post

রোহিঙ্গা ইস্যু ও মানবপাচার প্রসঙ্গ

১০ জুন ২০১৫
rohinga   সালমান রিয়াজ# রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি। মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে তাদের বসবাস। কিন্তু মিয়ানমারের কাছ থেকে তারা কোনো অধিকার পাচ্ছে না, বরং সেখানে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। মিয়ানমারের সরকারি ভাষা ‘বর্মী’ রোহিঙ্গাদের ভাষা নয়। তাদের নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে, যেটা আরবি, উর্দু, রোমান ও বার্মিজ ভাষার সমন্বয়ে তৈরি। যেটা নাকি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ভাষার সাথে কিছুটা মিল রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সেটার প্রেক্ষিতে অনেকে রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠী ভেবে ভুল করেন। একদিকে নিজেদের অঞ্চলে অমানবিক জীবনযাপন, অন্য দিকে অকথ্য নির্যাতন, দুয়ে মিলে ভাগ্যের তাগিদে পাড়ি জমায় পাশের দেশে। সরাসরি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ সহজতর হওয়ায় বাংলাদেশেই হয় তাদের অন্যতম নিরাপদ জায়গা। তারপর সেখান থেকে সহজ পন্থায় স্বল্প খরচে অন্য কোনো উন্নত দেশে যাওয়ার প্রচেষ্টা। বর্তমানে সাগরপথে পাড়ি জমানো হাজার হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উদ্ধার করায় এ সকল তথ্য উঠে আসে। জীবিকার তাড়নায় এসকল মানুষ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের ভাগ্যে সেই নির্যাতন ও বিনাশ্রম থেকেই যাচ্ছে। আর এর মধ্যে কিছু অসদুপায়ী লোক তাদেরকে বিদেশে গিয়ে ভালো উপার্জনের টোপ দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী ‘রোহিঙ্গা’ একটি জাতির নাম তা কারো অজানা নয়। তবে এই শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা জনের নানা মত। অনেকের ধারণা মতে, সপ্তম কিংবা অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটি আরব বাণিজ্য জাহাজ এ অঞ্চলে আসার সময় বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ে পতিত হয়। এ ঘটনায় জাহাজের অনেক যাত্রী সাঁতরে আরাকান উপক‚লে ওঠেন। এ সময়ে স্থানীয় জনগণ এগিয়ে এলে তারা ‘রহম’ শব্দটি উচ্চারণ করতে থাকেন। যার অর্থ আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি। আরবি ভাষা জানা না থাকার কারণে স্থানীয়রা ধরে নেন এটা তাদের জাতির নাম। সে থেকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির উৎপত্তি। তবে ইতিহাসবিদদের তথ্যানুযায়ী এ ঘটনাটাকে একেবারে ফেলে দেয়া যায় না। তাদের মতে, আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাস শুরু সপ্তম কিংবা অষ্টম শতাব্দরী মাঝামাঝি কোনো এক সময় থেকে। কারো মতে, আরাকানের সুপ্রাচীন নাম ‘রোহিং’ (আরাকানের পুরনো নাম) থেকে ‘রোহিঙ্গা’ জাতির নামকরণ করা হয়। মিয়ানমারের মূল ভূখন্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। সীমান্তবর্তী বাঙালি ও ভারতীয়দেরও তারা ‘কালা’ বলে অভিহিত করে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মূলত ইসলাম ধর্মের অনুসারী। যেহেতু বার্মা সরকার তাদের পড়াশুনার সুযোগ দেয় না, তাই অনেকেই মৌলিক ইসলামী শিক্ষাকেই একমাত্র পড়াশুনার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে। যথাযথ আদমশুমারির আওতায় না আনার কারণে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন। তবে, পাশের দেশের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প ঘুরে জাতিসংঘ একটি সংখ্যায় পৌঁছায়। প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করে। মিয়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক বাংলাদেশে, প্রায় ৩ লাখ সৌদি আরবে, প্রায় ২ লাখ করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বাস করে বলে প্রমাণ মেলে। মানবাধিকার লঙ্ঘন -১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তাদের ভোটাধিকারও নেই। rohinga-2 -তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারেন না, জমির মালিক হতে পারেন না এবং দু’টির বেশি সন্তান না নেয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে হয়। -রোহিঙ্গাদের চলাচলের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রিত। -তাদের ওপর বিভিন্ন রকম অন্যায় ও অবৈধ কর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। -তাদের জমি জবরদখল করা, জোর-পূর্বক উচ্ছেদ করা, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা এবং বিবাহের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দেয়া হয়। এমনকি সন্তান জন্মদানেও বিধিনিষেধ আরোপ করে। -রোহিঙ্গাদের কোনো প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করতে হয়। -রোহিঙ্গারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সমস্যা ও সম্ভাবনা বিপুল পরিমাণ মানুষ এ দেশে প্রবেশের ফলে সম্ভাবনার চেয়ে নানা ধরনের সমস্যাই তৈরি হচ্ছে বেশি। আর্থসামাজিক অনেক সঙ্কট যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি কক্সবাজার অঞ্চলে তাদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতার সৃষ্টি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের শ্রম তাদের চাইতে অনেক সস্তা। একজন স্থানীয় ক্ষেতে মজুরের কাজ করলে মজুরি নেন ৩০০ টাকা। অন্য দিকে একজন রোহিঙ্গাকে দিয়ে সেই একই কাজ ১৫০ টাকায় করিয়ে নেয়া যাচ্ছে। একজন স্থানীয় রিকশাচালক কোন নির্দিষ্ট দূরত্বে পারিশ্রমিক ৪০ টাকা নিলে সে একই দূরত্বে একজন রোহিঙ্গা রিকশাচালক নেন ৩০ টাকা কিংবা আরো কম। কক্সবাজারের অনেক শ্রমজীবী মানুষ এই কারণে তাদের ওপরে বিরক্ত। ফলে মাঝে মাঝে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও শোনা যাচ্ছে। নানা প্রকার কায়িক শ্রমের মধ্যে অন্যতম গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা। টেকনাফ এবং উখিয়ায় বসবাসকারী হাজার হাজার রোহিঙ্গা এ পেশায় জড়িয়ে সামুদ্রিক মাছের চাহিদা পূরণে একটা বড় অংশের জোগান দিচ্ছেন। এ ছাড়া তা আন্তর্জাতিক বাজারেও রফতানি হচ্ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদরা তাদেরকে অনেক অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে। অনেক রোহিঙ্গাকে মাদক আনা নেয়ায় বাধ্য করা হয়। তবে মানবপাচারের ব্যবসাটা চলছে রমরমায়। এভাবে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের টেকনাফ হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার অবৈধ পথ তৈরি করে। অনেক রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে এভাবে মালয়েশিয়া পৌঁছাতে সক্ষমও হয়েছেন। থাইল্যান্ডকে মূলত ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে তারা। বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া সমুদ্রপথে অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ার কারণে সেখানে ট্রলারকে তেল, খাদ্য, ইত্যাদি নানা প্রয়োজনীয় জিনিস পুনঃসংগ্রহ করে নিতে হয়। এরপর সেখান থেকে সরাসরি মালয়েশিয়া। মাথাপিছু মালয়েশিয়া পৌঁছে দিতে নেয়া হয় দুই হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। প্রতি ট্রলারে গড়ে ৪৫ জন করে যাত্রী পরিবহন করা হয়। এরকম অনেক ট্রলার প্রতি সপ্তাহে টেকনাফ, উখিয়া এসব অঞ্চল থেকে ছাড়ে। মানবপাচারকারী এসব চক্রের সাথে জড়িয়ে আছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের অনেক পাচারকারী দল। বর্তমানে মালয়েশিয়া যাত্রাপথে ট্রলারসহ যেসব যাত্রী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে ধরা পড়ছে তাদের মধ্যে ৬০-৭০ শতাংশ যাত্রীই মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকৃত রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা নির্যাতন ও মানবপাচার নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশসহ অন্যান্য পাশের দেশে ঠাঁই নিয়েছেন। কিন্তু নিজেদের ভাগ্যকে আরো একটু সফলতার দিকে নিতেই দালালদের টোপে পা দিচ্ছে এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ। আবার অনেকেই মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে সুবিধা আদায় করতে না পেরে ট্রলারে করে মালয়েশিয়া যাওয়ার সহজ পথ বেছে নেয়। এতে বুঝা যায়, অনেক আগেই সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার রুট আবিষ্কার করে রোহিঙ্গারা। স¤প্রতি সমুদ্রপথে মানবপাচারের ঘটনায় ব্যাপকভাবে এ তথ্য ফাঁস হয়। রোহিঙ্গাদের হাত ধরেই বাংলাদেশীরাও জড়িয়ে যায় সমুদ্রপথে মানবপাচার ব্যবসায়। আর এর সাথে যুক্ত হয় রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট শক্তিশালী চক্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় দুর্নীতিপরায়ণ সদস্য। এরই মধ্যে নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ৭৯ জন পাচারকারীর ও ২৪ জন পুলিশ কর্মকর্তার। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত শীর্ষ দালালরা বসবাস করে মালয়েশিয়ায়। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত তাদের নেটওয়ার্ক দিয়ে বিকাশের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে আর লোভ-প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সহজ-সরল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা অনায়াসে পাচারকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আসা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবপাচারের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায়। রোহিঙ্গারা সহায়-সম্বলহীনভাবে বাংলাদেশে আসায় তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে নিজেদের ভাগ্য গড়তে সমুদ্রপথে অনিশ্চিত যাত্রায় শরিক হয়। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) হিসাবে, গত ১৫ মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্রপথে এক লাখ ১৩ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে, যাদের মধ্যে সাগরেই মারা গেছে প্রায় এক হাজার। (সূত্র : ২০ মে ২০১৫, আমাদের সময়.কম ) সাগরপথে পাড়ি জমানো এসব মানুষ তাদের জীবনের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারছে না, বরং অনেকেই ওখানেই লাশ হয়ে গণসমাহিত হচ্ছে, আবার অনেকেই ডাঙায় ভিড়তে না পেরে সাগরে ভাসছে, এর মধ্যে কেউ বিধাতার আশীর্বাদে জীবন নিয়ে ফিরছে, আবার অনেকেই সাগরে বড় বড় মাছের আহারে পরিণত হচ্ছে। এভাবে ৪-৫ মাস সমুদ্রে বিনা-আহারে জীবনযাপন করে হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে তারা। তবুও মানবাধিকার সংগঠনগুলো নিশ্চুপ প্রায়। তবে বর্তমানে সাগরপথে নৌকা বা ট্রলারযোগে বহু বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ায় বিভিন্ন মহল রোহিঙ্গা ইস্যুটা সুরাহার কথা চিন্তা করছে। থাইল্যান্ডে পাচারের শিকার মানুষের গণকবর আবিষ্কারের পর অবশ্য বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশ একযোগে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন কূটনৈতিক মহল বর্তমান সঙ্কট নিরসনে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনের তাগিদ দিচ্ছে। চলতি মে মাসের শুরুতে থাইল্যান্ডে মানবপাচার এবং অভিবাসীদের গণকবরের সন্ধান এবং আন্দামান সাগরে হাজার হাজার ভাসমান অভিবাসী শনাক্ত হওয়ার পর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোচনায় এসেছে রোহিঙ্গা ইস্যুটি। বছরের পর বছর ধরে নাগরিকত্ব না পেয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘রাষ্ট্রহীন’ অবস্থায় বসবাস করে আসছে রোহিঙ্গারা। পরিচিতি ও স্বীকৃতিহীন এসব রাজ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। আর এ মিয়ানমারেরই অবিসংবাদিত নেত্রী বলে গণ্য করা হয় অং সান সু চিকে। বিশ্বশান্তিতে অপরিসীম অবদান রাখা, সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের অধিকার আদায়ে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ক্লান্তিহীন সংগ্রামের জন্য ১৯৯১ সালে মহান এই নেত্রীকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। অথচ নিজ দেশে রোহিঙ্গা নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে বরাবরই মিনমিনে গলায় কথা বলে আসছেন তিনি। এর ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। স¤প্রতি যখন মানবপাচারের শিকার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সাগরে ভেসে নির্মম দিনাতিপাত করছে, তখনও নীরব সু চি। যেখানে বহু বছর ধরে নির্যাতিত একটি জাতি বসবাস করছে, যাদের নেই কোনো মানবাধিকার, অথচ সেই দেশ থেকেই একজন শান্তি প্রতিষ্ঠায় নোবেল পুরস্কার পায় কিভাবে? এটা দ্বারা নোবেল পুরস্কার প্রশ্নবিদ্ধ হয় নাকি প্রশংসিত? করণীয় ব্রিটিশদের অযাচিত ভুল আর মিয়ানমারের গোঁড়ামির কারণে রোহিঙ্গার লাখ লাখ মানুষ বাস্তুভিটাহীন হয়ে বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে। সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে অবৈধভাবে পাড়ি জমাচ্ছেন অন্য কোনো দেশে। কিন্তু সে দেশ তাদেরকে সাদরে গ্রহণ না করায় তা সমুদ্রের অজানা গন্তব্যে ভাসছে। এতে যেমন বিঘœ হচ্ছে মানবাধিকারের তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মান ক্ষুণœ হচ্ছে ওই সব লোকের বসবাসকারী দেশগুলোর। তাই আঞ্চলিক সহযোগী দেশগুলোর উচিত অবিলম্বে তা সুরাহা করার ব্যবস্থা করা। দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি জনগণকে পাচারের বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে হবে। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর), জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার, (ইউএনওএইচসিএইচআর), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি (এসআরএসসি) এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর সমন্বয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা সমাধান হলে মানবপাচার বন্ধ করা অনেক সহজ হবে। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা পড়বে। ট্রানজিটভুক্ত দেশগুলোর সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরি করা। আঞ্চলিক সহযোগী সংস্থাগুলোকে আরো ত্বরান্বিত করা ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা। রাজনৈতিক নেতা বা সরকারি প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব যেই এ ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িত থাকুক না কেন, তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া নজরদারি বৃদ্ধি করা। মিয়ানমার রাষ্ট্রের অমানবিক চরিত্রের দরুন রোহিঙ্গারা চরমভাবে বিপন্ন। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ ভাবছে না। বরং মিয়ানমার পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে আঙুল ইশারা করে বসে আছে, কারণ তারা জানে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের কিছু বলবে না। মিয়ানমারের বিশাল খনিজ এবং বনজ সম্পদের লোভে পশ্চিমা দেশগুলো তাদেরকে কড়া ভাষায় কিছু বলতে কিংবা করতে খুব একটা রাজিও নয়। তারা মাঝে মধ্যে এটা সেটা বলেন শুধুমাত্র ফরমালিটি মানার জন্য। বিবৃতি ছাড়া কার্যকর কোনো ব্যবস্থা তারা এখন পর্যন্ত নিতে পারেনি। এমনকি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী অং সান সু চি যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের কেউ নন বলে অস্বীকার করেন, তখনো আন্তর্জাতিক মহলের নিশ্চলতা ছিল লক্ষণীয়। কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছে বটে, তবে সেটা শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ সমস্যার সমাধান কি আদৌ হবে, তা কবে হবে, কিভাবে হবে, তা কেউ জানে না। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। ফিরিয়ে নেয়া অনেক দূরের ব্যাপার। আগে তো স্বীকার করতে হবে তারা মিয়ানমারের অন্তর্ভুক্ত, তারপর না ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক মহলের নিশ্চুপ ভূমিকা এ সমস্যাকে ক্রমান্বয়ে আরও দীর্ঘ করছে। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় তার কবর রচিত হয়। এভাবে আশায় বুক বাঁধতে বাঁধতে ধৈর্যের বাঁধ হারিয়ে তারা পাড়ি জমাচ্ছেন অনিশ্চয়তার দিকে। যা না দিচ্ছে তাদের একটি বাসস্থানের সন্ধান, না পারছে তারা মানবাধিকার নিয়ে বাঁচার অধিকার। এভাবে চলতে থাকলে মানবাধিকারের দরজায় মানবাধিকারের জন্য বুক থাবড়ে পড়বে মানবতা, বিপন্ন হবে একটি জাতি। লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির