post

হাফেজ ড. মুরসি একটি ইতিহাস, আন্দোলন ও বিপ্লবের নাম । ড. মোবারক হোসাইন

১৩ জুলাই ২০১৯

“তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণতাদানকারী। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্যদ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের ওপর তা বিজয়ী করে দেন যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সূরা সফ : ৮-৯)

দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রত্যয়ে যারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাদের পথচলা নিঃসন্দেহে বর্ণনাতীত কঠিন। এ কাঠিন্যের মাপকাঠি দিয়ে মহান রাব্বুল আলামিন তার অতি প্রিয় বান্দাদেরকে বাছাই করে নেন। কিছু বান্দার জীবনকে কবুল করে নিয়ে একটি আদর্শের বুনিয়াদ দুনিয়ার মানুষের জন্য তৈরি করে নেন সত্যের সাক্ষ্য রূপে। শহীদ ভাইদের স্মৃতি আল্লাহর প্রিয়তা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। পথ চলতে চলতে যখন নানা মোহ ভীতি ও শঙ্কা আমাদের পথ আগলে দেয় তখন হৃদয়ের মাঝে অমর হয়ে থাকা শহীদের স্মৃতি আমাদের মনে আশার দ্বীপশিখা জ্বালায়। "As the star that are starry in the time of our drakness" অর্থাৎ শহীদরা মিল্লাতের জীবন, মিল্লাতের গৌরব দুর্যোগের রাহবার। হতাশাগ্রস্ত মুসাফিরের জন্য তারা দিশাহারা ধ্রুবতারা। শোহাদায়ে কারবালা মুজাহিদদের হৃদয়ে তাইতো সৃষ্টি করে চলছে বিপ্লবের জজবা। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব পৃথিবীর চিরন্তন ইতিহাস। মানুষ যখন অন্যায় অত্যাচার আর অসত্যে নিমজ্জিত, শয়তান তার অনুসারীদের সাথে নিয়ে পৃথিবীতে শয়তানি শক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত; তখন আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসূল ও তাদের সঙ্গী সাথী হিসেবে প্রেরণ করেছেন দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মর্দে মুজাহিদ। নবী-রাসূলদের পর তাদের উত্তরাধিকারীরা এ দায়িত্ব পালনে ব্রত হন। তারা শয়তানি শক্তি নির্মূলের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন এমনকি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সাক্ষী হয়ে আছেন। শহীদ ড. মুহাম্মদ মুরসি একটি প্রেরণার নাম। একটি আন্দোলনের নাম। একটি বিপ্লবের নাম। যার অসাধারণ মেধা, অতুলনীয় প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, অমায়িক ব্যবহার আর আল্লাহভীরু মানসিকতা বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের প্রেরণার উৎস। কিন্তু প্রভুর প্রেমে পাগল দ্বীনের পথে এ মুজাহিদ দুনিয়ার এ ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে ছিলেন অনেক দূরে। শহীদ ড. মুহাম্মদ মুরসি! সেতো কোনো ব্যক্তির নাম নয়, একটি আন্দোলনের নাম। যে নাম সমগ্র বিশ্বের সকল ইসলামী আন্দোলনের প্রতিটি কর্মীর হৃদয়ের মণিকোঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা। যে নাম বিপ্লবী সুর সৃষ্টি করে, স্পন্দন জাগায় হৃদয়ে হৃদয়ে, স্বপ্ন জাগায় হাজারো মানুষের মনে। মুরসি চলে গেলেন কিন্তু উদ্ভাসিত হয়ে থাকবেন হাজারো নক্ষত্রের মাঝে। ২০১৯ সালের ১৭ জুন, মুরসি শাহাদাতের মিছিলে যোগ দেন। চলে গেলেন জান্নাতে তাঁর প্রভুর সন্নিকটে। জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ এবং মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়। এ সময় এভাবে যদি আল্লাহ মৃত্যু নির্ধারণ করে থাকেন; তাহলে কারো সাধ্য নেই মৃত্যুকে ঠেকানোর। আর শাহাদাতের মৃত্যুই শুধু পারে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিতে। আল্লাহ তায়ালার অমিয় বাণী, “প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।” পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু একদিন সবাইকে মরতে হবে সে বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো মতপার্থক্য নেই।

হাফেজ ড. মুরসি একটি ইতিহাস, আন্দোলন ও বিপ্লবের নাম । ড. মোবারক হোসাইনযতক্ষণ আমি নিরপেক্ষ ও আল্লাহকে মেনে চলব ততক্ষণ আমাকে সাহায্য করবেন : মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হয়ে মুহাম্মদ মুরসি প্রথমদিন বলেছেলিন, ২০১১ সালে যে বিপ্লবের মাধ্যমে সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতন হয়েছে তার ধারা অব্যাহত থাকবে। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী ব্রাদারহুডের এ প্রার্থী জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকারও আহবান জানিয়েছেন। মুহাম্মদ মুরসি মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেয়া ওই ভাষণে বলেন, ‘আমি মিসরের প্রতিটি নাগরিকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করব।’ তিনি বলেন, ‘মিসরের জনগণকে তাদের ঐক্য ও সংহতি জোরদার করতে হবে। একমাত্র জাতীয় ঐক্যই পারে দেশকে চলমান সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে।’ মুহাম্মদ মুরসি মোবারকবিরোধী বিপ্লবের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বলেন, শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। সে সময় মিসরের নির্বাচন কমিশন দেশটির সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল প্রার্থী মুহাম্মদ মুরসিকে বিজয়ী ঘোষণা করে। তিনি শতকরা ৫১.৭০ ভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। মুরসি পেয়েছেন এক কোটি ৩২ লাখ ভোট। তিনি জেনারেল আহমাদ শফিকের চেয়ে বেশি পেয়েছেন ৯ লাখ ভোট। নির্বাচনে আহমাদ শফিক পেয়েছেন এক কোটি ২৩ লাখ ভোট। মুরসির এ বিজয়ে রাজধানী কায়রোসহ মিসরজুড়ে শুরু হয় জনতার বাঁধভাঙা উল্লাস। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওই ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে মিসরের জনগণের অধীর আগ্রহের অবসান হয়। মুহাম্মদ মুরসি তার ভাষণে মিসরের জনগণকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনাদের কাছে দেয়া আমার ওয়াদা ভাঙলে আমাকে সম্মান করার কোনো প্রয়োজন নেই। শান্ত ও ধীর কণ্ঠে মুরসি বলেন, আপনাদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। যতক্ষণ আমি নিরপেক্ষ ও আল্লাহকে মেনে চলব ততক্ষণ হে আমার জনগণ, আমাকে সাহায্য করবেন, নচেৎ নয়। মুরসি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন, কিন্তু যদি আমি আমার দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করি বা আল্লাহকে মেনে না চলি তাহলে আমাকে অনুসরণ করবেন না। মুরসি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ, পুলিশ, বিচারক, পেশাজীবীদের সম্মান জানিয়ে মিসরের উন্নয়নে স্বাধীনভাবে কাজ করার আহবান জানান। মুরসি মিসরের সাথে সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার করে বলেন, ভারসাম্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মেনে চলবে তার সরকার। তিনি বলেন, মিসর যে কোনো আগ্রাসন মোকাবেলায় সক্ষম। এবং বিশ্বের যে কোনো স্থানে মিসরের নাগরিককে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন মুরসি। তিনি বলেন, মিসরের সকল নাগরিকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়াই আমার প্রধান ও অন্যতম কর্তব্য। বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তা অপরিহার্য।

এক বছর তিন দিনের ক্ষমতা রাজধানী কায়রোতে মিসরের সাংবিধানিক আদালতে শপথ নেন মুরসি। তিনিই ছিলেন মিসরের প্রথম ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট যিনি কখনো সামরিক বাহিনীতে ছিলেন না। শপথ গ্রহণের পর কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া ভাষণে তিনি জানান, সেনাবাহিনীকে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের মতোই রক্ষা করবেন। এই বাহিনী কখনো জনগণের ইচ্ছার বিকল্প হতে পারে না। মাত্র এক বছর ৩ দিন ক্ষমতায় টিকে ছিলেন তিনি। এই সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন মুরসি। প্রথমেই তিনি চীন সফর করেন, পরে যান রাশিয়ায়। এভাবে ব্রাজিল, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাত সফর করেন। ২০১২ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইল কর্তৃপক্ষ অভিবাসনের চেষ্টা চালালে তিনি প্রতিবাদ জানান এবং তেলআবিব থেকে মিসরীয় দূতাবাস প্রত্যাহার করে নেন। প্রধানমন্ত্রী কিনদিলকে গাজায় পাঠান সাহায্যের চিহ্নস্বরূপ। কিনদিল হামাসের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঐকমত্য ঘোষণা করেন এবং খুলে দেয়া হয় রাফাহ সুড়ঙ্গ। এই ঘটনায় আরব বিশ্বে বেশ প্রশংসিত হন মুরসি। মিসরের সুয়েজ খালের উন্নয়নের জন্যও বিরাট অঙ্কের বাজেট নির্ধারণ করেন মুরসি। নির্বাচনী প্রচারণায় মিসরকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ক্ষমতায় এসেই নতুন খাদ্যগুদাম বানানোও শুরু করেন এবং কৃষকদের চাষ কাজে উৎসাহিত করার জন্য সহযোগিতা ও ঋণদান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খাদ্য আমদানি করা রাষ্ট্র হলো মিসর। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছিলেন মুরসি। এ ছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার জন্য প্রাথমিক, সেকেন্ডারি এবং হাইয়ার সেকেন্ডারি লেভেলে তিনি পাশ্চাত্য সিলেবাস বাতিল করার পদক্ষেপ নেন এবং মিসরের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রাধান্য দিয়ে বিকল্প শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে মিসরের বাজার তুর্কিদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তার নানা উদ্যোগ আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সেনা সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তাকে উৎখাতের চক্রান্ত চলতে থাকে, যার পরিণতি পায় ২০১৩ সালের ৩ জুলাই।


এক নজরে শহীদ মুহাম্মদ মুরসি পূর্ণ নাম : মুহাম্মদ মুরসি ইসা আল-আইয়াত। জন্ম : আগস্ট ৮, ১৯৫১। এল আদওয়াহ, শারকিয়া গভর্নরেইট, কিংডম অব মিসর। মৃত্যু : জুন ১৭, ২০১৯ (৬৭ বছর)। কায়রো, মিসর। মৃত্যুর কারণ : ড. মুহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে তাকে কারাগারেই বন্দী করে একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছিল। বঞ্চিত করা হয়েছিল চিকিৎসাসহ সকল প্রকার মানবিক অধিকার থেকে। তাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। অবশেষে আদালতের এজলাসেই প্রাণ হারালেন তিনি। সমাধি : কায়রোর মদিনাত নসরের আল ওয়াফা ওয়া আল-আমাল কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। নাগরিকত্ব : মিসরীয়। শিক্ষা : কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় ও সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা : অধ্যাপনা। যে জন্য পরিচিত : রাজনীতি, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, হাফেজে কুরআন।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার চার মাস পর মুরসি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের ১৪ জন সিনিয়র সদস্য বিচারের সম্মুখীন হন। প্রথমে মুরসিকে আলেকজান্দ্রিয়ার কাছে অবস্থিত একটি উচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে এবং পরে কুখ্যাত তোরা কারাগারে রাখা হয়। তোরা কারাগারের একজন সাবেক কারারক্ষী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই কারাগারের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যে কেউ একবার সেখানে গেলে মারা যাওয়া ছাড়া বের হতে পারে না। অন্য দিকে হোসনি মোবারকের সঙ্গে করা আচরণটি দেখুন। তিনি মুরসির মতো এমন অমানবিক আচরণের শিকার হননি। কোনো কুখ্যাত কারাগারে তাকে রাখা হয়নি। একটি সামরিক হাসপাতালে তাকে আরামদায়কভাবে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে আদালতে আসতেন। তার আইনজীবী বলেছিলেন, তার মক্কেল খুবই মুমূর্ষু। যেকোনো সময় তাঁর মৃত্যু হতে পারে। মিসরের বর্তমান সামরিক শাসকেরা কখনো ভোলেননি যে মোবারক সাবেক বিমানবাহিনী প্রধান একসময় তাদেরই একজন ছিলেন। ২০১৭ সালের মার্চে তাকে সামরিক হাসপাতাল থেকে নিজ বাড়িতে আনা হয়। ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হোসনি মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের ১১ দিনের মধ্যে প্রায় ৯০০ মানুষকে হত্যার জন্য সিসি কখনো মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেনি।

শোকাহত ও আবেগআপ্লুত মানুষের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মুরসির মৃত্যুতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। সাবেক এ প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে বহু সাধারণ মানুষকেও। মুরসির সংগ্রামী জীবনের নানা বিষয় তুলে ধরে প্রশংসা করেছেন সবাই। বিশ্বনেতাদের পাশাপাশি, বন্ধুবান্ধব, ভক্ত অনুরক্ত এবং প্রতিবেশীরাও মুহাম্মদ মুরসির সংগ্রামী জীবনের নানাদিক নিয়ে স্মৃতিচারণ করে শোক প্রকাশ করছেন। মুহাম্মদ মুরসির আমেরিকার দুই প্রতিবেশীও নিজেদের আবেগ সংবরণ করতে পারেননি। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে মুরসি কী করতেন সেটাই বলেছেন এই দুই প্রতিবেশী। সাঈদ আল গামিদি নামের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সৌদি এক নাগরিক মুরসিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে একটি টুইট করেছেন। তিনি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রে মুরসি আমার প্রতিবেশী ছিলেন। প্রতিদিন ফজরের আজানের আগেই স্ত্রীকে নিয়ে মসজিদে আসাটা ছিল তার নিয়মিত অভ্যাস। তারা উভয়ে নিয়মিত মসজিদ-পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশগ্রহণ করতেন। নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। ফজর নামাজ পড়ে মসজিদ ত্যাগ করতেন মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসি। কোনো দিন যদি ওই মসজিদে আজান না হতো, তাহলে তার কথাই আমরা স্মরণ করতাম। তিনি তখন আজান দিতেন। লসএঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সৌদি নাগরিক ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ পড়াশোনার সময়ই মুরসিকে চিনতেন। টুইটারে তিনি লেখেন, হে আল্লাহ! মুহাম্মদ মুরসির ওপর রহম করো। তাকে ক্ষমা করো। তার ভুলগুলো মার্জনা করো। তিনি কতই না সুন্দর মানুষ এবং একজন সুপুরুষ ছিলেন। ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আরো লিখেন, মুহাম্মদ মুরসি রাজনীতিতে আসার আগেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। সে সময়ই তিনি কুরআনে কারিমের হাফেজ ছিলেন। মসজিদ দেখাশোনা করতেন। মসজিদ সংশ্লিষ্টদের খোঁজখবর রাখতেন। এমনকি তাকে নিয়মিত মসজিদ পরিষ্কার করতেও দেখেছি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

মুহাম্মদ মুরসির ইন্তেকালে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শোকের ছায়া মুরসির মৃত্যুতে বাংলাদেশেও ফেসবুক, টুইটারসহ সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সেখানে সবাই তাঁর জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া প্রার্থনার পাশাপাশি মিসরের বর্তমান সরকারকে তিরস্কার জানিয়েছেন। শাহ আব্দুল হান্নানের স্ট্যাটাস, মুসলিম বিশ্বকে স্বপ্ন দেখানো মহানায়ক, মিসরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি ইন্তেকাল করেছেন। হে আল্লাহ, তাঁর প্রচেষ্টা কবুল করুন। আমিন। এম আজহারুল হক আরজু তার ফেসবুকে লিখেন, মিসরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা ড. মুহাম্মদ মুরসি আজ আদালতে ইন্তেকাল করেছেন। তিনি শুধু তাদের নিজ দেশের নেতা ছিলেন না। ছিলেন সমগ্র আরব জাহানের নেতা। মুরসির মৃত্যুতে দুনিয়ার সকল মুসলমানের নয়নে জল আসবে কিনা জানি না, তবে অকাতরে কাঁদবে ফিলিস্তিনের গাজা এবং জেরুজালেমবাসী। তাদের পরীক্ষিত বন্ধু ছিলেন এই মুরসি। ‘উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই; নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!’- মুরসির স্মরণে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার লাইন উল্লেখ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মারুফ আহমেদ লিখেন, আল্লাহ যেন তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করেন নেন। আরব বসন্তে ফুটেছিল মুরসি নামের যে অসীম আশার আলো, ফেরআউন সিসির কারাগারে নিপীড়নে অবিচারে সে অকালেই চলে গেলো।- মুরসির ছবি পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেন মিসবাহ উদ্দিন। কারান্তরীণ মুরসির ছবি শেয়ার করে এস আলম মন্টু তার টুইটারে লিখেন, চলে গেলেন মিসরের একমাত্র নির্বাচিত ও বৈধ প্রেসিডেন্ট, মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম নেতা হাফেজ ড. মুহাম্মদ মুরসি। জালিম সিসির আদালতেই মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন প্রিয় মানুষ। মুসলিম মিল্লাত হারালো সরাসরি জালেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বীর সেনানীকে। যিনি ছিলেন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার। মুরসির নাম গণতন্ত্রকামী মানুষ চিরকাল স্মরণ করবে। আর সিসিরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে এটাই চিরন্তন সত্য।- লিখেছেন মনির উদ্দিন চৌধুরী।

মুহাম্মদ মুরসি সম্পর্কে অজানা ১০টি তথ্য মুসলিম ব্রাদারহুডের জনপ্রিয় এই নেতাকে নিয়ে মুসলিম ম্যাটার ম্যাগাজিন বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেছে। ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন মুরসি আসুন জেনে নেই কুরআনে হাফেজ : মুরসি ছিলেন কুরআনে হাফেজ। পবিত্র কুরআন পুরোপুরি তার মুখস্থ ছিল। অল্প বয়সেই তিনি হাফেজ হন। কারাবন্দী অবস্থায় থাকাকালীন অবস্থায় তিনি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে কুরআন শরিফ চেয়ে ছিলেন। কিন্তু তাকে তাও দেয়া হয়নি। তাই তিনি বলেছিলেন, ওরা হয়তো জানে না, আমি ৪০ বছর আগেই কুরআন মুখস্থ করে ছিলাম। আমি তো শুধু এই পবিত্র কুরআনকে একটু ছুঁতে চেয়েছিলাম। এর চেয়ে বেশি কিছু চাইনি।


ড. মুরসির সংক্ষিপ্ত জীবনী ১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মিসরের উত্তরাঞ্চলীয় শারকিয়া প্রদেশে মুহাম্মদ মুরসির জন্ম। তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৫ সালে প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতক ও ১৯৭৮ সালে একই বিষয়ে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পারিবারিক জীবন তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক আর মা ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। সাংবাদিকদের কাছে তিনি জানিয়েছিলেন, ছোটবেলায় গাধার পিঠে চড়ে তিনি স্কুলে যেতেন। পরে বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য তিনি কায়রোতে চলে আসেন। তিনি ১৯৭৯ সালে নাজলা মাহমুদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি পাঁচ সন্তানের জনক ছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা বাল্যকাল থেকেই তার জ্ঞানার্জনের প্রতি ছিলো প্রবল আগ্রহ। শৈশবেই তিনি পবিত্র কুরআন মুখস্থ করেন। ১৯৭৫ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আর ১৯৭৮ সালে তিনি ধাতুবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। ওই বছরই উচ্চশিক্ষার্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যালিফোর্নিয়াতে মুহাম্মদ মুরসির প্রকৌশল বিষয়ে গবেষণা শেষ হয় এবং তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। পেশাগত জীবন ১৯৮২ সালেই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থরিজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অধ্যাপনা ছাড়াও ইমাম হিসেবে খ্যাতি আছে তার। ১৯৮৫ সালে মুরসি নিজ জন্মস্থান শারকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার উদ্দেশে ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপনার চাকরি ছেড়ে মিসরে চলে আসেন। রাজনৈতিক জীবন ২০০০ সালে মুহাম্মদ মুরসি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাংগঠনিকভাবে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্য হলেও, নির্বাচনে তাকে ব্রাদারহুডের অন্যান্য নেতাদের মত আইনত স্বতন্ত্রভাবে লড়তে হয় কারণ হোসনি মুবারকের শাসনামলে মুসলিম ব্রাদারহুড মিসরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিল। মুরসি ব্রাদারহুডের গুরুত্বপূর্ণ গাইড্যান্স অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন, যার পরিণতিতে ২০১১ সালে ব্রাদারহুডের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন। আরব বসন্তের যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তার উদ্দেশ্য ছিল একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরশাসন থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি। এই মুক্তি আন্দোলনে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে মুহাম্মদ মুরসি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। ২০১২ সালে মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন।

পিএইচডি করে অধ্যাপক: ছোটবেলা থেকেই মুরসি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই সাধারণ কৃষকের ঘরে জন্ম নিয়েও তিনি উচ্চশিক্ষিত হয়েছিলেন। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করার পর নিজের যোগ্যতায় স্কলারশিপ নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় পিএইচডি পড়তে যান। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। কিন্তু মাটির টানে তিনি জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। পরে জাগাজিগ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকতেন : আড়ম্বরহীনভাবে একটি মাত্র অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন তিনি। মিসরের কায়রোতে একাধিক বিলাসবহুল বাসভবন ছিল। তবে এসব প্রাচুর্য তাকে কোনো দিন আকর্ষণ করেনি। তাই প্রেসিডেন্ট হয়েও একটা ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন মুরসি। বচেয়ে কম বেতনের প্রেসিডেন্ট : বিশ্বের সবচেয়ে কম বেতনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুরসি। দেশের ধনকুবের ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো দিনই তিনি বিশেষ সুবিধা নেননি। পুরো বছরে তার মোট বেতন ছিল ১০ হাজার ডলার। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশী মুদ্রায় তার পরিমাণ ৮,৪২,৭৯০ টাকা। নিজের বেতন থেকে বাড়ির ভাড়া পরিশোধ করতেন। বোনের চিকিৎসায় সরকারি সুবিধা নেননি : পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি কখনই সরকারি বিশেষ সুবিধা নেননি। একবার অসুস্থ বোনকে দেখতে তিনি হাসপাতালে গিয়ে ছিলেন। সেখানে চিকিৎসকরা তার বোনকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন। মুরসি সহজেই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তার বোনকে নিয়ে বিদেশে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তাতে তিনি রাজি হননি। মিসরের সাধারণ অন্যান্য নাগরিকের মতো সরকারি হাসপাতালেই তার বোনের চিকিৎসা হয়েছিল। অবশেষে সেখানে তার বোন ইন্তেকাল করেন। বক্তব্যের চেয়ে আজান বড় : অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ছিলেন মিসরের এই নেতা। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কোথাও বক্তৃতা দেয়ার সময়ও তিনি নামাজের বিষয়ে সচেতন থাকতেন। আজান না শুনলে বক্তব্য থামিয়ে তিনি জোরে জোরে নিজেই আজান দিতেন। তার এই গুণ দারুণভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল। মসজিদে গিয়ে ফজর আদায় : সহজে ফজরের নামাজের জামাত বাদ যেত না তার। দিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তেন জামাতে। অধিকাংশ সময় মসজিদে গিয়েই নামাজ আদায় করতেন তিনি। জুমার খুতবাতেও তাকে অনেক সময় কাঁদতে দেখা গেছে। অফিসে নিজের ছবি ঝোলাতেন না : তার নিজের ছবি প্রদর্শনে অনীহা ছিল। মিসরের ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা ক্ষমতায় থাকা ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসানি মোবারকের ছবি দেখা যেত সব জায়গায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পর মুরসি তার ছবি সরকারি অফিসে না ঝোলানোর নির্দেশ দেন। মানবিক সহায়তায় সর্বদা আন্তরিক : সেবামূলক কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। ২০০৪ সালে সুনামি আক্রান্ত ইন্দোনেশিয়াতে ছুটে গিয়েছিলেন মুরসি। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ে সেখানে কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এইড মিশনের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিলেন তিনিও। সেবামূলক কাজে অংশ নিতে তিনি এবং তার পরিবারের জন্য কোনো সুবিধা গ্রহণ করতেন না। জনদরদি ব্যক্তি: ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত জনদরদি ছিলেন মুরসি। একদিন এক নারীকে তিনি রাস্তার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। তাৎক্ষণিক গাড়ি থামিয়ে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন, ওই মহিলা বিধবা। তিনি নিরাশ্রয়। তখন তিনি সরকারিভাবে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়ে ছিলেন। মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ওই নারী আবারো গৃহহীন হয়ে পড়েন।

হাফেজ ড. মুরসি একটি ইতিহাস, আন্দোলন ও বিপ্লবের নাম । ড. মোবারক হোসাইনআন্তর্জাতিক মহল, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের গভীর উদ্বেগ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে মিসর একজন বন্দির মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, “প্রায় ছয় বছরের বন্দিদশায় মুরসির পরিবার এবং তার আইনজীবীরা কারাকক্ষের পরিবেশ, সেখানে তার চিকিৎসার সুযোগ এমনকি পরিবার ও আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে না দেয়া নিয়ে ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ করে গেছে। ‘তাকে দীর্ঘদিন নির্জন কারাবাসও করতে হয়েছে।’ মিসরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি বলেছেন, মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির মৃত্যু দুঃখজনক ও কষ্টদায়ক। তিনি মিসরের নির্বাচনে মুরসির প্রতি গণরায়ের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মিসরের মহান ও সাহসী জাতির রায়ের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানায় এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ডক্টর মুহাম্মদ মুরসির মৃত্যুতে ইরান দেশটির জনগণ, মরহুমের পরিবার এবং তার শুভাকাক্সক্ষীদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছে। তিনি বলেন, মরহুম মুরসির জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত ও রহমত কামনা করছি। মুরসির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। মুরসির মৃত্যুর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এরদোগান বলেন, গাড়ি থেকে নামার সময় আমার কাছে মুরসির মৃত্যুর খবর আসে। আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের শহীদ ভাইদের জন্য দোয়া করছি, আল্লাহ যেন শহীদদের ওপর রহম করেন। আদালতের এজলাসেই তার মৃত্যু হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি আল্লাহর কাছে রহমত তার জন্য কামনা করি। মিসরের ইতিহাসে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মুরসির মৃত্যুকে সরাসরি হত্যাকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করেছে তার দল ইখওয়ানুল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহুড। তুরস্কের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মুরসির মৃত্যুতে মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা বলা হয়েছে, মুহাম্মদ মুরসিকে ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার ও পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর পর মুরসির শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে এবং এরই ধারাবাহিকতায় তার মৃত্যু হলো। কারাবন্দী মুরসিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না দিয়ে মিসরের সরকার তাকে (মুরসিকে) মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। মুরসির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর এক টুইট বার্তায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পরিচালক সারাহ লি উইটসন বলেন, মুরসির মৃত্যুর ঘটনা ভয়ঙ্কর। মিসরের সেনাশাসিত সরকার মুরসিকে বছরের পর বছর বিনা চিকিৎসায় কারাবন্দী করে রেখেছে। কারাবন্দী অবস্থায় তাকে চিকিৎসা বা ওষুধ খেতে দেয়া হয়নি। এমনকি তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি, তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতেও দেয়া হয়নি। মুসরির মৃত্যুর বিষয়ে নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে জাতিসংঘের কাছে দাবি জানিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এই কর্মকর্তা বলেন, মিসরের একনায়ক সরকার মুসরিকে ন্যূনতম বন্দি অধিকার থেকেও বঞ্চিত করেছে। তার প্রতি স্পষ্টত মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে। আমরা এর নিন্দা জানাই। সেই সঙ্গে মুরসির স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রমাণ দাবি করছি। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তার ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্টে শোক জানিয়ে লেখেন, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির মৃত্যুর খবর পেয়ে অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি। তার পরিবার ও মিসরীয়দের প্রতি সমবেদনা জানাই। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার কাছে সবাইকে ফিরে যেতে হবে। তিউনিসিয়ার এনাহাদা আন্দোলন মুরসির মৃত্যুর খবরে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। আনাদোলুর খবরে বলা হয়, সংগঠনটি এক বিবৃতিতে মুরসির পরিবার ও মিসরীয় জনগণের প্রতি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে বলে, আমরা আশা করছি দুঃখজনক এই ঘটনায় মিসরের হাজরো রাজনৈতিক বন্দী মুক্তির পথ সুগম হবে এবং দেশটি একটি নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ের সূচনা করবে। জর্ডানের মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে মুরসির মৃত্যুর জন্য সরাসরি সিসির সামরিক সরকারকে দায়ী করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, অস্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়ায় সাত বছরের কারাদণ্ড প্রদান ও কারাবন্দী করে রাখার মাধ্যমেই মুরসিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এর দায় এড়াতে পারে না। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস মুরসির মৃত্যুতে ফিলিস্তিনি জনগণের নিকটতম বন্ধু হারানোর সঙ্গে তুলনা করেছে। সংগঠনটির দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, মুরসি জীবনভর সংগ্রাম করেছেন মিসর ও দেশটির জনগণের জন্য, তার সংগ্রামের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। তিনি শুরু থেকেই জেরুজালেম ও আল আকসার প্রতি ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ন্যায়সংগত লড়াইয়ের প্রতি কথা বলেছেন।

বিশ্বব্যাপী গায়েবানা জানাজা ও দু’আ মাহফিল মুরসির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ফিলিস্তিন, তুরস্ক, ইরান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই শোকের ছায়া নেমে আসে। শাহাদাতের দিন বিকেলেই জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে মুরসির গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ওই জানাজায় অংশ নিতে ফিলিস্তিনিদের ঢল নামে। হামাস দেশটিতে তিনদিনের শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছে। মিসরের শহীদ সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির গায়েবানা জানাজা তুরস্কের সব মসজিদেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে তুরস্কের ধর্মীয় বিষয়ক পরিচালক বলেন, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসির গায়েবানা জানাজা মঙ্গলবার দেশজুড়ে সব মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকার নিউইয়র্কসহ বিশে^র বহু স্থানে গায়েবানা জানাজা ও দু’আ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

গোপনেই মুহাম্মদ মুরসির দাফন সম্পন্ন মিসরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিকে গোপনীয়ভাবে শুধুমাত্র পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের উপস্থিতিতে দাফন করা হয়েছে। মঙ্গলবার ভোরে তার দাফনের পুরোটা সময় কঠোর নিরাপত্তা বজায় রাখা হয়েছিল। তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সাবেক নেতাদের কবরের পাশেই তাকে কবর দেয়া হয়। এর আগে তার নিজ প্রদেশে কবর দিতে চাইলেও সরকারের অনুমতি মেলেনি। ড. মুরসির ছেলে আহমেদ মুরসি জানিয়েছেন, খুব ভোরে বাবাকে কবর দেয়া হয়। এই সময় পরিবারের সদস্যরা ছাড়া মুসলিম ব্রাদারহুডের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ফেসবুক বার্তায় আহমেদ মুরসি জানান, মুরসিকে তার নিজ প্রদেশ শারকিয়ায় সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের অনুমতি না মেলায় কায়রোর মদিনাত নসরে সমাহিত করা হয়। এর আগে তার মরদেহ তোরা কারাগার হাসপাতালে গোসল করানো হয় এবং তার জানাজা হয় ওই কারাগারের মসজিদে। মুরসির আইনজীবী আবেদল মোনেইম আবদেল মাকসুদও জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে কায়রোর মদিনাত নসরের আল ওয়াফা ওয়া আল-আমাল কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে।

শহীদ মুরসির স্ত্রীর আবেগঘন অভিব্যক্তি ‘মিসর প্রজাতন্ত্রের বৈধ প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসি আল্লাহর জন্য শহীদ হয়েছেন। কারাকক্ষে তিনি বিজয়ী হিসেবে শিরদাঁড়া সোজা রেখে মর্যাদার সঙ্গে জুলুমের প্রতিবাদ করে তিনি বেছে নিয়েছেন শাহাদাতকে। বহুলোক তার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও দেশকে এগিয়ে নিতে গিয়ে তিনি মারা যান। সত্য প্রচারের জন্য সামনে এগিয়ে গেছেন, কখনো পিছু হটেননি, যে জন্য তার মৃত্যু হয়েছে। কোনো রকম বিরক্তি, ক্লান্তি, আত্মসমর্পণ ও বশ্যতাস্বীকার ছাড়াই তিনি সত্যের তরবারি খাপখোলা রেখেছেন। কাজেই আল্লাহ তাকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। ভীরুতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও মোনাফেকির যুগ থেকে আল্লাহ তাকে দূরে নিয়ে গেছেন। আল্লাহ তাকে নিজের কাছে নিয়েছেন, যাতে তিনি ইয়াহইয়া, ঈসা; আসহাবে উখদুদ ও হাবিব আল নাজ্জারদের মতোই একই পরিস্থিতিতে যোগ দিতে পারেন। তার বাণী প্রচার ও দায়িত্ব বণ্টনের পর জান্নাতুল ফিরদাউস, উচ্চমর্যাদা ও সাহচর্যের জন্য আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। অপেক্ষা কর, বিশ্বাসঘাতকদের বিজেতারা, অসীম অন্ধকার তোমাদের ঢেকে ফেলবে এবং নেমে আসবে কঠিন শাস্তি। আগামীতে বহু প্রজন্মের জন্য তোমরা শিক্ষা হয়ে থাকবে। জান্নাতে, হে শহীদ। কী লাভজনক লেনদেন, হে শহীদ।’

জালিম তোমাকে একদিন বিদায় নিতেই হবে জোরপূর্বক ক্ষমতাচ্যুত জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফেজ ড. মুহাম্মদ মুরসি। নির্মম নির্যাতন সয়ে সয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অটল ছিলেন। দৃঢ় ছিলেন। কাউকে পরোয়া করেননি। হতাশও হননি। টলেননি। ছিল আল্লাহর আস্থা ও বিশ^াস। বিচলিত হননি একটুও। অবশেষে চলেও গেলেন। তার এ যাওয়াটা সুন্দরের। শিক্ষার। অনুকরণের। আদর্শের। তার জন্য বিশে^র কোটি কোটি মানুষ ব্যথা- বেদনায় কাতরতা প্রকাশ করেছে। চোখের পানি ফেলেছে। দুআ করেছে। তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছে। তার শহীদি মৃত্যু কামনা করেছে। তার জন্য জান্নাতপ্রাপ্তির দুআ করেছে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যে এবং সাজানো মামলায় হাজিরা দিতে এসে আদালতে তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। মিথ্যার বিরুদ্ধে, অপশক্তির বিরুদ্ধে, জালিমের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন। তার এ মৃত্যু গৌরবের। তার এ মৃত্যু সম্মানের। কিন্তু সিসি আপনি যা করছেন তাতে আপনার জন্য কেউ কাঁদবার থাকবে তো? কেউ ভাববার থাকবে তো? কেউ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার থাকবে তো? আপনার পরিণতি হবে জালিম বাদশাহ নমরুদ ও ফেরাউনের মতোই!

উপসংহার থমাস জেফারসনের কথামতো When injustice becomes law, resistance becomes duty. অর্থাৎ অবিচার যখন আইন হয়ে পড়ে প্রতিরোধ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকে একত্রিত হয়ে হত্যা, নির্যাতন, অন্যায়, জুলুম, অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো সময়ের অনিবার্য দাবি। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আর মিথ্যাকে সত্য দিয়ে ঢাকার অপপ্রয়াস চালিয়েছে হরদম। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের রক্তস্নাত মিসর। জালিমের কারাগারে বন্দি থেকে, মজলুম অবস্থায় বিচার নামক প্রহসনের নাটকের কাঠগড়ায় ড. মুরসি নিহত হলেন, হলেন শহীদ। এই রক্তের বদলা অবশ্যই আল্লাহ দিবেন। ড. মুরসির রক্তের বিনিময়ে যেন মিসরের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনকে আল্লাহ বিজয় দান করেন। আল্লাহতায়ালা প্রিয় দায়িত্বশীল মহাম্মদ মুরসিকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিন। অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি আর দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে সর্বশ্রেষ্ঠ ডিগ্রিটিও তিনি অর্জন করলেন শাহাদাত। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।

লেখক: বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির