কাব (রা) বর্ণিত। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার উন্মেষ ঘটে গেছে, আবর্তন ও বিবর্তনের মাধ্যমে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতিক স্বরূপ একটা নির্দিষ্ট অবয়ব পেয়েছে। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতি নিয়মের অধীনে একটি কল্যাণময় পৃথিবী তৈরি করতে হলে হযরত মুহাম্মদ সা. আনীত কুরআন এবং তার দেখানো পথ অনুসরণ করলেই তা সম্ভব। আর নতুন কোন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদ্ভব হবে না সেটা নয় তবে যা-ই ঘটুক তা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতেই সঠিক পথে চালনা করা সম্ভব। বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির স্বরূপ বিচার করতে হলে নবীর সা. আগমনের প্রাক্কালে পৃথিবীর রাজনীতি অর্থনীতি ও সংস্কৃতির রূপ কেমন ছিল তা আমাদের সামনে থাকা দরকার। স্মরণ রাখা দরকার যে আল্লাহ তাআলার পাঠানো নবী ও রাসূলরা যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন তা মানুষ এক সময় বিকৃত করে ফেলেছে, জনপদ আবার অকল্যাণের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, তখনই আল্লাহ তাআলা নবী পাঠিয়েছেন, এইভাবে লক্ষ লক্ষ নবী-রাসূলের আগমন ঘটেছে। আর তাদের আনীত আইন ব্যবস্থাও বিলুপ্ত হয়েছে। শেষ নবী সা. যখন আগমন করেন তখন সমস্ত পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ছিল এব বিকৃতির শিকার। পরিবার সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থব্যবস্থা, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সংস্কৃতি ছিল অমানবিক ও অশ্লীল পন্থার অনুসারী। আজকের  পৃথিবীতে যত জনগোষ্ঠী বিদ্যমান তাদের মধ্যে যতটুকু কল্যাণ ও মানবিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করা যায় তা একমাত্র ইসলামেরই অবদান এটা অকাট্যভাবে সত্য। শেষ নবী সা. আনীত জ্ঞান উপযুক্ত মানুষের মাধ্যমে সার্বিকভাবে অর্থাৎ সত্যিকার মুসলমানদের ছাড়া কেয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে পৌঁছানোর অব্যাহত চেষ্টা থাকবে বলেই নতুন করে নবী পাঠানোর কোন যুক্তি থাকে না, আর তাই কোন নবীর আগমন ঘটবে না। নবী সা. আগমনের প্রাক্কালে ভারতবর্ষ, আফ্রিকা, এশিয়া  ও ইউরোপের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ অবস্থান নির্ণয় এবং বিশ্লেষণ করার সুযোগ আলোচ্য প্রবন্ধে নেই তবে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের খোদ মক্কানগরীতে রাসূলের সা. একটি ঘটনা তাবৎ মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরে। মদিনার খাযরাজ গোত্রের একজন নেতা নাম আসআদ বিন যুরারাহ মক্কায় গেল কুরাইশদের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য নেবার জন্য, যাতে মদিনায় তাদের দুশমন আওস গোত্রকে পদানত করতে পারে। আসআদ কুরাইশ নেতা উতবাহ বিন রাবিয়ার বাড়িতে গেল। উতবাহ বললো, আমরা তোমাকে কোন সাহায্য আপাতত করতে পারবো না, কারণ এক কঠিন সমস্যায় পড়েছি আমরা। আমাদেরই এক ব্যক্তি (রাসূল সা) আমাদের উপাস্যদের সম্পর্কে কটূক্তি করছে। মিষ্টি মধুর ব্যবহার আর ভাষা দিয়ে আমাদের একদল যুবককে তার দলে ভিড়িয়েছে। এভাবে সে আমাদের নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। হজের মৌসুমে আগত লোকদেরকে সে তার ধর্মের দিকে আহ্বান জানায়। এসব নিয়ে আমরা খুব বিপদে আছি। আসআদ অগত্যা মদিনায় ফিরে যাবার মনস্থ করে। কিন্তু কাবা তাওয়াফ ও জিয়ারত না করে মদিনায় ফিরে যাওয়া শোভনীয় নয়। যদিও উতবাহ বলেছে কাবাঘর জিয়ারত করতে গেলে লোকটির (রাসূল সা) কথা শুনে তুমি কিন্তু বদলে যেতে পার। তাই কাবা জিয়ারত করতে গেলে কানের ভেতর তুলো দিয়ে রেখো। আসআদ মসজিদুল হারামে যায়- তাওয়াফ করার সময় মহানবীকে সা. দেখেন যে তিনি হুজরতে ইসমাঈলে বসে আছেন। সে তাঁর সামনে গেল না। কিন্তু শেষে কৌতূহল দমন করতে না পেরে মহানবী সা. এর সামনে গিয়ে-আরবদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সম্ভাষণ জানালোÑ ‘‘আপনার প্রাতঃকাল মঙ্গলময় হোক”।- সম্ভাষণটি যদি আমাদের রেডিও, টিভি ও চ্যানেলের সম্ভাষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায় তবে আমাদের বর্তমান সময়ের সংস্কৃতি ও সে সময়ের আরবদের সংস্কৃতির একটা সেতুবন্ধ আমরা খুঁজে পাই। আমাদের সংস্কৃতির এখন যারা বাহক বলে দাবি করেন তাদের বিশ্বাস, তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি বুদ্ধিবৃত্তিও এ সবের সংস্কৃতির স্বরূপ জাহিলি সংস্কৃতির আধুনিক সংস্করণ ছাড়া কিছুই নয়। সুদ, জুয়া, মদ, অশ্লীলতা, বর্ণপ্রথা, শোষণ-শাসন পদ্ধতি সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ তাদের সংস্কৃতিতে বিদ্যমান। যাই হোক-আসআদের সম্ভাষণের জবাবে মহানবী সা. বললেন, ‘‘আমার মহান প্রভু আল্লাহ এর চেয়ে উত্তম সম্ভাষণ ও সালাম অবতীর্ণ করেছেন। আর তা হচ্ছে, ‘‘আসসালামু আলাইকুম”Ñ আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আসআদ আকৃষ্ট হলো। সে মহানবীর সা. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। মহানবী সা. সূরা আনআমের ১৫১ ও ১৫২ নম্বর আয়াত পড়ে শোনালেন। আসআদের অন্তরে তা গভীর প্রভাব বিস্তার করলো এবং তিনি তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেন। আসআদ (রা) কেন ইসলাম গ্রহণ করলেন? কি ছিল দু’টি আয়াতের মধ্যে? তাঁর নিজের জীবন, মন-মস্তিষ্ক, তাঁর রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি কোনখাতে প্রবাহিত হচ্ছিল? হঠাৎ তার গতি পরিবর্তন হলো কেন? এসবের জবাব হয়তো ব্যাপক বিস্তৃত। কিন্তু সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্ছে অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে প্রবেশ করা। উক্ত আয়াতে ছিল- ‘‘তোমার সবকিছুর মালিক, রব, প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ- তাঁর কোন শরিক নেই, তোমরা শিরক করো না।’’ অর্থাৎ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীর জনবসতি তখন শিরকে লিপ্ত ছিল। আর এর একমাত্র কারণ ছিল অজ্ঞতা ও অশিক্ষা। আয়াতের মধ্যে আরো ছিল, ‘‘তোমাদের পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো। আমাদের জেনে রাখতে  হবে-যখন একটা বিষয়ের অনুপস্থিতি থাকে তখনই বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়।’’ অর্থাৎ পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ তখনকার পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল। উক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেছেন, ‘‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমরা তোমাদেরকে এবং তাদেরকে জীবিকা দান করি। তোমরা গোপন ও প্রকাশ্য পাপাচারের নিকটবর্তী হয়ো না।’’ এ ছাড়াও রয়েছে অন্যায় হত্যা নিষিদ্ধকরণ, অনাথের সম্পত্তি হস্তগত না করা, ন্যায়পরায়ণতার সাথে ওজন করা, নিকটাত্মীয় হলেও ন্যায্য কথা বলা, আল্লাহর সাথে যে অঙ্গীকার (অর্থাৎ আল্লাহর আইন বিধান মেনে চলা) পূর্ণ করা ইত্যাদি। একটি সূর্যই সমস্ত পৃথিবীকে আলোকিত করে। তেমনি আল্লাহতায়ালার হেদায়াত বাণী সূর্যের আলোর চেয়েও চিরন্তন চিরভাস্বর-সমস্ত জনগোষ্ঠীর অন্ধকার জীবনে আলোস্বরূপ। তাই অন্ধকারের বাসিন্দা আসআদ (রা) আলোর সন্ধান পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ত্যাগ করলেন। মহানবীর সা. আগমনের পূর্ব থেকেই সমস্ত পৃথিবীর অবস্থা তৎকালীন আরবদের চেয়ে কোন অংশে কম জাহিলি ছিল না। বরং কোন কোন জনপদে আরো বীভৎস ভয়ঙ্কর অবস্থা বিদ্যমান ছিল। যেমন সমগ্র আফ্রিকার মানুষ মানুষের গোশত খেত। দাস ব্যবসা ছিল অবারিত। বেশিরভাগ এলাকার মানুষ উলঙ্গ থাকতো। তাদের আচার আচরণ ছিল অসভ্য বর্বরসুলভ। নোংরামি ছিল তাদের সহজাত। মাত্র তিনশত বছর পূর্বেও তাদের অবস্থা এমন ছিল কিন্তু ইসলাম প্রবেশের পর তাদের জীবনধারা বদলে যায়। জনৈক ইউরোপীয় পর্যটকের উদ্বৃতি মাওলানা মওদূদী (রহ) উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমি (পর্যটক) যখন মধ্য সুদানের নিকট পৌঁছলাম তখন উপজাতীয় গোত্রগুলোর জীবনে আমি প্রগতির নিদর্শনাবলি দেখতে পেলাম, যা দেখে আমার ধারণা পাল্টে যেতে লাগলো। আমি দেখলাম, সেখানে মানুষ খাওয়ার প্রবণতা নেই, মুর্তিপূজারও অস্তিত্ব নেই, মদখোরি নেশাখোরিও বিলুপ্ত প্রায়। সকল গোত্রের লোক কাপড় পরে। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার ও পবিত্র রাখে এবং আচার আচরণে ভদ্রতা রক্ষা করে। ... নিগ্রো প্রকৃতি যেন কোন উন্নততর প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে আর এ সবই হচ্ছে ইসলামের কল্যাণে। ‘লোকোজা’ নামক জায়গাটা অতিক্রম করার পর আমি ইসলামী প্রচার কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছলাম এবং সেখানে এক অতি উচ্চাঙ্গের শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রশাসন সক্রিয় দেখলাম। চারদিকের লোকবসতিতে সর্বত্র সভ্যতার নিদর্শন পরিস্ফুট। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও কারিগরির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে এবং আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন একটি সুসভ্য দেশে এসে উপস্থিত হয়েছি। শুধু সুদান নয়, সমগ্র আফ্রিকার সেনেগাল, গায়েনা, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, লাগোস, ঘানা, নাইজেরিয়া ইত্যাদি এলাকার জনবসতি ইসলামের আইনের আলোয় আলোকিত হয়েছে।’’ সমগ্র চীনে ছিল প্রকৃতি পূজা, পুরোহিত পূজা, পূর্বপুরুষ পূজা। পরবর্তীদের বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে চীনের জনসমষ্টি নাস্তিক হয়ে পড়ে। বুদ্ধের মূর্তি পূজাই ছিল তাদের সারধর্ম। বনু উমাইয়ার যুগে চীনে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। ১৩ শতকে মার্কোপেলো লিখেছেন, ‘প্রায় সমগ্র উনান প্রদেশে মুসলমান হয়ে গেছে।’ দক্ষিণ চীন সম্পর্কে ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘সব শহরগুলোতে মুসলিম মহল্লা রয়েছে’। ১৫শ শতকে আলী আকবর নামক জনৈক মুসলিম বণিক লিখেছেন যে, পিকিং এ (বেইজিং) প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলিম পরিবার বাস করে। মালয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে পৌত্তলিকতা ও হিন্দু ধর্মের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। জাভা দ্বীপ, সুমাত্রা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মরক্কো দীপপুঞ্জ, বোর্নিও দ্বীপ, ফিলিপাইন, নিউগিনিÑ এ সব এলাকায় পৌত্তলিকতার অভিশপ্ত জনপদ ছিল, কোথাও ছিল হিন্দু পৌত্তলিকতা, কোথাও ছিল ‘যিশু ও মেরি’ পৌত্তলিকতা। আর শিরকউদ্ভূত যাবতীয় সঙ্কীর্ণতা, বর্ণপ্রথা, নির্যাতন, নিষ্পেষণ, অশ্লীলতা, অবিচার অনাচার তার শিকড় বিস্তার করেছিল সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভারতবর্ষে কথা তো সবার জানা-অসভ্যতা আর অপসংস্কৃতি ভারতীয় জনপদকে অমানবিকতার নিকৃষ্ট স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। চুরির অপরাধে এক এক জাতিগোষ্ঠীর এক এক শাস্তির বিধান ছিল। এখানেও বর্ণবাদ মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়েছিল। হত্যার অপরাধেও বর্ণভেদে শাস্তির বিধান ছিল। ব্রাহ্মণের শাস্তি ছিল-তাকে অন্ধ করে দেয়া হতো। ক্ষত্রিয়দেরকে অন্ধ করা হতো না, তাদেরকে বিকলাঙ্গ করা হতো। শূদ্র, বৈশ্য এবং অন্য জাতিকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হতো। ব্যভিচারিণীকে দেশ ছাড়া করা হতো। যুদ্ধবন্দীরা দেশে ফিরলে তাদেরকে কয়েকদিন উপবাস রাখা হতো, তারপর গোবর, গোমূত্র ও গো-দুগ্ধ খাওয়ানো হতো। এতেই অনেকে বমি করতে করতে মারা যেত। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং প্রজাদের বশীভূত করার জন্য রাজানার প্রচলন করেন। বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধকরণও সহমরণ প্রচলিত ছিল। সন্তানের জাত বিচার হতো মায়ের দিক থেকে। ধর্মগ্রন্থ পাঠ বৈশ্য ও শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কেউ পাঠ করলে তার জিহ্বা কেটে দেয়া হতো, কেউ শুনলে তার কানে গরম সীসা ঢেলে হত্যা করা হতো। তারা শরীরে কোন অংশের কেশ মুন্ডন করতো না। স্ত্রী সহবাসের পূর্বে গোসল করতো। তারা ঘরে প্রবেশের অনুমতি নিত না, কিন্তু বেরোনোর সময় অনুমতি নিত। থুথু ফেলা বা নাক ঝাড়ার সময় আশপাশের লোকদের পরোয়া করতো না। তারা তাদের পুস্তকের শিরোনাম গ্রন্থের শুরুতে দেয় না নিচে দেয়। মৃতের ব্যাপারে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর মতো তারাও ধারণা করে যে মৃত্যুর আত্মা মৃতের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। নারীকে তারা দাসী হিসেবে গণ্য করত। হিন্দুশাস্ত্রকার মনু বলেন, “মন্ত্র দ্বারা স্ত্রীলোকের সংস্কার হয় না এ কারণে তাদের অন্তঃকরণ নির্মল হতে পারে না।” তৎকালীন পৃথিবীতে পারস্য (ইরান-ইরাক) বিবেচিত ছিল সভ্যতার উচ্চভূমি হিসেবে। তাদের ধর্ম ছিল অগ্নিপূজা, মূর্তি পূজা, প্রকৃতি পূজা ইত্যাদি। সমাজ ছিল নিষ্ঠুর শ্রেণীবৈষম্যের শিকার। সম্পদের মালিকানা এবং স্বত্বাধিকার সাতটি পরিবার বা বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ জনগণ ছিল বঞ্চিত। অভিজাত সাতটি পরিবার শিক্ষাগ্রহণের অধিকার রাখত। সাধারণ জনগণ শিক্ষালাভের অধিকার থেকে ছিল বঞ্চিত। সম্রাট খসরু পারভেজের ছিল তিন হাজার স্ত্রী, বারো হাজার গায়িকা দাসী। এ ছাড়াও তার হেরেমে কয়েক হাজার নারী, দাসী ও নর্তকী ছিল। পারস্য এবং রোম বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো। এ ছাড়াও ছিল অভ্যন্তরীণ কোন্দল, যার পরিণতিতে চার বছরের মধ্যে চৌদ্দ বার ক্ষমতা বদল হবার ইতিহাসেও রয়েছে। প্রশাসনের ইতিহাস হত্যার ইতিহাস। পুত্র পিতাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসে। সম্রাট খসরুর চল্লিশ জন পুত্রসন্তানকে হত্যা করে শীরাভেই নামক সম্রাট। তৎকালীন রোম সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। ইহুদিরা ছিল রোমের ঘোর শত্রু। রোমে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড সংঘটিত হতো। ইহুদিরা একবার ইরান থেকে আশি হাজার খ্রিষ্টানকে ক্রয় করে দুম্বার মতো জবাই করেছিল। রোম সাম্রাজ্য খ্রিষ্টে বিশ্বাসী হলেও তারা মূলত যিশুর মূর্তি পূজা করতো। তাদের সমাজবন্ধন একেবারেই শিথিল হয়ে গিয়েছিল, দুর্নীতি ও কুসংস্কারে ডুবে গিয়েছিল। অশ্লীলতা ও পাপপঙ্কিলতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল রোম সাম্রাজ্য। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে শাসকবৃন্দ সিংহের খাঁচায় ফেলে দিয়ে তার নারকীয় বীভৎস মৃত্যু দর্শন করে তৃপ্ত হতো। সে সময়ে ইউরোপের অবস্থা শুধুমাত্র একটি উদাহরণেই যথেষ্ট মনে হবে। প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ফ্লামারিয়োন ইউরোপের একটি পুস্তকের কথা উল্লেখ করেছেন যেটি চারশ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ইউরোপে পঠিত হতো। উক্ত পুস্তকে আলোচনা হয়েছে- “একটি সুইয়ের অগ্রভাগের সরু ছিদ্রের মধ্যে কতজন ফেরেস্তা অবস্থান করতে পারে।” আর একটি আলোচনা এসেছে, “চিরন্তন পিতার বাম চোখের পুতুলি থেকে ডান চোখের পুতুলি পর্যন্ত দূরত্ব কত ফারসাখ।” (১ ফারসাখ= প্রায় ৬ কিলোমিটার)। এখন অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে তখনকার ইউরোপীয় সমাজে পুরোহিতরা কী দাপটের সাথে তাদের প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। তাদের গির্জাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা কি নিষ্পেষণ, নির্যাতন এবং অশ্লীল সংস্কৃতির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছিল সাধারণ মানুষকে। অজ্ঞতা, মূর্খতা, সংকীর্ণ জীবনযাত্রা, হিংস্রতা, পাশবিকতা, স্বার্থান্ধতা, অবিচার, বর্ণপ্রথা এবং আরো অন্যান্য চারিত্রিক ও নৈতিক দোষ-ত্রুটির ন্যায় বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান সমগ্র পৃথিবীর জনগোষ্ঠীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যা অন্যায় তা ছিল ন্যায়, যা ছিল লজ্জাজনক এমন স্বাভাবিক ও বৈধ হয়ে যায় যে সেসব কাজ মানুষ প্রকাশ্যে সমাধা করতো। মক্কা ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলো পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় ভিন্ন কিছু ছিল না। তাদেরও দাসব্যবস্থা ছিল তবে ইউরোপের মত অত্যাচার নির্যাতন এবং ভারতের মতো শোষণ আরবরা করতো না। দাসমুক্তির ব্যবস্থা তারা রেখেছিল। তারা নরখাদক ছিল না। কিন্তু অবুঝ কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দিত। আরব সমাজে অন্যান্য দেশের মতো নারীদেরকে পণ্যের মত কেনাবেচা করা হতো। নারীরা সমস্ত সামাজিক অধিকার ও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। তাদের জঘন্য কু-অভ্যাস ছিল মদ্যপান। পানশালা ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকতো। পানশালার ছাদের ওপর বিশেষ ধরনের পতাকা উড়াতো। তাদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল মদ। লটতরাজ, জুয়া, সুদ ও মানুষকে বন্দী করে দাস হিসেবে কেনাবেচা করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আরবরা সহাস্য ছিল, দানশীল ছিল, অতিথিপরায়ণতা, আমানতদারি, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না করা, আকিদা বিশ্বাসের জন্য আত্মোৎসর্গ করা, স্পষ্টভাষী, অশ্বচালনা, তীর নিক্ষেপে সিদ্ধহস্তÑ এসব ছিল তাদের সহজাত গুণ, পলায়ন শত্রুর প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা তারা গর্হিত কাজ বলে মনে করতো। তবে বর্তমান যুগে বিভিন্ন রাষ্ট্র এমনকি বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতো ঐ সব সদগুণের ভিন্ন ব্যাখ্যা ছিল আরবদের। যেমন সাহসের অর্থ ছিল ব্যাপক হত্যাকান্ড ও রক্তপাত ঘটানো। আত্মসম্ভ্রমবোধ বলতে তারা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবরস্থ করা বুঝাতো। তাদের দৃষ্টিতে বিশ্বস্ততা ও সংহতি ছিল নিজ গোত্র ও চুক্তিবদ্ধ মিত্রদেরকে সমর্থন করা, তা সত্যই হোক অন্যায়ই হোক। মদ, নারী ও যুদ্ধের প্রতি তারা তীব্রভাবে আকৃষ্ট ছিল। তারা কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিল। তারা উলঙ্গ হয়ে কাবা তাওয়াফ করতো। এতসব সত্ত্বেও তারা সাহিত্যচর্চায় ছিল উন্নত। বৈদেশিক বাণিজ্যে ছিল অগ্রসর। তারা রোমান জাতির আবির্ভাবের আগে উন্নত শহর ও নগর স্থাপন করেছিল যা অবস্থিত ছিল ইয়েমেনে। তারা ছিল তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ভাষা “আরবি ভাষার” অধিকারী। তাদের ছিল ৩৬০টি মূর্তি। তারা মনে করতো প্রতিদিনের ঘটনা ঐ ৩৬০টি মূর্তির যে কোন একটির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া বিভিন্ন গোত্র বিভিন্ন বস্তুর পূজা করতো। চিন্তাশীলরা চাঁদের পূজা করতো, কিনানাহ্ গোত্র চাঁদ; তাই গোত্র শুকতারা; লাখম গোত্র “বৃহস্পতি”, হিময়ার গোত্র “সূর্য” আসাদ গোত্র “বুধ গ্রহের” পূজা করতো। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বুঝা গেলা যে জীবনের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছাড়া শুধুমাত্র ভোগবিলাস আর স্বার্থ-উদ্ধারের মানসিকতা মানবসমাজকে কী  গভীর পঙ্কিল আবর্তে নিক্ষেপ করতে পারে। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এমন নিষ্পেষণ, হানাহানি, অবিচার, শোষণ নিপীড়ন, নিষ্ঠুরতা আর অরাজকতার কারণ ছিল মানুষের অজ্ঞতা। আর অজ্ঞতার কারণেই মানুষ ছিল সঙ্কীর্ণ চিন্তার অধিকারী, সঠিক কোন লক্ষ্য উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। হতাশা দুর্বলতা, হীনতার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে তারা নিজ হাতে মূর্তি তৈরি করে তারই মধ্যে আরোধ্য বস্তুর সন্ধান করতো। এই পৌত্তলিকতা এবং শিরকবাদিতা মানুষের অন্তরে নিকৃষ্টতম দোষ ‘অহঙ্কারের’ ভিত্তি স্থাপন করে। আর অহঙ্কার মানুষকে তার অন্তর্দৃষ্টি সত্যের দিকে ধাবিত হতে দেয় না। এই নিকৃষ্ট দোষ “অহঙ্কারকে” ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করার একমাত্র অস্ত্র হলো কালেমা তৈয়্যবা-“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।” রাসূল সা. সেই কালেমা তৈয়্যবা নিয়েই এলেন। যার অর্থ আমরা হয়তো সংক্ষিপ্ত আকারে বুঝি, কিন্তু আবু জেহেল, আবু লাহাব তার যথাযথ মর্মার্থ বুঝতো বলেই চরম বিরোধিতা করেছিল। কালেমা তৈয়্যবার যথার্থ অর্থ মাওলানা মওদূদী (রহ) বর্ণনা করেছেনÑ “মানুষ আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও নিজের পৃষ্ঠপোষক, কার্যসম্পাদনকারী প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ দূরকারী, ফরিয়াদ শ্রবণকারী ও গ্রহণকারী এবং সাহায্যদাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করিবে না। কেননা তিনি ব্যতীত আর কাহারো নিকট ক্ষমতা নাই।” “আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও কল্যাণকারী মনে করিবে না, কাহারও সম্পর্কে অন্তরে ভীতি অনুভব করিবে না, কাহার ওপর নির্ভর করিবে না, কাহার প্রতি কোন আশা পোষণ করিবে না এবং এই কথা বিশ্বাস করিবে না যে, আল্লাহর অনুমোদন ব্যতীত কাহারও ওপর কোন বিপদ মুসিবত আপতিত হইতে পারে। কেননা সকল প্রকার ক্ষমতা ও ইখতিয়ার একমাত্র আল্লাহরই। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও নিকট দোয়া প্রার্থনা করিবে না, কাহারও নিকট আশ্রয় খুঁজিবে না, কাহাকেও সাহায্যের জন্য ডাকিবে না এবং আল্লাহর ব্যবস্থপনায় কাহাকেও এতখানি প্রভাবশালী বা শক্তিমান মনে করিবে না যে তাহার সুপারিশে আল্লাহর ফয়সালা পরিবর্তিত হইতে পারে। কেননা তাহার রাজ্যে সকলেই ক্ষমতাহীন প্রজামাত্র। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও সম্মুখে মাথা নত করিবে না এবং কাহারও উদ্দেশ্য মানত মানিবে না। কেননা এক আল্লাহ ব্যতীত ইবাদাত (দাসত্ব আনুগত্য ও উপাসনা) পাইবার অধিকারী আর কেহই নাই। আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তার দেয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারও আসলেই নাই।” কলেমা তাইয়্যেবার উক্ত অর্থই নির্ধারণ করে দেয় ক্ষমতাধররা নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য মনগড়া আইন তৈরি করে তার প্রচলন করে  এবং তার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। আর মানুষের মনগড়া নীতিনিয়ম, আইন-কানুন, রসম-রেওয়াজই সমস্ত অনিষ্টের মূল। হতে পারে তা  একজন সংসারের কর্তারূপী ক্ষমতাধর অথবা ছোট্ট মুদি দোকানের কর্তারূপী ক্ষমতাধর অথবা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর। আসলে সমস্ত ক্ষমতার উৎস এবং সমস্ত আইন বিধানের উৎস একমাত্র এক আল্লাহতায়ালা। কারণ তিনিই স্রষ্টা। যারা এই সত্যকে মেনে নিল তারা কল্যাণময় এক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিবাসী হলো। এই সত্যকে যারা মেনে নিতে পারে না তারাই অহঙ্কারী। হযরত সাবেত ইবনে কায়স ইবনে শামমাস (রা) আরজ করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি স্বভাবগতভাবে রূপ সৌন্দর্য পছন্দ করি এবং নিজে সাজ-সজ্জা গ্রহণ করে থাকি এটা কি অহঙ্কার? মহানবী সা. বললেন, “না এটা অহঙ্কার নয় বরং অহঙ্কার হচ্ছে হক ও সত্যকে অপছন্দ করা, অঙ্গীকার করা এবং লোকদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা অথচ তারা তোমারই মত আল্লাহর বান্দা অথবা তারা তোমার তুলনায় শ্রেষ্ঠও হতে পারে।” আজ আমাদের দেশেই শুধু নয়, সারা পৃথিবীতে যে সংস্কৃতির প্রচলন, যাকে অপসংস্কৃতি বলা হয় তা সেই সত্য অস্বীকারকারী অহঙ্কারীদের সৃষ্ট। যা রসূল সা. এর আগমনের  প্রাক্কালে সার পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ছিল। আমাদের দেশে রাম ও বামপন্থী এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাম ও জড়বাদীরা হয়তো বই পড়ে লেখাপড়া শিখেছে, হয়তো বস্তুর ব্যবহারে ধনী ও চাকচিক্যময় জীবনের অধিকারী হয়েছে কিন্তু আসলে তারা অজ্ঞ ও অশিক্ষিত। তাদেরই অজ্ঞতা ও অশিক্ষার ফসল হিসেবে বর্তমান পৃথিবীর যে জাহিলিরূপ আমরা দেখছি যা পনেরশত বছর পূর্বে সমস্ত পৃথিবীতে বিরাজ করেছিল। পৃথিবীর সমস্ত দেশে সমস্ত লোকালয়ে যে কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত আছে তা মহানবী সা. আনীত সত্যজ্ঞান থেকে উ™ভূত। মহানবীর সা. নবুওয়ত প্রাপ্তির সূচনা থেকে আজ অবধি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে কলেমা তৈয়্যবা এবং ঈমান থেকে  উ™ভূত সংস্কৃতিক রূপরেখা। যে খ্রিস্ট ধর্ম বিকৃত হয়ে গেছে, পুরোহিতদের গির্জাকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা যা সমস্ত ইউরোপকে দোজখ সমতুল্য করে ফেলেছিল সে বিকৃত কর্মও সংশোধিত হয়েছে ইসলামের পরশে। গির্জাকেন্দ্রিক অত্যাচার তিরোহিত হয়েছে। বাথরুম ব্যবহার, ঘরে প্রবেশের অনুমতি এবং সেচব্যবস্থা, হাসপাতাল ইত্যাদি থেকে শুরু করে মানুষের জীবনের সমস্ত দিকগুলিতে যে কল্যাণময়তার স্বরূপ সমস্ত পৃথিবীতে আমরা দেখেছি তা ইসলামেরই অবদান। আর যত অকল্যাণ তা সবই পৌত্তলিক, শিরক উদ্ভূত এবং নাস্তিকতা থেকে সৃষ্ট। পরিবার ব্যবস্থা, পিতামাতার অধিকার, স্ত্রীর অধিকার, সন্তানের অধিকার, এতিম ও বৃদ্ধদের প্রেমময় নিরাপত্তা- তথা দুর্নীতির উচ্ছেদ, মানব-সেবা, বৈধ-অবৈধ পন্থার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, ভালো মন্দের স্বরূপ, এ সবই ইসলামের দেখানো- মহানবী সা. আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। পূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে আরবদের কাছে সাহস, আত্মমর্যাদা ইত্যাদি কি অর্থ বহন করতো। সমস্ত দুনিয়াবাসীর কাছে প্রত্যেকটি সদগুণের অর্থ এভাবে কদর্য পন্থায় ব্যবহৃত হতো। আজ যেমন আমাদের দেশের মিডিয়া বা চলচ্চিত্রে যে অশ্লীলতা তা বাম ও রামদের কাছে শ্লীল। যা গোপন ব্যবহারে সুন্দর  রাম-বামরা তা প্রকাশ্যে ব্যবহার করে। যা সাধারণভাবে লজ্জার বিষয় তা বাম ও রামদের কাছে লজ্জাই নয়। লগি-বৈঠা দিয়ে প্রকাশ্যে হত্যাযজ্ঞ তারা সমর্থন করে। তিল তিল করে গড়ে তোলা কোন সম্মানিত ব্যক্তির সম্মান কলমের কয়েকটি খোঁচায় তারা কলঙ্কিত করে দিচ্ছে। তারা অপরাধীর শাস্তির কথা বলেছে কিন্তু যে আইন ব্যবস্থা অপরাধী তৈরি করে সেই আইনব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলছে না। কারণ তারা জানে কোন আইন-ব্যবস্থা অপরাধ ও অপরাধী নির্মূল করে। আর জানে বলেই  তারা ইসলামের আইন ব্যবস্থাকে ব্যান্ড করার পাঁয়তারা করেছে। কারণ তারা চায় অপরাধী তৈরির কারখানাটি থাকুক, তবেই তাদের রাজত্ব স্থায়ী থাকবে। এসবই পনের শত বছরের পূর্বেকার পৌত্তলিক ও জাহিলি সমাজের চিন্তধারা। তারাই ‘ভাস্কর্য’ নামের মূর্তি ব্যবস্থা জারি রেখেছে। ইন্দ্র যেমন রাজা অশ্বরীশকে তার মূর্তির বেদিতে ফুল ছড়াতে বলেছিল রাম ও বামরা সে ব্যবস্থা চালু রেখেছে। এসব কিছুই অজ্ঞতা থেকেই সৃষ্ট। এর ফলে হচ্ছে শিরকবাদিতা। মূর্তি পূজা থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার পূজা, ব্যক্তি পূজা, নফসের পূজা, ক্ষমতাধর ব্যক্তির পূজা (যা থেকে ঘুষ প্রথার সৃষ্টি) নিজস্ব স্বার্থের পূজা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আজকের বিশ্বসংস্কৃতির যত কল্যাণময় রূপ তা মহানবীর সা. দেখানো পথ ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্রুসেডের যুদ্ধ্ এসে ইউরোপীয়রা ইসলামের অনেক কিছুই গ্রহণ করে নিজেদের দেশে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই বলা হয় ইউরোপে ইসলাম আছে কিন্তু মুসলমান নেই। অর্থাৎ তাদের আইনব্যবস্থার বেশির ভাগই ইসলাম থেকে নেয়া। বিশ্বসংস্কৃতির যে কল্যাণময় উজ্জ্বল দিকগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মহানবীর সা. সাহাবী (রা), পরবর্তীকালের তাবেঈ, তাবে-তাবেঈন ও আলেম-উলামা এবং মুসলিম সৈনিকরাই তার বাহক। মহানবীর সা. উম্মত হিসেবে আল্লাহ ঘোষিত শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে আজ আমাদেরকে আমাদের সমস্ত তৌহিদী জ্ঞান নিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে হবে- শুধুমাত্র পরকালে আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়- আল্লাহ সেই তৌফিক আমাদের দান করুন। লেখক : মরহুম আবুল কাশেম মিঠুন সাবেক চলচ্চিত্র অভিনেতা,  সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির