post

সিন্ডিকেট হলুদ সাংবাদিকতা ও কয়েকটি ঘটনার পোস্টমর্টেম

০২ মার্চ ২০১৪

আবু সালেহ মো. ইয়াহইয়া

Story(পর্ব ৪) শিবির নেতা রান্টু হত্যা ও একে-৪৭ হাতে রহস্যময় ব্যক্তি কী ঘটেছিল সেদিন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ২৭, ২৮ ও ২৯ অক্টোবর ’১৩ টানা তিন দিনের হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে ১৮ দলীয় জোট। হরতালের সমর্থনে ২৬ অক্টোবর সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও ১৮ দল যৌথভাবে মিছিল সমাবেশের আয়োজন করে। নগরীর কাজলা এলাকায় মিছিল চলাকালে হঠাৎ করে পেছনের দিকে একটি গাড়ি এসে থামে। ভারী আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত র‌্যাবের একটি টিম গাড়ি থেকে নেমেই মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করতে থাকে। অতর্কিত গুলির মুখে পড়ে ১৮ দলের কর্মীরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান নগরীর ২৯ নং ওয়ার্ড শিবিরের অর্থ সম্পাদক ২৮ বছরের টগবগে যুবক রাশেদুল ইসলাম রান্টু। বিএনপির মতিহার থানা সভাপতিসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হন। আরো অনেকেই মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে কমপক্ষে ১৫ জনকে গ্রেফতার করে। ১০-১২ জনের র‌্যাব টিমের সাথে ৪ জন সাদা পোশাকধারী সন্ত্রাসী টাইপের লোকও হামলায় অংশগ্রহণ করে। যাদের হাতে ছিল পেশাদার অপরাধীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একে-৪৭ সহ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। এ অস্ত্র আমাদের দেশের র‌্যাব সদস্যদের হাতেও ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। আবার হামলাকারীদের কোনোক্রমেই র‌্যাব সদস্যও বলা যায় না। রাজশাহীবাসীও কখনো তাদেরকে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে দেখেননি। ফলে হরতালবিরোধী কোনো দলের কর্মী বা ক্যাডার হিসেবেও তাদের চিহ্নিত করা যায়নি। মিডিয়া কী বলে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো প্রথমে পুরো বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। অধিকাংশ মিডিয়া একে-৪৭ ধারী একজনের অ্যাকশনের ছবি ছাপিয়ে সাদাপোশাকধারী র‌্যাব সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে। সরকারপন্থী মিডিয়াগুলো বিষয়টি পুরোপুরি চেপে যায়। প্রথম আলোর ভীমরতি ‘বদলে যাও বদলে দাও’ স্লোগানধারী পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলো অনলাইনে (অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে) একে-৪৭ ধারী লোকটির ছবি ছাপিয়ে ক্যাপশনে লেখা হয় ‘রাজশাহী নগরীর কাজলায় শিবিরের সশস্ত্র মিছিল’। অর্থাৎ যারা একে-৪৭ সহ অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ১৮ দলের মিছিলে হামলা করছে তারা সবাই শিবিরকর্মী হয়ে গেল। আর অস্ত্র হাতে র‌্যাব ও সাদা পোশাকের ব্যক্তিদের হামলা ও গুলিবর্ষণের দৃশ্য হয়ে গেল ‘শিবিরের সশস্ত্র মিছিল’। এখানেই থেমে থাকেনি তারা। আরেকটু আগ বাড়িয়ে ক্যাপশনে লেখা হয় ‘এরা (শিবির) এই অস্ত্র কোথায় পেল? ওদের কাছে এমন কত অস্ত্র আছে?’ নিচে ছবি ধারণকারী ব্যক্তি তথা ফটোসাংবাদিক হিসেবে ‘শহীদুল ইসলামে’র নাম উল্লেখ করা হয়। অস্ত্রের সাথে শিবিরের অবাস্তব সম্পর্ক আবিষ্কার করে অনেকটা জোর করে জনগণকে তা গিলতে বাধ্য করার হীন মানসে উপরোক্ত বক্তব্য ছবির সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়। ছবিটি ছাপানোর ১ ঘণ্টার মধ্যে অনলাইনে ৪ হাজার ২৪৬ জন লাইক করেন এবং ১০৮৫ জন এটি অন্যদের সাথে শেয়ার করেন। এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও ছবিটি শেয়ার করে শিবিরকে ঘৃণা করার আহবান জানান। ছবির নিচে কমেন্ট বক্সে শিবিরের পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য কমেন্ট পড়তে থাকে। এ দিকে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ভিডিও ফুটেজ ও চিত্র চলে আসে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। ফলে অনলাইনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এতে দেখা যায় অস্ত্রধারী যুবকরা র‌্যাবের সাথে র‌্যাবের গাড়িতে করেই এসেছে। প্রায় ১৫ মিনিট তারা মিছিলকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। হামলা ও গুলি করার ব্যাপারে পোশাকধারী র‌্যাব সদস্যদের চেয়ে সাদা পোশাকের অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের আগ্রহ ও আক্রোশ ছিল চোখে পড়ার মতো। আর এভাবেই প্রথম আলোর মিথ্যাচার পাঠকসমাজের কাছে ধরা পড়ে যায়। শিবিরের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ প্রথম আলোর অনলাইনে এমন হলুদ সাংবাদিকতার বিষয়টি নজরে আসার সাথে সাথে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয়। আমাদের জানানো হয়, রাজশাহী প্রতিনিধি এবং তাদের ফটোসাংবাদিক যা দেখেছেন তাই তারা প্রচার করছেন। পরে সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া ছবি ও ভিডিও ফুটেজগুলো প্রথম আলো সম্পাদক, বার্তাসম্পাদক, জামায়াত বিট, অনলাইন ইনচার্জের ইমেইলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর জানানো হয় ‘আমরা বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’ ভোল পাল্টালো প্রথম আলো আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সচেতন পাঠক মহলের ব্যাপক সমালোচনার মুখে কয়েক ঘণ্টা পর বাধ্য হয়ে ছবিটি সরিয়ে ফেলে তারা। এরপর ‘প্রথম আলো ডটকম’এ একই ছবি ছাপিয়ে ক্যাপশন দেয়া হয় ‘রাজশাহী নগরে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিবিরের মিছিলে ধাওয়া করে’। অর্থাৎ প্রথম আলোর তথাকথিত সেই অস্ত্রধারী শিবির ক্যাডার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বনে গেলেন। প্রথম আলোর জন্য এটি নতুন কোনো ঘটনা ছিল না। এ ধরনের তিলকে তাল কিংবা তালকে তিল করার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে প্রথম আলোর ইতিহাসে। এতে তাদের কোনো দুঃখ নেই। যেখানে শুধু আদর্শিক মতপার্থক্যের কারণে একটি পত্রিকা কাউকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয় সেখানে দিনকে রাত আর রাতকে দিন করার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ কিংবা প্রতিবাদ ছাপানোর প্রশ্নটি তাদের কাছে অবান্তর। প্রকৃত ঘটনা কী ছিল সাদা পোশাকের অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের পরিচয় নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়। রাজশাহীর র‌্যাব কর্মকর্তারা তাদেরকে র‌্যাব সদস্য বললেও জনগণের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য ঠেকেনি। তাদের পোশাক, পায়ের স্যান্ডেল, চুলের কাটিং, গুলিবর্ষণের সময় অস্থির আচরণÑ কোনো কিছুই পেশাদার কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মানায় না। আবার গুলিবর্ষণের ব্যাপারে তাদেরকেই বেশি তৎপর ও ক্ষেপা প্রকৃতির পরিলক্ষিত হয়। হামলার পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যদের সামনে-পেছনে যাবার ব্যাপারে তারা কমান্ডও করে। এদের প্রত্যেকের পায়ে ছিল স্যান্ডেল। চুলের কাটিং বখাটে মাস্তানের মতো আর চেহারা দেখে বাংলাদেশী মনে করা দুষ্কর। অনেকটা নেপালি বা ভারতের আসাম, ত্রিপুরা রাজ্যের নাগরিকের মতো এদের গড়ন। কখনো ফিল্মিস্টাইলে আবার কখনো গেরিলা স্টাইলে ড্রিবলিং দিতে দিতে তারা গুলি করতে থাকে। হামলা ও গুলির দৃশ্য দেখে অনেকেই এটা বাংলাদেশের চিত্র হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেননি। ভেবেছেন এটা হয়তো দীর্ঘ দিন ধরে যুদ্ধরত সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন বা আফগানিস্তানের পরস্পর বিদ্রোহী দু’টি গ্রুপের লড়াইয়ের দৃশ্য। পরবর্তীতে দৈনিক নয়া দিগন্ত, আমার দেশ অনলাইন সংস্করণ, দৈনিক মানবজমিন, শীর্ষ নিউজ ডট কমসহ প্রথম সারির অনেক জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের পরিচয় রহস্য নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রচার করে। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, এই প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে এমন ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ করে দেশবাসী। ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং ইন্ডিয়ান কিছু তরুণ-যুবকদের সমন্বয়ে আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করেছে বলে বেশ কয়েক মাস থেকেই জনগণের মাঝে গুঞ্জন ছিল। ভারতে দীর্ঘ দিন ধরে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে জামাই আদরে রাখা হয়েছে। বিরোধী দলের আন্দোলন দমন এবং গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ব্যক্তিদের গুম, খুন করাই এদের একমাত্র দায়িত্ব। বিএনপির জনপ্রিয় নেতা এম ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম, ছাত্রশিবিরের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্রনেতা ওয়ালীউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাসের গুমের ঘটনায় এ বিশেষ স্কোয়াড জড়িত থাকতে পারে বলে সচেতন মহলের ধারণা। পর্দার আড়ালে থেকে গুম, খুনের ঘটনা ঘটালেও রাজশাহীতেই প্রথম তাদের প্রকাশ্যে দেখা মেলে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এ ব্যাপারে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। (চলবে) লেখক : প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির