post

অতি আধুনিকতার অন্তরালে পশ্চাৎপদতা ও বিপথগামিতা

মোহাম্মদ সাঈদী আলম

১০ মার্চ ২০২০

Modernism শব্দটির অর্থ: নতুনত্ব, নবীনত্ব, অভিনবত্ব, অনভ্যস্ততা, আধুনিকতা, recent ইত্যাদি। উইকিপিডিয়া অনুসারে আধুনিকতা একটি দার্শনিক আন্দোলন যা ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমা সমাজে সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক রূপান্তরের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবণতা ও পরিবর্তনের সাথে সাথে উত্থান লাভ করে। যে সব ফ্যাক্টর আধুনিকতাবাদ বর্তমান রূপ দান করে তার মধ্যে শিল্পভিত্তিক সমাজ গঠন নগরের দ্রুত বিকাশ। বিভিন্ন দার্শনিকগণ এটাকে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেননি। তবে তারা এতটুকু বলতে চেয়েছেন পুরাতনকে নতুনভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করাই আধুনিকতা। সাধারণত আধুনিকতাবাদ সেসব লোকদের অন্তর্ভুক্তি যারা কাজকর্মে অনুভব করেন ঐতিহ্যবাহী শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য, ধর্মীয় বিশ্বাস, দর্শন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এমনকি দৈনন্দিন কাজকর্মে সেকেলে হয়ে পড়েছিল। যা অর্থনীতিসহ সব সেক্টর কাঠামোগত দুর্বল হয়ে পড়েছিল, বলা যায় একধরনের স্থবিরতা, এর নতুনত্বের উন্মোচন, শৈল্পিক গতি প্রকৃতিকে আধুনিকতা বলা হয়। বিশিষ্ট সাহিত্যিক রেমন্ড হেনরি উইলিয়ামস Key words : A vocabulary of culture and society আধুনিকতাবাদ হলো একটি নান্দনিক আন্দোলন (aesthetic movement) এই আন্দোলন ছিল চিত্রশিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে পুরাতন ভিক্টোরিয়ান ধ্যান ধারণাকে খারিজ করা হয় তার স্থলে নতুন ধারণার প্রবর্তন করা হয় এসময়টা হলো (১৯১০-১৯৩০) দশ বছর আগে যেটা আধুনিক ছিল আজকে সেটা পুরাতন বা আজকে যেটা আধুনিক দশ বছর পর সেটা পুরাতন। এভাবে আপডেট ভার্সনকে আমরা আধুনিক বলে সংজ্ঞায়িত করি।

উৎপত্তি আধুনিক শব্দটির সাথে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে কমবেশি সবাই পরিচিত এটি আমাদের কাছে জনপ্রিয় একটি পরিভাষা হিসেবে চিহ্নিত। বিখ্যাত মার্কসবাদী ঔপন্যাসিক রেমন্ড হেনরি উইলিয়ামস modern শব্দটি ইংরেজিতে প্রচলিত হয় ষোলশতকের গোড়াতে মডার্নিজম আঠারো শতকের জ্ঞানদীপ্তির যুগেই উদ্ভূত হয়। এর উৎপত্তি ১৮৭০ সালে এর দিকে কোন এক গ্রন্থে, উত্তর আধুনিক স্থাপত্য ও শিল্প বিশেষজ্ঞ চার্লস জেং কস খবরের কাগজে চিঠি লিখে জানান তার ধারণা শব্দটির প্রয়োগ বোধ হয় তখন যেভাবে এবং যে অর্থে উল্লিখিত হতো পরবর্তীকালে এর অর্থ প্রয়োগ ভিন্ন হয়ে যায় সেখানে উত্তর আধুনিকতাবাদ শুরু হয়। বর্তমান আধুনিকীকরণ তত্ত্ব মূলত জার্মানি সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েভার (১৮৬৪-১৯২০) ধারণা দেন যা ধারণাটি জনপ্রিয় করে তুলেন হার্ভার্ডের সমাজবিজ্ঞানী থেলকট পার্সনস (১৯০২-১৯৭৯) ওয়েভারের ধারণাটি অনুবাদ ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন। যাদেরকে আধুনিক মতবাদের প্রবক্তা বলা হয় Woolf, jozce, eliot, pound, stevens, proust, Mallarme. প্রভাব আধুনিকতা আসলে শিল্প সাহিত্যে ব্যক্তিজীবনে সবখানে প্রভাব পড়ছে। আধুনিকতার অন্তরালে ধর্মহীনতার ভয়াল রূপ আঁচ করা যাচ্ছে। বাংলা সাহিত্যে অনেক বিদেশী শব্দ যা দেশি শব্দের সাথে মিশে ওটা দেশি শব্দ নামে বেশ পরিচিত পাচ্ছে। সাধারণত দেশি শব্দগুলো বললে যতটুকু না চিনতে পারছে তার চেয়ে বেশি চিনতে পারছে বিদেশী মিশ্র শব্দে। যেমন চেয়ার, টেবিল, ভার্সিটি ইত্যাদি। এই আধুনিকতার ওপর ভিত্তি করে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অনেক সমালোচকগণ এগুলোকে মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্কহীন অনেক জঞ্জাল, কিট তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন। যা দিয়ে উপকারের চেয়ে অপকার হচ্ছে বেশি। আধুনিক মানে আমরা সবচেয়ে বেশি চিনি যান্ত্রিক সভ্যতা, তথ্যপ্রযুক্তি, দালান কোটা। যেগুলোর ব্যবহারকে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হয়। যেগুলোর আপডেট বা উন্নতির কারণে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার অপরূপ প্রকৃতি উপাদান এবং গৃহসামগ্রী যেগুলো ব্যবহার করে অনেকে উন্নতি করেছে ব্যক্তিজীবনে। করেছে জীবিকা নির্বাহ। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রাখতে হতে পারে জাদুঘরে। যেমন হারিকেন, ঢেঁকি, লাঙ্গল ইত্যাদি।

পশ্চাৎপদতার অনুসরণে বিপথগামিতা একটা মানুষের মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের সাথে গঠনমূলক চিন্তা ভাবনা ভারসাম্যপূর্ণ আবেগ এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির গভীর সম্পর্ক আছে। যে মানুষটি নিজের জীবন সম্পর্কে সচেতন সে অন্য মানুষের জীবনের মূল্য বূঝবে সে নিশ্চয় আধুনিক ও সচেতন। সচেতন ও আধুনিক মানুষ নিজে সচেতন সে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তবে নিজ পরিচয় উপেক্ষা করে নয়। সে আরেকজনের পরিচয় বহন করে চলে না। নিজের কর্মে তার পরিচয় বহন করে। সে কোন নেতা /মন্ত্রী/উচ্চবর্গের ব্যক্তির পাশে ছবি তুলে নিজে পরিচয় দেয় না। সে বুলিতে নয়, কর্মে বিশ্বাসী। আধুনিকতার অন্তরালে রয়েছে ধর্মীয় ও মৌলিক অবক্ষয়। পঠন-পাঠনে, চলাফেরায় দেহ সত্তাকে আধুনিক করতে পারলেও হৃদয় বা অন্তরাত্মাকে সংকুচিত করেছে। যান্ত্রিক কাঠামোয় মানুষ হলেও উদার ও নৈতিকতাকে করেছে একঘরে। ধর্মীয় চেতনা টোটালে সেকালে মনে করা হয়। বাহ্যিক ডিসপ্লেকে মূল বিষয় হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ভিভিআইপিদের রুচিকর অনেক খাবার নষ্ট হচ্ছে। অথচ পড়ে আছে কত নাখা, ভুখা এগুলোকে হেয় মনে করছে। বিবাহপূর্ব সম্পর্ককে মনে করছে আধুনিকতার ছোঁয়া। বিবাহকে মনে করছে বিরক্তিকর একঘেয়েমি এবং কঠিন বানিয়ে পেলছে। নায়িকাদের নগ্নতাকে আইডেল, মডেল হিসেবে ধরে নিচ্ছে। পরিবার প্রথাকে ভেঙে তৈরি হচ্ছে সিঙ্গেল ফ্যামিলি। একত্রে ইউরোপ আমেরিকাকে আদর্শ হিসেবে নিচ্ছে। বাচ্চা থাকবে দোলনায় পিচ (কুকুরের বাচ্চা) থাকবে কোলে। সন্তান পিতা-মাতার সম্পর্ক হয়েছে Hi, hello, dad, mom সালাম-কালামকে উপেক্ষিত হচ্ছে। লিভ টুগেদার বেড়ে যাচ্ছে। যার প্রতিফল পথে ঘাটে নালা-নর্দমায় মিলছে নবজাতকের লাশ। পার্কগুলো পরিণত হয়েছে যৌনচর্চার কেন্দ্র। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীদের ডিসপ্লেতে নিয়ে আসা হচ্ছে। ব্যবসায়ী পলিসি হিসাবে বিজ্ঞাপনে যৌনাবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপনে কাস্টমার আকর্ষণ করা হচ্ছে। বেগম রোকেয়া বলেছেন নারীরা পর্দা মোচন হয়েছে সত্য, তবে মানসিক দাসত্য থেকে মুক্ত হতে পারে নাই পোশাকের ক্ষেত্রে যত শর্ট পরিধানকে মডার্নিং মনে করছে। আঁটসাঁট স্লিম পোশাক যাই হোক বাঙালির চেতনার সাথে যায় না। আধুনিকতার সাথে তথ্যপ্রযুক্তির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মত। মিডিয়ার কল্যাণে যত আপডেট হচ্ছে দূরপ্রাচ্যের নীতিকে সহজে আলিঙ্গন করছে। নিকট প্রাচ্যের খবরই নেই। সামাজিক, পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে চলতেছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে ডিভোর্স শিক্ষিত নারী-পুরুষের মাঝে। শালিনতাকে মনে করা হচ্ছে অঙ্গতা কিংবা সেকেলে। আমাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে বক-কাক কাহিনীর মত হয়ে গেছে। আধুনিকতার এই যুগে মানুষের আগের থেকে অনেকটা অভাব মোচন হয়েছে সত্য তবে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে বেশি। সুখকে আলিঙ্গন করতেছি, প্রশান্তিকে বিদায় দিচ্ছি। অনেক সময় শিক্ষিত লোকদের আচরণ প্রত্যক্ষ করেছি, একজন অজপাড়াগাঁয়ের মূর্খ লোকের চেয়ে খারাপ। স্মার্ট ফোন কল্যাণকর হলেও আমাদের একঘরে করে ফেলছে। একজন অপরজনের বাড়িতে যাওয়া আসার মাধ্যমে যতটুকু ভালোবাসা, আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায় ততটুকু স্মার্টফোন এর মাধ্যমে হয় না। তথ্যপ্রযুক্তি যত সহজলভ্য হচ্ছে ছড়াচ্ছে ততবেশি মরণব্যাধি। খাদ্যের রেসিপি যেমন বাড়ছে খাদ্যে ভেজালের পরিমাণও বাড়ছে। সারা বিশ্বে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পৃথিবীর জনমানব ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ মিলবে। মানুষগুলো পরিণত হয়েছে খেলনার পুতুল। সহজে গোপন নথিগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে হ্যাকাররা। সাইবার হামলা বেড়েই চলেছে। ছাত্র-ছাত্রীরা সহজে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। নীতিবাক্য নীতিবাক্যই থেকে যাচ্ছে। নৈতিক জগতে বিরাট শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির