post

আদর্শ সমাজগঠনে তারুণ্য

সাকী মাহবুব

২৪ জুলাই ২০২২

আদর্শ শব্দের অর্থ যা অনুসরণ করার যোগ্য বা অনুসরণীয়। ইংরেজিতে যাকে বলে মডেল। যা দেখে মানুষ অনুপ্রেরণা পায়, অনুকরণ বা অনুসরণ করতে চায় তাকেই আদর্শ বলা হয়। আদর্শ সমাজ বলতেও তাই এমন একটা সমাজকেই বুঝায় যা দেখে দুনিয়ার মানুষ অনুপ্রাণিত হতে পারে এবং উক্ত সমাজের অনুকরণ বা অনুসরণ করতে পারে। আদর্শ সমাজ একটা আদর্শ জীবনদর্শনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে পারে। আর ইসলাম ছাড়া সেই জীবনদর্শন কিছুই হতে পারে না। মানুষের জন্য একটি সুখী-সুন্দর সমাজব্যবস্থা পৃথিবীর ইতিহাসে কেবল ইসলামই দিতে পেরেছে। সত্যিকারের শান্তি, কল্যাণ এবং ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধানকে বাদ দিয়ে আদৌ কায়েম হতে পারে না। আজকের দিনেও আমরা সেই একটি মাত্র আদর্শকে অবলম্বন করেই সুখী সুন্দর এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি, যে আদর্শ বলে শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সা. আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে আরব মরুর অসভ্য মানবগোষ্ঠী নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক নজিরবিহীন সুখী সুন্দর সমাজ। আমাদের মহান নেতা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা. প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজব্যবস্থাই একমাত্র আদর্শ সমাজব্যবস্থা নামে অভিহিত হতে পারে। উক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই একজন তরুণ যুবকের একমাত্র কাজ। এ প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা একজন তরুণের জন্য অপরিহার্য।

জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়ের নাম তারুণ্য। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বয়স যাদের ১৪ থেকে ৩০ কিংবা ১৫ থেকে ৪০ এর কোঠায় তারাই তরুণ, যুবক। জাতিসংঘ তারুণ্যকে ২৫ বছরব্যাপী এক সুন্দর সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজচিন্তক আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ তরুণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন-

‘তরুণ এক অসাধারণ অনুপম সুন্দরের স্রষ্টা। 

তরুণ এক অকল্পনীয় অসহনীয় ভাঙনের প্রমিথিউস।

তরুণ এক অসাধ্য সাধনের পারঙ্গম কারিগর।

তরুণ এক প্রতিবাদী সাহসী সত্তা যার হাতে কোনো অন্যায় অনাচার সহ্য হয় না। প্রতিবাদ ছাড়া সে বাঁচতে পারে না। যেখানে সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে সেখানেই সে মিছিলের ভাষায় গর্জে উঠে। যেখানে প্রতিকারহীন মানবতা বারবার অশ্রু ঝরিয়ে বোবা কান্নায় মুষড়ে পড়ে, সেখানেই সে রূপান্তরিত হয় সিংহী দিলীর যোদ্ধা পুরুষে।’ বাংলা সাহিত্যের ঝড়তোলা কবি কাজী নজরুল বলেন-

‘কত নমরুদ, কত ফেরাউন, কত শাদ্দাদ ও কারুণ

আসিয়াছে মোর এই চলাপথে হইয়া বাধা দারুণ

পুড়ি নাই আমি নমরুদী হুতাশনে

বিকাইনি আমি বিপুল কারুনী ধনে

শাদ্দাদের ঐ অহংকারী মাথা বালুতে মিশেছে শেষে

ফেরাউন গেছে নীল দরিয়ায় ভেসে

নমরুদ শিরে পড়েছে পরযার

আমি মুসলিম

এক আল্লাহ ছাড়া করি না কারো তাসলিম

বল সবাই উচ্চ কণ্ঠে

নারায়ে তকবির॥’

কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন-

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় 

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

কবি সুকান্তের ভাষায়-

‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়

পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,

এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়--

আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।’

প্রখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ ছাইদুল হক বলেন, দুপুরের সময় সূর্য যেমন মধ্য আকাশে অবস্থান করে চারদিকে আলো ছড়ায় এবং ভরা যৌবনের জানান দেয়, তেমনি তরুণরাও তাদের যৌবনের প্রারম্ভে সবচেয়ে বিপ্লবী সময় অতিবাহিত করে। এ সময়ই একজন তরুণ যুবক তার নিজের, সমাজের ও বিশ্ববাসীর জন্য সর্বাধিক অবদান রাখতে পারে। এজন্য দেখা যায়, যুগে যুগে যারা বিশ্ববাসীকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে সৃষ্টির জয়গান গেয়েছেন, তারা সবাই ছিলেন তারুণ্যদীপ্ত যুবক। আর তাদের অন্যতম পুরোধা হলেন নবী-রাসূলগণ। ইবরাহিম (আ) যখন নমরুদের রাজত্ব মেসোপটেমিয়ায় তাওহিদের বাণী প্রচার করেন তখন তিনি ছিলেন একজন তারুণ্যদীপ্ত যুবক। ইসমাইল (আ) যখন তাঁর পিতার সাথে দাওয়াতি মিশনে শামিল হন তখন তিনিও ছিলেন একজন তরুণ। ইউসুফ (আ) যখন কারাগারে ছিলেন তখন তিনিও ছিলেন তরুণ। তরুণ বয়সেই তিনি নবুওয়াত লাভ করেন এবং মিশরের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ইউনুছ (আ)কে যখন মাছ গিলে ফেলে তখন তিনিও ছিলেন তরুণ। হযরত দাউদ (আ) যখন জালিম শাসক জালুতকে হত্যা করেন তখন তিনিও ছিলেন তরুণ। রইসুল মুফাসসিরীন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহ যে সকল নবীই প্রেরণ করেছেন তারা বয়সে সকলেই ছিলেন তরুণ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর হাতে প্রাথমিক পর্যায়ে যে সকল সঙ্গী-সাথী বাইয়াত গ্রহণ করেন তাঁরা সবাই ছিলেন টগবগে তরুণ। ইতিহাসের বর্ণিল পাতা উল্টালে দেখা যায়, আবু বকর রা.-এর বয়স ছিল ৩৭ বছর, হযরত উমর রা.-এর বয়স ২৬, হযরত উসমান রা.-এর ২০, হযরত আলী রা.-এর ১০, হযরত আবু যুবাইর রা.-এর ১০, জাফর ইবন আবু তালিব রা.এর ১৮, সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস রা.-এর ১৭, সুহাইব রুমী রা.-এর ১৯, হযরত যায়িদ ইবন হারিসা রা.-এর ২০, হযরত আবু ওবায়দা রা.-এর ২৭, হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ রা.-এর ৩০, হযরত বিলাল ইবন রাবাহ রা.-এর ৩০, আল আরকাম ইবন আবুল আরকাম রা.-এর ১১, যে ৭০ জন সাহাবি কুরআনের দাওয়াত নিয়ে বীরে মাউনায় গমন করেছিলেন তারা সবাই ছিলেন তরুণ। যুদ্ধের ময়দানে তো তরুণদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বদরের যুদ্ধে ইসলামের ঘোর দুশমন আবু জাহেলকে যারা রণাঙ্গনে হত্যা করেন হযরত মুয়াজ ও মুআওয়িজ দুজনই ছিলেন তরুণ। খায়বার বিজয়ী বীর সেনানী শেরে খোদা হযরত আলী রা. যিনি কামুস দুর্গের লৌহকপাট উপড়িয়ে ফেলে একহাতে নিয়ে এটাকে যুদ্ধের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন তিনিও ছিলেন তারুণ্যদীপ্ত যুবক। মুতার যুদ্ধে সেনাপতি ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. তিনিও ছিলেন তরুণ। স্পেন বিজয়ী তারিক বিন যিয়াদ তিনিও ছিলেন তরুণ। এ ছাড়া অন্যান্য যুদ্ধের সেনাপতি হযরত আবু বকর রা., হযরত আলী রা., হযরত উমর রা., হযরত উসমান রা., হযরত জাফর রা., হযরত তালহা রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.সহ প্রায় সাহাবায়ে কেরামগণই ছিলেন তরুণ ও যুবক।

এমনিভাবে ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে তরুণদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের কথা। ভারত বিজয়ী সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন সিন্ধু নদ পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করেন তখন তিনিও ছিলেন তরুণ। কুতাইবা বিন মুসলিম যিনি এশিয়ার মধ্যে ইসলামের বিস্তার ঘটান, তখন তিনিও ছিলেন স্বল্প বয়সী। তারুণ্যদীপ্ত বখতিয়ার মাত্র ১৭ জন সওয়ারি নিয়ে বাংলা জয় করেছিলেন। মাত্র ১২ বছরের কিশোর আকবর, যুবক বাবর পেরেছিলেন বিশাল ভারত বর্ষের বুকে নতুন ইতিহাস রচনা করতে। ক্রীড়াঙ্গনে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েছেন কারা? তারা হলেন শচিন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান, আফ্রিদি, শোয়েব আকতার, আজহার, ধনী, লারা, জয়সুরিয়া, হাশিম আমলা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহীম, তামিম, মুস্তাফিজ, মেসি রোনালদো, সালাহ, এমবাপ্পে, উসাইন বোল্ট, সেরেনা, ম্যারাডোনা, প্লে, জিদান এরা সবাই ছিলেন তরুণ। ভাষার জন্য অকাতরে জীবন দিলেন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক ও জব্বার। তাঁদের ঋণ কোনোদিন শোধ করা যাবে? আমাদের বাংলার ইতিহাসে যে কয়টি সংগ্রাম হয়েছে যেমন, ১৯৫২ সালের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার সংগ্রাম, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থন, ১৯৯০ এর স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯২ সালের বাবরি মসজিদ রক্ষার আন্দোলন, ১৯৯৪ এর নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলন, ২০০১ এর ফতোয়া বিরোধী আন্দোলন, ২০১১ এর কুরআনবিরোধী রায় বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলনসহ সব আন্দোলনে তরুণরাই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। ব্রিটিশদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তদানীন্তন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য যারা ছিনিয়ে এনেছিলেন তারা ছিলেন তরুণ আলিম সমাজ।

‘গণতন্ত্র মুক্তি চাই’ স্লোগানে সুসজ্জিত হয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণকারী তরুণ নুর হোসেন ছিলেন তরুণ। যদি চেয়ে দেখি ইতিহাসের চেনামুখগুলোর দিকে, ওরা কারা? দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষগুলোর ভালোবাসার স্রােতে যে বিজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা, যৌবনই তার শ্রেষ্ঠ সংগ্রাম, ত্যাগ ও সাধনের সময়। কর্ম ও সাধনার এক মহৎ প্রেরণা তিনি। এখনও তিনি তরুণ। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগেও তিনি বলেছিলেন, আমি বুড়িয়ে যেতে চাই না। তুরস্কের রজব তাইয়েব এরদোগান, পাকিস্তানের ইমরান খান এখনও টগবগে তরুণ। তাদের হুংকারে এখনও বিশ্ব কাঁপে ভয়ে থরথর। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সেনা, নৌ, বিমান, পুলিশ বাহিনীতে তরুণ চৌকস অফিসারদেরই নিয়োগ দেওয়া হয় এবং বার্ধক্যে পৌঁছার পূর্বেই তাদেরকে অবসরে পাঠানো হয়। কারণ যে কোনো সঙ্কটময় মুহূর্তে তারা যাতে দেশ রক্ষায় প্রবল শক্তি নিয়ে উল্কার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। পৃথিবীর যে কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল তরুণরাই। তারাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের ত্যাগ কুরবানির বিনিময়ে ইসলামের প্রভাতবেলা থেকে হকের বিজয়ী পতাকা উড্ডীন হয়েছে, বাতিলের শোচনীয় পরাজয় সূচিত হয়েছে। এ পৃথিবীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহের ধারাকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

১. শৈশব

২. যৌবন ও

৩. বার্ধক্য।

এই তিনকালের মধ্যে সকল বিবেচনায় তরুণ তথা যৌবনকাল হলো শ্রেষ্ঠ সময়। শৈশবে মানুষ থাকে অসহায় ও পরনির্ভর। পিতা-মাতা ও অন্যের সহযোগিতা ছাড়া সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না এবং এ সময় তার  চিন্তার কোন সুষ্ঠু বিকাশ ঘটে না। অনুরূপ ভাবে বার্ধক্যেও সে অসহায় দুর্বল ও পরনির্ভর হয়ে পড়ে। মনের ইচ্ছা থাকলেও সে সব কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারে না। এমনকি চিন্তাশক্তির বিলোপ পর্যন্ত ঘটে থাকে। তাই বাংলায় বিখ্যাত এক প্রবাদে বলে ‘গাছ পাকলে সার আর মানুষ পাকলে অসাড়।’ কিন্তু যৌবনকালে এ দুয়ের ব্যতিক্রম। যৌবনকালে মানুষ অসাধ্য সাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারে। তপ্ত লহু ও বাহুর শক্তিবলে শত ঝড়-ঝাপটা, অসত্যের কালোমেঘ ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সত্য ন্যায়ের ও ঐশী বিধান প্রতিষ্ঠায় বীর বিক্রমে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ইংরেজিতে বলা হয়- Youth is called the golden session of life. অর্থাৎ যৌবনকে জীবনের সোনালি কাল বলা হয়।

একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হলো তার তারুণ্যের সময় তথা যৌবনকাল। এই সময়টি একজন মানুষের জীবনের স্বর্ণযুগ। ফলে ক্যারিয়ার গড়া ও নেক আমল করার সুবর্ণ এই সময়টিকে যে কাজে লাগাবে সে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে পারবে। পক্ষান্তরে যে এ সময়টিকে হেলায় খেলায় নষ্ট করবে সে জীবনে কোনো উন্নতি করতে পারবে না। সুতরাং এ সময়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া ও কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা এ সময় সম্পর্কে পরকালে জবাবদিহিতা করতে হবে আর এ কারণেই বিশ্বনবী সা. বলেছেন, তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে গুরুত্ব প্রদান কর। ১. বার্ধক্য আসার আগে যৌবনের ২. রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে স্বাস্থ্যের ৩. দারিদ্র্য আসার আগ সচ্ছলতার ৪. ব্যস্ত হওয়ার আগে অবসর সময়ের এবং ৫. মৃত্যু আসার আগে জীবনের। (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান-১০২৪৮)

ইমাম আহমদ (রহ:) বলেছেন, আমি যৌবনকে এমন বস্তুর সাথেই তুলনা করি, যে বস্তুটি ক্ষণিকের জন্য আমার বগলের নিচে থাকে, তারপর তা হারিয়ে যায়। তারুণ্য অফুরন্ত প্রাণশক্তির আঁধার, যা মানুষের জীবনকে করে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। দুর্বার উদ্দীপনা, ক্লান্তিহীন গতি, অপরিসীম ঔদার্য, অফুরন্ত প্রাণ চঞ্চলতা এবং অটল সাধনার প্রতীক, যৌবন মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সকল বাধার পাহাড় পেরিয়ে সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করে নতুন স্বপ্নময় খেলাফতে রাশেদার সোনালি ইতিহাস কায়েম করতে পারে। তরুণরাই পারে বিপন্ন, বিধ্বংস মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে। পারে আলোকিত সমাজ উপহার দিতে। কথাসাহিত্যিক, ডা: লুৎফর রহমান লিখেছেন-‘যুবকদের গায়ের জোরে আস্থা বেশি। যুবকেরাই যুদ্ধের যোগ্য। লড়াই করা, নিজের জীবনের মায়া না করা ওদের স্বভাব। নিজে ছোট বা দুর্বল, পরাজয়ের বিপদ তার ভাগ্যেও ঘটতে পারে এ কথা সে মোটেই বিশ্বাস করে না। যুবকের ঔদ্ধত্যের সম্মুখে যারা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে চায়, তারা বড় ঠকে। যুবক কোনোমতে দমে না, যৌবনের শক্তি অতি প্রচণ্ড। যৌবন শক্তির কাছে কত সেনাপতিকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে।’ মিশরের খ্যাতিমান লেখক হাসানুল বান্না তরুণদের উদ্দেশ করে লিখেছেন- ‘তোমরা এ জাতির বুকে এক নতুন আলো। আল কুরআনের সাহায্যে এ জাতিকে দেবে নতুন জীবন। তোমরা এক নতুন আলো। আল্লাহর পরিচিতি লাভ করে তোমরা জ্বলজ্বল করছো, তোমরা বস্তুবাদের বিনাশ করবে। তোমরা এক বুলন্দ কণ্ঠ। রাসূল সা.-এর বাণী নতুনভাবে ঘোষণা করতে তোমরা উত্থিত।’ হে তরুণ যুবকেরা জেগে ওঠো, বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপট ঘোষণা করছে আগামী শতাব্দী ইসলামের শতাব্দী।’ পৃথিবীর যে কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকায় ছিল তরুণ সমাজ। তারাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ, সমাজের কাণ্ডারি। তাদের অসীম ত্যাগ ও জান-মালের কুরবানির বিনিময়ে ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে সত্যের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়েছে, বাতিলের পরাজয় সূচিত হয়েছে।

আজ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিদিনের খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই তরুণ-তরুণীদের কার্যকলাপ আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে। গুম, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানাবিধ অসহনীয় সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র যাদের সাথে জড়িয়ে আছে তারা আমাদের কোমলমতি তরুণেরা। পুত্রের হাতে নৃশংস নির্মম মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে নেশার পয়সা জোগাতে ব্যর্থ পিতা, যুবক স্বামীর হাত ধরে একদিন ঘর বেঁধেছিল যে যুবতী তাকে যৌতুকের বলি হয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে পথের পাশে। পরকীয়া প্রেমের ছোবলে দংশিত যুবতী বধূর লাশ বারবার আঘাত হানছে আমাদের বিবেকের দ্বারে। মাস্তানির বিরোধিতা করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরছে এলাকার শান্তিপ্রিয় সুবোধ যুবক। অ্যাকশন ফিল্মের প্রভাবে আজ বন্ধুু খুন হয় বন্ধুর হাতে। সারারাত ধর্ষিতা হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আধুনিকতার জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়া অসাবধান তরুণী।

স্বামীর সামনে সারারাত সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে হত্যা করা হয় গার্মেন্টস কর্মী অবলা যুবতীকে। সন্ত্রাস কবলিত শিক্ষাঙ্গনগুলোর চিত্র আরো ভয়াবহ। দলীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হয়ে কাজ করতে গিয়ে মা বাবার কাছে লাশের কফিন হয়ে ফিরে যাচ্ছে কত সাহসী তরুণ। ঠিকাদারি আর টেন্ডার বক্স ছিনতাইয়ের প্রতিযোগিতায় নেমে প্রাণ হারাচ্ছে কত সম্ভাবনাময় যুবক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রী আজ জড়িয়ে পড়ছে নেশায়, নেশার পয়সা জোগাড় করতে গিয়ে জড়াচ্ছে দেহ-ব্যবসায়। বড় বড় হোটেলে আজ তারা নিজেকে বিকিয়ে বেড়াচ্ছে। অধিকাংশ মুসলিম তরুণ তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতিগঠনে তেমন স্বপ্ন দেখে না। স্বপ্ন দেখে না নিজের ক্যারিয়ার, সফলতা দিয়ে দেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার। পশ্চিমা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের চোরাবালিতে গা ভাসিয়ে তারা মিথ্যা মরীচিকার মায়াজালে পড়ে ঈমান আকিদা নষ্ট করে ফেলছে। ফলে তাদের অনেকেই নাস্তিক, মুরতাদ ধর্মহীনে পরিণত হচ্ছে এবং তাদের চিন্তাধারাতে ভ্রান্ত মতবাদ স্থান করে নিচ্ছে। তারা শক্তিহীন, কর্মহীন, দায়িত্ব জ্ঞানহীন জীবনযাপন করছে। যেখানে সেখানে ঘুরে, আড্ডা দিয়ে, মোবাইল ফেসবুক ও ভারতের নষ্ট সিনেমা, নাটক, সিরিয়াল দেখে অযথা সময় নষ্ট করছে। মাদকের নীলজালে পা দিয়ে, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে গার্লফ্রেন্ডের পিছনে সময় দিয়ে নিজেদের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে। অথচ এ তরুণরাই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ ’৪৭ এর ভারত বিভাগ, ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ’৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের রক্তের বিনিময়েই বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-

১. তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা আবশ্যক, যারা মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ দিবে, মন্দ কাজের নিষেধ করবে। আর এরাই হলো সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)

২. তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান : ১১০)

৩. আর তোমরা নেক কাজে এবং তাকওয়ার ব্যাপারে একে অপরকে সহায়তা কর। (সূরা মায়িদা : ৫)

৪. হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজ পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (সূরা তাহরিম : ৬৬)

৬. যে ব্যক্তি কোন ভালো কাজের পথ দেখায় সেও ঐ পরিমাণ সওয়াব পায়, যতটুকু সওয়াব এর আমলকারী পায়। (তিরমিজি)


বাংলাদেশের একজন বড় কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন-

‘লক্ষ আশা অন্তরে ঘুমিয়ে আছে মন্তরে

ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’

আজকে যে শিশু, আগামী দিনে সেই শিশুই দেশ ও জাতির কর্ণধার। আগামীর মুক্তির নায়ক। দেশ বরেণ্য মন্ত্রী, সমাজসংস্কারক। আজ যে শিশু দোলনায় দোল খায় জীবনের ক্রমধারায় সেই এক সময় তরুণ বয়সে পদার্পণ করে। তরুণ তথা যৌবনে পদার্পণ করার পর তার দায়িত্ব নিতে হয় পরিবারের, আশপাশের মানুষের, সমাজের, দেশ ও জাতির। যে কোন দেশ ও জাতির উন্নয়ন নির্ভর করে তার তরুণ সমাজের উপর।

তরুণ সমাজ যদি বেখেয়ালিপনায় লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে- সেই সমাজের, সেই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে পড়ে। তরুণ সমাজ হলো যে কোন জাতির আশার আলো, প্রেরণার বাতিঘর। একটি ঘুণেধরা নষ্ট সমাজকে আলোর পথে আনতে বিশাল অবদান রাখতে পারে এই ডানপিটে তরুণ সমাজ। নোংরামি আর অশ্লীলতায় ভরা সমাজব্যবস্থাকে পাল্টে দিতে পারে তরুণ সমাজ। যে কোনো রাষ্ট্রকে নতুন করে তৈরি করতে বা সমাজ কাঠামো ভেঙে চুরে নতুন করে নতুন রূপে রূপ দান করতে পারে তরুণ সমাজ।

দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্ন পাড়ি দিতে হলে তরুণ সমাজের অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। তাকওয়াবান তরুণদের দ্বারাই পৃথিবী উপকৃত হয়েছে এবং পৃথিবীতে উত্তম আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার পথভ্রষ্ট অনেক তরুণদের দ্বারাই পৃথিবীর বহু সভ্যতার পতন ঘটেছে। বিশ্বনবী সা. তাকওয়াবান যুবকদের নিয়েই বদর, ওহুদ, খন্দক, তাবুকসহ অন্যান্য যুদ্ধে বিজয় পতাকা ছিনিয়ে এনেছেন। চীন বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, ব্রিটিশ বিতাড়নে, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধেও লক্ষ লক্ষ তরুণদের অবদান অবিস্মরণীয়। ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, কাশ্মির, চেচনিয়া, বসনিয়া, হার্জেগোবিনা, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, মিশর, প্রভৃতি দেশে একদল জানবাজ, দুঃসাহসী তরুণদের জানমাল আর বুকের তাজা খুনের বিনিময়ে ইসলামের পতাকা ও তাওহিদের বাণী রক্ষার ঘামঝরা প্রচেষ্টা চলছে। লেলিহান জাহান্নামের তীব্র অনলের ভয়ে ভীত এবং নয়নকাড়া জান্নাতের মোহরাঙ্কিত সুধা পানে উদগ্রীব একদল তরুণ সমাজ ক্ষণস্থায়ী পার্থিব মোহ-মায়া ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে ঐশী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আপন প্রাণ বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। কেননা তাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় সদা সর্বদা জাগ্রত আছে পরম প্রভুর সেই অমর বাণী। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুমিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়। অতঃপর তারা মরে ও মারে। উপরিউক্ত সত্য মজুদ রয়েছে তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে। আল্লাহর চেয়ে ওয়াদা পূর্ণকারী আর কে আছে? অতএব তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদের ক্রয় বিক্রয়ের উপরে, যা তোমরা সম্পাদন করেছো তাঁর সাথে। আর সেটিই হলো মহান সফলতা। (সূরা তাওবা : ১১১)

আল কুরআনে আসহাবে কাহাফ বা গুহাবাসীদের যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন তারাও প্রত্যেকেই ছিলেন তরুণ-যুবক। আল্লাহ বলেন ‘যখন কজন গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল এবং তারা বলল, হে আমাদের রব, তোমার বিশেষ রহমত দ্বারা আমাদের প্লাবিত কর। (সূরা কাহাফ : ১০)

তরুণরা ইচ্ছে করলেই তাগুতি সমাজ ভেঙে ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ করতে পারেন। কাজেই তরুণ সমাজের কাছে প্রত্যাশা, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান কায়েম করতে আপনারা ঈমানী চেতনা নিয়ে আরো নির্ভীকভাবে এগিয়ে আসুন। কেননা-যোগ্য নেতৃত্ব ও কর্মতৎপরতার মাধ্যমে আদর্শ সমাজ বা দেশগঠন এবং দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে তরুণদের ভূমিকা অপরিসীম। 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির