post

রোহিঙ্গা নির্যাতন সমস্যার সমাধান মুসলমানদেরই করতে হবে

মো: কামরুজ্জামান (বাবলু)

০৯ অক্টোবর ২০১৭
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে নির্যাতিত ও নিপীড়িতদের মধ্যে অন্যতম মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিষয়ে আলোচনা শুরুর প্রাক্কালে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার এক নির্মম চিত্র সবার সামনে তুলে ধরা যুক্তিযুক্ত বলে মনে হচ্ছে। কারণ এই চিত্রটি সামনে থাকলে রোহিঙ্গাদের করুণ পরিণতিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা সহজ হবে। নানা কারণে বিষয়টি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্তও সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ ইহুদি-খ্রিস্টান-হিন্দু- বৌদ্ধ গংয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমান দুনিয়ায় যা কিছু প্রকাশ্যে ঘটছে তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটছে পর্দার আড়ালে। সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকেই শুরু করা যাক। ১৯৪৫ সালে রুজভেল্ট, চার্চিল এবং স্ট্যালিন রাশিয়ার কিসিয়ায় ইয়াল্টা নামক বন্দরে বসে একটি নতুন দুনিয়ার (A New World Order) পরিকল্পনা করেছিলেন। এই গোপন বিশ্বরাষ্ট্র(Secret World State)এর কার্যবিধি এবং দুনিয়াকে শাসনকারী শক্তিকে উপলব্ধি করার জন্য তাদের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে জানা জরুরি। আর এই সব পরিকল্পনার মূল হোতা হলো যায়নবাদী (Zionist) ইয়াহুদি চক্র। প্রকৃত অর্থে ইয়াহুদিরা নিজেদেরকে ‘শ্রেষ্ঠজাতি’ মনে করে এবং বিশ্বাস করে সারা দুনিয়াকে শাসন করার একমাত্র অধিকার তাদের। আর এটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য ইয়াহুদিদের মৌলিক গ্রন্থ ‘কারবালা’তে অনেক বক্তব্য রয়েছে। দুনিয়ার শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এই কারবালার শিক্ষাগুলোকে মৌলিক ভিত্তি হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কারবালায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা রয়েছে। এগুলো হলো- গোপনীয়তা, আনুগত্য এবং ইয়াহুদি আইনজ্ঞ কর্তৃক ঘোষিত আইন-কানুনের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য। যারা কারবালার শিক্ষা পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্য থেকে বাছাই করে ইয়াহুদি রিব্বিগণ (Rabbinates) মহাসভার সদস্য নির্বাচিত করেন। এই গোপন সভাসদের সদস্য সংখ্যা হলো ৭০ ইয়াহুদি আইনজ্ঞ। জেনারেল ওভারসাইট কাউন্সিল (General Oversight Council) নামে তারা ইসরাইলে জমায়েত হয়ে থাকেন। এরাই সারা দুনিয়ায় ইয়াহুদিদের Secret World Governmen তথা গোপন বিশ্ব সরকার পরিচালনা করে থাকেন। আমেরিকার রকফেল পরিবার (Rockfel Family), ইংল্যান্ডের রটস চাইল্ড পরিবার (Rotschild Family) এবং ইতালির এগনেলি পরিবারের(Agnlli Family) মতো সকল পরিবার এই ৭০ জনের মহাসভার সদস্য। এই গ্রুপের বা মহাসভার অঙ্গসংগঠন রয়েছে জাপান এবং ইউরোপে। এ ছাড়া শপথভুক্ত গ্রুপটির ছোট-বড় আরো বহু অঙ্গসংগঠন রয়েছে সারা পৃথিবীব্যাপী, হাজারো প্রতিষ্ঠান রয়েছে এর সাথে সম্পৃক্ত। এই সংগঠনটিই আজকের জাতিসংঘ নামক সংগঠনের মূল উদ্যোক্তা। এই জাতিসংঘের নাম করে তাদের হাতের পুতুল ভেটো শক্তির দেশগুলোর মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। মূলত জাতিসংঘ এই গোপন এবং গভীর শক্তির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ‘বিনাই ব্রিথ(Bnai Brith)’ এবং বিল্ডারবার্গের (Bilderberg) মতো বিশালাকার ইহুদি সংগঠন। বিল্ডারবার্গ গোপন বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক বিপবের আয়োজন করেছে। অনেক রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করা এবং ধ্বংস করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এসব সংগঠন। দুনিয়াতে সংঘটিত বড় বড় সকল ঘটনার সাথে বিল্ডারবার্গের সম্পর্ক রয়েছে। বিল্ডারবার্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ট্রিল্যাটারাল কমিশন(Trilateral Commission) প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্ব অর্থব্যবস্থাসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে যেই কমিশন কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিল্ডারবার্গের সকল প্রোগ্রাম মিডিয়া থেকে সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়েছে। এই সংগঠনের ব্যাপারে সবচেয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে স্পেনের গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান লুইস গনজালেস ম্যাটা (Luis Gonzales Mata) এর বইয়ে। তার The Real Matters of the World (দি রিয়েল ম্যাটারস অব দি ওয়ার্ল্ড) নামক পুস্তক অনুযায়ী বিল্ডারবার্গের প্রতি বছর আয়োজিত প্রোগ্রামে নেয়া সিদ্ধান্তগুলোকে বাস্তবায়ন করার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো (NATO)-র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কেউ একজন ওই প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকেন। প্রকৃত অর্থে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হলো মানুষকে দেখানো একটি মন্ত্রণালয়। আমেরিকার আসল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন গোপন বিশ্ব সরকারের (Secret World Government) এর পরিচালক। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করার জন্য উলেখ করা যেতে পারে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে লাখ লাখ মানুষ হত্যাকারী আণবিক বোমা বানানোর ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা আমেরিকার ইয়াহুদি রিব্বিদের পক্ষ থেকেই নেয়া হয়েছিল। এই লাখ লাখ মানুষ হত্যাকারী বোমা ব্যবহৃত হবে কি না সেই সিদ্ধান্তও যায়নবাদী কমিশনই দিয়েছিলো। গোপন বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হিসেবে যায়নবাদীরা দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় নির্বাসিত ইয়াহুদিদের ফিলিস্তিনে সমবেত করার কাজ প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছে। দ্বিতীয় ধাপ হলো ফোরাত এবং নীলনদের মধ্যবর্তী প্রতিশ্রুত (Promised Land) ভূমিতে বৃহৎ ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা। ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটির শান্তি এবং নিরাপত্তার জন্য মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ২৮টি দেশের শাসকদের তারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং তাদেরকে ভাগ করে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। শুধু তাই নয়, ইসরাইল নামক রাষ্ট্রটির নিরাপত্তার জন্য আনাতোলিয়াতে ১৯টি ক্রুসেড পরাজিতকারী সেলচুক খিলাফত ও উসমানী খিলাফতের উত্তরাধিকারী কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে না। বায়তুল মোকাদ্দাসের স্থলে সুলাইমানের মন্দির(Temple of Suleyman) নতুন করে প্রতিষ্ঠা করবে এবং এগুলো বাস্তবায়ন করার পর মাসিহ পৃথিবীতে আগমন করবে এবং সে দাউদ (আ)-এর আসনে একজন ইয়াহুদি রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করবেন। এই রাজা দুনিয়ায় তার কর্তৃত্বকে পর্যালোচনা করবেন এবং এই দুনিয়ার শাসনভার বনি ইসরাইলের বংশধরদের হাতে আজীবনের জন্য সমর্পণ করবেন। ইয়াহুদিদের ধর্মবিশ্বাস হলো এটা, এটাই তাদের দ্বীন। তুরস্কের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ প্রয়াত প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘দাওয়াম’ অর্থাৎ ‘আমার সংগ্রাম’ গ্রন্থের ৮৫ থেকে ১০৭ পৃষ্ঠায় বর্ণিত বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত থেকে অতি সংক্ষেপে গোপন বিশ্বরাষ্ট্রের ধারণা উপরের আলোচনায় তুলে ধরা হলো। মেধা বিকাশ প্রকাশন কর্তৃক গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে। আর এই গোপন বিশ্ব সরকার (Secret World Government) প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা হচ্ছে মুসলমানদের। কারণ এই গোপন মিশনকে ভণ্ডুল করে দেয়ার মতো একমাত্র বিকল্প ও পূর্ণাঙ্গ বিধিবিধান সংবলিত দিকনির্দেশনা রয়েছে কেবলমাত্র মুসলমানদের হাতে। মুসলমানদের পবিত্র কুরআন যাকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে দেখা হচ্ছে তা প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে সম্পূর্ণ অবিকৃত এবং মহান আল্লাহর ঐশী গ্রন্থ হিসেবে ভূমিকা রাখছে যাকে যায়নবাদীরা তাদের লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছে। আর সে কারণে মুসলমানদের ধ্বংসকারী যেকোনো উদ্যোগকে যায়নবাদীদের ক্রীড়নক গোটা পশ্চিমা বিশ্ব সব সময়ই সমর্থন দিয়ে যাবে এটাই বাস্তবতা। বর্তমানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর শিক্ষাগুরু হিসেবে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদের’ আবির্ভূত হওয়াও এই গোপন বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং এশিয়া অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও তাদের ধ্বংস করার এক মহা পরিকল্পনারই অংশ। অসচেতন মুসলমানদের এটা বুঝতে হয়তো বা অনেক দেরি হয়ে যাবে। এবার মিয়ানমারের দিকে নজর দেয়া যাক। মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এর সামান্য ব্যত্যয় ঘটেনি এবং অন্যথা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই দৃঢ় বিশ্বাস অনেকের। একটু খেয়াল করুন সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র (Weapons of Mass Destruction)রয়েছে- এমন শতভাগ মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে দেশটিতে আক্রমণ চালিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হলো এবং অদ্যাবধি আগ্রাসন চলছে, আল-কায়দা দমনের নামে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হলো এবং এখনো সেখানে দখলদারিত্ব অব্যাহত রয়েছে। অথচ সেই পশ্চিমাদের চোখের সামনে, সেই জাতিসংঘ ও ন্যাটোকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে মিয়ানমারে গণহত্যা চলছে, জ্যান্ত মানুষকে আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, গণহারে ধর্ষণ করা হচ্ছে অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিম নারীদের, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখানে তথাকথিত মানবতার রক্ষক যায়নবাদীদের দালাল পশ্চিমা বিশ্বের পদক্ষেপ বলতে আমরা দেখতে পাই- নিন্দা প্রকাশ, উদ্বেগ জানানো এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার আহবান জানানো ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমার দৃঢ়বিশ্বাস এর চেয়ে বেশিকিছু হবেও না। আর মিয়ানমারের ঔদ্ধত্যও দিনকে দিন বেড়ে যাবে কারণ তারা খুব ভালোভাবেই জানে যে শুধুমাত্র মুসলমানদের সাচ্চা অংশটি ছাড়া বাকি গোটা বিশ্বই তাদের পক্ষে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হয়েছে এর সিকিভাগও যদি পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কোনো ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু কিংবা বৌদ্ধদের ওপর চালানো হতো নিঃসন্দেহে এতদিনে সেখানে ন্যাটো সামরিক হামলা চালিয়ে ওই সরকারের পতন ঘটাতো। বিশ্ব কূটনীতির ব্যাপারে ধারণা আছে, এমন সবার কাছে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার। আর তা হলো, পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে ইহুদি-খ্রিস্টান চক্র যখন কোন কিছু চান তাদের বক্তব্য হয় এমন Do it অর্থাৎ- এটা করো, করতে হবে, অন্যথায় হামলা কিংবা কঠিন অবরোধ। ইরান ও উত্তর কোরিয়া যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু তারা যখন কোন বিষয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করতে চায় এবং বিশ্ববাসীকে সেটা বুঝতে দিতে চায় না তখন তাদের বক্তব্য হয় অনেকটা এরকম এটা বন্ধ করা উচিত, এভাবে চলতে পারে না, আমরা এ ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, আমরা এটা বন্ধের আহবান জানাচ্ছি, ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু খেয়াল করে দেখুন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার ক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের ভূমিকা একই রকম। অপর দিকে, আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হলো মিয়ানমার সেনাদের বর্বরোচিত হত্যা, ধর্ষণ ও ধ্বংসাত্মক কার্যাবলির নিন্দা জানানোর পাশাপাশি প্রায় একই ভঙ্গিতে এবং কখনো কখনো আরো কড়া ভাষায় আরাকানের স্বাধীনতাকামী ও সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি(Arakan Rohingya Salvation Army -ARSA)--এর আন্দোলনের নিন্দা জানাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বসহ চরমপন্থী মোদি-অধ্যুষিত ভারত এবং কমিউনিস্ট-শাসিত চীন। আর এর সাথে সম্প্রতি যোগ হয়েছে বাংলাদেশের শেখ হাসিনার সরকার। এদিকে চীন সরাসরিভাবে মিয়ানমার সেনাদের গণহত্যাকে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর ভারত তার গতানুগতিক চানক্য নীতির আলোকে বলে বেড়াচ্ছে মিয়ানমারে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এবার রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা’র সশস্ত্র বিপ্লব কতটা যৌক্তিক সে ব্যাপারে খানিকটা আলোকপাত করতে চাই। প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ এবং পরবর্তীতে মূলধারার গণমাধ্যমে রাখাইনে গণহত্যা ও নিপীড়নের লোমহর্ষক কাহিনী একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে। আর এরই প্রেক্ষাপটে রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনা ও চরমপন্থী বৌদ্ধদের চালানো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। তবে, একই সাথে কোন কোন মহল খুব সুকৌশলে রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র অংশ তথা আরসা’র সশস্ত্র সংগ্রামকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়ে পুরো বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টা করছে। ওই সশস্ত্র সংগ্রামকে এমনভাবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে যেন এ ধরনের সন্ত্রাসবাদ পৃথিবীতে এই প্রথম এবং এর কোনো মার্জনা নেই। আসলেই কি ব্যাপারটি সে রকম? রোহিঙ্গা মুসলমানদের সশস্ত্র যুদ্ধ করার কি কোনো যৌক্তিকতা নেই? একেবারে সাদামাটাভাবে সবারই জানা, রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের নাগরিক বলেই স্বীকার করছে না মিয়ানমার। তাদের কোন জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, নেই ভোটাধিকার। মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ‘বাঙালি’ বলে গালি দেয়। এমনকি চারদিকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যখন নিন্দার ঝড় বইছে তখনও বেহায়ার মতো দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং (Min Aung Hlaing) তার সরকারি ফেসবুক পেজে দাবি করছেন যে, রোহিঙ্গারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না। এটি ‘বাঙালি’ ইস্যু। এমনকি এই নির্জলা মিথ্যাটি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সবাইকে একতাবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর (২০১৭) বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই খবরটি প্রকাশিত হয়। শুধু নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েই শান্ত থাকেনি না মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এক বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন পাস করার মধ্য দিয়ে হাজার বছরের পুরনো রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটাধিকার পুরোদমে কেড়ে নেয়া শুরু করে মিয়ানমার সরকার। নিজ দেশে রোহিঙ্গারা হয়ে পড়ে উদ্বাস্তু, শত শত বছর ধরে পুরুষানুক্রমে বাস করা নিজেদের ভিটেমাটিতে তারা হয়ে যায় কয়েদি। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় রাষ্ট্রবিহীন সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী। অথচ সত্যিকারের ইতিহাস হলো আরাকান রাজ্য এক সময় স্বাধীন ছিল। রাখাইন প্রদেশসহ বিশাল অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন আরাকান রাজ্যের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের রয়েছে হাজার বছরের সোনালি ইতিহাস। বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র মহাকবি আলাওল ছিলেন সেই আরাকান রাজ্যেরই রাজসভার কবি। ১৭৮৪ সালে আরাকানের স্বাধীনতা লুপ্ত হয় বর্মি রাজা ভোদায়ার আরাকান দখলের মাধ্যমে। এমনকি বর্তমান মিয়ানমার তথা তৎকালীন বার্মিজ সরকারের আরাকান দখলের পরও দেশটিতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। বার্মার পার্লামেন্টে পর্যন্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের ভূখন্ডকে দখল করে বহিরাগত বার্মিজ সন্ত্রাসীরাই উল্টো নাগরিকত্ব পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে সেখানকার আদিবাসী রোহিঙ্গাদের। এই বর্বরোচিত কর্মকান্ডে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন তথাকথিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি। ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়ার চক্রান্তে মেতে উঠেছে দখলদার বার্মিজ সেনারা। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই মিয়ানমার সরকার নিপীড়ন চালিয়ে আসছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর। রাজনীতি সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞান রাখেন এমন যে কারো কাছে যদি প্রশ্ন করা হয় এ ধরনের পরিস্থিতিতে একটি নিপীড়িত জাতির সামনে কী কী উপায় অবশিষ্ট থাকে? নিঃসন্দেহে এর জবাব একটাই। আর তা হলো স্বাধীনতার ডাক। আর ঠিক সেই কাজটিই দশকের পর দশক ধরে সীমাহীন নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের একটি অংশ সবেমাত্র শুরু করেছে। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে নিজ দেশে বহিরাগতদের দ্বারা নাগরিকত্ব হারিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হলে তাদের সামনে স্বাধীনতার ডাক ও সশ্রস্ত্র বিপ্লব কি অন্যায়? তাহলেতো চেগুয়েভারার মতো বিপ্লবীরাও সব ভয়ানক সন্ত্রাসী! একজন ইতিহাসসচেতন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করলে মিয়ানমারের এই সশস্ত্র আন্দোলনকে সব দিক দিয়েই বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে যেসব যুক্তি ছিল মিয়ামনারের রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র আন্দোলনের পেছনে তার চেয়েও বেশি যুক্তি রয়েছে। কারণ পাকিস্তানিরা কখনো বাংলাদেশের মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়নি, তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেনি (অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেক বাংলাদেশী), গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়নি, জ্যান্ত মানুষকে আগুনে ফেলে দিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে উল্লাস করেনি। বাংলাদেশের মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পটভূমিতেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং ভারত শুধুমাত্র পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করার লক্ষ্যেই সেই যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল যা ঐতিহাসিক সত্য। আর এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তসহ বেশ কয়েকটি লেখা এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় লুটপাট, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভূমিকা ও ভারতীয় হোটেলে অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত থেকে যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সেনাদের পেছনে পেছনে বাংলাদেশে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধা সেজে পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে লুটতরাজসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার খতিয়ান সবারই জানা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এ ধরনের বহু মুক্তিযোদ্ধাকে অনেকেই কৌতুক করে বলে থাকেন কলকাতাফেরত মুক্তিযোদ্ধা। যাই হোক, এসব বিষয় আজকের লেখার বিষয়বস্তু না হওয়ায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। তবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাদের সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ আছে তারা কিছুতেই রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগ্রামকে খাটো করে দেখতে পারেন না। আরাকানের স্বাধীনতার জন্য চলমান সশস্ত্র সংগ্রামকে বরং সর্বতোভাবে সহযোগিতা করাই তাদের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে মুসলিম বিশ্বকে। রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমি আরাকানে ফিরিয়ে সেখানে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বসবাস করার সুযোগ দানে মিয়ানমারের খুনি সরকারকে বাধ্য করার জন্য মুসলমানদের একজোট হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাস সাক্ষী, ছলচাতুরী ও ইসলামবিদ্বেষীদের মিষ্টি কথায় ভুলে এ যাবৎ মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্য ও ধর্মবিরোধী এবং আপসকামী যত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার প্রত্যেকটি ভুল হয়েছে এবং তার চড়া মূল্য দিতে হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। তাই আর বিলম্ব নয়, এখনই রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার আদায়ে মুসলিমবিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এক কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই। তা না হলে অচিরেই প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রকে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যবরণ করতে হবে। পরিশেষে পবিত্র আল কুরআনের সূরা আনফালের ৬০তম আয়াতের একটি অংশ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি : “তোমরা তোমাদের (শত্রুদের) মোকাবেলায় নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বাধিক শক্তি অর্জন করে রাখ।” লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির