post

২৮ অক্টোবর আমাদের প্রেরণার উঁচু মিনার

০১ অক্টোবর ২০১৩

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

[caption id="attachment_1936" align="alignleft" width="300"] সারিবদ্ধ শহীদদের জানাজার নামাজে ইমামতি করছেন
আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী[/caption]

ক্ষমতালিপ্সুদের হিংস্র থাবায় ২৮ অক্টোবর ২০০৬ রক্তরঞ্জিত হলো রাজধানীর কালো পিচঢালা রাজপথ। সত্যের সেনানীদের লগি-বৈঠার আঘাতে ও লাশের ওপর নর্দন-কুর্দন করে ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহীদের নিঃশেষ করাই ছিল ইসলামবিদ্বেষীদের টার্গেট। নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্যের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে জীবন উৎসর্গ করলেন দ্বীনের মুজাহিদেরা কিন্তু পিছু হঠলেন না এককদমও। মিডিয়ার সুবাদে আওয়ামী হায়েনাদের বীভৎসতা ভয়ানক তাণ্ডব, নীচতা ও পাশবিকতা প্রত্যক্ষ করল বিশ্বমানবতা। শহীদ ও আহতদের রাজপথে রেখে এক মুহূর্তের জন্য পিছুটান নিলেন না আন্দোলনের সাথীরা। এ যেন কারবালার আর এক নিষ্ঠুর প্রান্তর। ভাইয়ের সামনে ভাইয়ের লাশ। জান্নাতের মেহমানেরা পাখি হয়ে ঘুরছেন জান্নাতে। বছর ঘুরে ২৮ অক্টোবর আসে। শহীদের সাথীরা প্রতিদান দেয়ার স্পৃহায় নবোদ্দীপনায় জাগ্রত হয়। আজ আন্দোলনের কর্মীদের কাছে ২৮ অক্টোবর প্রেরণার সুউচ্চ মিনার। ২৮ অক্টোবর চারদলীয় ঐক্যজোটের সরকারের মেয়াদকালের পরদিন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ছিল প্রথম দিন। পল্টনে বিএনপি ও বায়তুল মোকাররম উত্তরগেট ছিল জামায়াতের পূর্বনির্ধারিত এবং অনুমোদিত সভাস্থল। পাল্টা আওয়ামী লীগও পল্টন ময়দানে সভা করার ঘোষণা দেয়। এ যেন রাজনীতির চরম শিষ্টাচারিতার লঙ্ঘন। যার কারণে বিএনপি সঙ্ঘাত এড়িয়ে নির্ধারিত স্থানে তাদের সমাবেশ না করে নয়াপল্টন দলীয় কার্যালয়ের সামনে তাদের কর্মসূচি পালন করছিল। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা বলে এক রকম, করে অন্য রকম। তাদের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ভয়াল নগ্ন চেহারা তারা সেদিন প্রদর্শন করে। তাদের কার্যালয় বাদ দিয়ে জামায়াতের নির্ধারিত সভাস্থল বিনা উসকানিতে দখলের চেষ্টা করে সাহারা, তোফায়েল, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মায়া, ডাক্তার ইকবাল ও হাজী সেলিমের লগি-বৈঠা বাহিনীর নেতৃত্বে। তাদের গতিবিধি আচার-আচরণ দেশবাসীর কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছিল যে এ ধরনের আচরণ ছিল অত্যন্ত পূর্বপরিকল্পিত। চোরাপথে ক্ষমতায় আসার ডিজিটাল নাটকের মঞ্চায়ন। কথিত স্বাধীনতার চেতনার একক দাবিদার আওয়ামী হায়েনাদের তাণ্ডবে সেদিন জান্নাতের পাখি হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন টগবগে অকুতোভয় তরুণ শহীদ মুজাহিদ, শিপন, রফিক, ফয়সাল, মাসুম ও শাহাজাহান আলী। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো যারা সৌভাগ্যবানদের কাতারে নাম লিখালেন শহীদ জসিম-১, সাবের, শহীদ জসিম-২, আরাফাত, আব্বাস, রুহুল আমিন, হাবিব ও বয়োবৃদ্ধ জাবেদ আলী। জীবনের স্বপ্নসাধ তাদেরকে মুহূর্তের জন্যও স্থির লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এ যেন শাহাদাতের পেয়ালা পানের এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিযোগিতা। আন্দোলনের সাথীরা ইয়ারমুকের যুদ্ধের ন্যায় পানি পান না করে পাশের ভাইকে পানি পান করানো, নিজের সুরক্ষা নয় আন্দোলনের ভাইয়ের সুরক্ষার জন্য ইস্পাত দেয়াল হয়ে যান। দুনিয়ার মায়া মমতা যেন তাদের কাছে তুচ্ছ। নিজেরা মজলুম হয়েছিলেন সেদিন, জালিমের কাতারে শামিল না হয়ে শহীদের কাতারে রিক্তহস্তে নিজেদের শামিল করে কালের অনাগত বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস মিনারস্বরূপ। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চিরন্তন, সত্য-অসত্য কখনো এক হতে পারে না; যেভাবে আলো-আঁধার এক হতে পারে না। দেশে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হবে, রায়ের মাধ্যমে দেশবাসী তাদের নেতৃত্ব বাছাই করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাম্র্রাজ্যবাদীদের নখরে ফ্যাসিবাদীদের জয়ধ্বনিতে বাংলাদেশের রাজধানী থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়েও এর আঁচড় লেগেছিল। যে কারণে একটি অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ তৈরি হলো। যার মাধ্যমে পরবর্তীতে সাজানো নির্বাচন প্রত্যক্ষ করল সমগ্র জাতি। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বললেন এক-এগারো আমাদের আন্দোলনের ফসল। খুন করে ঘটনাস্থল থেকে লাশ চুরি করে অপরাজনীতি করার মতো নির্লজ্জ ইতিহাস উপহার দিতেও আওয়ামী লীগ কুণ্ঠিত হয়নি। ২৮ অক্টোবর কালো অধ্যায় রচনাকারীদের স্বপ্নসাধ সাময়িকভাবে বাস্তবায়ন হলেও শহীদের সাথীরা রক্তের বদলা নিতে কফিন ছুঁয়ে আন্দোলনের কাজ পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দীপ্তশপথ গ্রহণ করেন। পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে কুৎসিত ফ্যাসিবাদীদের চেহারা পুনরায় প্রকাশ করল আওয়ামী লীগ। সারা দেশে ইসলামপন্থীদের নানা অভিযোগে দমনের ভয়ঙ্কর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো বর্তমান সরকার। সত্যপন্থীদের জীবন দিয়ে হলেও আন্দোলনের সুরক্ষার তীব্রতায় দিশেহারা হয়ে আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে একটি স্পর্শকাতর কথিত ‘যুদ্ধাপরাধ’ ইস্যু এনে ঘায়েল করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীন নীলনকশার সরকার! সেদিন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা নেতৃত্বের নির্দেশে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সমাবেশস্থলে অবস্থান করছিলেন। এত লগি-বৈঠার আক্রমণের শিকার একটা দলের নেতাকর্মীরা স্বাভাবিকভাবে বেপরোয়া ও প্রতিশোধপরায়ণ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দলের আমীরের গঠনতান্ত্রিক বক্তব্যের মাধ্যমে সবাই হানাহানির পরিবর্তে চরম ধৈর্য ধারণ করল। সেদিনের ঘটনা যারা প্রত্যক্ষ করেছিল তাদের অনেকের ভাষ্যমতে- সেদিন যদি দলের আমীরের বক্তব্য বেপরোয়া হতো হয়তো বা পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। আবার ইসলামী সংগঠন ব্যতীত অন্য বৈষয়িক দল হলে সেই ধৈর্য ও ক্ষমা প্রদর্শনের নমুনা প্রদর্শন করা সম্ভব হতো কি না তাণ্ডও ভাববার বিষয় ছিল। বাংলাদেশের যেসব প্রান্তরে শহীদের খুন ঝরেছে সেসব প্রান্তরেই আন্দোলন গতিশীল হয়েছে, গণভিত্তি রচিত হয়েছে। ভিন্ন দল-মত ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ দল সম্পর্কে জানার প্রচণ্ড আগ্রহ জন্মেছে। ঢাকা শহরে ২৮ অক্টোবর ছিল দেশের ইতিহাসে জনশক্তির আত্মত্যাগের সবচেয়ে বড় নজির। আন্দোলনের কর্মীরা দৃঢ়চিত্তে মনে করে এ রক্ত কখনো বৃথা যেতে পারে না। রাজধানীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে আন্দোলনের আহ্বান পৌঁছিয়ে দিয়ে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ার মাধ্যমে আমরা এর প্রতিশোধ নিতে চাই। ২৮ অক্টোবরের শহীদ পরিবারগুলোর আত্মীয়দের সাথে যখনই আমরা দেখা করতে গিয়েছি প্রশান্তিতে হৃদয় ভরে গেছে, বার বার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি। শহীদদের স্বজনদের বক্তব্য আমাদের আন্দোলনের কাজে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেরণা পেয়েছি। শহীদের মা-বাবা এখনও আমাদের কণ্ঠে মা-বাবা ডাক শুনে তাদের হৃদয়ের অপূরণীয় রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন, আন্দোলনের নেতাকর্মীদেরকে নিজের সন্তান মনে করেন, আমাদের সুখ যেন ওনাদের পরম পাওয়া, আমাদের দুঃখ-কষ্ট যেন ওনাদের সবচেয়ে বড় যন্ত্রণার। আমাদের মাঝে তাদের সন্তাদেরকে খোঁজে ফেরেন। তারা আমাদের আপনেরও আপন। আর সন্তানের আত্মত্যাগের চূড়ান্ত মনজিলের সার্থকতার অপেক্ষায় থাকেন- ‘কবে এ দেশে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে!’ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে নয়া জঘন্যতম অধ্যায় রচনা করল আওয়ামী লীগ। যে দলের দলীয়প্রধান জনগণের বিরুদ্ধে লঠি-বৈঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, ষড়যন্ত্রের নীলনকশায় তিনি আজ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার ষড়যন্ত্রের মুখোশ প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হতে থাকে। বিরোধী দল-মতের ওপর চলতে থাকে নির্যাতনের স্টিম রোলার। তার আচরণে বার বার তিনি প্রমাণ করতে চাইছেন তিনি চিরস্থায়ী ক্ষমতার অধিকারী, যা অনাগত কালেও সম্ভব নয়। তার শেকড় বাংলাদেশে নয়, তার শেকড় যেন ভিনদেশে। যে কারণে দেশ ও দশের প্রতি নেই কোনো মায়া। একের পর এক পর দেশের সাথে চুক্তি করে সর্বস্বান্ত করে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন সব কিছু। বিশেষ করে ইসলামপন্থীদের ওপর দমন পীড়ন দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচনা করেছে। ২৮ অক্টোবরের শহীদ ও পঙ্গুত্ববরণকারীদের স্বজনেরা অপেক্ষায় আছেন খুনিদের বিচারের প্রত্যাশায়। যাদের নির্দেশে একটা শান্ত জনপদ অশান্ত হয়ে গেল, সামাজিক সম্প্রীতি খান খান হয়ে গেল। দেশাভ্যন্তরে ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদের কালো মেঘ প্রলেপ করল, কে না চায় তাদের বিচার। সে বিচারের প্রতীক্ষায় বাংলাদেশ। প্রকৃত অপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের জমিনে হবেই, ইনশাআল্লাহ। ২৮ অক্টোবর আমাদের প্রেরণার সুউচ্চ মিনার। ২৮ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আন্দোলনকে মনজিলে পৌঁছাতে হলে ত্যাগ কোরবানির বিকল্প নেই। আন্দোলন হলো একটি নির্মাণাধীন ঘর। শহীদেরা এ ঘরের চিরস্থায়ী খুঁটি। যারা জীবন্ত শহীদ হাত-পা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে আমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে বারবার তাকিয়ে একটি প্রত্যাশিত দিনের জন্য প্রতীক্ষা করছেন তারা ঘরের ছাদ। এখানে আন্দোলনের কর্মীরা ছায়া নেয়, উজ্জীবনীশক্তি সংগ্রহ করে সম্মুখে এগিয়ে চলে সাহসের সাথে দ্বিধাহীন সোজা রাজপথে। এখানে কেউ কেউ এই ঘরের চিরস্থায়ী অধিবাসী হয়ে যান অনন্তকালের অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণার চিহ্নস্বরূপ। এ পথে শাহাদাত, ত্যাগ, কোরবানি স্বাভাবিক পরিক্রমা। কেউ শহীদ কেউ বা গাজী। কারণ খোদাদ্রোহী জনপদকে বদলে দেয়ার চ্যালেঞ্জ সমাজের নরখাদকদের মুখে এক প্রচণ্ড চাপেটাঘাত। আর মুক্তিকামী হেরার রাহের যাত্রীদের কাছে এর বিকল্প কোনো মঞ্জিল খোলা নেই। কবি আল মাহমুদের কবিতায় (আমাদের মিছিল) সে কথার প্রতিধ্বনি যেন বারবার অনুরণিত হচ্ছে- আমাদের এই মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্তকালের দিকে আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে, শত সঙ্ঘাতের মধ্যে এ শিবিরে এসে দাঁড়িয়েছি। কে জিজ্ঞেস করে আমরা কোথা যাব? আমরাতো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্তকালের। উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনোদিনই বিহবল করতে পারেনি। আমাদের দেহ ক্ষত-বিক্ষত। আমাদের রক্তে সবুজ হয়ে উঠেছিল মোতার প্রান্তর। পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুটে তার লাল বর্ণ আমাদের রক্ত। লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির