post

সময়ানুবর্তিতা

০৩ আগস্ট ২০১২
ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম বস্তুবাদীরা বলে টাইম ইজ মানি। তাই তারা সময়কে টাকা উপার্জনের সুযোগ হিসেবে দেখে। ইসলাম বলে সময় হলো জীবনকাল মানে হায়াত। জীবন নিয়ে ভাবে না অনেকেই। জীবনের কখন সূচনা, কোথায় গন্তব্য তাও জানে না প্রায় সকলেই। মানুষ জীবন যাপন করে কিন্তু জীবনের আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করে না। জীবনে মানুষ অনেক কিছু পেতে চায়, ভোগ করতে চায়, বিলাস চায়। জীবনে মানুষ নিরাপত্তা, অধিকার, সুখ, শান্তি, সৌন্দর্য, সাফল্য চায়। কিন্তু মানুষ যা যা চায় সেগুলোর সঠিক পরিচয়ই অনেকের জানা নেই। সেগুলো পাওয়ার পথ সম্পর্কে বিভ্রান্ত অনেকেই। মানুষ যা যা পেতে চায়, সেগুলো সাময়িক পেতে চায়, নাকি স্থায়ীভাবে পেতে চায়, সে বিষয়ে মানুষের সিদ্ধান্ত নেই। মানবদেহের দু’টি অংশ। একটি দেহ, অপরটি আত্মা। মানুষ দেহকে জীবন্ত রাখে রূহ (ঝঢ়রৎরঃ) বা জীবন ()। একজন মানুষকে জীবন্ত দেখা গেলেও তার জীবন বা রূহ দেখা যায় না। মূলত রূহ দেখা যাওয়ার জিনিস নয়। রূহ সম্পর্কে মানুষকে সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে। “তোমাকে তারা রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করছে। তুমি বলো, রূহ আমার প্রভুর একটি নির্দেশ। আর তোমাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে সামান্যই।” (১৭ : সূরা বনি ইসরাইল : ৮৫) এই রূহÑ আত্ম বা জীবন হলো আল্লাহর নির্দেশ। এটা একটা বিমূর্ত বিষয়। প্রত্যেকের রূহ আল্লাহর এক একটা নির্দেশ। রূহ মূর্ত হয় বা প্রকাশ পায় মানুষের দেহের মধ্যে। রূহ বা জীবনবিহীন দেহ মৃত। মানুষের রূহের মৃত্যু হয় না। মানুষের রূহ  অমর। পৃথিবীর জীবনে মানুষের যে মৃত্যু হয়, সে মৃত্যু হয় দেহের, রূহের নয়। মূলত রূহের হয় ইনতেকাল আর দেহের হয় মৃত্যু। ইনতেকাল মানে স্থানান্তর (ঃৎধহংভবৎ)। অর্থাৎ দেহ থেকে রূহ বা জীবন স্থানান্তর হয়ে যায়। দেহ থেকে রূহ স্থানান্তর হয়ে গেলেই দেহ হয়ে যায় মৃত। কুরআন অধ্যয়ন করলে জানা যায়, মানুষের জীবন বা রূহের কয়েকটি ইনতেকাল হয়। এর সর্বশেষ ইনতেকাল হয় জান্নাতে বা জাহান্নামে। জান্নাত বা জাহান্নামই মানুষের সর্বশেষ গন্তব্যস্থল (ঁষঃরসধঃব ফবংঃরহধঃরড়হ)। কুরআন মজিদ বা হাদিস পড়লে জানা যায় যে মানুষের জীবনের (রূহের) সৃষ্টি থেকে নিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছা পর্যন্ত মোট ছয়টি অধ্যায় রয়েছে। একটি অধ্যায় থেকে আরেকটি অধ্যায়ে রূহ স্থানান্তরিত হয়। এগুলো হলো :
  •   আলমে আরওয়াÑ রূহের জগৎ।
  •    আরহামে উম্মেহাত। মাতৃগর্ভ।
  •    হায়াতুদ দুনিয়াÑ পৃথিবীর জীবনÑ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৃথিবীর জীবন।
  •    আলমে বরযখÑ অন্তরাল জগৎ।
  •    ইয়াওমুল কিয়ামত/হাশর কিয়ামতকাল/ হাশরÑএ তিনটি অধ্যায় নিয়ে আখেরাত।
  •     জান্নাত/ জাহান্নামÑ জান্নাত বা জাহান্নাম।
দুনিয়ার জীবনটি মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের সমষ্টিমাত্র। সময় ও জীবন একাকার। নির্ধারিত সময়ে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় অনিবার্য বিধায় সময় সচেতনতা অপরিহার্য। সময় সচেতনতা ও সাফল্য অনেকটাই সমানুপাতিক। দুনিয়ার জন্য নির্ধারিত সময়কে পরকালের সাথে তুলনা করে কুরআনে কোথাও কয়েকটি ঘণ্টা, একটি সকাল বা একটি বিকেল ইত্যাদি শব্দ দ্বারা দুনিয়ার জীবনের সময় গুরুত্ব অনুধাবন করে সিরিয়াস হওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। সমাজে যারা উঁচু পর্যায়ে অবস্থান করেন তাঁরা সময় সঙ্কটে ভোগেন। নেতৃবৃন্দের গণসংযোগ, নির্বাহীদের ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে সময়ের ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। ইসলাম এ ব্যাপারে বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্বের মডেল (ওরা রাকাআনা লাকা জিকরাক; ৯৪ : সূরা আল ইনশিরাহ : ৪) হিসেবে মহানবী (সা) কে দিয়ে তাঁর সময়কে পরিকল্পিত ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে বলেছে, ফাইযা ফারাগতা ফানসাব; ৯৪ : সূরা আল ইনশিরাহ : ৭) অর্থাৎ একটি কাজ শেষ করেই আরেকটি কাজ শুরু করে দিন। পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া এমনটি কখনই সম্ভব নয়। অবসর সময় বুঝাতে কুরআনে ফারাগ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু যাদের পূর্ব পরিকল্পনা থাকে না তারা সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে না। ফলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাদের ব্যাপারেই মহানবী (সা) বলেছেন, আল্লাহর দেয়া দু’টি নেয়ামত ব্যবহারে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকা খেয়েছে। একটি হলো তার সুস্থতা, অপরটি তার অবসর সময়। জীবনের সময় নির্ধারিত বলেই প্রয়োজন হলো সময়ের যথার্থ ব্যবহার, সময়ের বাজেটিং। কোন কাজের জন্য কতটুকু সময় প্রয়োজন, কখন শুরু করে কখন শেষ করতে হবে, কোন কাজটি অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়াও প্রয়োজন কাজের মূল্যায়ন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ, নষ্ট সময়ের জন্য আফসোস করে সময় আরও ব্যয় করার চাইতে সামনে যেন আর সময় নষ্ট না হয় তার সিদ্ধান্তই জরুরি। এছাড়া সময়কে ঘিরে রয়েছে শয়তানের চক্রান্ত। শয়তান চায় মানুষ বেহুদা সময় কাটাক, অলস সময় কাটাক। নিজের জরুরি কাজ সম্পর্কে ভুলে থাকুক। আড্ডাবাজি, ধান্দবাজি ইত্যাদিতে মানুষকে লাগিয়ে দিয়ে শয়তান মানুষের সময়কে নষ্ট করতে তৎপর থাকে। কর্মপরিকল্পনার কথা শয়তান ভুলিয়ে দিতে পারে। ফলে জীবনে আসে শেষ সময়ের তাড়াহুড়া যা হলো শয়তানের প্রডাক্ট। সচেতন মানুষ তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডায়েরি সংরক্ষণ করেন, দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে কাজের সময় বণ্টন করেন। এমনকি দৈনিক কাজের জন্য আগাম সময় বণ্টন করে ক্রমান্বয়ে সম্পাদন করে থাকেন। ফলে তারা অনেক সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। সময় নষ্ট করা থেকে বাঁচতে হলে কথাবার্তা সংক্ষেপ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে চুপ থাকল সে বেঁচে গেল। এই হাদিসটি আমল করে শুধু অপ্রয়োজনীয় কথা পরিহার করে অনেক সময় বাঁচিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ সমাধা করা যায়। টিভি, মোবাইল মানুষের বহু সময় নষ্ট করছে। তৃতীয় বিশ্বের মানুষদেরকে টিভির সামনে বসিয়ে দিয়ে পাশ্চাত্য জগৎ আজ ল্যাবরেটরিতে বসে গবেষণা করছে। দৈনিক এক ঘণ্টা করে সময় বাঁচিয়ে বছরে ৩৬৫ ঘণ্টা বাড়তি সময়ে একটি বিরাট কাজ সম্পাদন করা যেতে পারে। এ সময়ে কুরআন অধ্যয়ন করা যেতে পারে। কুরআনের কয়েকটি সূরা মুখস্থ করা যেতে পারে, একটি আন্তর্জাতিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা যেতে পারে। যেমন মহানবী (সা)-এর সাহাবী হযরত যায়িদ বিন সাবিত (রা) ৭ দিনে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা শিখে নিয়েছিলেন। একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি পেশাগত কোনো ডিগ্রি নেয়ার জন্য এ সময়টুকুর পড়াশোনা যথেষ্ট কাজ দিতে পারে। সময়ের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। মহানবী (সা) হলেন জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মানুষ যিনি সময়ের মূল্য দানের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পেশ করেছেন। তাঁর ৬৩ বছরের জীবনকালের কর্মপরিধির বিস্তার এবং সকল ক্ষেত্রে সাফল্যের উদাহরণ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি যথাযথই বলেছেন, ‘এমন কোনো একটি সকাল আসে না যখন একজন ফেরেশতা ঘোষণা করে না যে, ‘হে বনি আদম! আমি একটি নতুন দিন এবং আমি তোমার কাজের সাক্ষী। সুতরাং আমার সর্বোত্তম ব্যবহার করো। শেষ বিদায়ের দিনের আগে আমি আর কখনো ফিরে আসব না।’ সময় স্রোতের মতোই বয়ে যায়। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কুরআনে আল্লাহপাক সময়ের কসম খেয়ে বলেছেন, ‘সময়ের বিচারে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।’ (১০৩ : সূরা আল আসর : ১-২) কেউ কেউ তো সময় নষ্টকারীকে তুলনা করেছেন সেই বরফ বিক্রেতার সাথে যার বরফ বিক্রয়ের আগে গলে পানি হয়ে যাচ্ছে তার। মহানবী (সা) সেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিটির পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন, যার দু’টি দিন একই রকম যায় নিঃসন্দেহে সে-ই ক্ষতিগ্রস্ত। তাই গতকালের অবস্থার চাইতে আজকের অবস্থা অধিক ভালো করার জন্য প্রয়োজন হল সিদ্ধান্তের আর সময়ের বাজেট অনুযায়ী প্রচেষ্টার। দুনিয়ার জীবনের সময় নির্ধারিত। কখন তা শেষ হবে তা কারোরই জানা নেই। ‘মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে।’ বাউল কবি অবশেষে মিস্ত্রির সন্ধান না পেলেও দেহ ঘড়ির ডিজিটাল প্রমাণ অনুযায়ী নির্ধারিত সময় এলেই সব শেষ। সে জন্য প্রয়োজন অনেক অর্জন ও বর্জন যা পরকালের পাথেয় হতে পারে। যেন সেখানে পৌঁছে কেউ না বলে যে আমি অল্প কালই ছিলাম। আর আফসোস করে বলবে, হায় আমি যদি হায়াত (সময়কে) কাজে লাগানোর ব্যাপারে যথার্থ পদক্ষেপ করতাম! (৮৯: সূরা আল বালাদ : ২৪) মহান আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে যত নিয়ামত দিয়েছেন সময় তার অন্যতম। এ সময়ই উন্নতি অবনতির সোপান। এখানে যাদের হার হয়েছে তারা আর শির উঁচিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। লেখক : বিশিষ্ট ব্যাংকার ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির