post

মুমিনের কোনো দিন পরাজয় নেই

০৮ জুলাই ২০১৫
মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত# ইসলামী সঙ্গীতের প্রতি আমার প্রচন্ড আগ্রহ বরাবরই ছিল। গান শুনতে যেমন পছন্দ করতাম তেমনি কণ্ঠ ভালো না হলেও গাইতেও চেষ্টা করতাম। মাঝে মধ্যে গান লেখার চেষ্টাও যে একেবারেই ছিল না তা কিন্তু নয়। ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে প্রতিটি মুহূর্তে প্রেরণা দেয়ার মত অনেক গান রয়েছে। এসব গানের একেকটি লাইন প্রতিটি কর্মীকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে তোলে। কিছু কিছু গান মনের প্রশান্তি জোগায়। সম্প্রতি সময়ে মনে হচ্ছে কিছু জনশক্তির মাঝে একটু হতাশা বিরাজ করছে। যারা সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছেন, তারা তো প্রশ্ন করেছেনই বরং যারা সেই সুযোগ পাননি, তারা ফেসবুকের ইনবক্সে সেই প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিয়েছেন। তাতে প্রচ্ছন্ন হতাশা ফুটে উঠেছিল। ঘটনা পরিক্রমায় তখন থেকেই একটি গানের দু’টি লাইন আমার মুখে বারবার উঠে আসছিল, আর তা হল গীতিকার আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ রচিত ও প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুরের সুরে গাওয়া “জনতার সাগরে বলে যেতে চাই মুমিনের কোন দিন পরাজয় নাই” গানটি। আমার লেখার শিরোনাম এবং ভূমিকা গানের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়ে হলেও লেখার বিষয়বস্তু গান নিয়ে নয়। বরং যারা ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত সেই সকল ভাইকে সাম্প্রতিক কিছু অভিব্যক্তিকে সামনে রেখে লেখা। আমার লেখাতে আমি এটিই লেখার চেষ্টা করেছি যে, একজন মুমিন তথা মর্দে মুজাহিদের পরাজয় থাকতে পারে কি না? মুমিনরা হতাশ হয়ে ভেঙে পড়া উচিত কি না? লেখার বিষয়বস্তুর সাথে গানের লাইন মিলিয়ে আমি দ্বীধাহীন কণ্ঠে বলতে চাই ‘প্রকৃতপক্ষে সাচ্চা ঈমানদার-মুমিন মুসলমানের কোন পরাজয় নেই। হতাশা গ্লানি মুমিনদের দুর্বল করতে পারে না। মুমিনতো তারাই যারা পরীক্ষায় চুল্লিতে দগ্ধ হয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হন। দুঃখ-কষ্ট, জুলুম-নির্যাতন, ঘাত-প্রতিঘাত, মুমিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যারা সত্যিকারের মুমিন ইসলামী আন্দোলনের সাথে তারা যেদিনই সম্পৃক্ত হয়েছেন সেদিনই দুঃখ-কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। ভয় কিংবা ডর মুমিনদের হৃদয়কে কিঞ্চিৎ পরিমাণও বিচলিত করতে পারে না। মুমিনরা যে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন দুনিয়ার কোন রক্তচক্ষুই তাদের সেই অবস্থান থেকে একচুল পরিমাণও টলাতে পারে না। সত্যিকারের মুমিন যারা, হতাশা এবং দুঃখ তাদের থাকতে পারে না। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা এ প্রসঙ্গে বলেন, তোমরা হতাশ হয়ো না, দুঃখ পেয়ো না, বিজয় তোমাদেরই যদি সত্যিকার মুমিন তোমরা হয়ে থাক। (সূরা আল ইমরান : ১৩৯) পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ বলেছেন, আজ যে দুঃখ কষ্ট তোমাদের পেয়ে বসেছে এর আগে এই ধরনের দুঃখ কষ্ট তোমাদের বিরোধীরাও পেয়েছে। এতো কালের উত্থান-পতন মাত্র, মানুষের মাঝে আমি এর আবর্তন করে থাকি। এ সময় এ অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে? আর তিনি এ সময়ে তোমাদের মাঝ থেকে কিছু লোককে শহীদ হিসেবে কবুল করতে চান। আর আল্লাহ জালেমদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা আল ইমরান : ১৪০) শহীদ হওয়ার বাসনা নিয়ে যে মুমিনরা জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে মুমিনরা কখনও মৃত্যুকে পরোয়া করে না, বরং সব সময় মৃত্যুর জন্য তৈরি থাকে। মৃত্যুকে সাহসের সাথেই আলিঙ্গন করে থাকে। মুমিনরা বিশ্বাস করে মহান রাজাধিরাজ আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছাড়া কখনও মৃত্যু আসবে না। মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। নির্ধারিত সময়ের একটু আগেও যেমন মৃত্যু আসবে না ঠিক তেমনি মৃত্যুর সময় যখন হয়ে যাবে তখন এক মুহূর্তকালও বিলম্ব করা হবে না। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক জাতির জন্য আকাশের একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। তারপর যখন সময় পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মুহূর্তকালের জন্যও  তাকে বিলম্বিত করা হবে না। (সূরা আরাফ : ৩৪) আর মুমিনরা কাপুরুষের মতো মৃত্যু থেকে পালিয়ে থাকারও চেষ্টা করে না। কারণ মৃত্যু অবধারিত, এটি মানুষকে আলিঙ্গন করবেই। এ প্রসঙ্গে কুরআনে এসেছে, ‘তাদের বলো, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাচ্ছো তা তোমাদের আলিঙ্গন করবেই, তারপর তোমাদেরকে সেই সত্তার সামনে পেশ করা হবে যিনি গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুই জানেন। তখন তিনি  তোমাদের জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করছিলে।’ (সূরা জুমআ : ৮) আরেকটি আয়াতে এসেছে, আর মৃত্যু, সে তোমরা যেখানেই থাকো না কেন  সেখানে তোমাদের নাগাল পাবেই, তোমরা কোনো সীসাঢালা প্রাচীরের  ভেতর অবস্থান করলেও। (সূরা নিসা : ৭৮) মুমিনদের পরিচয় যখন এমনই তখন সেই মুমিনদের কি পরাজয় স্পর্শ করতে পারে? গ্লানি বা দুঃখ কষ্টে কি ভেঙে পড়তে পারে? না পারে না। কারণ সাময়িক কোনো দুঃখ, কষ্ট যাতনা কিংবা বাহ্যিক পরাজয়কে মুমিনরা পরাজয়ই মনে করে না, বরং এটি চলার পথে ঈমানের নিখাদ পরীক্ষার একটি অংশ বলে বিশ্বাস করে। কুরআনের সেই শাশ্বত ঘোষণা মুমিনরা ভালো করেই জানে যে পরীক্ষা তাদের জন্য অবধারিত। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে এ প্রসঙ্গে বলেন- মানুষ কি মনে করেছে ঈমান এনেছি এ কথা বলার কারণেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। তাদের পরীক্ষা করা হবে না। পূর্বেকার লোকদেরকেও আমি পরীক্ষা করেছি, অতঃপর নিশ্চয়ই আল্লাহ জেনে  নেবেন ঈমানের দাবিতে কারা সত্যবাদী, কারা মিথ্যাবাদী। (সূরা আনকাবুত : ২-৩) অপর একটি আয়াতে আল্লাহ আরও বলেন, তোমরা কি মনে করেছ এমনিতেই বেহেশতে প্রবেশ করে যাবে। অথচ (পরীক্ষার মাধ্যমে) আল্লাহ জেনে নেবেন না, কে জিহাদ করতে প্রস্তুত আর কে ধৈর্য ধারণ করতে পেরেছে। (সূরা আলে ইমরান : ১৪২) মুমিনরা এ কথাও বিশ্বাস করে যে, ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক হওয়ার কোনো বিকল্প  নেই। এ জন্য সাময়িক কোনো বিজয়ে মুমিনরা যেমন আনন্দে উদ্বেলিত হয় না, ব্যাপক উচ্ছ্বাসে গা ভাসিয়েও দেয় না। তেমনি সাময়িক কোনো পরাজয়েও হতাশ হয়ে পড়ে না। ভেঙে পড়ে না। মুমিনরা সাময়িক ক্ষতির বিষয়টিকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যম মনে করে। ইসলামী রেনেসাঁর যে ইতিহাস, সাহাবায়ে আজমাইনের যে ইতিহাস আজ আমাদের মাঝে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত, তাতে যদি আমরা অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাই, রাসূল সা:- এর সাহাবারা জুলুম-নির্যাতনকে হাসিমুখে বরণ করেছেন। নির্যাতনের মুখে হতাশ হননি কিংবা ভেঙে পড়েননি। নির্যাতনের স্টিম রোলার চালানোর পরও হতাশ হয়ে ইসলামী আন্দোলনের পথ থেকে একচুল পরিমাণও সরে দাঁড়াননি। বরং নির্যাতনে তারা আরো দৃঢ় হয়েছেন। হযরত বেলাল রা:কে মক্কার তপ্ত বালুতে উটের পেছনে রশি লাগিয়ে টেনেহিঁচড়ে নির্যাতন করা হলেও তিনি দ্বীনের পথ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরে দাঁড়াননি। হযরত খাব্বাব রা:কে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে জ্বলন্ত কয়লার ওপর শুইয়ে বালু চাপা দেয়া হয়েছিল। আর তার শরীরের চর্বি গলে গলে সেই আগুন নিভে গিয়েছিল। উফ! কী নৃশংসতা! তবুও কি খাব্বাব রা: দ্বীনের পথ থেকে সরে গিয়েছিলেন? না! শরীরে চর্বি গলে পিয়ে গর্ত হয়ে গিয়েছিল তবু ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক এই মুমিন ভয়ে কিংবা হতাশ হয়ে ইসলামী আন্দোলনের পথ থেকে একচুল পরিমাণও  নড়েননি। সাচ্চা মুমিনরা পরাজয়ের মানসিকতা লালন করেন না। বেদনা কিংবা যন্ত্রণা কাতর হয়ে কুঁকড়ে যান না। বরং সর্বক্ষেত্রে তারা একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করেন। দুনিয়ার কোনো শক্তির কাছে মুমিনরা যেমন  মাথা নত করে না, তেমনিভাবে তারা দুনিয়ার কোনো শক্তির কাছে আশ্রয় গ্রহণ কিংবা সাহায্যও চান না। বরং মুমিনরা বিশ^াস করেন যে, সাহায্য চাইতে হলে একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। ভয় এবং হুঙ্কার মুমিনদের যেমন টলাতে পারে না, তেমনি কোনো ধরনের প্রলোভনও মুমিনদের দুর্বল করতে পারে না। তার জ্বলন্ত উদাহরণ দেখার জন্য আমাদের বেশি দূরে যেতে হবে না। সম্প্রতি মিথ্যা এবং বানোয়াট অভিযোগের রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ভাইকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়েছে। ওনাকে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য। কিন্তু আল্লাহর পথের মর্দে মুজাহিদ এই মুমিন প্রাণভিক্ষা শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, বরং হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন। পায়ে হেঁটে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে আরোহণ করেছেন। তিনি ভয়ে ভীত কিংবা প্রলোভনে প্রভাবিত না হয়ে বলেছেন, আল্লাহর নিকট ছাড়া অন্য কারো কাছে তো সাহায্য চাওয়া জায়েজই নেই। যে মুমিনরা শাহাদাতের তামান্না নিয়ে ইসলামী আন্দোলনে শরিক হন সেই সকল মুমিনদের কাছে যখন চির আকাক্সিক্ষত শহীদি মৃত্যু ধরা দেয় তখন এটি যে মুমিনদের সুস্পষ্ট বিজয় তার মাঝে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। মহান আল্লাহই মুমিনদের অভিভাবক। তাইতো যাবতীয় দুঃখ, কষ্ট, বালা-মুসিবতে মুমিনরা একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা করেন। আর যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। (সূরা তালাক : ৩) পরিশেষে বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার, শিল্পী চৌধুরী গোলাম মাওলার লেখা একটি গানের কয়েকটি চরণ উল্লেখ করে শেষ করতে চাই- “আল্লাহকে যারা বেসেছে ভালো, দুঃখ কি আর তাদের থাকতে পারে, হতাশা কি আর তাদের থাকতে পারে।” লেখক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির