post

লক্ষ্য অর্জনের পথে

মু. রাজিফুল হাসান

০৩ জুলাই ২০২০

পর্ব-১৫ (গত সংখ্যার পর) ওহুদে অর্জিত হলো আনুগত্যের শিক্ষা আর সুদৃঢ় হলো নেতৃত্বের ভিত: ওহুদ যুদ্ধের আগের দিন আবু সুফিয়ান আবদুদ্ দার গোত্রকে উত্তেজিত করার লক্ষ্যে বলেছিল: ‘হে বনু আবদুদ্ দার, তোমরা বদরের যুদ্ধে আমাদের পতাকা বহন করেছিলে। কিন্তু সে যুদ্ধে আমাদের কী পরিণতি হয়েছিল তা দেখেছো। মনে রেখো সৈন্যদের ওপর পতাকার দিক থেকে হামলা এসে থাকে। পতাকা যদি নেমে যায় তাহলে সৈন্যরা পর্যুদস্ত হয়। সুতরাং তোমরা হয় পতাকা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখবে নয়তো সরে যাবে। ওটা আমরাই ধরে রাখতে পারবো।’ এ কথা শুনে বনু আবদুদ্ দারের পতাকাবাহীরা আবু সুফিয়ানের নিকট প্রতিজ্ঞা করে বলল: ‘আমরা আমাদের অধিনায়কত্ব তোমার কাছে অর্পণ করছি। আগামীকাল যখন আমরা লড়াইয়ে নামবো, তখন দেখে নিও আমরাও কেমন লড়াই করি।’ ঐতিহ্যগতভাবেই কুরাইশদের যুদ্ধের পতাকা বহনের দায়িত্ব ছিল বনু আবদুদ্ দার গোত্রের। তাই বদর যুদ্ধেও তারা পতাকা বহন করেছিল। যুদ্ধ শুরু হলে কুরাইশদের মহিলা বাহিনীর প্রধান হিন্দ বিনতে উতবা তার সহকারীদের নিয়ে কুরাইশদের পুরুষ যোদ্ধাদের উত্তেজিত করার লক্ষ্যে ঢোল বাজিয়ে বলছিল: ‘চমৎকার, হে আব্দুদ্ দার, চমৎকার (তোমাদের তৎপরতা) হে পশ্চাৎদিকের রক্ষকগণ! প্রতিটি ধারালো তরবারি দ্বারা আঘাত হানো।’ ‘যদি ধাবমান থাক, আলিঙ্গন করবো এবং নরম গদি (বিছানা) বিছিয়ে দেবো। আর যদি পিছিয়ে যাও আলাদা হয়ে যাবো, আমাদের ভালোবাসা পাবে না তোমরা।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১৭৮ পৃষ্ঠা) বংশ মর্যাদা রক্ষা আর কুরাইশ সেনাপতি ও মহিলাদের মদদে প্রভাবিত আবদুদ দার প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো পতাকাকে উড্ডীন রাখার। তবে হযরত হামজা ইবনে আবদুল মোতালিব (রা), সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা), আলী ইবনে আবি তালিব (রা), আসেম ইবনে সাবেত (রা), তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা) এবং কুজমানের ক্রমাগত আক্রমণে ধরাশায়ী হয়ে যায় পতাকাবাহীরা। একে একে বনু আবদুদ্ দার গোত্রের ১০ জন পতাকাবাহী মারা যায়। মুশরিকদের পতাকা তোলার মতো কেউ রইল না। এমতাবস্থায় একজন ক্রীতদাস পতাকা তুলে ধরে যুদ্ধ করতে লাগলো। অবশেষে সেও মারা যায় কুযমানের আক্রমণে। ফলে মাটিতে পড়ে যায় পতাকা। (রাহিকুল মাখতুম, ৩১০-৩১১ পৃষ্ঠা) উল্লেখ্য যে, কুজমান ছিল একজন মোনাফেক (কাফের)। সে জীবন বাজি রেখে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করলেও তার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। মূলত ইসলামের পরিবর্তে নিজের বংশের মর্যাদা রক্ষা করাই ছিল তার যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য। ওহুদের যুদ্ধে সে প্রচণ্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং কিছুদিন পর সেই আঘাতের দাহনেই মারা যায়। এদিকে আবু দোজানা মাথায় লাল পট্টি বেঁধে যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে যেতে লাগলো, কাফেরদের যাকেই সামনে পায় তাকেই কুপোকাত করে চলেছে সে। হযরত হামজা (রা) ক্ষিপ্রগতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। তার সেদিনের যুদ্ধ এবং শাহাদাত নিয়ে ওয়াহ্সি বলেন: ‘আমি হামজার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম, তিনি স্বীয় তরবারি শত্রুদের দিকে তুলছেন আর চোখের নিমিষে তাদেরকে সাবাড় করে দিচ্ছেন। সামনের কাউকেই জীবিত ছাড়ছেন না। যুদ্ধ করতে করতে তার সারা দেহ ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে ধূসর বর্ণের উটের মতো হয়ে গেছে। এই সময় সিবা ইবনে আবদুল উযযা আমার সম্মুখ দিয়ে গিয়ে হামজার কাছাকাছি হলো। হামজা তাকে দেখে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘এই হাজামনীর বেটা, আয় আমার কাছে, মজা দেখাই!’ এই বলে তাকে আঘাত হানলেন। কিন্তু তার মাথায় আঘাত লাগলো না বলে মনে হলো। আমি হামজার প্রতি আমার বর্শা তাকে করলাম। লক্ষ্য ঠিক হয়েছে বলে যখন নিশ্চিত হলাম, তখন বর্শা ছুড়ে মারলাম তাঁর প্রতি। যা তাঁর তলপেটে গিয়ে বিদ্ধ হল এবং দুই ঊরুর মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তিনি এ অবস্থায়ও আমার দিকে এগোলেন। কিন্তু পরক্ষণেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে গেলেন। আমি তাকে খানিকটা সময় দিলাম। তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তখন আমি গিয়ে আমার বর্শা টেনে বের করলাম। অতঃপর কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে ফিরে গেলাম। রণাঙ্গনে আমার হামজাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন কিছুর প্রয়োজন ছিল না। আমি তাকে হত্যা করতে পারলে স্বাধীন হতে পারব জেনেই তাকে হত্যা করলাম। মক্কা ফিরে যাওয়া মাত্রই আমাকে স্বাধীন করে দেয়া হলো।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১৭৯ পৃষ্ঠা) এ দিকে গিরিপথে (জাবালে নূরে) নিয়োজিত মুসলমানদের তীরন্দাজ বাহিনীও সাহসী ভূমিকা রেখে চলেছে। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে কুরাইশদের অশ্ববাহিনী পরপর ৩ বার হামলা চালিয়ে চেষ্টা করে গিরিপথ দিয়ে প্রবেশ করার। তবে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা) নেতৃত্বে থাকা মুসলিম তীরন্দাজ বাহিনী তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিবারই প্রতিহত করে তাদের। অন্যদিকে কুরাইশ বাহিনীর পতাকা পদদলিত, আবার তাদের অশ্ববাহিনীও হচ্ছে ব্যর্থ। অন্য দিকে মুসলিম বাহিনীর বীরদর্পে যুদ্ধ করে যাওয়া। যেখানে ছিল ঈমান, ইয়াকিন, সাহসিকতা আর শাহাদাতের তামান্নার এক আধ্যাত্মিক সমন্বয়। কাফেরদের নিকট মুসলিম বাহিনীর এই শক্তিশালী আঘাত ক্রমেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছিল। ফলে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ল মুশরিক বাহিনীর, মনোবল হারালো তারা। অতঃপর নিশ্চিত পরাজয় ভেবে পলায়ন শুরু করলো যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে। মুশরিকদের পালানোর বিষয়ে বলতে গিয়ে যুবায়ের (রা) বলেন: ‘আল্লাহর শপথ, আমি উতবা তনয়া হিন্দ ও তার সহচরদেরকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে দেখেছি। তাদেরকে পাকড়াও থেকে বাঁচানোর জন্য মুশরিকদের কোন বড় বা ছোট দলকে এগোতে দেখলাম না।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১৮১ পৃষ্ঠা) আর বারা ইবনে আযেব রাদিআল্লাহু আনহু বলেন: “মুশরিকদের সঙ্গে আমাদের মোকাবেলা হলে তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। মোশরেক মহিলাদের আমি দেখলাম তারা হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পায়ের নূপুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। এ ধরনের ভয়-ভীতি আর ত্রাসের অবস্থায় মুসলমানরা মুশরিকদের ওপর তলোয়ার চালাচ্ছিলেন এবং মালামাল সংগ্রহ করতে করতে তাদের তাড়া করছিলেন। এ অবস্থায় মুসলমানরা মুশরিকদের তাড়া করে যাচ্ছিল পাশাপাশি গনিমতের মাল সংগ্রহ করছিল। মুসলিম সৈন্যদের গনিমতের মাল সংগ্রহ করতে দেখে গিরিপথে থাকা তীরন্দাজ বাহিনী একে অন্যকে বলতে লাগলো: ‘গনিমত, গনিমত। তোমাদের সঙ্গীরা জয়ী হয়েছে, এখন আর কিসের প্রতীক্ষা।” (আর রাহিকুল মাখতুম, ৩১৫ পৃষ্ঠা) তীরন্দাজদের কথা শুনে তাদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) বললেন: “তোমরা কি ভুলে গেছো, রাসূলুল্লাহ (সা.) তোমাদের কী আদেশ দিয়েছেন?” তবে তাতে তারা কর্ণপাত করেনি বরং বললো: ‘আল্লাহর শপথ আমরাও ওদের কাছে যাবো এবং কিছু গনিমতের মাল অবশ্যই সংগ্রহ করবো।’ (আর রাহিকুল মাখতুম, ৩১৫ পৃষ্ঠা) ফলে তীরন্দাজদের ৪০ জন গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) সংগ্রহে চলে গেল। অবশিষ্ট ১০ জন আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের (রা) নেতৃত্বে পাহারা দিতে থাকলো। এ সময় তারা বলছিল: ‘যদি নবী করীম (সা.) অনুমতি দেন তবেই আমরা এখান থেকে যাবো অথবা নিজেদের প্রাণ তার মালিকের কাছে সমর্পণ করব।’ (আর রাহিকুল মাখতুম, ৩১৫ পৃষ্ঠা) এদিকে গিরিপথে মুসলমানদের সংখ্যা কমে গেলে সে সুযোগটি হাতছাড়া করল না খালিদ বিন ওয়ালিদ। খালিদ বিন ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে দ্রুতগতিতে আঘাত হানলো গিরিপথে থাকা ১০ জন তীরন্দাজের ওপর। খালিদ বাহিনী অল্প সময়ের মাঝেই সবাইকে হত্যা করে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে মুসলিম বাহিনীর ওপর। খালিদের বাহিনী কুরাইশদের বিজয় ধ্বনি তুলে যুদ্ধের ময়দানে। ফলে পরাজিত প্রায় কুরাইশ বাহিনী পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুধাবনে সক্ষম হয় এবং ঘুরে দাঁড়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এদিকে মাটিতে পড়ে থাকা কুরাইশদের পতাকা তুলে ধরে আমরাহ বিনতে আলকামা নামক এক মহিলা। পতাকা দেখে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে থাকা মুশরিকরা জড়ো হতে থাকে পতাকার নিকট এবং সামষ্টিকভাবে হামলা চালায় মুসলিমদের ওপর। এভাবেই যুদ্ধের ময়দানের দৃশ্য বদলে গেল। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে মুসলমানদের পেছনে দিকে খালিদের বাহিনীর আক্রমণ আর সামনের দিকে পলায়নরত মুশরিকদের ঘুরে দাঁড়ানো। ফলে দুই দিকের আক্রমণে মাঝখানে পড়ে এলোমেলো হয়ে যায় গনিমতের মাল সংগ্রহ করতে থাকা মুসলিম বাহিনী। মুসলমানরা এমন নাজুক অবস্থায় উপনীত হলো যে কিছু সাহাবী যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালাতে লাগল, এমনকি পেছনে কী হচ্ছে সেদিকে খেয়াল করেনি তারা। তাদের কেউ কেউ পাহাড়ে উঠে গেল, আবার কেউ কেউ মদিনায় চলে গেল। অন্য একটি দল পেছনে যেতে গিয়ে মুশরিকদের সাথে মিশে যায়। অবস্থা এমন যে, কে মুসলিম আর কে মোশরেক তা চেনা যাচ্ছিল না। ফলে কিছু মুসলিম মুসলমানদের হাতেই মারা যায়। হযরত হুযায়ফা (রা) দেখলেন কিছু মুসলিম তার পিতার উপর আঘাত করছে। এ অবস্থায় তিনি বললেন: ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা, ইনি আমার পিতা, কিন্তু আল্লাহর শপথ, লোকেরা তার থেকে হাত ফেরায়নি। শেষ পর্যন্ত তাকে মেরে ফেলল।’ (আর রাহিকুল মাখতুম, ৩১৭ পৃষ্ঠা) এদিকে রাসূল (সা.) মাত্র ৯ জন সাহাবী নিয়ে মোরশেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য দাঁড়ালেন এবং সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘হে আল্লাহর বান্দারা আমার দিকে এসো, আমি আল্লাহর রাসূল।’ (আর রাহিকুল মাখতুম, ৩১৬ থেকে ৩১৯ পৃষ্ঠা) রাসূল (সা.)-এর এই আওয়াজ মুসলমানদের আগে মুশরিকদের কানে পৌঁছালো। কারণ মুশরিকরা রাসূল (সা.)-এর নিকটবর্তী ছিল। আওয়াজ শুনে কাফেরদের একটি দল রাসূল (সা.)কে হামলার কেন্দ্রবিন্দু বানিয়ে তাকে ঘিরে ফেলে। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে হযরত আনাস (রা) বলেন: ‘ওহুদের দিন রাসূল (সা.) ৭ জন আনসার ও ২ জন কুরাইশী সাহাবীদের সাথে মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। হামলাকারীরা রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর তিনি বললেন, কে আছো, যে ওদের আমার থেকে প্রতিরোধ করতে পারো? তার জন্য জান্নাত রয়েছে। অথবা তিনি বলেছেন, সে ব্যক্তি জান্নাতে আমার সাথী হবে। এরপর একজন আনসার সাহাবী সামনে অগ্রসর হয়ে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে যান। এরপর মুশরিকরা নবী করীম (সা.)-এর আরো কাছে পৌঁছে যায়। এবারও পূর্বাবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এভাবে পুনঃপুন প্রতিরোধ যুদ্ধে ৭ জন আনসার শাহাদাত বরণ করেন। এতে নবী করীম (সা.) তার সঙ্গে অবশিষ্ট দুইজন সাহাবীকে বললেন, আমরা আমাদের সঙ্গীদের সাথে সুবিচার করিনি।’ (সিরাতে আর রাহিকুল মাখতুম, ৩১৯ পৃষ্ঠা) ৭ জনের মাঝে সর্বশেষ হযরত ওমর ইবনে ইয়াজিদ ইবনে সাকান (রা) আহত হলে রাসূল (সা.) বলেন: ‘ওকে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ তাকে নিয়ে আসা হলে রাসূল (সা.) তাকে পায়ের সাথে ঠেস দিয়ে রাখেন। এ অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন রাসূল (সা.)-এর কাছে শুধু দুজন সাহাবী অবশিষ্ট ছিলেন, একজন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস অন্যজন তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা)। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কাফেররা রাসূল (সা.)-এর ওপর আঘাত হানে। উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাসূল (সা.)কে পাথর নিক্ষেপ করে, ফলে তিনি পড়ে যান। তখন তার নিচের মাড়ির ডানদিকের দাঁত ভেঙে যায় এবং নিচের ঠোঁট কেটে যায়। এদিকে আবদুুল্লাহ ইবনে শেহাব জহুরী নামে এক মুশরিক রাসূল (সা.) এর কপালে আঘাত করে আর আবদুল্লাহ ইবনে কোমায়া আঘাত করে কাঁধে। উল্লেখ্য, এ আঘাতে রাসূল (সা.)-এর লৌহবর্ম কাটেনি। অতঃপর ইবনে কোমায়া রাসূল (সা.)কে দ্বিতীয় আঘাত করে, যে আঘাত তার ডান চোখের নিচের হারে লাগে এবং বর্মের দু’টি করা চেহারায় বিঁধে যায়। (সিরাতে আর রাহিকুল মাখতুম, ৩২০ পৃষ্ঠা) এ সময় রাসূল (সা.)কে নিরাপত্তা দিতে তার পাশে থাকা অবশিষ্ট দু’জন সাহাবী প্রাণপণে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। রাসূল (সা.) তার তুণীরের সকল তীর সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসকে (রা) দিয়ে বললেন : ‘তীর চালাও, আমার মা-বাবা তোমার জন্য কুরবান হোক।’ আর হযরত তালহার (রা) কথা বলতে গিয়ে হযরত জাবের (রা) বলেন: ‘আনসাররা (৭ জন) শহীদ হওয়ার পর হযরত তালহা (রা) সামনে এগিয়ে একাই ১১ জনের (কাফেরের) সামনে বীরত্বের পরিচয় দেয়। এ সময় তার হাতে তরবারির আঘাত লাগে, এতে তার আঙুল কেটে যায়। সাথে সাথে তিনি 'ইস,সি' শব্দ উচ্চারণ করেন। রাসূল (সা.) বললেন: ‘তুমি যদি এখন ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করতে, তাহলে ফেরেশতারা সকলের সামনে তোমাকে উপরে তুলে নিয়ে যেতেন।’ জাবের (রা) আরো বলেন: ‘এরপর আল্লাহ তা’আলা কাফেরদেরকে অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন।’ (আর রাহিকুল মাখতুম, ৩২১ পৃষ্ঠা) এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) সর্বপ্রথম রাসূল (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হন। অতঃপর উপস্থিত হন আবু উবাইদা ইবনে জাররাহ (রা)। এ বিষয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) বলেন: ‘আমরা উভয়ে দৌড়ে রাসূল (সা.)-এর পাশে গেলাম, সেখানে দেখলাম হযরত তালহা (রা) রাসূল (সা.)-এর সামনে আড়াল হয়ে পড়ে আছেন। আমরা দেখলাম রাসূল (সা.)-এর চেহারা মোবারক জখম হয়ে গেছে। শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া চোখের নিচে চেহারায় গেঁথে গেছে। আমি সেগুলো বের করতে চাইলে আবু ওবায়দা (রা) বললেন, আল্লাহর ওয়াস্তে এগুলো আমাকে বের করতে দিন। এরপর তিনি দাঁত দিয়ে একটি কড়া কামড়ে ধরে ধীরে ধীরে বের করতে লাগলেন, যাতে রাসূল (সা) ব্যথা কম পান। শেষ পর্যন্ত তিনি একটি কড়া বের করেন, এতে তার নিচের একটি দাঁত পড়ে যায়। দ্বিতীয় কড়াটি আমি বের করতে চাইলাম কিন্তু আবু ওবায়দা (রা) বলেন, আবু বক্কর (রা) : আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে বের করতে দিন। এরপর তিনি দ্বিতীয় করাটিও ধীরে ধীরে টেনে বের করেন, এতে তার নিচের মাড়ির আরেকটি দাঁত ভেঙে গেল। এরপর রাসূল (সা.) বললেন: তোমাদের ভাই তালহার দিকে খেয়াল করো, সে নিজের জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে নিয়েছে। এরপর আমরা হযরত তালহা (রা) প্রতি মনোনিবেশ করি, তখন তার দেহের দশটির বেশি আঘাত লেগেছিল।’ অল্প সময়ের মাঝেই রাসূল (সা.)-এর ওপর ঘটে যাওয়া এই আক্রমণের পর দ্বীনের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সাহাবী হযরত আবু দোজানা (রা), হযরত মোসয়াব ইবনে ওমায়র (রা), হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা), হযরত সাহল ইবনে হোনায়ফ (রা), হযরত মালেক ইবনে সেনান (রা), হযরত উম্মে ওমারা নোসায়বা বিনতে কাব মাযেনিয়া (রা), হযরত কাতাদা ইবনে নোমান (রা), হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা), হযরত হাতেব ইবনে আবু বালতায়া (রা) এবং হযরত আবু তালহা (রা) রাসূল (সা.)-এর নিকট এগিয়ে আসে। (আর রাহিকুল মাখতুম) এদিকে রাসূল (সা.)-এর চারদিকে শত্রুদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। একসময় রাসূল (সা.) একটি গর্তে পড়ে হাঁটুতে আঘাত পান। তখন আলী (রা) তার হাতে ধরে ফেলেন। চারদিক থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর তীরের বৃষ্টি শুরু হলে তালহা (রা) নিজেকে ঢাল বানিয়ে রাসূলের (সা) দিকে আসা তীরগুলো নিজের হাতে ও শরীরে বিদ্ধ করে নিচ্ছিলেন। আবু দোজানা (রা) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে নিজের মুখ ও বুক ঝেঁকে দাঁড়ালেন। শত্রুদের নিক্ষিপ্ত অসংখ্য তীর বিদ্ধ হতে থাকলো তার পিঠে। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা) রাসূলকে প্রতিরক্ষার জন্য শত্রুদের দিকে তীর নিক্ষেপ করেছিলেন। এ সময় আবু দোজানা (রা) তাকে তীর দিয়ে যাচ্ছিলেন। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা) বলেন: ‘আবু দোজানাকে দেখলাম, আমাকে একটার পর একটা তীর দিয়েই চলেছেন আর বলছেন, ‘তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক। তুমি তীর নিক্ষেপ করতে থাকো।’ এমনকি সময় সময় তিনি ফলকবিহীন তীরও দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন, ‘নিক্ষেপ করো।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম) হযরত মুসআব ইবনে উমাইর (রা) রাসূল (সা.)-এর ওপর ইবনে কোমায়া বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। একসময় তিনি ইবনে কোমার হাতে শাহাদাত বরণ করেন। মুসআব ইবনে উমাইর (রা)-এর চেহারা রাসূল (সা.)-এর চেহারার সাথে মিল ছিল। ইবনে কোমিয়া মুসআবকে (রা) হত্যা করে মনে করেছিল যে, মুহাম্মদ (সা.)কেই হত্যা করেছে। তাই সে কুরাইশদের নিকট গিয়ে বলল: ‘মুহাম্মদকে হত্যা করেছি।’ এ খবর শুনে কুরাইশরা তা তড়িৎগতিতে প্রচার করতে থাকলো। রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুসলমানরা আরো হতভম্ব হয়ে যায়। কিছু সরলপ্রাণ সাহাবী যুদ্ধ রেখে অস্ত্র ফেলে বসে থাকল। কিছু সংখ্যক এমন চিন্তা করছিল যে: ‘মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বলবে, সে যেন আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে তাদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে।’ (আর রাহিকুল মাখতুম) আবার রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর সংবাদ শুনে মুশরিকরাও তাদের ঘেরাওয়ে থাকা মুসলমানদের ওপর আক্রমণের প্রতাপ কিছুটা কমিয়ে দেয়। তাদের অনেকেই হামলা বন্ধ করে মুসলিম শহীদের মৃতদেহ বিকৃত করতে লাগলো। কারণ তারা ভেবেছিল যে, রাসূল (সা.)কে হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের আসল উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেছে। এদিকে মুসআবের (রা) শাহাদাতের পর রাসূল (সা.) মুসলিম বাহিনীর পতাকা তুলে দেন আলী ইবনে আবু তালিবকে (রা) এবং তাকে নির্দেশনা দিয়ে বললেন: ‘পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও।’ অতঃপর মুসলিম বাহিনীর পতাকা হাতে হযরত আলী (রা) কাফেরদের বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি ময়দানে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন: ‘আমি বিভীষিকার বাবা।’ উল্লেখ্য যে, কুরাইশদের পক্ষে আবু সাদ হুঙ্কার দিয়ে বলেছিল: ‘আমি বিভীষিকা সৃষ্টিকারী। আমার সাথে লড়তে কে প্রস্তুত আছে, আস।’ আর এই জবাবে আলী (রা) উক্ত হুঙ্কার দিয়েছিলেন। অতঃপর উভয়ের মাঝে যুদ্ধ হলে আলী (রা) তাকে আঘাত করে ধরাশায়ী করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম) আলী (রা) সহ কিছু সাহাবীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় কিছুটা পিছপা হয় রাসূল (সা.)কে কেন্দ্র করে আক্রমণ করা মুশরিক বাহিনী। তখন রাসূল (সা.) সাহাবীদের নিরাপত্তা বলয়ের দিকে এগিয়ে যান। এ সময় কাব ইবনে মালেক (রা) তাকে চিনে ফেলেন এবং চিৎকার করে বললেন: ‘ওহে মুসলমান তোমাদের জন্য সুসংবাদ, এই যে রাসূল (সা.) আসছেন।’ (আর রাহিকুল মাখতুম) এ কথা শুনে রাসূল (সা.) কাবকে (রা) চুপ থাকার ইঙ্গিত দেন, যেন মুশরিকরা তার সম্পর্কে জানতে না পারে। তবে ঘোষণাটি মুসলমানদের কানে পৌঁছে গিয়েছিল ফলে ধীরে ধীরে ৩০ জন সাহাবি রাসূল (সা.)-এর নিকট জড়ো হয়ে যায়। তখন ৩০ জনের বাহিনী নিয়ে রাসূল (সা.) পাহাড়ে অবস্থিত মুসলিম বাহিনীর শিবিরে এগোতে থাকলেন, তবে এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুশরিকরা। কিন্তু রাসূল (সা.) সকল বাধা মোকাবেলা করে মুসলিমদের নিরাপত্তা শিবিরের পৌঁছে গেলেন এবং অন্য সকল সৈন্যদের জন্য রাস্তা করে দেন। ফলে মুসলিম বাহিনীকে ঘেরাওয়ের প্রচেষ্টায় থাকা মুশরিকদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এসময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, একটি উঁচু জায়গা উঠতে পারছিলেন না। কারণ তিনি মারাত্মকভাবে আহত ছিলেন। তাছাড়া তাঁর পরনে ছিল দুটি ভারী বর্ম। এসময় তালহা (রা) তাকে কাঁধে করে আরোহণ করলেন। আর তখন রাসূল (সা.) তাকে উদ্দেশ করে বললেন: ‘তালহা রাসূলের প্রতি যে সদাচরণ করল, তাতে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেল।’ (ইবনে হিশাম) (চলবে)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির