post

হাওরে মানবতার আর্তনাদ, পাশে দাঁড়াতে হবে

সাদিক বিন তানহার

৩১ মে ২০১৭
জলবায়ুগত কারণে অসময়ে বন্যার প্রকোপে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলা- সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরাঞ্চলের ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে বিশাল এলাকার হাওরাঞ্চলে প্রায় ২৪ লাখ কৃষক ও সাধারণ মানুষের বাস। গ্রামের কৃষক শ্রেণির জীবনমান সম্পর্কে আমাদের সকলেই মোটামুটি জানা। হাওরাঞ্চলে সাধারণত গরিব শ্রেণির বাস। যাদের জীবন সম্পূর্ণভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর হাওর এলাকার প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমি হলো তাদের জীবনধারণের বাহন। অসময়ের বন্যার প্রকোপে হাওরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে মানবেতর। বন্যায় হাওরাঞ্চলে ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ টনেরও বেশি চাল, ২ হাজার টন মাছ, ১১ হাজার ৩০৫ টন গো-খাদ্য। মোট ক্ষতির পরিমাণ টাকার অঙ্কে ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে আসল হিসাব এর চাইতেও অনেক বেশি। কারণ মিড়িয়াতে ক্ষতির সংবাদ সব সময় আসবে কম আর উন্নয়নের সংবাদ সব সময় বলা হবে বাড়িয়ে। কারণ মিড়িয়ার নিয়ন্ত্রণ হয় ক্ষমতা দ্বারা। তবে সেটা যাই হোক উপর্যুক্ত তথ্য মতে হাওরের জন-জীবনের পরিস্থিতি কতটা মানবেতর হয়ে পড়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে বলা হয়েছে, হাওরে পানি দূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১২ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস মারা গেছে। মৎস্যজীবী মানুষের জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তা সহজেই অনুমেয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষের পেশার বিচিত্রতা রয়েছে। কৃষক, জেলে, খামারি সব মিলিয়ে গ্রামের জীবন। বন্যার প্রভাবে সব পেশার মানুষ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাজারগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সব ধরনের ব্যবসায় নেমেছে ধস। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব থেকে জানা যায় হাওর এলাকায় ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের ২ লাখ হেক্টর জমির ফলন নষ্ট হয়েছে। ৬টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। কৃষকের জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, মাছচাষির মাছ নষ্ট হয়েছে, খামারির নষ্ট হয়েছে খামার- সব মিলিয়ে হাওরে মানবিক পরিস্থিতি চরম বিপর্যয়ে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার কথা বলা হচ্ছে। আমি মনে করি এমন পরিস্থিতি কোন অঞ্চলে সৃষ্টি হলে সে অঞ্চলকে আর দুর্গত ঘোষণা করার দরকার নেই। সে এলাকা দুর্গত হয়েই আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে। মানবসভ্যতার ইতিহাসের সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইতিহাস জড়িত। বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়, এটা সবার জানা। তবে জেনেও আমাদের নেই দুর্যোগ মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি। প্রায় প্রতি বছরই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। তারপরও সে অঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বা প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। কোন কাজের সুফল ভোগ করার জন্য প্রয়োজন সুন্দর পরিকল্পনা। সুন্দর পরিকল্পনা কোন কাজকে অর্ধেক সফল করে। কিন্তু আমাদের রয়েছে সে পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব। তা না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল আসতে পারে জেনেও আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি তেমনভাবে নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বন্যা প্রতি বছরই হয়। পরিবেশবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। অসময়ে এমন ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাস আগে থেকেই জানা গেছে। কিন্তু তারপরও আমরা সতর্ক হতে পারিনি। বাঁধ নির্মাণ করে ঠেকাতে পারিনি হাওরের বিপর্যয়। কারণ স্বচ্ছতার সঙ্গে বাঁধ নির্মাণ হয়নি। মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করার হীন চরিত্র আমরা ছাড়তে পারিনি। হাওরাঞ্চলে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে সেটাকে এখন সামাল দিতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশের এক অংশ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হলে তার প্রভাব সারা দেশের ওপর পড়বে। এ বছর অসময়ে বৃষ্টির এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সারা দেশেই কৃষিতে ফলন কমে গেছে। ধানের দাম অন্যান্য বছরের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। ধানের ফলনও হয়েছে বেশ কম। এই সাথে দেশে সরকারি খাদ্যের মজুদও অর্ধেক কমে গেছে। সব দিক মিলিয়ে দেশে বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। কিন্তু যুগান্তর ও সমকালের (১৫.০৫.২০১৭ ইং) প্রতিবেদন মতে দেশের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। কোনটা সত্য তা প্রমাণের বিষয় আমার না। তবে কথা হলো যদি সত্যিই প্রবৃদ্ধি কমে থাকে তাহলে অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়ার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়াবে। গেলো বছর দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল সে বন্যার ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি সে অঞ্চলের জনগণ। এই অবস্থায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনগণও অর্থনৈতিক ভাবে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে। দেশের দু’টি অঞ্চলের মানুষ উন্নয়নের অগ্রযাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এদিকে আবার বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, যদি আবার দেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তাহলে সারা দেশজুড়ে সৃষ্টি হবে হাহাকার আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো যথেষ্ট সামর্থ্য আমাদের নেই। যার প্রমাণ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি। এখন কথা হচ্ছে- বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো কতটা প্রস্তুতি আছে আমাদের? এটা নিয়েও রয়েছে বেশ সংশয়। পত্রিকাতে দেখলাম যে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাওরাঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখলাম। বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলোও সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। সরকারি- বেসরকারি বেশ কিছু সংগঠন আর্থিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করছে। এ রকম উদ্যোগ বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে সবদিক থেকে যখন বিপর্যয় দেখা দিবে তখন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে? না, আর এটাই বাস্তবতা। তাহলে প্রাকৃতিক এই সব দুর্যোগ থেকে দেশকে বাঁচাতে প্রয়োজন আগাম প্রস্তুতি। হাওরাঞ্চলেও সে রকম প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিলো। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু কিছু এলাকাতে বাঁধ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তাতেও সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে বেশ কিছু জাগায় দেখলাম যে, বাঁধ নির্মাণে হয়েছে দুর্নীতি। এখন কথা হচ্ছে যে দুর্নীতি হাওরাঞ্চলে হয়েছে সেটা যদি আবার অন্য বন্যাকবলিত অঞ্চলে করা হয় তাহলে পরস্থিতি কী হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাহলে দুর্নীতিবাজদের থাবা থেকে এসব স্থান মুক্ত রাখতে হবে। তা না হলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আর সরকারি ত্রাণেই দেশ চালাতে হবে। দুর্যোগের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে হলে পূর্বপ্রস্তুতি থাকার পাশাপাশি পরবর্তী প্রস্তুতিটাও থাকতে হবে। হাওরাঞ্চলে পূর্বপ্রস্তুতির বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত ছিলো বলে মনে হয়। এখন পরবর্তী কাজ করতে হবে সবার অংশগ্রহণে। মনে রাখতে হবে দেশের উন্নতি করতে হলে প্রত্যেকটা অঞ্চল থেকে এবং প্রত্যেকটা বিষয়ে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে উন্নয়ন সম্ভব না। হাওরাঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো যে সহায়তা দিচ্ছে তা জীবন ধারণের জন্য খাদ্য, পোশাক আর জরুরি ঔষধ ছাড়া বেশি কিছু না। তবে এছাড়াও আরো রয়েছে সে অঞ্চলের শিক্ষাগত একটা দিক। সে বিষয়ে যথাযথ দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ শিক্ষা একটা চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে এর সম্পর্ক গভীর। প্রায় ৪ লাখ পরিবারের সন্তানদের শিক্ষার বিষটা জড়িয়ে পড়েছে হাওরাঞ্চলের পরিস্থিতির সাথে। আর্থিক বা পরিবেশের কারণে যদি সে এলাকার শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়ে তাহলে সেটা হবে গোটা দেশের জন্য ক্ষতির কারণ। তাই আর্থিক, চিকিৎসাসহ যে সাহায্যগুলো করা হচ্ছে তার মধ্যে শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি ও অন্যান্য সব ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যার সময় বিভিন্ন এনজিও সংস্থা বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। এছাড়াও দেশের যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এনজিও সংস্থাগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। হাওরাঞ্চলের মানবিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য এনজিও সংস্থাগুলো এবারও তাদের সাহায্যের হাতকে প্রসারিত করবে বলে আশাবাদী। হাওরের সমস্যাটা কোনো আঞ্চলিক সমস্যা নয়, এটা সমগ্র দেশের সমস্যা। আমাদের দেশে বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। ১৭ কোটি মানুষ যদি ১ টাকা করে দেয় তাহলে গোটা হাওরে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান হবে বলে আশাবাদী। তবে এই কাজটা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন মানবসেবার ইচ্ছা। সে জন্য দেশের উদ্যমী তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে সমস্যা এক জায়গাতে সেটা হলো আমরা যেকোনো সমস্যা সমাধান করার আগে সেখান থেকে ফায়দা লুটার ফন্দি খোঁজতে থাকি। সাহায্যের হাত প্রসারিত করার চাইতে আমরা ভোট ব্যাংক বাড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকি। এমন মন-মানসিকতা পরিহার করতে হবে। মানবতার সেবায় দেশের সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে এটা শুধু হাওরের বিপর্যয় নয় এটা গোটা দেশের বিপর্যয়। পত্রিকাতে দেখলাম যে কয়েকটা ইসলামিক দল মানবিক সাহায্য করতে গেলে তাদের বাধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন বাধা দেয়া হলো সেটা স্পষ্ট নয়। এর পেছনে রাজনৈতিক কারণটাই বড়। এমন নিচু মানসিকতা পরিহার করা একান্ত কাম্য। দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির