post

সভ্যতার সঙ্কট নিরসনে রাসূল (সা)

এর অবদান

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

প্রফেসর আবু জাফর

মানব সৃষ্টির আদিকাল থেকে অদ্যাবধি সভ্যতার বিকাশ সাধিত হয়ে আসছে। এই বিকাশ মানব বংশের ক্রমাগত অগ্রগামিতা ও নিরন্তর আত্মোপলব্ধির সাক্ষ্য বহন করে। অবশ্য এটা সত্য যে, মানবসভ্যতা কখনোই গতি ও আদর্শের প্রশ্নে স্থির লক্ষ্য সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হয়নি, যে কারণে মানবসভ্যতা নানা রূপ ও রেখায় নানামুখী বিশ্বাসের ভিন্ন ভিন্ন আধার হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ সভ্যতা সর্বমানবিক সমর্থক চৈতন্যের শাশ্বত রূপ পরিগ্রহ করতে সক্ষম হয়নি এবং এই কারণে মানবসভ্যতা সেই আদিকাল থেকে চিরকালই দুই বিপরীতমুখী ধারায় প্রবাহিত, আর এক জন্যই কোনো কোনো সভ্যতা আদিম-প্রবৃত্তিতাড়িত প্রায় আরণ্য-বর্বরতারই সমার্থক, অপরদিকে কোনো কোনো সভ্যতা সর্বমানবিক কল্যাণকামিতা নিয়ে মানব ইতিহাসের প্রচ্ছদপটে সমুজ্জ্বল। আধুনিক পাশ্চাত্য-চিন্তাবিদ হান্টিংটন বলেছেন, ‘সভ্যতার সংঘাত’ (ঞযব ঈষধংয ড়ভ ঈরারষরুধঃরড়হ), যেখানে তিনি ইসলামকে আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেছেন। এই বিশ্বখ্যাত গবেষকের বক্তব্য আংশিক ত্রুটিপূর্ণ। ত্রুটিপূর্ণ কারণ, তথাকথিত আধুনিক ইঙ্গ-মার্কিন সভ্যতা ইসলামী জীবনধারার সাথে ঘোরতরভাবে সাংঘর্ষিক বটে, কিন্তু একে সভ্যতার সঙ্ঘাত বলা আদৌ সঙ্গত বা সমীচীন নয়, এই সংঘর্ষ প্রকৃতপক্ষে প্রবৃত্তিতাড়িত আদিম বর্বরতার সঙ্গে সত্য শুভত্ব ও শাশ্বত জীবনবোধের সংঘর্ষ। অর্থাৎ একদিকে বন্য-বর্বরতা অন্য দিকে সর্বমানবিক কল্যাণকামিতায় ভাস্বর এক চিন্ময় শুভত্বের আলোকিত অঙ্গীকার। উল্লেখযোগ্য যে, মহানবী মুহাম্মদ (সা) কর্তৃক আনীত ও প্রদর্শিত ইসলামের যে পূর্ণাবয়ব শাশ্বত পয়গাম, তা আসলে সকল ক্ষুদ্রতা ও সকল আদিমতার বিরুদ্ধে এই আলোকিত অব্যর্থ অঙ্গীকার। মানববংশের অন্যতম অভিজ্ঞান হলো এগিয়ে চলা। মানুষ কখনোই স্থির অনড় ও অবিচল হয়ে থেমে থাকে না। শুভ অশুভ যাই-ই হোক, এক অন্তর্নিহিত তাগিদে সে নব নব রূপান্তরে নিজেকে বদলে নেয়। পশুপ্রকৃতির সঙ্গে এখানেই তার পার্থক্য। অর্থাৎ নিরন্তর অগ্রসরমানতা মানুষের স্বভাব বৈশিষ্ট্যের মৌলিক অপরিহার্য অভিজ্ঞান; যে কারণে মানব ইতিহাসে সভ্যতার পালাবদল ঘটেছে, নতুন রূপ ও অবয়বে সভ্যতা বিনির্মিত হয়েছে। এটাই সাধারণ সত্য, কিন্তু এতদসঙ্গে যেটা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো বিষয় তাহলো, মানবসভ্যতা আদিকাল থেকেই দু’টি সুস্পষ্ট ধারায় প্রবহমান। একটি ধারায় নিখাদ প্রবৃত্তি ও নিছক আনন্দ-সম্ভোগের স্থল উপাসনা, ক্ষমতা ও বিত্তবৈভবতাড়িত নিছক অন্ধকার দৃশ্য পার্থিবতার দাসত্ব; অন্য ধারায় রয়েছে সর্বমানবিক প্রেম ও ইনসাফের আলোকিত জীবনচেতনা, মহামহিমান্বিত স্রষ্টার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যসমৃদ্ধ সভ্য ও সুন্দরের পরম সওগাত। প্রথম ধারাটি হলো অভিশপ্ত ইবলিসের, যেখানে প্রতিনিধিত্ব করে নমরূদ, ফেরাউন ইত্যাদি ইবলিসের অনুগত কিংকর, যেখানে সপ্রতাপে রাজত্ব করে পাশবিক শক্তিমত্তা, নানাবর্ণ বেহায়াপনা, শোষণ-জুলুম, অবিচার ও স্থূল স্বার্থপরতা, দম্ভ ও দায়িত্বহীন যথেচ্ছাচার, পরদ্রব্য-লুণ্ঠনের মহোৎসব, মানববিদ্বেষ, অন্ধ ও নির্লজ্জ আত্মমুগ্ধতা ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধারাটি হলো, ঐশী নির্দেশে (উরারহব এঁরফধহপব) আলোকোজ্জ্বল নির্মল নির্ভুল পথরেখা, যা নবী-রাসূলদের দ্বারা প্রদর্শিত, যা পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির জন্য নিশ্চিত কামিয়াবি, যা মানবসৃষ্ট সকল কুহক ও কুজ্ঝটিকা থেকে মুক্ত এক অব্যর্থ সাফল্যম-িত জীবনের জন্য সর্বতোমুখী অব্যাহত আশীর্বাদ। এখানে মূর্ত হয়ে ওঠে মানবপ্রেম, মূর্ত হয়ে ওঠে কুৎসিত স্বার্থপরতার স্থলে পরার্থপরতা, দম্ভ ও নিরেট আত্মমুগ্ধতার স্থলে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ, বেহায়াপনার স্থলে লজ্জা সম্ভ্রমবোধ ও আত্মসম্মান, সর্বোপরি মনুষ্যজীবনে মুখ্য হয়ে ওঠে ¯্রষ্টার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও মৃত্যুপরবর্তী পারলৌকিক জবাবদিহিতার ভয়। এই পথই বিশ্বমানব সম্প্রদায়ের জন্য প্রকৃত পথ, যেখানে মানবজীবনের সাফল্য ও উৎকর্ষ নির্ধারিত হয় মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের মানদ-ে। যাই হোক, মানবসভ্যতার দ্বিতীয় এই ধারাটি বিকশিত হয়েছে আল্লাহপাক প্রেরিত নবী-রাসূলদের একাগ্র নেতৃত্বে, জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও সাধনায়। আর সভ্যতা বিনির্মাণে নবী-রাসূলদের এই বিপ্লবী আন্দোলনের নামই ইসলাম, যা কেবল ধর্ম নয়, সকল বন্যতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে যা-এক সর্বতোমুখী দুর্নিবার জীবন সংগ্রাম এবং মনে রাখা আবশ্যক, নবী মুহাম্মদ (সা) এই ক্রমবিকশিত ইসলামেরই সর্বশেষ নবী, নেতা ও চূড়ান্ত রূপকার। আলোচনার পরিপ্রেক্ষেতে এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে, সভ্যতা বলতে আসলে কী বোঝায় বা কী বোঝা উচিত? এ বিষয়ে যিনি যাই বলুন, নিশ্চিতভাবেই এটা সত্য যে, সর্বমানবিক কল্যাণ ও শুভত্ব ও বৈশ্বিক মমতা নিয়ে যে জীবনবোধ ও জীবনব্যবস্থা মানবসমাজে অপরাজেয় সুস্থতা ও সৌন্দর্য নিয়ে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে, সেটাই মানুষের সভ্যতা, সেটাই কাক্সিক্ষত বিশ্বমানবিক সভ্যতার অভিজ্ঞান। কিন্তু অতীব দুঃখজনক যে, নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ পাকপ্রদত্ত ও নির্দেশিত পথরেখা জাগরুক থাকা সত্ত্বেও কি-এক অমোঘ অভিশাপে মানুষের সভ্যতা মানুষের জন্যই গুরুভার ও বিপজ্জনক হয়ে পৃথিবীকে শাসন করেছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে কতিপয় ক্ষমতাবান বিবেকহীন মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার এক বর্বর প্রবৃত্তিবিলাস। সুদূর ব্যাবিলন থেকে গ্রিক রোমান ইসলামপূর্ব পারস্য যেখানেই দেখি, সর্বত্রই আমরা আমাদের বক্তব্যের নির্ভুল সাক্ষ্যই অবলোকন করি। এমনকি বহু মনীষীর প্রাজ্ঞতাসমৃদ্ধ আধুনিক যুগও একই সাক্ষ্য বহন করে। আলেকজান্ডার কি সিজর, কি খসরু-পাহলভিদের আমলে ছিল জৌলুস ও জাঁকজমক ও আড়ম্বর, ছিল মানুষের শ্রম-রক্তশোষিত বিলাসবৈভব, আর একালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছত্রছায়ায় গণতন্ত্রের আলখাল্লা পরিহিত বিশ্বে এমন এক তথাকথিত পরিহাসময় সভ্যতা বীরদর্পে বিরাজমান, যাকে ‘সভ্যতা’ বলাই রীতিমতো মূর্খতা ও আত্মপ্রতারণা। বরং যা বলা উচিত তাহলো, ‘সভ্যতা’ একটি মুখরোচক ও শ্রুতিমধুর শব্দ মাত্র। আসলে বিশ্বমানবতা বরাবরই এক আদিম দানবীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ ও অন্তরীণ। এই অকথ্য অবস্থা থেকে মানববিশ্বকে মুক্তিদানের অভিপ্রায় নিয়ে বহু মনীষী বহুভাবে চেষ্টা সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছেন, নিজেদের জীবনকে কোরবানি করে দিয়েছে, কিন্তু তাদের কাছে কোনোরূপ ঐশী নির্দেশনা না-থাকার কারণে, তাদের কোনো চেষ্টাই ফলবতী হয়নি, তিমিরাচ্ছন্ন পৃথিবী বরং আরো দুর্ভেদ্য ও আরো গাঢ়তম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। আর এইখানেই রাসূল মোহাম্মদ (সা)-এর বিকল্পহীন অবিসংবাদিত ভূমিকা, যা বিপন্ন সভ্যতার নিরাময়কল্পে মানবমুক্তির অব্যর্থ ব্যবস্থাপত্র। উল্লেখ করা আবশ্যক, রোগগ্রস্ত বিশ্বসভ্যতা ও বিশ্বমানবতাকে ব্যাধিমুক্ত করার দায়িত্ব অর্পণ করেই আল্লাহপাক মুহাম্মদ (সা)কে ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু লক্ষ্য করার মত বিষয়, এই কঠিন দায়িত্ব পালনে আল্লাহপাক তাঁকে বিরাট কোনো সৈন্যদল দ্বারা সাহায্য করেননি, বিরাট কোনো অর্থভা-ারও দান করেননি। একবারে আক্ষরিক অর্থেই নিঃস্ব রিক্ত নিঃসম্বল একটি মানুষ, তাঁরই স্কন্ধে অর্পিত হলো বিশ্বসভ্যতার সঙ্কটমোচন ও পুনর্গঠনের কঠিনতম গুরুভার। লোকবল, অস্ত্রবল, বিত্তবৈভব বলতে কিছু নেই, আছে শুধু আল্লাহ পাক প্রেরিত একটি মহিমান্বিত মহাগ্রন্থ, মনুষ্যজীবনের শাশ্বত পয়গাম আল কুরআন। আর ২৩ বছরের নাতিদীর্ঘ নবুওয়তি-জীবনে এই আল কুরআনের পরম নির্দেশনাকে পাথেয় করেই রাসূল (সা) সহস্র বৈরিতার মোকাবেলায় দৃঢ়পদে লড়াই চালিয়ে গেলেন, বর্বর জাহেলিয়াতের ঘন অন্ধকার বিদীর্ণ করে মানববিশ্বের সম্মুখে জাগিয়ে দিলেন শুভ আলোকোজ্জ্বল এক শাশ্বত প্রশস্ত অভ্রান্ত রাজপথ। অবশ্য সবাই এই তাওহীদি রাজপথ ধরে চলতে চায়নি, জেনে শুনেও জাহেলিয়াতকেই আপন করে নিয়েছে। অথচ পৃথিবীবক্ষে ইসলামের চেয়ে যে বড় আর কোনো নেয়ামত নেই, মহানবী (সা)-এর চেয়ে যে বড় আর কোনো শুভাকাক্সক্ষী নেই, এই চিরন্তন সত্যকে প্রবৃত্তির দাসত্ব মেনে এড়িয়ে চলা যায় কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। আর ইঙ্গ-মার্কিন আধুনিক জীবনধারার ক্রীতদাসরূপী হান্টিংটন সাহেবরা যে ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ (সা)কে তাদের ঘোরতর প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে, তার একমাত্র কারণ অসভ্য অশ্লীল আদিম বর্বরতার সম্মুখে ইসলাম সততই এক নিরাপস ও দুর্বার প্রতিবাদ। অতএব মিথ্যা ও মোনাফেকি তাড়িত এই আধুনিক বিশ্বের পক্ষে ইসলামকে সহ্য করা খুবই অসম্ভব। অসম্ভব বটে, তবু পৃথিবী একবার অন্তত ইতিহাসের মুক্ত-বাতায়ন পথে চেয়ে দেখতে পারে যে, পুরো সপ্তম শতাব্দী এবং তৎপরবর্তী আরো অনেকদিন বিশ্বের এক বিশাল অংশে ইসলামী সভ্যতার কী হৃদয় জুড়ানো সৌরভ ও সুতাবাস বয়ে গিয়েছিল। পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জিন্দেগির কী অনন্ত সাফল্য গাথাই না সেদিন মূর্ত হয়ে উঠলো। সেই কাক্সিক্ষত সুদিন আবারও ফিরে আসতে পারে, আবারও পৃথিবী সর্বমানবিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার হিল্লোলে আন্দোলিত হতে পারে। শুধু একটিই শর্ত, আল কুরআনের অব্যর্থ ঐশী নির্দেশনা এবং রাসূল মুহাম্মদ (সা)-এর শিক্ষা ও জীবনাদর্শকে মনুষ্যজীবনের অবিসংবাদিত অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সেই খোশ-নসিব কি পৃথিবীকে আবার কখনো আলোকিত করবে? আল্লাহ পাক জানেন, কিন্তু আল্লাহপাক দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘আমরা পথ দেখিয়েছি, ইচ্ছা করলে শোকরকারী হবে, না করলে অস্বীকারকারী হবে।’’ (সূরা দাহার : আয়াত ৩)। লেখক : কলাম লেখক, গীতিকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির