post

অধঃপতিত ক্যাম্পাস রাজনীতি একটি সরল বিশ্লেষণ

মো: কামরুজ্জামান (বাবলু)

১২ মার্চ ২০২০
[caption id="attachment_7466" align="alignleft" width="353"] আবরার ফাহাদ[/caption]

পৃথিবীর অনেক দেশেই ছাত্ররাজনীতি বলতে কিছু নেই। একজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী থাকবেন পড়াশুনা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতি নিয়ে একজন শিক্ষার্থীর মাথা ঘামানোর ফলে তার পড়াশুনা ও গবেষণার কাজ ব্যাহত হতে পারে এমন যুক্তিতেই ওইসব দেশে ছাত্ররাজনীতি বা ক্যাম্পাস রাজনীতির কোনো অনুমতি নেই। এ নিয়ে অবশ্যই বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে, নিঃসন্দেহে এটা বলা যায় যে একজন শিক্ষার্থীর মূল কাজ হলো পড়াশুনা ও গবেষণা। সেই কাজকে ব্যাহত করে অন্য কোনো কাজে ব্যাপক হারে ছাত্রদের নিমজ্জিত হওয়া কখনোই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। অনেকে হয়তো বলবেন, ছাত্রজীবন থেকেই যদি একজন শিক্ষার্থী দেশের স্বার্থে ভূমিকা রাখা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ও গণমানুষের কল্যাণে কাজ করা না শিখে তাহলে কর্মজীবনে গিয়ে সে দেশের কল্যাণে কতটা নিবেদিতপ্রাণ হতে পারবে। আর এমন যুক্তিতেই সাধারণত আমাদের দেশে তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ছাত্ররাজনীতির ধারা চালু রয়েছে দশকের পর দশক ধরে। বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা অবশ্যই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কিন্তু ওইসব ঐতিহাসিক আন্দোলনে ছাত্রদের যেই জোরালো ভূমিকা ছিল সেখানে রাজনৈতিক পরিচয় কতটা জরুরি ছিল তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর সংশয়। দেশমাতৃকার বৃহত্তর স্বার্থে তখন ছাত্রসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। ওই প্রেক্ষাপটে কোন শিক্ষার্থী কোন রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করছে তা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। বিষয়টি উপলব্ধি করতে আমরা অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা বিশ্লেষণ করতে পারি। ২০১৮ সালের ২৯শে জুলাই রাজিব ও দিয়া নামে দুই শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে প্রথমে ঢাকা এবং পরবর্তীতে অন্যান্য বিভাগীয় শহরে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসেন। এমনকি এক পর্যায়ে ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্ব পুলিশের কাছ থেকে কিছু দিনের জন্য রীতিমতো ছিনিয়ে নেয় তারা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সেই সময় মন্ত্রী ও পুলিশের গাড়ি পর্যন্ত আটকে দেয় অনিয়মের দায়ে। তারা শুধু রাস্তায় নিরাপত্তা নয়, দেশের সবক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবিতেও স্লোগান দেয়। দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত সেই ছাত্রআন্দোলনের সময় কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু সেখানেও দেখা গেছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্যরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায়। একটি গণতান্ত্রিক দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ছাত্রলীগকে এক ধরনের সন্ত্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। স্কুলপড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সেই অমানবিক আচরণ হয়তোবা কখনোই ভুলতে পারবে না এদেশের ছাত্রসমাজ। ২০১২ সালের ৯ই ডিসেম্বর বিরোধী রাজনৈতিক জোটের আন্দোলন চলাকালে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের কাছে ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে বিশ্বজিৎ নামে এক হিন্দু যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করতে করতে নির্মমভাবে হত্যা করে ছাত্রলীগের কিছু সন্ত্রাসী সদস্য। গত বছরের ৫ই অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে রাতভর বেধড়ক লাঠিপেটা করে ছাত্রলীগ। নির্যাতনের ধকল সইতে না পেরে আবরার মারা যান। এমনকি আবরারকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও নির্যাতন শেষে তাকে ফেলে রেখে যাওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ সরিয়ে ফেলা হয়। তবে, শেষমেশ পুলিশ সেই ফুটেজ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আবরার হত্যার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আবরার হত্যার ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয় সারা দেশজুড়ে। কী অপরাধ ছিল আবরারের? বাংলাদেশের ওপর ভারতের বিদ্যমান আগ্রাসন ও সরকারের নতজানু নীতির ব্যাপারে একটি ছোট্ট বিশ্লেষণ তুলে ধরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন আবরার। সেই স্ট্যাটাসে আববার ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রের বরাতও দিয়েছিলেন। আর তারই পটভূমিতে তাকে হত্যা করা হলো। আর সেটাকে জায়েজ করতে তার গায়ে শিবির ট্যাগ দেয়া হলো। শুধু তাই নয়, কখনো শিবির আবার কখনো বা রাজাকার আখ্যা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) নুরুল হক নুরুকে প্রায় ডজনখানেক বার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আক্রমণ করা হয়েছে। সবশেষ গত ২২শে ডিসেম্বর (২০১৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাকসু ভবনে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ নামে একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা ন্যক্কারজনক এক হামলা চালায়। এতে নুরুসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। গত ২১শে জানুয়ারি শিবির সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে চার শিক্ষার্থীর ওপর রাতভর নির্যাতন চালায় ছাত্রলীগ। পরে তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রক্টরও ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন এবং সাংবাদিকদের জানান শিবির সন্দেহে ওই শিক্ষার্থীদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। যেখানে কোনো বড় অপরাধীকে ধরেও তাকে তৎক্ষণাৎ নির্যাতন করার অধিকার নেই কোনো দেশের পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আর বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কাউকে আটক করা হলে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। তার শাস্তির বিষয়টি একান্ত আদালতের এখতিয়ার। কাউকে শিবির সন্দেহ হলে তাকে ধরে বেধড়ক মারধর করার কোনো আইনসঙ্গত অধিকার ছাত্রলীগের রয়েছে কিনা? শিবির কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনও নয়। যদি নিষিদ্ধ সংগঠনও হতো তাদের ধরার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু শুধুমাত্র শিবির সন্দেহে কাউকে ধরে মারধর করার পর নির্যাতিতদেরই আবার পুলিশে দেয়া হলো এবং যারা নির্যাতন করলো তাদের কিছুই হলো না। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার এই যে ধারা চালু হলো তা একদিন তাদেরও ওপর যে এসে পড়বে না তার নিশ্চয়তা নিশ্চয়ই কেউ দিতে পারবে না। এভাবে, ছাত্রলীগের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের রেকর্ড ঘাঁটা শুরু করলে রীতিমতো তা মহাকাব্যে রূপ নিবে। মাত্র কিছুদিন আগের ঘটনা ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দল থেকে এক প্রকার বহিষ্কার করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসির কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করার পটভূমিতে। ছাত্রলীগের সেই বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এমনকি চাঁদাবাজিকে সংগঠের ন্যায্য পাওনা বলেও উদ্ধত্য মন্তব্য করে সাক্ষাৎকার দেয় পত্রিকায়। এ ছাড়া কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সশস্ত্র মহড়া কারো কাছে নতুন কিছু নয়। এমনকি মাঝে মধ্যে ক্ষমতার জোরে তারা নিজেরা নিজেদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে ভয়ানক সংঘর্ষে যার বলি হতে হয় আবুবকরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের। বিগত প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বেপরোয়া ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের প্রসঙ্গটিই বেশি আলোচিত হলো। স্বাভাবিক সত্যের দাবিও তাই। কারণ এত বেপরোয়া ও অপরাধপ্রবণ কোনো ছাত্রসংগঠন এর আগে ছিলো বলে আমার জানা নেই। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ও জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল মাঝে মধ্যেই এমন বেপরোয়া আচরণ করতো। টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী সাবিকুন নাহার সনি হত্যার ঘটনা হয়তো এরই মধ্যে কালের পরিক্রমায় অনেকেই ভুলে গেছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে তখন নিয়মিত ক্যাম্পাস রিপোর্টিং করার সুবাদে সুযোগ হয়েছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সেই উত্তাল আন্দোলন দেখার যারা সনির হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল। একই দৃশ্য ফের দেখার সুযোগ হয় আবরার হত্যার পর। আবরার হত্যার পর ক্যাম্পাসজুড়ে প্রতিবাদের মুখে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি এরই মধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে সমসাময়িক কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা একটু গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, দেশ ও জাতির স্বার্থে ছাত্রসমাজ যে কোনো সময়ই ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করতে পারে। এক্ষেত্রে তাদেরকে কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে আগে থেকেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর এই লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করতে গিয়ে চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ- হেন কোনো খারাপ কাজ নেই যা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা করছে না। ধর্ষণে সেঞ্চুরি করে সেই সেঞ্চুরি উদযাপন করার মতো ন্যক্কারজনক নজিরও সৃষ্টি হয়েছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ^বিদ্যালয়ে। স্বাভাবিক আদব-কায়দা, মুরুব্বিদের সম্মান করা ও ভদ্র ভাষায় কথা-বার্তা বলার মতো অত্র অঞ্চলে বিদ্যমান চিরায়ত চিত্রও যেন দিনকে দিন পাল্টে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সমাধানের দুটি পথই খোলা আছে। এক- হয় ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হবে অথবা, দুই- ছাত্ররাজনীতির নামে বেপরোয়া আচরণ বন্ধ করতে হবে। ছাত্ররাজনীতিকে ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। আর সেটি অবশ্যই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের মধ্য দিয়ে শুরু করতে হবে। শুধু লোকদেখানো দু-একটি পদক্ষেপ নেয়ার মধ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে পরিস্থিতির আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি হবে না। তবে, আশার দিক হলো ছাত্রসমাজের বড় অংশই অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়কের দাবিতে অনুষ্ঠিত রাজপথ কাঁপানো আন্দোলন, ঢাবি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হাজারো মেকানিজম সত্ত্বেও ছাত্রলীগের প্রার্থীকে হারিয়ে নুরুর বিজয়, ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরে যাওয়া এবং আবরার হত্যার পর ছাত্রসমাজের ফুঁসে ওঠার মাধ্যমে যে গ্রিন সিগন্যাল দেশবাসী দেখতে পেলেন তা হলো আগামীর ক্যাম্পাস সুস্থ রাজনীতির ক্যাম্পাস, কোনো সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি বা লম্পটের জায়গা সেই রাজনীতিতে থাকবে না। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির