post

মাতৃভাষা বাংলা ভাষা

অধ্যাপক মুহাম্মদ মতিউর রহমান

০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মহান স্রষ্টা বিশ্বজগৎ এবং এর অভ্যন্তরস্থ যাবতীয় বস্তুনিচয় ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। তাঁর এ বিশাল সৃষ্টির মূলে এক সূক্ষ্ম পরিকল্পনা, নিখুঁত বৈজ্ঞানিক কৌশল ও গভীর তাৎপর্য বিদ্যমান। ফলে বিশ্বজগতের সবকিছু যথানিয়মে পরিচালিত হচ্ছে, স্রষ্টার ইচ্ছানুযায়ী সকল সৃষ্টিনিচয় স্ব স্ব সুনির্দিষ্ট পরিণতির দিকে অগ্রসরমান। এ বিপুল বিশ্বে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষ অন্যতম। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে মানুষের পরিচয়। বিশাল সৃষ্টিজগতে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রাণী মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করার পেছনে যে তাৎপর্য বিদ্যমান তা বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গভীর পর্যলোচনার পর বিজ্ঞ ব্যক্তিদের অভিমত, জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনার কারণেই মানুষ শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করেছে। জ্ঞানের সাধনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমেই অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির দুর্বল মানুষ প্রভূত শক্তি, যোগ্যতা ও আধিপত্যের অধিকারী হয়েছে; অন্যান্য সৃষ্টিকে নিজের বশীভূত করেছে, গ্রহ-গ্রহান্তরের সৃষ্টি-রহস্য উন্মোচনে নিরন্তর ব্যাপৃত রয়েছে। আদি মানব হযরত আদম (আ) কে সৃষ্টির পর মহান ¯্রষ্টা তাঁকে জ্ঞান শিক্ষা দেন। তারপর ফেরেশতাদের সাথে তাঁর জ্ঞানের প্রতিযোগিতা হয়। সে জ্ঞানের পরীক্ষায় আল্লাহর কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের স্বভাবতই জয় হয়। আল্লাহর এ প্রশিক্ষণ দানের ধারা অব্যাহত থাকে। যুগে যুগে নবী-রাসূলদেরকে আল্লাহ এভাবেই প্রশিক্ষণ দিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন মানুষকে আসল জ্ঞানের সন্ধান দিতে। তাই প্রকৃত জ্ঞানের আকর হিসেবে ঐশী কিতাব ও নবীর শিক্ষাই সর্বোৎকৃষ্টরূপে পরিগণিত। আগের কথায় ফিরে আসা যাক। আদম (আ)কে আল্লাহ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। জ্ঞান শিক্ষার মাধ্যম হলো ভাষা। অর্থাৎ আল্লাহ ভাষার মাধ্যমে আদম (আ)কে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। অতএব ভাষার আদি ¯্রষ্টাও আল্লাহ। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : “খালাক্বাল ইনসানা আল্লমাহুল বায়ান।” অর্থাৎ “তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।” (সূরা আর রাহমান, আয়াত সংখ্যা ২-৩) আল কুরআনে আল্লাহর এ পবিত্র বাণী থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মানুষ সৃষ্টির পর মানুষের মনের ভাব প্রকাশের পদ্ধতি ও তার মাধ্যম ভাষা আল্লাহই মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটাই বুদ্ধিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক সত্য। সুতরাং ভাষা আল্লাহর দান-আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টি ও নিয়ামতের মতো ভাষাও মানুষের জন্য এক অপরিসীম নিয়ামত। এ ভাষার দ্বারা মানুষের মনের ভাব প্রকাশ, তার প্রতিভার বিকাশ ও মানবিক নানা সম্ভাবনার দ্বারোদঘাটন সম্ভব। ভাষা শুধু সাহিত্যেরই বাহন নয়, সভ্যতারও বাহন। সকল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও মানবসভ্যতার বিকাশে ভাষা অপরিহার্য অবলম্বন। ভাষা শুধু বর্তমানকেই নয়; অতীতকেও আমাদের সামনে তুলে ধরে, ভবিষ্যতের রূপরেখাও বর্ণনা করে। তাই এক কথায় ভাষা আল্লাহতায়ালার এক বিশেষ নিয়ামত। সন্দেহ নেই আদম (আ)-এর ভাষা ছিল একটাই। কিন্তু পৃথিবীতে আদমসন্তানের বংশ বিস্তারের সাথে সাথে আদি মানবের আদি ভাষাও নানা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে। ফলে বিস্তীর্ণ পৃথিবীর বিচিত্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আজ হাজার হাজার ভাষার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এ বৈচিত্র্যময় বিপুল বিশ্বে বিভিন্ন জনপদে নানা ভাষা-বর্ণে-গোত্রে বিভক্ত মানুষ আল্লাহর অসীম কুদরত ও মহা তাৎপর্যময় শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বিশ্ব¯্রষ্টা বলেন: “ওয়ামিন আইয়াতিহি খালকুছসামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখ্তিলাফু আলছিনাতিকুম ওয়া আলা-ওয়ানিকুম ইন্না ফি জালিকা লা-আয়াতিল লিল আ-লিমিন।” অর্থাৎ “এবং তাঁর (আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা রূম, আয়াত সংখ্যা ২২) স্বয়ং আল্লাহ মানুষের ভাষাকে তাঁর সৃষ্টির অন্যতম নিদর্শন হিসাবে গণ্য করেছেন। অতএব এটাকে কোন অর্থেই তুচ্ছ জ্ঞান করার অবকাশ নেই। এখানে ভাষা বলতে কোন নির্দিষ্ট ভাষার কথা বলা হয়নি। স্থান-কাল-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষ যেমন আল্লাহর সৃষ্টি মানবসমাজের অসংখ্য বিচিত্র ভাষাও তেমনি আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে গণ্য। সে হিসেবে পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষার মর্যাদাই সমান। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাই কোন না কোন মানুষ ও জনমণ্ডলীর মাতৃভাষা। কোন না কোন ভাষা ছাড়া যেমন মানুষ তার মনের ভাব ব্যক্ত করতে পারে না, মানুষ ছাড়াও তেমনি কোনো ভাষার অস্তিত্ব অকল্পনীয়। প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজ মাতৃভাষা অতিশয় প্রিয়। আল্লাহর কাছে তাঁর প্রতিটি বান্দাই যেমন সমান, সাধারণ মানবিক দৃষ্টিতেও মানুষে মানুষে যেমন কোন বিভেদ নেই; ভাষার মর্যাদার ক্ষেত্রেও তেমনি কোন প্রভেদ থাকতে পারে না। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার মাতৃভাষা যেমন আদরের তেমনটি আর কোন ভাষাই নয়। মাতৃজঠরে অস্তিত্ব লাভের পর মায়ের রক্তে সে অস্তিত্বের ক্রমবিকাশ ঘটে। ভূমিষ্ঠ হবার পর মাতৃস্তনে আমরা বেড়ে উঠি, তারপর ধীরে ধীরে মায়ের ভাষা শিখে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করি। তাই মা, মাতৃভাষা আমাদের অস্তিত্বের সাথে অবিমিশ্রভাবে জড়িত। এটাকে অস্বীকার করা নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার নামান্তর। আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক মানুষকেই স্ব স্ব মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছেন। এ প্রকাশের পদ্ধতি দ্বিবিধ। প্রথমত, মুখের দ্বারা, দ্বিতীয়ত, হাত বা লেখার দ্বারা। এ দ্বিবিধ উপায়েই মনের ভাব প্রকাশের দ্বারা মানুষ তার নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করে তুলতে পারে। নিজে থেকে কোন ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারে না। আর চর্চার মাধ্যমে যে ভাষা যত উৎকর্ষতা অর্জন করে, পৃথিবীর ভাষাসমূহের মধ্যে সে ভাষার মর্যাদাও তত অধিক। কিন্তু শুধু বর্ণ-গোত্র-ধর্ম-অঞ্চল হিসেবে কোন ভাষার কোন বিশেষ মর্যাদা থাকতে পারে না। মহান ¯্রষ্টা যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ও ভাষাভাষী জনমণ্ডলীর মধ্যে তাঁর বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। এসব সম্মানিত বার্তাবাহক বা নবী-রসূলগণ যেসব এলাকার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন, সে এলাকার ভাষাই ছিল তাঁদের মাতৃভাষা। তাঁরা তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলেছেন, সে ভাষাতেই আল্লাহর আদেশ-নিষেধ-উপদেশ প্রচার করেছেন এবং প্রেরিত কিতাবসমূহও আল্লাহতায়ালা নবী-রাসূলদের মাতৃভাষায়ই অবতীর্ণ করেছেন। আর পৃথিবীর এমন কোন অঞ্চল ও জনমণ্ডলী নেই যেখানে আল্লাহ তাঁর বাণীবাহক এবং কিতাবাদি প্রেরণ করেননি। এ দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর সব জনমণ্ডলীর ভাষার গুরুত্বই আল্লাহর কাছে সমান এবং সকলের মাতৃভাষাই সমান গুরুত্বের অধিকারী। আল্লাহ কুরআন শরিফে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন : “ওয়ামা আরসালনা মিররাসুলিন ইল্লা বিলিসানি কাওমিহি লিউবাইয়্যেনা লাহুম।” অর্থাৎ “আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।” (সূরা ইবরাহিম, আয়াত সংখ্যা : ৪) আল কুরআনে অন্যত্র আল্লাহ বলেন : “ইন্না আরসালনাকা বিল হাককি বাশিরাও ওয়া নাজিরাও ওয়া ইমমিন উম্মাতিন ইল্লা খালা ফিহা নাজির।” অথাৎ “আমি তোমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি।” (সূরা ফাতির, আয়াত সংখা ২৪) এর পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ আরো বলেন: “যায়াতহুম রুসুলুহুম বিল বাইইনাতি ওয়াবিননাসুরি ওয়াবিল কিতাবিল মুনির।” অর্থাৎ “তাদের (পূর্ববর্তী সকল মানুষ) নিকট এসেছিল তাদের রাসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শন, গ্রন্থাদি (অর্থাৎ ছোট ছোট আসমানি কিতাব-সহিফা) ও দীপ্তিমান কিতাবসমূহ।” কুরআন শরিফের অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন : “লাকাদ মান্নাল্লাহু আ’লাল মুয়ামিনিনা ইয বায়াশা ফিইহিম রাসূলামমিন আনফুসিহিম ইয়াতলু আলাইহিম আয়াতিহি ওয়াযাককিহিম ওয়াইয়া আল্লিমুহুমুল কিতাবা ওয়াল হিকমাতা।” অর্থাৎ “তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি রাসূল প্রেরণ করে আল্লাহ মু’মিনদের অবশ্য অনুগ্রহ করেছেন; সে তাঁর আয়াত তাদের নিকট আবৃত্তি করে, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৬৪) অতএব বিশ্ব¯্রষ্টার পবিত্র কালাম থেকে এটা সুস্পষ্ট হলো যে, আল্লাহ পৃথিবীর সব অঞ্চল, যুগ ও জনমণ্ডলীর জন্যই নবী-রাসূল ও আসমানি কিতাব প্রেরণ করেছেন এবং প্রেরিত স্থানের ভাষাই ছিল নবী-রাসূলদের ভাষা এবং সেসব ভাষায়ই বিভিন্ন যুগ, জনমণ্ডলী ও স্থানের উপযোগী করে আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছিল। সুতরাং পৃথিবীর কোনো ভাষাই তুচ্ছ বা নিন্দনীয় নয়; সকল ভাষাই আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্য গণ্য এবং সে হিসাবে সমমর্যাদার অধিকারী। পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলকে আল্লাহ প্রেরণ করেছিলেন একটি নির্দিষ্ট এলাকা এবং সম্প্রদায়ের জন্য। তাঁদের কাছে প্রেরিত কিতাবও ছিল একটি নির্দিষ্ট এলাকা, সম্প্রদায় ও যুগের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আখেরি নবীকে বোধগম্য কারণেই আল্লাহ প্রেরণ করেছেন সমগ্র বিশ্ব, অনাগত সকল মানুষ ও সর্বযুগের জন্য। যেহেতু তাঁর পরে আল্লাহ আর কোনো নবী প্রেরণ করবেন না তাই তাঁর মাধ্যমেই তিনি অনাগত সর্বযুগ ও জনমণ্ডলীর সর্ববিধ প্রয়োজন পূরণের সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেছেন। তাঁর মাধ্যমে প্রেরিত মহাগ্রন্থ আল কুরআনও সমগ্র পৃথিবীর সর্বকালীন সমস্ত মানবজাতির উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ। এ মহাগ্রন্থ সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে চিরস্থায়ীরূপে সংরক্ষণের দায়িত্বও স্বযং বিশ্বনিয়ন্তার হাতে। এ মহাগ্রন্থও যে মহামানবের মাধ্যমে অবতীর্ণ হয় তাঁর মাতৃভাষা আরবিতেই রচিত। এটা যদি মহানবী (সা)-এর মাতৃভাষায়, তৎকালীন আরববাসীর বোধগম্য ভাষায় রচিত না হতো তাহলে এটা প্রেরণের উদ্দেশ্যই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতো। এ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন : “ইন্না আনজালনাহু কোরআনান আরাবিয়াল্লায়াল্লাকুম তাকিলুউন।” অর্থাৎ “ইহা (কুরআন) আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় যাতে তোমরা বুঝতে পারো।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত : ২) আল্লাহ কুরআন শরিফের অন্যত্র বলেন : কুরআনান আরাবিয়ান গায়রা জি ইওয়াজিন লায়াল্লাহুম ইয়াততাক্কুন। অর্থাৎ “আরবি ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে।” (সূরা জুমার, আয়াত : ২৮) মানুষ জেনে-বুঝে যাতে যথার্থ হেদায়াত লাভ করতে পারে, অন্যায়-অসত্য পথ থেকে বিরত হয়ে, ন্যায় ও কল্যাণ লাভে সমর্থ হতে পারে সে উদ্দেশ্যেই কুরআন মহানবী (সা) ও তাঁর স্বদেশবাসীর মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়। এ সম্পর্কে অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন, “ওয়ালাক্বাদ ইয়াশশারনা লিয্যিকর।” অর্থাৎ “আমি কুরআন সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য।” (সূরা কামার, আয়াত : ১৭) উক্ত সূরার ২২ নং আয়াতে আল্লাহ পুনর্বার ঘোষণা করেন : “ওয়ালাক্বাদ ইয়াশ্্শারনাল কুরআনা লিযযিকরি ফাহাল মিন মুযযাকির।” অর্থাৎ “কুরআন আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?” আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, “ওয়াকাযালিকা আওহাইনা’ ইলাইকা কুরআনান আরাবিয়া লিতুনযিরা উম্মাল কুরা ওয়ামান হাওলাহা।” অর্থাৎ “এভাবে আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে তুমি সতর্ক করতে পার মক্কা ও তার চারপাশের জনগণকে।” (সূরা শূরা, আয়াত : ৭) এর দ্বারা বোঝা যায়, মক্কা ও তার চারপাশের জনগণের মাতৃভাষা আরবিতে মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিলের প্রধানতম উদ্দেশ্যে ছিল যাতে মহানবী (সা) তাঁর নিজের ও তাঁর জন্মভূমির অধিবাসীদের মাতৃভাষায় সহজবোধ্যভাবে আল্লাহর দ্বীন প্রচার করতে সক্ষম হন। এটাই বাস্তবতার দাবি। কিন্তু এর দ্বারা অন্য ভাষার প্রতি কোনো অবজ্ঞা করা বুঝায় না। অবশ্য এটা স্বীকার্য যে, সর্বশেষ আসমানি কিতাব এবং সর্বকালীন সকল মানুষের হেদায়াতের জন্য অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের কারণে বিশ্ব-মুসলিম তথা মানবজাতির কাছে আরবি ভাষা একটি স্থায়ী বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। এটা বিশেষভাবে কুরআনের কারণে নতুবা অন্য ভাষার ওপর আরবি ভাষার আর কোন শ্রেষ্ঠত্ব আছে বলে মনে হয় না। অতএব মহাগ্রন্থ আল্ কুরআন থেকে এটা সুস্পষ্ট হলো যে, মাতৃভাষার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। তা সে ভাষা যে ভাষাই হোক না কেন। ইসলাম কোন বিশেষ স্থান, কাল ও সম্প্রদায়ের জন্য নয়। সকল সৃষ্টিই আল্লাহর, সকল মানুষই আল্লাহর বান্দা, সকল মানুষের সব ভাষাই আল্লাহর দান। ইসলামের দৃষ্টিতে কোন ভাষাই ইতর বিশেষ নয়। সকল মানুষের মাতৃভাষার মর্যাদাই সমান। তবে পৃথিবীতে সকল মানুষ যেমন সমান নয়, সকল ভাষাও তেমনি সমান উন্নত নয়। মানুষ নেক আমলের দ্বারা যেমন মহৎ ও মর্যাদাবান হতে পারে ভাষাও তেমনি চর্চা ও অনুশীলনের দ্বারা উৎকর্ষ লাভ করতে পারে। পৃথিবীর ভাষাসমূহের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার স্থান অধিকার করতে পারে। কিন্তু তাই বলে উন্নততর ভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে মাতৃভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়। আবার মাতৃভাষার প্রতি অন্ধভক্তি দেখাতে গিয়ে অন্য ভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনও অন্যায়। যে ভাষা আমার মাতৃভাষা নয়; সেটা অবশ্যই অন্য কারো মাতৃভাষা। মাতৃভাষার প্রতি আমার অনুরাগ যেমন সহজাত-অন্যের ক্ষেত্রেও সে অধিকার স্বীকার করে নেয়াই ন্যায়সঙ্গত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। অথচ উর্দু পাকিস্তানের কোন এলাকার মাতৃভাষা ছিল না। মূলত উর্দু ভাষা দিল্লির মুসলিম শাসকদের আমলে, তাঁদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় আরবি, ফার্সি, তুর্কি এবং স্থানীয় বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে। জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন ভাষার শব্দরাজি আত্মস্থ করার সহজ প্রবণতার কারণে অতি অল্প-পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় উপমহাদেশের প্রায় সব এলাকায় এ ভাষা দ্রুত প্রসার লাভ করে। তাই এককালে দিল্লি ও তার আশপাশ এলাকায় এর উৎপত্তি ঘটলেও উপমহাদেশের সর্বত্র বিশেষত মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে উর্দু ভাষা যথেষ্ট আদরণীয় হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে এটা ভারতীয় মুসলমানদের সাধারণ ভাষার মর্যাদা লাভ করে। উন্নত সাহিত্যকর্ম এবং মুসলমানদের দ্বীনি শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় এ ভাষার মর্যাদা সম্পর্কে কারো মনে কোনো প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর দাবি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কিছুতেই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। কেননা, বাংলা ভাষা ছিল অত্যন্ত উন্নত ভাষা এবং দীর্ঘদিন যাবৎ আরবি, উর্দু, ফার্সি, তুর্কি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষার সংস্পর্শে এসে এবং এসব ভাষার অসংখ্য শব্দ আত্মস্থ করে বাংলা ভাষা পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধতম ভাষায় রূপান্তরিত হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের প্রিয় মাতৃভাষার দাবিকে জলাঞ্জলি দিতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। এ কারণেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষণার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজের মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অন্যের ভাষার প্রতি কোনরূপ অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেনি। মূলত তাদের দাবি ছিল সম্পূর্ণ বাস্তবভিত্তিক ও ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত। মানুষের মানবিক মর্যাদা এবং মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে মাতৃভাষা অন্যতম। মাতৃভাষা ছাড়া মনের ভাব সম্যকরূপে প্রকাশ করা দুরূহ। পৃথিবীতে কোন বড় কবি বা লেখকই তাঁর মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় অমর সাহিত্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হননি। যশোরের সাগরদাড়ি গ্রামের মাইকেল মধুসূদন দত্তের ন্যায় বিরাট প্রতিভা আজন্ম ইংরেজি ভাষায় চর্চা করা সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হননি। অবশেষে যে মাতৃভাষাকে চরম অবজ্ঞা করতেন, সেই মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য চর্চা করেই তিনি খ্যাতিমান হতে পেরেছেন। মূলত অন্য ভাষা শিক্ষা করলেও, অন্য ভাষার বিষয়বস্তু বোঝার জন্যে মনে মনে মাতৃভাষায় তা অনুবাদ করার মাধ্যমেই আমরা তা বুঝে থাকি। কোনো কিছু বোঝার জন্য মাতৃভাষার অনুষঙ্গ তাই একান্ত আবশ্যক। এজন্য মাতৃভাষাকে বলা যায় মানুষের জন্য এক সহজাত প্রবণতা। এ সহজাত প্রবণতাকে অস্বীকার করা কেবল অবাস্তবই নয়, আত্মঘাতীর সমতুল্য। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে এ সহজাত প্রবণতারই স্বপক্ষে। তাই ইসলামকে বলা হয়, ফিতরাতের (স্বভাবের) ধর্ম। অর্থাৎ আল্লাহ যাকে যে প্রকৃতি বা স্বভাব দান করেছেন, তাকে সে স্বভাব বা প্রকৃতির মধ্যেই যথার্থ মানায়। বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে ‘ল’ অব ন্যাচার’- প্রকৃতির বিধান। সৃষ্টিজগতের কোন কিছুই এ ‘ল’ অব ন্যাচারকে অস্বীকার করতে পারে না। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক বিশ্বজগতের সবকিছুই প্রকৃতির বিধান মেনে চলে। আল্লাহ সবকিছু সৃষ্টির পর যাকে যে প্রকৃতিগত নিয়মের অধীন করে দিয়েছেন সে প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলাই তার ধর্ম-এটাই ফিত্্রাত বা ল অব ন্যাচার। এ নিয়ম মানার ব্যতিক্রমহীন পদ্ধতিই সব সৃষ্টির জন্য ইবাদত অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন। আল কুরআনের ভাষায় : “ওয়াশ সামসু তাযরি লিমুসতাক্বাররিল্লাহা জালিকা তাক্বদিরুল আজিজিল আলিম ওয়ালক্বামারা ক্বাদ্দরনাহু মানজিলা হাত্তা আদা কালউরযুও নিল ক্বাদিমি লা-শামসু ইয়ামবাগি লাহা আন তুদরিকাল ক্বামারা ওয়ালাল লাইলু সাবিকুননাহারি ওয়াকুল্লুন ফি ফালাকিইয়াসবাহুন।” অর্থাৎ “এবং সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে, এটা মহাপরাক্রান্ত, সর্বজ্ঞ (আল্লাহর) নিয়ন্ত্রণ এবং চন্দ্রের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনজিল; অবশেষে তা শুষ্ক, বক্র, পুরাতন খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে। সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া এবং রজনীর পক্ষে সম্ভব নয় দিবসকে অতিক্রম করা; এবং প্রত্যেক নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে।” (সূরা ইয়াসিন, আয়াত সংখ্যা ৩৮-৪০) কুরআন শরিফের অন্যত্র আল্লাহ বলেন: “ওয়ালিল্লাহি ইয়সজুদু মান ফিসসামাওয়াতি ওয়াল আরদি ত্বাওয়াত্তওয়াকার হাওওয়া জিলালুহুউ বিলগুদুউবি ওয়াল আছাল।” অর্থাৎ “আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলিও সকাল সন্ধ্যায়।” (সূরা রা’দ, আয়াত-১৫) এভাবেই সৃষ্টি জগতের সবকিছুই আল্লাহর হুকুম মেনে চলছে। একমাত্র আশরাফুল মখলুকাত মানুষের জন্যই কিছু কিছু ব্যাপারে ল অব ন্যাচারের ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। মানুষ ইচ্ছা করলে সেসব ক্ষেত্রে প্রকৃতির নিয়মকে অস্বীকার করতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে নয়। জন্ম মৃত্যু, দুর্ঘটনা ইত্যাদি ব্যাপারে সে অবশ্যই প্রকৃতির নিয়মের অধীন। কিন্তু জীবনব্যবস্থা বা জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে সে যেমন আল্লাহর বিধান মেনে নিয়ে ফিতরাতের দাবি অনুযায়ী আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে চলতে পারে, আবার আল্লাহর বিধান অস্বীকার করে নাফরমান বান্দার মত জিন্দেগি যাপন করার এখতিয়ারও তার রয়েছে। এটাই হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা প্রয়োগের ক্ষেত্রেই মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক কাজে লাগানোর প্রয়োজন রয়েছে। আর এগুলো কিভাবে কাজে লাগানো হলো আখিরাতের জীবনে সে ব্যাপারেই মানুষকে প্রশ্ন করা হবে। এ স্বাধীনতার জন্যই জববিদিহিতার প্রশ্ন রয়েছে। অন্য কোন সৃষ্টির জন্য এ জবাবদিহিতা প্রশ্ন অবান্তর। কারণ তাদের কারো এ স্বাধীনতা নেই। প্রকৃতির বিধান মেনে তারা সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করে চলছে। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের অনুরাগ সহজাত। স্বকীয় প্রতিভা বিকাশের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম মাতৃভাষা- এটা আগে উল্লেখ করেছি। কিন্তু তাই বলে অন্য কোন ভাষা শেখা বা তার চর্চা করা যাবে না, এমন নয়। বরং নিজের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য অন্য যে কোন ভাষা সাধ্যানুসারে শেখা যেতে পারে। মহানবী (সা) বিদ্যা অর্জনের জন্য সুদূর চীন দেশ অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোন দেশে যাবার উপদেশ দিয়েছেন। ভাষা শিক্ষা ছাড়া জ্ঞানের তালিম সম্ভব নয়। অতএব জ্ঞান অন্বেষণে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে গিয়ে যে কোন ভাষা শেখার জন্য ইসলাম উৎসাহ প্রদান করে। এ ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অতিশয় উদার ও বিশ্বজননী। মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সাথে সাথে অন্য ভাষার প্রতি সমদর্শিতার মনোভাব প্রদর্শন ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হলো যে, ইসলাম মাতৃভাষাকে যথার্থ মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদানের শিক্ষা দেয়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। প্রায় বিশ কোটি মানুষ বর্তমানে এ ভাষার কথা বলে। সে হিসেবে এটা পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম ভাষা। মাতৃভাষার জন্য আমরা দীর্ঘ সংগ্রাম ও চরম আত্মত্যাগের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে পৃথিবীর ভাষাসমূহের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছি। মাতৃভাষার জন্য এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল মূলত হাজার বছর আগে- এ ভাষার জন্মলাভের অব্যবহিত পরেই। বিভিন্ন যুগে এ সংগ্রামের বিভিন্ন রূপ ও বৈচিত্র্য ঘটেছে মাত্র। এ সংগ্রামের সর্বশেষ ও চূড়ান্ত পর্যায় হলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে। কিন্তু এ সর্বশেষ ও চূড়ান্ত পর্যায়কেই যারা আমাদের ভাষা-আন্দোলনের সমগ্র ইতিহাস বলে গণ্য করেন তাদের ইতিহাস-জ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। বৌদ্ধ পাল-রাজাদের আমলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, এর লালন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়। বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ সকলেই তখন এ ভাষার কথা বলতো, এটাই ছিল তাদের মাতৃভাষা। পাল-রাজাদের পরাস্তÍ করে দাক্ষিণাত্য থেকে আগত আর্য-ব্রাহ্মণ্য সেনাগণ বাংলার রাজ-শক্তি অধিকার করে নেয়ার পর বাংলা ভাষার চরম দুর্দিন শুরু হয়। আর্য-ব্রাহ্মণ শক্তি বৌদ্ধ ও তাদের আচরিত ধর্ম, স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও প্রচলিত বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে অমানুষিক নির্মম আচরণ শুরু করে। বৌদ্ধদের ব্যাপক হারে হত্যা করা হয় অথবা ধর্মান্তরিত করা হয়। প্রাণভয়ে কিছু লোক সমতল ভূমি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী পাহাড়ি অরণ্যানি এলাকা অথবা প্রতিবেশী দেশ বার্মা, চীন, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ইত্যাদি দেশে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। বৌদ্ধ ধর্ম, স্থাপত্য ও সংস্কৃতিও সমূলে ধ্বংস করা হয়। বৌদ্ধ আমলে প্রচলিত বাংলা ভাষাকে তৎকালীন শাসকবর্গ ম্লেচ্ছ ও ইতরজনদের ভাষারূপে আখ্যায়িত করে। এ ভাষায় কথা বললে ‘রৌরব’ নামক নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলা ভাষার তখন ছিল যথার্থই দুর্দিন। এ ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করা সুকঠিন বিবেচিত হয়। এ তমসা যুগের নিকষ কালো অন্ধকাররাশি বিদূরিত করে মৃতপ্রায় বাঙালি সমাজ ও বাংলা ভাষাকে নতুন জীবন দান করেছিল ইসলামের সর্বজনীন, উদার ও শাশ্বত মানবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ বহিরাগত তুর্কি মুসলমানগণ। সুদীর্ঘ সাড়ে পাঁচশ বছর মুঘল-পাঠান-নবাবী আমলে বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সর্বক্ষেত্রে চরম উন্নতি সাধিত হবার সাথে সাথে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যও নতুন প্রাণাবেগে পূর্ণ হয়ে চরমোৎকর্ষ লাভ করে। বাংলা ভাষার ইতিহাসে এটা স্বর্ণযুগ নামে অভিহিত । যদি এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারতো, তাহলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রূপ ও পরিচয় আজ সম্পূর্ণ ভিন্নতর হয়ে দেখা দিতো। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ বিধান এক চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করে। বাংলা ভাষার দুর্দিনের আরেক পর্যায় শুরু হয়। পলাশীর প্রান্তরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হবার সাথে সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে বাংলা ভাষার ওপরও খড়গাঘাত পড়ে। একদিকে বেনিয়া ইংরেজ, অন্যদিকে বাংলার সমাজে ঘাপটি মেরে থাকা ক্ষয়িষ্ণু আর্য-ব্রাহ্মণ্য শক্তির প্রতিভূরা তাদের নতুন প্রভু ইংরেজদের সহযোগিতা ও যোগসাজশে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। রাজভাষা হয় ইংরেজি। বাঙালিদেরকে ইংরেজি শেখাবার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। বাংলা ভাষা হয় অপাঙ্ক্তেয়, অনাদৃত। ফলে ইংরেজ আগমনের পর দীর্ঘ প্রায় একশ বছর পর্যন্ত বাংলা ভাষা তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রন্থই রচিত হয়নি। ইংরেজ রাজত্ব স্থায়ী হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি সমাজও নানা বিপর্যয়-বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক ধরনের স্থিতি লাভ করে। এ পরিবর্তিত সমাজ-ব্যবস্থায় নানা কূটকৌশলে আর্য-ব্রাহ্মণরা হয় এ দেশে ইংরেজদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। ইংরেজদের সহযোগিতায় তারা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে এক অভিনব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সেন আমলে আর্য-ব্রাহ্মণেরা বাংলা ভাষাকে সমূলে উৎখাত করে বৈদিক ভাষা সংস্কৃতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা চেয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ আমলে পরিবর্তিত যুগ-পরিবেশ তারা বাংলাকে সমূলে উৎখাত করা অসম্ভব বিবেচনা করে বাংলাকে তারা সংস্কৃতায়ন অর্থাৎ বাংলা ভাষার অবয়বে দুরূহ-দুর্জ্ঞেয় সংস্কৃত শব্দরাজি প্রয়োগ ও সংস্কৃত ব্যাকরণের কণ্টকাকীর্ণ নিয়ম-পদ্ধতির দ্বারা বাংলা ভাষার আসল পরিচয় মুছে ফেলা এবং এর স্বাভাবিক বিকাশের পথকে অবরুদ্ধ করার সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বাংলা ভাষায় এ যাবৎকাল আত্তীকৃত অসংখ্য আরবি, উর্দু, ফরাসি, তুর্কি শব্দ বর্জন করে তারা সংস্কৃতবহুল নতুন বাংলা ভাষা চালু করে। ইংরেজ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ নতুন ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও শিক্ষাদান কর্মসূচি চালু করায় এভাষা সহজেই ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। এটা ছিল বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলা ভাষার রূপ বহুলাংশে বিকৃত ও পরিবর্তিত হয় এবং ইংরেজ-পূর্ব আমলে রচিত বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল অংশকে ‘পুঁথি সাহিত্য’ বা ‘বটতলার সাহিত্য’ নামে আখ্যায়িত করে তা অপাঙ্ক্তেয় করা হয়। দীর্ঘ অনাদর-অযতেœ ধীরে ধীরে তা এক রকম বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যায়। ফলে আমরা আমাদের সমৃদ্ধ সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ থেকে বঞ্চিত হই। বাংলা ভাষার ওপর সর্বশেষ ষড়যন্ত্র চলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে। এবারে বাংলা ভাষাকে উৎখাত বা অস্বীকার করা হয়নি। কিন্তু বাংলাভাষীদের ওপর অন্য অঞ্চলের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চলে। বাংলার মানুষ এটা মেনে নেয়নি। ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক-কৃষক সকলেই এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দীর্ঘ চার বছরের আপসহীন সংগ্রাম এবং চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার এ মর্যাদা আরো সুদৃঢ় ও তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও বিকাশ এবং সর্বোপরি এর যথার্থ মর্যাদা লাভের সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা স্মরণ করলে আমরা যথার্থ আবেগাপ্লুত ও উদ্দীপ্ত হই। এ আবেগ-উদ্দীপনা বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধকে নিরন্তর উষ্ণতর করে তুলুক- বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা ও উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে বিশ্বভাষার দরবারে এর গৌরবময় আসন সুপ্রতিষ্ঠিত হোক। এ প্রত্যাশা নিয়েই কবির কণ্ঠে উচ্চারণ করি : ‘মাতৃভাষা, বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান বিশ্বসভায় এ ভাষারই আসন মহীয়ান। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির