post

মানবিক শূন্যতায় কাতরাচ্ছে মানবতা

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

৩০ অক্টোবর ২০১৫
ss2ss3মানুষকে সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর ও সেরা জীব বলা হয়। (সূরা আত-তীন : ৪) আল্লাহ তা’য়ালা প্রিয় সৃষ্টিকে তার নির্দেশনা পালনের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। (সূরা যারিয়াত : ৫৬) তাই আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। মানুষকে মানুষ বলা হয় কারণ তার মধ্যে মানবিকতা আছে, বোধ-বিবেক আছে, হিতাহিত জ্ঞান আছে, ভালো-মন্দ যাচাই করার সক্ষমতা আছে, যা ভিন্ন কোনো প্রাণী বা জীবের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। মানুষের বিবেক-বোধকে আরো উৎকর্ষিত করার নিমিত্তে আল্লাহ তা’য়ালা যুগে যুগে তাঁর বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন। যারা মানুষকে মানবতা শিখিয়েছেন, সত্যগ্রাহী অহি মানবতার নির্দেশনার নিমিত্তে বার্তাবাহকদের ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়েছে। (সূরা নাহাল : ৩৬) ক্ষণস্থায়ী জীবনে শান্তি, নিরাপত্তা ও পরকালে মুক্তির জন্যই বান্দার তরে আল্লাহ তা’য়ালার সকল ব্যবস্থাপনা ও গাইডলাইন। যে জাতি যখনই গাইডলাইনের সীমারেখা অতিক্রম করেছে তখনই আল্লাহ তাদের জন্য প্রলয়ঙ্করী ধ্বংস ঢেলে দিয়েছেন। যার ইতিহাস আমাদের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ধ্বংসাবশিষ্ট জাতির বিভিন্ন স্থাপনা এখনো মানবজাতিকে সীমালঙ্ঘন থেকে দূরে থাকতে প্রতিনিয়ত সতর্ক করছে। এখন পৃথিবীতে ¯্রষ্টার নির্দেশনা না মানার প্রতিযোগিতা চলছে। একটি পক্ষ আল্লাহর নির্দেশনা না মানাকেই বিশেষ কৃতিত্ব বলে ধরে নিয়েছে। ধর্ম না মানাকেই জীবনের উৎকর্ষতা অর্জনের অনন্যোপায় হিসেবে উপস্থাপন করছে। তাই তারা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে প্রচার করছে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা তাদের বক্তব্যে যদিওবা যার যার ধর্ম পালন স্ব-স্ব ইচ্ছা অনুযায়ী পালনের দাবি জানালেও মূলত এই ফর্মুলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ধর্মহীনতা। প্রকৃত ধর্ম কখনো মানুষের ভেতর পশুত্ব সৃষ্টি করে না। মানবিকতা, দয়ার্দ্রতা, পরোপকারিতা, মানবিক মূল্যবোধ ধর্মই সৃষ্টি করতে পারে, অশান্ত পৃথিবীকে শান্তির নীড়ে পরিণত করতে পারে। অধর্ম, দানবিকতা, পরশ্রীকাতরতা, পাষন্ডতা ও কলহ ছড়িয়ে দিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসের চরমে উপনীত করে।  যে মানবিক মূল্যবোধের অভাবে আজ ঘরে বাইরে, দেশে-বিদেশে কোথাও শান্তির দেখা মিলছে না। রাষ্ট্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে, দেশের শাসক জনগণের বিরুদ্ধে, ক্ষমতান্ধরা ক্ষমতাহীনের ওপর, পরিবারের আপনজন আপনজনের বিরুদ্ধে চলছে এক অসম যুদ্ধ। যে যুদ্ধের তাবদাহে মানবতা আজ আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। আল্লাহ তা’য়ালা মানুষের প্রতি মানুষের মানবিকতার নির্দেশ করেছেন, “হে ঐসব লোক, যারা ঈমান এনেছ! তোমরা ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর ওয়াস্তে সাক্ষ্যদাতা হও, যদিও তা (তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য) তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে অথবা তোমাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে যায়। সে ধনী হোক বা গরিব  হোক (তা বিবেচনার বিষয় নয়), আল্লাহ তোমাদের চেয়ে বেশি তাদের হিতকামী। কাজেই নফসের তাঁবেদারি করতে গিয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকো না। যদি তোমরা পেঁচানো কথা বলো বা সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাও তাহলে জেনে রাখ, তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার খবর রাখেন।” (সূরা নিসা : ১৩৫) মানুষের প্রতি মানুষের মানবিকতা শূন্যের কোটায় তখন দাঁড়ায় যখন কোন সমাজ, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি আত্মম্ভরিতায় ও পুঁজিবাদী চিন্তায় উবে থাকে। তখন তারা নিজের পরিধির বাইরে কারো অধিকার বা দায়িত্বানূভূতির কথা দিব্যি ভুলে যায়। অবৈধ ও অবৈধতার বিষয় যখন তাদের কাছে গৌণ বিষয়। ইসলাম ইনসাফ ও মানবিকতার নির্দেশ করেছে, যে মানবিক মূল্যবোধের শূন্যতায় কাতরাচ্ছে সমগ্র বিশ্ব, যা কখনো কোনো মানবগোষ্ঠীর আচরণ হতে পারে না। দেশে দেশে ভয়াবহ যুদ্ধের হুঙ্কার, অভিবাসন সমস্যা, সিরিয়া সঙ্কট, আফগান সঙ্কট, ফিলিস্তিন সমস্যা, মিয়ানমার ও ভারতে মুসলিম নিধনযজ্ঞ, মানবপাচার, নারী-শিশু নির্যাতন, দলীয় কোন্দল, রাজনৈতিক কলহ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ধর্মদ্রোহিতা ও অবাধ বিকৃত যৌনাচার সমগ্র বিশ্বকে বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলছে। এমন ভয়াল গ্রাস থেকে পৃথিবী রক্ষা না পেলে ভবিষ্যৎ আইয়্যামে জাহেলিয়াতকেও হার মানবে। ১. বিশ্বব্যাপী অমানবিকতা (ক) যুদ্ধের ডামাডোল দেশে দেশে ভয়াবহ যুদ্ধের দামামা : বিশ্বব্যাপী এখন যেন চারদিকে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ডামাডোল বেজে গেছে। রাষ্ট্রচিন্তকদের মতে যেকোনো সময় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। যে যুদ্ধের ভয়াবহতা যেকোনো যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ হবে যা ইতঃপূর্বে পৃথিবী দেখেনি। সিরিয়ায় বাশার বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াই চলছে। একদিকে বাশার বাহিনীকে সহযোগিতার নামে রাশিয়ার সম্ভব সকল শক্তি প্রয়োগ করছে, অপর দিকে বিদ্রোহীদেরকে আমেরিকা পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাশিয়ার ভাষ্য মতে, তারা একটি দেশের পাশে দাঁড়াতে চায়! যার নেপথ্য কথা হলো তারা মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যবাদ কায়েম করতে চায়। অপর দিকে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের ওপর দাদাগিরি খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় তটস্থ হয়ে রাশিয়ার সিরিয়ায় বিরোধী দমন আক্রমণকে প্রতিহত করার কৌশল খুঁজছে। লেবাননে হাইতি বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে সৌদি আরব এখন গলদঘর্ম। আমেরিকার সাথে চীন তার সামরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শনে মুখিয়ে আছে, যা বিশ্বকে ভয়াবহতায় ঠেলে দেবে বলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তালেবান দমনের নামে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ওপর ন্যাটো বাহিনীর চলছে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। এমন সা¤্রাজ্যবাদী চিন্তাসীমা থেকে বিশ্ব নেতৃত্বের দাবিদার শাসকগোষ্ঠী বেরিয়ে আসতে না পারলে মানবতার বিপর্যয় অনিবার্য। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবোধক! জাতিসংঘের একদেশদর্শী ভূমিকা বিশ্বকে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। এমন অনিবার্য যুদ্ধংদেহি বিশ্বকে সুরক্ষার জন্য ভবিষতে প্রশ্নবিদ্ধ সঙ্ঘ কী ভূমিকা পালন করবে তা দেখার বিষয়। (খ) অভিবাসীদের ভয়াবহ দুরবস্থা : সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, মিয়ানমারসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে অভিবাসীদের আশ্রয়সঙ্কট চরমে। জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংগঠনসমূহ যুদ্ধপীড়িত এলাকার জনগণের আশ্রয় প্রদানের জন্য পাশের দেশের নেতৃবৃন্দকে আহবান জানালেও তারা তা কর্ণপাত করেনি। জাতিসংঘের নির্জীব ভূমিকায় এটা স্পষ্ট যে এই সংস্থাটি ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’। যে সংস্থাটি মজলুম মানবতার পাশে দাঁড়ানোর সক্ষমতা রাখে না তাকে কী করে কার্যকর জাতিসংঘ বলা চলে? যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার সিভিলিয়ানরা কী যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার তার খবর ক’জন রাখে। হয়তোবা একজন নিষ্পাপ শিশু আইলান কুর্দির করুণ মৃত্যু নাড়া দিয়েছে বিশ্বকে। কেউ কেউ বলছেন, সাগরের বেলাভূমিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে মানবতা। সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে আইলান কুর্দির নিথর লাশ। কে জানে আরো কত বাবার আইলান যুদ্ধের বহুবিধ ঝড়ো হাওয়ায় মিশে গেছে চিরতরে না ফেরার দেশে। আইলানদের আর কোনো ঝক্কি ঝামেলা নেই। সংঘাত, সীমান্ত, পাসপোর্ট-ভিসা, কারো কাছে বাঁচার আকুতি জাগতিক সব জটিলতার ঊর্ধ্বে ওরা। মৃত্যুর জন্য সবাই দায়ী করছে বিশ্বমোড়লদের, কাঠগড়ায় তুলছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসননীতিকে। পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই ঘর ছেড়েছিলেন আইলানের বাবা আবদুল্লাহ। প্রিয় সন্তানরাই হারিয়ে যাওয়ায় ফুরিয়েছে সে প্রয়োজন। মানবতার এমন করুণ মৃত্যুতেও কথিত বিশ্ববিবেকদের হৃদয় টলেনি। এমন নির্মম অমানবিকতাকে পাষন্ডতা ছাড়া আর কিসের সাথে তুলনা করা চলে? এমন নির্দয় ঘটনায় বিশ্ব স্তম্ভিত হলেও জাগ্রত হয়নি কথিত বিশ্ববিবেক। লোক দেখানো অভিবাসীদের আশ্রয় দেযার ঘোষণা দিলেও ক’টা রাষ্ট্র শরাণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে? (গ) মিয়ানমার পরিস্থিতি : সম্প্রতি চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে মিয়ানমারে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর চলছে অমানবিক অকথ্য নির্যাতনের স্টিমরোলার। যেন নিজ দেশে তারা পরবাসী। অথচ রাখাইন প্রদেশে মুসলমানদের বসবাস শুরু ১৩শত বছর আগে। এতদিন ধরে বসবাস করে আসা একটি জনগোষ্ঠী সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না, তা হতে পারে না। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে নানা ধরনের ঘটনার সূত্রপাত সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কাজ চালু রেখেছে। এদের অনেকে বাধ্য হয়ে শরণার্থী হিসেবে দিনাতিপাত করছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। প্রকৃতপক্ষে তাদের অবস্থা ন্যাটিব আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকার মায়্যান ও অধিকৃত আরব ভূখন্ডের ফিলিস্তিনিদের চাইতেও দুর্বিষহ। রোহিঙ্গা মুসলমানদের অত্যাচার নিপীড়ন করে তাড়িয়ে দিয়ে সময়ের ব্যবধানে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগত কাঠামোই পাল্টিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা যেন এমনÑ রাখাইন রাজ্য যেন রাখাইনদের জন্যই। অন্য কোন জাতি বসবাস করা নিষিদ্ধ। যে জন্য সেখানে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তাদের স্থাবর, অস্থাবর ও ওয়াকফ করা সম্পত্তি। মসজিদ ধ্বংস করে প্যাগোডা ও মঠ তৈরি করা হচ্ছে পূর্ণোদ্যমে। এতে বোঝা যায় মুসলমানদের যাবতীয় নিশানা মুছে দিতে খোদ মিয়ানমার সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক তদারক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রধানের কাছে বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগণ নয়, বিতাড়নই এ সমস্যার সমাধান। তিনি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘তৃতীয় কোন দেশ চাইলে সেখানে তাদের পাঠানো হবে।’ দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে বিতাড়নতো চলছেই, তৃতীয় দেশেও সেটা চলতে পারে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকানের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৬৭ কিলোমিটার সীমান্ত। রোহিঙ্গারা যদি আরাকানি তথা মিয়ানমারি না হবে, তাহলে ১৯৪৭ সালে বার্মার প্রথম সংবিধান সভার নির্বাচনে কিভাবে তারা ভোট দিয়েছিল? ১৯৫১ সালে তাদের আরাকানের অধিবাসী হিসেবে পরিচয়পত্র দিয়েছিল। বার্মার প্রথম প্রেসিডেন্ট উ নু রোহিঙ্গাদের আরাকানের অধিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী উ বা রোহিঙ্গাদের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতোই একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৯৪৭ সালে অং সান সু চির বাবা জেনারেল অং সানের উদ্যোগে জাতিগত সমঝোতার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত পালং সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শাও সোয়ে থাইক বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি স্থানীয় আদিবাসী না হয়, তাহলে আমিও তা নই।’ ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন জারির আগে পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অবাঞ্ছিত বলার বাস্তবতা ছিল না। কিন্তু জেনারেল নে উইনের সামরিক সরকারের প্রতিষ্ঠার দিন থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের জীবনে ইতিহাসের কালো অধ্যায়। তাদের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়, বন্ধ করে দেয়া হয় রোহিঙ্গা ভাষার রেডিও অনুষ্ঠান প্রচার। শুরু হয় অপারেশন ড্রাগন কিং নামে রোহিঙ্গা বিতাড়ন কর্মসূচি। বর্তমান প্রেসিডেন্টও সম্ভবত সেই কর্মসূচি শুরু করেছেন। ১৯৮৯ সালে বার্মা ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ‘অপারেশন গোল্ডেন ঈগল’ নামে কর্মসূচিতে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া শুরু করে। আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমারকে তখন পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি নির্বাচনের ভোটার তালিকা প্রমাণ এবং বাংলাদেশের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো প্রমাণ করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার সফরের সময় সে দেশের সরকার ২৫ হাজার শরণার্থীকে ফেরত নিতে রাজি হয়। এ চুক্তি মিয়ানমার অদ্যাবধি বাস্তবায়ন করেনি। মিয়ানমার সরকার একের পর এক আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ করছে এবং বাংলাদেশের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করছে। এভাবেই গুমরে মরছে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম জনতা। ২০০৫ সালে উকিয়মিনকে (ওরফে মো: শামছুল আনোয়ারুল হক) রোহিঙ্গা জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতির দাবি নিয়ে কথা বলায় তাকে ৪৭ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। যদিও তিনি বুদিন সাহারা অঞ্চলের ১ নম্বর নির্বাচনী এলাকার পার্লামেন্ট সদস্য। একই অভিযোগে তার সহধর্মিণী ও তিন সন্তানকে ১৭ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। আশির দশকেও মিয়ানমারে মুসলমাননিধন চরম আকার ধারণ করেছিল। যদিওবা মুসলিম-বৌদ্ধ দাঙ্গার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। অথচ প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে হতাহতের মধ্যে নিহতরা সকলেই মুসলমান। মানবাধিকার সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের বরাত দিয়ে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার আহবান জানায়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জমান বাংলাদেশকে শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যাপারে যেভাবে বারবার নোটিশ জারি করছে, মিয়ানমার সরকারকে সম্ভবত ততবার নোটিশ জারি করার প্রয়োজন অনুভব করেন না। ২০১৪ সালে রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা দেখে পাষাণ হৃদয়ও  কেঁপেছে। পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এদের গণকবরের সন্ধান মিলেছে। যেখানে নিরীহ মানুষগুলোর নিঃসহ লাশের কঙ্কাল পড়ে আছে। যারা শুধু একটু নিরাপদ আশ্রয় চেয়েছিল। ধিক বিশ্ববিবেক! সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নতুন করে আশ্রয় দিতে অপ্রস্তুত বাংলাদেশ, যদিও বা আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক বাংলাদেশ দায়বদ্ধ এমন উদ্বাস্তদের আশ্রয় দিতে। জান বাঁচানোর স্বার্থে কেউ যদি অন্য দেশে প্রবেশ করে তবে কোন সভ্য দেশই তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলতে পারে না। জান বাঁচানো প্রতিটি মানুষেরই মৌলিক মানবিক অধিকার। সেটি কোন দেশে বিপন্ন হলে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্য যেকোনো দেশে আশ্রয় নেয়ার অধিকার রাখে। সেটিই আন্তর্জাতিক নীতি। কিন্তু মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মানবিক বিবেচনায় সরকার চাইলে তাদের আশ্রয় দিতে পারত। এক দিকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন, অপর দিকে বাংলাদেশের বিজিবির কঠোর অবস্থানে দিশেহারা মিয়ানমারের নিরীহ মুসলমানেরা। তাদের জীবন সাগরে কী নিঃশেষ হয়ে যাবে? জাতিসংঘ বাংলাদেশকে শরণার্থীদের আশ্রয়ের কথা বললেও বিগত সময়ে সকল শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের বিষয়টি এখনও সুরাহা তারা করেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মিয়ানমারের সীমানায় বৃহৎশক্তি চীন থাকার কারণে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমারের শরণার্থীদের ব্যাপারে সঠিক কোনো সমাধানে আসতে পারছে না। আবার এ দেশটির সাথে খারাপ সম্পর্কের মাধ্যমে সামরিক অবরোধের মুখে পড়–ক তারা তা চান না। কারণ মিয়ানমার পণ্যদ্রব্য রফতানির ক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা পালন করছে। সাদা চামড়ার লোকগুলো নিজেদের সুবিধার জন্যই শুধু মানবাধিকারের বুলি আওড়ায়। বাংলাদেশ দুর্বল বলে বাংলাদেশের ওপর যত্তসব খবরদারি! তবে বাংলাদেশ সরকার এত দীর্ঘদিনের এ সমস্যা সমাধান করতে না পারায় পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থানীয় জনগণ ও বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলো সাহায্য করতে এলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে, যা অনভিপ্রেত। বৌদ্ধদের বাণী ‘জীব হত্যা মহাপাপ’। অথচ রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞ চালানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। কী বিভীষিকা? মানবতা ভূলুণ্ঠিত! কত জীবন নিঃস্ব হলো! আর কতকাল এ অমানবিক আচরণ, পৈশাচিকতার দুর্দান্ত প্রতাপ ইতিহাসকে কলঙ্কিত করবে? মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাতিরিক্ততাই যেন মানবাধিকারের রক্ষা। নানা ছুতোয় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে হত্যা, নির্যাতনের চরম সীমায় উপনীত করাই যেন মানবাধিকারের সংরক্ষণ! (ঘ) মানবপাচার : অভিবাসীর সমস্যার মতো মানবপাচার এখন বিশ্বব্যাপী এক ভয়াল রূপ ধারণ করেছে। এর শিকার হচ্ছেন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ। বিশেষ করে নারী ও শিশু। এমন ভয়াবহতার দৃশ্য অবলোকন করে মনে হয় বিশ্ব আবার ফিরে গেছে আইয়্যামে জাহেলিয়্যাহ যুগের প্রান্তসীমায়। তাদেরকে দাস বা চাকর হিসেবে বিক্রি করে মানবপাচারকারীরা। ভুক্তভোগীরা জানে না তাদের ভাগ্যে কী জুটবে! মানবপাচারের শিকার মানুষগুলোকে উন্নত জীবনে প্রলোভিত করে অথবা জোরপূর্বক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। অনেকে দাস হিসেবে, আবার কারো কিডনিসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ শরীর থেকে আলাদা করে বিক্রি করে দেয়া হয়। নারীদেরকে যৌনদাসী হিসেবেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহারের খবর পাওয়া যায়। স্লেভারি বা দাসপ্রথা স্বতঃসিদ্ধভাবে নিষিদ্ধ হলেও জাতিসংঘ এর কার্যকর বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এমন কর্ম থেকে বোঝা যায় পৃথিবীতে অমানুষরা এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে মানুষের ছদ্মবেশে! এদের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন হওয়া জরুরি। তাই প্রয়োজন ভুখা-নাঙ্গা মানুষগুলোর পাশে সম্মিলিতভাবে দাঁড়ানো ও উল্লেখিত দানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। (ঙ) সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও আফগান সঙ্কট : সিরিয়ার আসাদ বাহিনী ও বিদ্রোহীদের বাড়াবাড়িতে পৃথিবীর কারো যেন কোন মাথাব্যথা নেই। ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান সিভিলিয়ানের মৃত্যু হয়েছে। আহত ও পঙ্গু মৃত্যুপথ যাত্রীদের গোঙানি আর মৃত্যু আতঙ্কে দেশটি এখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। আসাদ ও বিদ্রোহী বাহিনী কেউ যেন থামতে চায় না। সবাই ক্ষমতায় থাকতে চায়। রাশিয়া ও আমেরিকার বর্তমান মুখোমুখি অবস্থান সিরিয়ার জন্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতোই। বেশ কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের সঙ্কটকাল চলছে। ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের ওপর গড়ে ওঠা বিষফোঁড়া ইসরাইলি রাষ্ট্র দানবীয় কায়দায় ফিলিস্তিনিদের নির্মমভাবে পাখির মত হত্যা করছে। বারবার বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে নানাবিধ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এর সুরাহায় ইহুদিরা কথা রাখেনি। মধ্যেপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া হিসেবে খ্যাত ইসরাইলকে চাঙ্গা রেখে ফিলিস্তন সঙ্কট দীর্ঘতর রাখতে পশ্চিমা বিশ্বেরও হাত রয়েছে। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা তাদের ওপর চলমান নির্মমতার পরও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে চলছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশের আমলে একটি সাজানো গোছানো আগানিস্তানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে পুতুল সরকার জনগণের শাসন পরিচালনা করছে। যদিওবা প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই কাবুলের বাইরে তার শাসন পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। আফগানরা পুতুল সরকার ও ভিন দেশীয়  সৈন্য দ্বারা পরিচালিত হতে চায় না। এখনো তালেবান দমনের নামে ন্যাটো বাহিনীর অভিযান চলছে সমগ্র আফগানজুড়ে আর আফগানরাও তাদের অধিকার আদায়ে মরণপণ লড়াই করে চলছে। এভাবে আর কত যুদ্ধ বিগ্রহ লাগিয়ে দিয়ে দেশগুলোর জনগণকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিবে বিশ্বমোড়লরা! ২. ধর্মের নামে অধর্ম (ক) ইসলামের নামে চরমপন্থা : বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামের স্বরূপকে পরিবর্তন করে দিয়ে ইসলামের নামে ইসলাম অননুমোদিত কার্যক্রম চালু হচ্ছে। নির্বিচারে বিরোধী মত বা সাধারণ মানুষকে হত্যা করে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করার কার্যক্রম এর অন্যতম! এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ইসলামী ফোবিয়া বিশ্বব্যাপী অমুসলিমদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে একটি মহল কাজ করছে যারা সেই হত্যার সাথে জড়িত। ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত জীবনব্যবস্থার নাম। যেখানে ইসলামকে এবং ইসলামের অনুসারীদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এখন বিশ্বব্যাপী এ ধরনের অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠছে। অবশ্য সুচতুর ষড়যন্ত্রকারীদের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ইহুদি ও খ্রিষ্টান চক্রের নানাবিধ চক্রান্ত বিশ্বব্যাপী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। টুইন টাওয়ার আক্রমণ ষড়যন্ত্র এর অন্যতম। এখন মধ্যপ্রাচ্যের আইএস চরমপন্থীরাও একই নৌকার মাঝি হিসেবে প্রতীয়মান হতে শুরু করেছে। (খ) ভারতের শিখদের বাড়াবাড়ি : সম্প্রতি পুরো ভারতজুড়ে মুসলমানদের ওপর কট্টরপন্থী শিখদের নির্যাতন চরমে উপনীত হয়েছে। বেশ ক’জন মুসলমানকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়াকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা অমানবিক। অথচ ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেয়া হয়। পরিসংখ্যান মতে ১ কোটি ২০ লক্ষ হিন্দুধর্মের অনুসারী গরুর গোশত ভক্ষণ করে। তাহলে মুসলমানদের এই অভিযোগে হত্যা কেন? বাবরী মসজিদ ভেঙে রামমন্দির তৈরির ধুয়া তুলে পুনরায় দাঙ্গার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এতে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এখন আসামের মুসলমানদের কষ্টের সীমা চরমে। ১৯৪৬ সাল ভারতীয় উপমহাদেশের খুবই উত্তাল আর অস্থির সময়। ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার প্রাক্কালে মুসলমান ও হিন্দুরা ব্রিটিশদের অনুপস্থিতিতে কাদের হাতে থাকবে শাসনভার, কী হবে এ দেশের ভবিষ্যৎ; এ নিয়ে চলছিল দরকষাকষি। হিন্দু ও কংগ্রেসদের দাবি অখন্ড ভারত। মুসলমানদের দাবি ছিল দেশ বিভক্তির পর তারা যাতে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত না হয়, তাই মুসলমানরা তাদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনকেই তাদের মুখ্য দাবি হিসেবে উপস্থাপন করে। তাই দাবি আদায়ের প্রত্যয়ে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ হরতাল ডাক দেয়। এতে উভয় পক্ষ অনিবার্য সংঘাতে লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি গণহত্যায় রূপ নেয়। (অফিসিয়াল-নন-অফিসিয়াল) হিসাব মতে দশ থেকে চল্লিশ হাজার মানুষের সলিল সমাধি হয়। নিহত বেশির ভাগই হতভাগা দরিদ্র মুসলমান। দাঙ্গার সময় মুসলমানরা কলকাতা ছাড়তে শুরু করে। একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুদের। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের তান্ডবলীলা ও বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে মুসলিম গণহত্যা ইতিহাসের আরেক কালো অধ্যায়। ভারতের শীর্ষ হিন্দু নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি, অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং নরেন্দ্র মোদির মতো নেতারা অযোদ্ধার বাবরী মসজিদ ভাঙার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একইভাবে তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও বর্তমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরিকল্পনা ও প্রশ্রয়ে গুজরাটে মুসলমানদের ওপর নির্মূল অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুদের উন্মত্ততার বলি হয়ে মুসলমানেরা যে অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েছে, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ক্ষমতাসীনরা তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। বাবরী মসজিদ ভেঙে হিন্দুবাদী সংঘ পরিবার অযোদ্ধায় রামমন্দির নির্মাণ করার সময় দিল্লির শাসন ক্ষমতা ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন নরসীমারাও-এর সরকার। গুজরাটে যখন মুসলিম গণহত্যা হয়, তখনও শাসন ক্ষমতায় কংগ্রেস। কিন্তু উগ্র হিন্দুদের পতাকাবাহী সংঘ পরিবারের ঘাতকদের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সরকার কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। হিন্দু ভোটব্যাংক হারানোর ভয়ে ভেতরে ভেতরে হিন্দু তোষণ! অথচ স্বাধীনতার পর থেকে মুসলমানরা কংগ্রেসকেই ভোট দিয়ে আসছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, জঙ্গি হিন্দু সংগঠন ভারতের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের কট্টর সাম্প্রদায়িক জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যদিও ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতে ধর্মীয় বিভাজন, অসহিষ্ণুতা, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা ও সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুরতা গোটা বিশ্বে এক নজিরবিহীন নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সকল বোমা হামলা, সন্ত্রাস ও নাশকতার দায় ভারতীয় সরকারি মহল, রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সংগঠন যুগপৎভাবে মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে আসছে। তাদের অবান্তর অভিযোগ হচ্ছে মুসলমানেরা আলকায়দা, লস্করে তাইয়্যেবা, হুজি, জয়শে মুহাম্মদ প্রভৃতি সংগঠনের সাথে যোগসাজশে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইএর মদদে ভারতকে অস্থিতিশীল করার জন্য বোমা সন্ত্রাস চালাচ্ছে। ভারত কর্তৃপক্ষ মালেগাঁও, মুম্বাই, দিল্লি, এলাহাবাদ, আহমেদাবাদসহ সকল বোমা হামলার জন্য মুসলমানদের জঙ্গিপনাকে দায়ী করেছে। বোমা হামলা সন্দেহে মুসলিম যুবকদের বিচার না করেই এনকাউন্টারে হত্যা করা হয় অহরহ। অথচ ভারত সরকারের তদন্তে অধিকাংশ ঘটনার নাটের গুরু হিসেবে হিন্দু জঙ্গিবাদী সংঘ পরিবার ও তাদের ভাবাদর্শের বিভিন্ন সংগঠন জড়িত। এমনকি ভারতের সেনাবাহিনীর সদস্যের একটি অংশ হিন্দু জঙ্গিবাদী নাশকতার সাথে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ আছে। ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধরার ট্রেনে রাতে আগুন লেগেছিল। সেটাকে কেন্দ্র করে গুজরাটে চলেছিল সংখ্যালঘু নির্যাতন। গুজরাট সরকারেরই হিসাব বলে মৃত্যু হয়েছিল হাজারেরও বেশি মানুষের, বেশির ভাগই মুসলমান। বেসরকারি মতে দু’হাজার থেকে পাঁচ হাজার। (আর একটি ট্রাইব্যুনালের হিসাব হলো, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ঐ গণহত্যা পর্বে ঘরছাড়া হতে হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ মানুষকে। এখনো হাজার চারেক পরিবারকে কাটাতে হচ্ছে রহিমাবাদ সোসাইটির মতো রিলিফ কলোনিতে। পারেনি ঘরে ফিরতে, কেননা তারা যে মুসলিম, তারা যে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক।) গুজরাটের সেন্টার ফর সোস্যাল জাস্টিস নামের বেসরকারি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ২০০২ সালের সেই মুসলিম গণহত্যা ও লুটতরাজের ঘটনায় কমপক্ষে ২০০০ মুসলমান নিহত হয়। উগ্র হিন্দুবাদীরা ঐ দাঙ্গায় চারশত মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করেছে। ৫৬৩টি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আড়াই লক্ষ মানুষকে হতে হয় গৃহহীন। এ সংস্থাটি আরও বলেছে, ধ্বংসলীলায় ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার আটশত কোটি টাকা। দাঙ্গাপীড়িত মুসলমানদের জন্য কর্মরত সংগঠন জবনিকার সমিতির প্রধান গগন শেঠী বলেছেন, গুজরাটের মুসলমানরা নানভাবেই আজও হেনস্তার শিকারে পরিণত হচ্ছে। ভারতের মুসলমানদের ওপর যে অমানিক নির্যাতন চলছে তার ফিরিস্তি অবর্ণনীয়। মুসলমানরা তাদের সকল প্রকার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমন অমানবিকতার নিরসনে ভারত তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে হয় না। শুধুমাত্র গরুর গোশত খাওয়ার অভিযোগে মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যাকান্ডই প্রমাণ করে ভারত ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার সুরক্ষা করতে পারেনি। এমনভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ কারো জন্য কল্যাণ হবে না বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন। ৩. শিশু নির্যাতন ইয়েমেনের ৯ বছরের ফরিদ বোমাহত হয়ে হাসপাতালের বেড়ে কাতরাতে কাতরাতে ডাক্তারকে বলেছিল তাকে যেন কবর দেয়া না হয়। কারণ সে প্রতিনিয়ত বোমার আঘাতে তার খেলার সাথীদের মৃত্যুবরণ করতে দেখেছে, যাদেরকে কবর দেয়া হয়েছে। যে কারণে তার ছোট্ট হৃদয়ে কষ্ট ও ভয় জমেছে। কিন্তু জরাজীর্ণ নিথর দেহটাকে একদিন কবরস্থ করতেই হয়েছে। অন্যায় যুদ্ধের বলি হয়ে মরে যাওয়া ফরিদ আর ফিরে আসবে না সত্যি কিন্তু ফরিদকে সামনে রেখে যুদ্ধবাজ বিশ্ব নেতৃত্ব একবারও কি ভেবে দেখতে পারে? তাদের অর্থ ও অস্ত্রের তুলনায় একটি প্রাণ অনেক বেশি দামি। সিরিয়ার আইলান, পাকিস্তানের মুনতাহা, বাংলাদেশের রাজন সৌরভ ভারতের কিশোর নামের শিশুরা পাপ-পুণ্য বোঝার আগেই দানবীয় ক্রোধের শিকার হচ্ছে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও যেন এখন শিশু নির্যাতনে ভয়াল আখড়া। এখানে মাতৃগর্ভেও শিশু নিরাপদ নয়! পৃথিবীর আলো দেখার আগে বন্দুকের বুলেটের আঘাত তুলতুলে শরীরে লেগে ঘৃণ্য পাষন্ড পৃথিবীর অমানুষগুলোর সাথে পরিচিত হয়ে গেছে! এখানে সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাতকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ অথবা দুর্বল কান্নাজড়িত শিশুর দেহ ডাস্টবিনে খুঁজে পাওয়া যায়। রাস্তায় ফেলে যাওয়া ভূমিষ্ঠ সন্তান রেখে যাওয়া কোন অভাগিনীর কলিজার ধনকে কুকুর-বিড়াল টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কত নিষ্পাপ শিশু বেঁচে যায় ভাগ্যের জোরে আর কত শিশুর জীবনের সলিল সমাধি ঘটে তার ইয়ত্তা নেই। ক’টা অভাগা বাচ্চারই বা খবর টিভি পত্রিকায় ছাপায়? এ দেশের প্রভাবশালী বিত্তবানরা এখন শিশু নির্যাতকের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত। রাজনীতিবিদ, এমপি, গায়ক, নায়ক, খেলোয়াড়, বাহ! অনেক পাষান্ড পিতা বা মাতাকেও তাদের শিশু সন্তানকে নির্বিচারে হত্যার মত ঘটনাও অহরহ বেড়েই চলছে। এসবের খবর নেয়ার সময় কি রাষ্ট্রের হবে? ক’টা মামলার বিচার হয়েছে। শিশুদের প্রতিনিয়ত গুম করে মুক্তিপণ আদায় করে জীবন্ত ফেরত অথবা আস্তা লাশ ফিরিয়ে দিচ্ছে! এভাবে অনাগত ভবিষৎরা অনিরাপদ একটি ভুবনে পাড়ি দেবে? নিষ্পাপ ফুলগুলো কিছু হুতোম পেঁচার নির্মম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হবে? আমাদের কারো কি কিছু করার নেই? ৪. নারী নির্যাতন ও পারিবারিক কলহ : নারী নির্যাতন এখন মামুলি ব্যাপার মাত্র। নারীরা মায়ের জাতি, তাদের মর্যাদাহানি মানে মায়ের মর্যাকে পদদলিত করা। ঠুনকো অভিযোগে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। সুশিক্ষার অভাব এর প্রধান কারণ। নারীর প্রাপ্ত হক পিতা ও স্বামীর পক্ষ থেকে না পাওয়া। নারী উন্নয়নের ধ্বজাধারীরা নারী উন্নয়নের ধুয়া তুলে নিজেরাই কেন নীরব! নারীদের বিরুদ্ধে যৌতুক অনাদায় অথবা ঠুনকো অভিযোগে শারীরিকভাবে নির্যাতন, ধর্ষণ এখন মহামারীর রূপ ধারণ করেছে। বাসা বাড়ির কাজের নারী ও বিভিন্ন নিম্ন পেশার সাথে জড়িতরা সবচেয়ে অমানবিকতার শিকার। পারিবারিক কলহে আমাদের পরিবারগুলো চৌচির হতে চলছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পারস্পরিক সন্দেহ সংশয় দানা বেঁধে উঠছে। সন্তানরা পিতা-মাতাকে সমীহ করছে না। পিতা পুত্রকে বা পুত্র পিতাকে দিব্যি হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠছে। এমন বীভৎসতাকে কিসের সাথে তুলনা করা চলে? এ যেন কেয়ামত অত্যাসন্ন! ৫. রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, রাজনৈতিক কলহ ও বিরোধী দল দমনে ক্ষমতার অপব্যবহার : দেশে দেশ চলছে রাজনৈতিক সঙ্কট। দুর্বৃত্তায়ন, সরকারি দল বিরোধী দলের ওপর ক্ষমতার অপব্যবহার রাজনৈতিক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এখানে যেন ন্যূনতম মানবিক সৌজন্যতা নেই। যেনতেন ক্ষমতা দখলে রাখাই নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব। শুধুমাত্র ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার নিমিত্তে বিরোধী দলের ওপর জুলুম-অত্যাচার করে সরকার সমালোচক ও প্রতিপক্ষমুক্ত হতে চায়, রাষ্ট্রক্ষমতাকে অপব্যবহার করে সরকার পক্ষ এমন দুর্বৃত্তায়নে অংশগ্রহণ করে। সরকারের এমন দুর্বৃত্তায়নে বিভিন্ন দেশ তাদের স্বার্থসিদ্ধি করার নিমিত্তে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার নিমিত্তে মিথ্যা অভিযোগে প্রতিপক্ষকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাতেও এরা দ্বিধা করে না। এ কেমন ক্ষমাতান্ধতা? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা সরকারের সমালোচকরা যখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সরকারকে সতর্ক রাখতে ব্যর্থ হয় তখন ক্ষমতাধরদের অধঃপতন শুরু হয়। এমন থমথমে অবস্থায় পদ-পদবির মোহ ও রাষ্ট্রের অর্থ আত্মসাতের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয় ক্ষমতার স্বাদ আস্বাধন করতে গিয়ে নিজেরা অন্তঃকোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় খুনোখুনি রক্তারক্তি। সব মিলিয়ে দেশের জনগণের অবস্থা হয় ত্রাহি ত্রাহি। এমন সঙ্কট বিরাজ করলে একটি দেশ সা¤্রাজ্যবাদীদের ভয়াল থাবায় পিষ্ট হয়ে নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসে, তখন দেশের পরিচয় হয় ‘অকার্যকর রাষ্ট্র’ নামে। ক্ষসতান্ধদের সহযোগীদের অতিরিক্ত তৈলমর্দনে নেতৃত্ব অন্ধকারে থেকে যায়, কোনটা করা উচিত আর কোনটা উচিত নয় তার হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এভাবেই মহাসঙ্কটের আবর্তে নিঃশেষ হয়ে যায় একটি জনগোষ্ঠীর স্বপ্নসাধ। ক্ষমতান্ধ নেতৃত্বের গোঁড়ামিতে দেশে দেশে এমন ভয়াবহ সঙ্কট চলছে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও এই সঙ্কটের আবর্তে ঘূর্ণায়মান। ৬. অবৈধ কাজকে সর্বত্র বৈধ! (ক) দুর্নীতি, সুদ-ঘুষ ও অপরের সম্পদ আত্মসাৎ : যা অগ্রহণযোগ্য তাই অবৈধ। যা জীবন, সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। যুগে যুগে আল্লাহ তা’য়ালা মানবতার মুক্তির নিমিত্তে বৈধ ও অবৈধতার নির্দেশনা সবিস্তারে বিধৃত করেছেন। মানবিক মূল্যবোধ বিবেচনায় আবার নিজেদের সুবিধা অসুবিধাকে সামনে রেখে মানুষ নিজেরা বৈধতা ও অবৈধতার মাপকাঠি নিরূপণ করেছে। মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ কাজে এখন বৈধতা ও অবৈধতার মানদন্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সমাজের উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন সারির কেউ এই রোগ থেকে মুক্ত নয়। দুর্নীতিকরণ এখন জাতীয় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনও যেখানে দুর্নীতিগ্রস্ত! দেশের জনগণের সম্পদ লুন্ঠন করে নিজের সহায় সম্পত্তি বাড়ানোর এক ভয়াবহ প্রতিযোগিতা আমরা লক্ষ করছি। এতে করে সমাজে পুঁজিবাদের প্রসার ঘটছে। রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একটি অংশ জমিদার বনে যাচ্ছে, আরেকটি অংশ হতদারিদ্র্যের কশাঘাতে পিষ্ট হচ্ছে। এমন জঘন্য দুর্নীতিকে বৈধ হিসেবে কিছু লোক গ্রহণ করে নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির পাশাপাশি ঘুষ ও সুদকে একেবারে বৈধ হিসেবে সর্বত্র লুফে নিচ্ছে। অফিস আদালতে ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না, সুদ ছাড়া লেনদেন হয় না! এ কেমন অনাচার! মানুষ আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশনা অমান্য করে নিজের হাতে সুখ কামাই করতে গিয়ে নিজের বিপত্তি নিজেই ডেকে আনছে। এক কথায় অন্যায়ভাবে অপরের সম্পদ লুণ্ঠন। এ লুণ্ঠনের অগ্রনায়ক ক্ষমতাধররা। কোন রাষ্ট্র দুর্নীতি করতে পারে না, দুর্নীতিবাজদের কবলে পড়ে এখন রাষ্ট্রও দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। একজন মানুষের কত লাগে? সে কত খায়? কতই বা ভরণ পোষণের জন্য প্রয়োজন? আরেক জনের ঘাম আর রক্ত ঝরা অর্থের টাকায় নিজের ঐশ্বর্য কামাই করতে হবে? আসলে এরা নিজের সুখের লাভের মিথ্যা আশায় মিছে মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবন নিঃশেষ করে ফেলে, আসলে কি তারা দুর্নীতি, সুদ, ঘোষ নামক অবৈধ অর্জন ভোগ করে যেতে পারে? যখন তার ভাবনায় অবৈধ আর বৈধতার বিবেক জাগ্রত হয় তখন কি আর কিছু করার থাকে? (খ) প্রেমের নামে অবৈধ সম্পর্ক ও পরকীয়া: বিশ্বব্যাপী এক মারাত্মক বিকৃত যৌনরোগে আক্রান্ত! কথিত প্রেমের নামে অবৈধ দেহভোগ। ইসলাম এর কোন ভাবেই অনুমোদন করে না। বিয়ের আগের যে সম্পর্কে আমাদের সমাজে একটি গোষ্ঠী নির্লজ্জের মতো অলিখিত অনুমোদন দিয়েছে, ইসলাম তা কোনোভাবেই সমর্থন করে না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো যে এটাকে তারা জীবনের ফ্যাশন হিসেবে ধরে নিয়েছে! যারা এমন কুকর্মের সাথে জড়িত নয় তাদেরকে ব্যাকডেটেড বলা হয়! এখন এর আধুনিক নাম লিভটুগেদার। অবৈধ সম্পর্ককে যারা বৈধ বলে বেড়ায় তারা আহাম্মক! প্রতারক ও নীচু স্বভাবের। এ ধরনের সম্পর্ক বিস্তারের কারণে ক’দিন পর পরিবারের মধ্যে ভাঙন ধরছে। প্রায় ৮০ শতাংশ বিয়ে ভাঙে বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্কধারীদের। এর পর ভালো না লাগা ভালো না বাসা। তারপর পরকীয়া সম্পর্ক! এসব বিষয়গুলোকে অনেকে উদার চোখে দেখছেন! এমন উদারতা আগামী প্রজন্মকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমন প্রবণতা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আল্লাহ কর্তৃক অবৈধ জিনিসকে কিভাবে আমরা বৈধ করে নিচ্ছি? মানবতার এমন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার অন্যতম কারণ হিসেবে বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে মানুষ আল্লাহর অবাধ্য হয়ে চলছে। মানুষের নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ বেশি। যদিওবা তার জন্য ক্ষতিকর। মানুষের এমন অবাধ্যতার চরম শিখরে উপনীত হলেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জিঘাংসা ও উন্মত্তায় মেতে ওঠে। তখন তার কাছে বৈধ বা অবৈধ বলে কিছু থাকে না। নিজের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করাই যেন তার কামনা বাসনা হয়ে দাঁড়ায়। তখন সে কর্তব্যকর্ম ও জবাবদিহিতার কথা দিব্যি ভুলে যায়। অশান্ত পৃথিবীর চারদিকে মানবতা যখন শান্তির জন্য হন্যে হয়ে ফিরছে বাস্তবিক পক্ষে তাকে তার স্রোষ্টার নির্দেশ পালনের দিকেই ফিরে আসতে হয়, অনেকে যে সময় তাঁর নির্দেশনা পালনের জন্য হাজির হয় তখন তার আর সময় থাকে না! ফিরাউনও জীবনসায়াহ্নে নিজেদের শুধরানোর চেষ্টা করেছিল, তখন সময় আর হয়ে ওঠেনি। তাই সময় থাকতে সবার একটু নিজের পরিচয় জানা দরকার। আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য স্মরণ করা প্রয়োজন। জানা দরকার নিজের গন্তব্য-আখেরের। তাহলে মানবিকতাশূন্য পৃথিবী অমানবিকতার করালগ্রাস থেকে মুক্ত হয়ে মানবিক পূর্ণতায় ভরে উঠবে।  ঘোচে যাবে সকল অনাচার আর অবৈধ কীর্তি। আমরা সবাই মানুষ, সৃষ্টির সেরা তো আমরাই। আমরা আমাদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করি। আমরা এ ধরায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসেছি, এই সফরের কর্মসূচি যদি ব্যর্থ হয়ে যায় এর পরিণতি কী হতে পারে! কে জানে? আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ আমাদেরকে তোমার গন্তব্য পানে নিয়ে চলো, যেখানে আছে শান্তি নিরাপত্তা আর তোমার দিদার। শান্ত কর এ অশান্ত ধরাকে। লেখক : কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির