post

আমেরিকার বিশ্বশাসন ও নতুন স্নায়ুযুদ্ধ

হারুন ইবনে শাহাদাত

১১ জুলাই ২০২১

এক সময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশ আমেরিকা আজ বিশ্বমোড়ল। বিশেষ করে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে উত্তর আমেরিকার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ববাসী আমেরিকা নামে যে দেশটিকে চিনে ১৭৭৬ সালের আগে কেউ আজকের এই আমেরিকাকে চিনতোই না। থমাস জেফারস ১৭৭৬ সালের ২রা জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মার্কিন কংগ্রেসে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে ৪ঠা জুলাই গৃহীত হয়। এই দিনটিই আমেরিকার জন্মদিবস। এর আগে দেশটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অথচ বর্তমান দুনিয়া চলছে আমেরিকার রাষ্ট্রনায়কদের ইশারায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কোন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় তাদের এই উত্থান। আজ থেকে ২৪৫ বছর আগে দাসপ্রথার শিকল থেকে মুক্তি পেতে ও ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জনে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্বাধীনতার পর থেকে এই আড়াই শতাব্দীতে দেশটি নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী, ধনী ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বিশ্বশক্তি হবার পেছনে যদি কোনো মুহূর্ত থাকে তবে তা স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধ। শতাব্দীব্যাপী ভঙ্গুর দশায় থাকা স্প্যানিশ সা¤্রাজ্যবাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দেশটিকে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত করেছে, বিশ্বে এ নিয়ে এক মারাত্মক বিতর্কও প্রতিষ্ঠিত। এই বিতর্ক কিউবাকে কেন্দ্র করেই : মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদীরা স্পেন থেকে এটি কিনে নিতে চেয়েছিলেন (১৮৬১ সালের পূর্বে, একে একটি নতুন দাস রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা ছিল), বিরোধী সা¤্রাজ্যবাদীরা কিউবান স্বাধীনতাকে সমর্থন করতে চেয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালে কিউবার অ্যাক্টিভিস্টরা স্পেন থেকে স্বাধীনতা অর্জনে যুদ্ধ শুরু করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে। যুদ্ধে স্পেনের পরাজয়ে মার্কিন বিরোধী-সা¤্রাজ্যবাদীরা কিউবাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযোজন বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সা¤্রাজ্যবাদীদের প্রভাবে এই অঞ্চলকে মার্কিন প্রভাববলয়ে যুক্ত করতে এক সমঝোতা হয়। আপাতদৃষ্টিতে তাকে সা¤্রাজ্যবাদ বলা না গেলেও বিষয়টা আসলে একই। কিউবার গুয়ানতানামো বেতে মার্কিন ঘাঁটি এই সমঝোতারই একটি অংশ। সেই থেকে শুরু বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকান প্রভাব। আরো সহজ ভাষায় বললে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের সূচনা। অথচ এই আমেরিকা এক সময় ছিল ইউরোপীয়দের উপনিবেশ। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৪৯৩ সালের ১৯ নভেম্বর কলম্বাস আমেরিকার মাটিতে পা ফেলার পরে ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের যোগসূত্রের শুরু হয়। বিশ্ব তখন ইউরোপের দখলে, ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগালের মতো দেশগুলো বিভিন্ন স্থানে তাদের উপনিবেশ গড়ে তুলতে মরিয়া। ইউরোপীয়রা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতেই প্রথম উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। একে একে প্রায় সর্বত্র দখলে নেয় ব্রিটিশরা, সেসময়ে দাসপ্রথার নির্মম ইতিহাস রচিত হচ্ছিল। ব্রিটেনের পাশাপাশি ফরাসি, স্প্যানিশরাও আমেরিকাতে বাণিজ্য করতে যায়। ব্রিটিশদের দখলে থাকা প্রায় প্রতিটা রাজ্যেই বিদ্রোহ দেখা দেয় অষ্টাদশ শতকে। ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে রেড ইন্ডিয়ান থেকে শুরু করে মার্কিন আদিবাসীদের সহায়তা করেছিল ফরাসি ও স্প্যানিশরা। প্রাথমিক পর্যায়ে আটলান্টিক মহাসাগর তীরস্থ উত্তর আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আর এই রাজ্যগুলোতে ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহে ফরাসিরা সর্বাত্মকভাবে অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেছিল। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই এই উপনিবেশগুলো একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে উপনিবেশগুলো তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ঘোষণা করে এবং একটি সমবায় সংঘের প্রতিষ্ঠা করে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বিদ্রোহী রাজ্যগুলো গ্রেট ব্রিটেনকে পরাস্ত করে। এই যুদ্ধ ছিল ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসে প্রথম সফল ঔপনিবেশিক স্বাধীনতাযুদ্ধ। আর সেই থেকে ৪ঠা জুলাইকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ঊনবিংশ শতকেও দাসপ্রথার সঙ্গে মার্কিনিদের লড়াই করতে হয়, আব্রাহাম লিংকনের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের দাসপ্রথার অবসান ঘটতে শুরু করে। এরপর থেকে ক্রমে ক্রমে উন্নত হতে শুরু করে দেশটি। বিশাল আয়তনের দেশটি বিংশ শতকে এসে বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের জাহির করতে শুরু করে। ঐ শতকের শেষে ইউরোপ থেকে বিশ্বের একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। বহু সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, উন্নত জীবনযাত্রা, সামরিক পরাশক্তি, গণতন্ত্র ও আর্থিক দিক থেকে সেরা দেশটি একদিনে এই অবস্থায় আসেনি। হাজার হাজার বছর ধরে উত্তর আমেরিকায় এক বহুসমাজ ও বহুসংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল ইউরোপীয় অনুসন্ধানকারীরা পা রাখার আগেই। তারা হয়তো সার্বভৌম রাষ্ট্র হতে পারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জমি থেকে তাদের উৎখাত করে, তাদের স্বায়ত্তশাসনকে অস্বীকার করে। একবার যখন তারা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে তখন তাদের এবং তাদের জমিকে জোরপূর্বক গ্রহণ করে নেয়া হয়। এই কাজগুলোই আমেরিকার ভিত্তি, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এক বৈশ্বিক পরাশক্তিতে পরিণত করে। এই মানচিত্রটি ১৭৯৪ সালে স্থানীয় আমেরিকানদের জমি দেখিয়ে শুরু করে, যা উপজাতিদের দ্বারা নির্ধারিত এবং সবুজ রঙে চিহ্নিত। ১৭৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং স্পেনের মধ্যে সান লোরেঞ্জোর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা তাদের মধ্যে মহাদেশের বেশির ভাগ অংশকে সমৃদ্ধ করার চুক্তি। এই চুক্তি নেটিভ আমেরিকানদের জন্য বিপর্যয়ের এক শতাব্দী নিয়ে আসে, কারণ তাদের জমিকে টুকরা টুকরো করে ভাগ করে নেয়া হয়েছিল। ১৮৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডাউস অ্যাক্ট পাস করে কার্যকরভাবেই আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনকে নির্মূল করা হয় এবং অঙ্গীভূত করায় বাধ্য করা হয়, সেখানে খুব অল্প জমিই বাকি ছিল নেটিভদের জন্য। তার মানে খুব পরিষ্কার এখন আমেরিকা যারা শাসন করছেন, তারা আসলে ইউরোপীয় দখলদার। এই ভূ-খণ্ডের ভূমিপুত্র রেড ইন্ডিয়ানরা এখন সংখ্যালঘু। আমেরিকান সম্প্রসারণবাদ বহুদূর গেলেও ১৮২১ সালে মেক্সিকো স্বাধীনতা লাভ করে। দেশটি বর্তমান টেক্সাস থেকে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার স্প্যানিশ-দাবিকৃত সুবিশাল কিন্তু মূলত অনিশ্চিত এবং অসংলগ্ন ভূমি নিয়ে দেশ গঠন করেছিল। আমেরিকান বসতি স্থাপনকারী সম্প্রদায়গুলো সেই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠে। ১৮২৯ সালের মধ্যে মেক্সিকোর টেক্সাস অঞ্চলে স্প্যানিশদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছিল তারা। ১৮৩৫ সালে আমেরিকার অধিবাসীদের দ্বারা একটি ক্ষুদ্র বিদ্রোহের ফলে অবশেষে স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকানরা সেই যুদ্ধে জিতে টেক্সাস প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, ১৮৪৫ সালে তারা স্বেচ্ছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে যায়। কিন্তু, মেক্সিকো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও সেই টেক্সাস সীমান্ত নিয়ে বিরোধিতায় জড়িত। আমেরিকার ১১তম রাষ্ট্রপতি জেমস কে পোল্ক পশ্চিম দিকে আরও জমি দখল করতে চেয়েছিলেন। মেক্সিকোর ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলের জন্যেও তিনি নকশা তৈরি করেছিলেন, যেখানে আমেরিকানরা বসতি গড়ে তুলেছিল। ১৮৪৬ সালে বিতর্কিত টেক্সাস অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হয়, তবে দ্রুতই মেক্সিকোর অধিকাংশে বিস্তার লাভ করে। মেক্সিকোর এক কঠোর জেনারেল ক্ষমতা দখল করে এবং যুদ্ধকে এক তিক্ত সমাপ্তির দিকে ঠেলে দেয়। আমেরিকা মেক্সিকো সিটিতে হামলা করে এবং দেশটির এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল দখল করে নেয়। প্রেসিডেন্ট পোল্ক যদি আমেরিকাকে সেসময় বিস্তৃত না করতো তাহলে হয়তো আজ ক্যালিফোর্নিয়া, ইউটাহ, নেভাদা, অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো ও টেক্সাস আমেরিকার অংশ হতো না। আমেরিকার এই বিস্তৃতি না ঘটলে হয়তো পরাশক্তি রূপে আবির্ভূত হতে পারতো না। তবে আমেরিকার পরাশক্তি হওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং ট্রুম্যান ডকট্রিনের। কারণ এর ফলে বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধ নামের একটি নতুন অনুষঙ্গের সাথে পরিচিত হয়। এই স্নায়ুযুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা ও স্নায়ুযুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে স্নায়ুযুদ্ধ একটি অন্যতম ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) এর মধ্যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব ইতিহাসে স্নায়ুযুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯১৭ সালে সাড়া জাগনো রুশ বিপ্লবের দ্বারা রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল পুঁজিবাদী আদর্শের অন্যতম ধারক ও বাহক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রপক্ষে যুদ্ধ করে সা¤্রাজ্যবাদী জার্মান জাপান এবং ইতালিকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিত্রপক্ষের এই দুই শক্তি আরেক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আর যেটি ছিল বিশ্বব্যাপী নিজ নিজ আদর্শ প্রতিষ্ঠাকরণের যুদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ পুঁজিবাদী আদর্শের অনুসারী হোক আর সোভিয়েত ইউনিয়ন চাইত অধিকাংশ দেশ তার সমাজতন্ত্রের আদর্শে সরকার ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলুক। আদর্শ বিস্তার করাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, ঠাণ্ডা লড়াই বা স্নায়ুযুদ্ধ বলেই পরিচিত (ইংরেজিতে কোল্ড ওয়্যার)।

ট্রুম্যান ডকট্রিন ১৯৪৭ সালের ১২ মার্চ মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ভাষণের মাধ্যমে ঘোষণা করেন, যে সকল দেশ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং বহিঃচাপ মোকাবেলা করতে বদ্ধপরিকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদেরকে সহায়তা করবে। এ সময় ট্রুম্যান গ্রিস ও তুরস্ককে সোভিয়েত কমিউনিস্ট প্রভাব হতে মুক্ত করতে ৪০০ মিলিয়ন অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রস্তাব করেন। তার এই ঘোষণা ট্রুম্যান ডকট্রিন নামে পরিচিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের এ নীতির মূল কথা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক আদর্শের হুমকি এবং কর্তৃত্ববাদী আদর্শের হুমকিতে থাকা সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা করবে। ট্রুম্যান ডকট্রিনের দ্বারাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। কেবল গ্রিস এবং তুরস্কের জন্য আর্থিক সহযোগিতার প্রস্তাব করা হলেও অধিকাংশ বলকান দেশ এবং পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহে এ নীতির বাস্তবায়ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপে তার মিত্ররাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পাশাপাশি সোভিয়েত বিরোধী পক্ষ তৈরি করতে সমর্থ হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজতন্ত্রের বিদায় ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯১ সালে ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সোভিয়েত ঐক্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ১৫টি নতুন প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুশের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে সই করেন। ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার পর পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে কমিউনিজমেরও পতন ঘটে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো টিকে ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা তখন মিখাইল গর্বাচেভ। ১৯৯১ সালের আগস্টে তার বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা। কিন্তু সেই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি সব কিছু। ১৫টি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ইউক্রেনসহ অনেক ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটও হয়ে যায়। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান। একই বছর ডিসেম্বরে বেলারুশে বৈঠকে বসেন তিনটি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নেতারা। বৈঠকটি ডেকেছিলেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট স্ট্যানিস্লাভ শুশকেভিচ। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন যোগ দেন তার সঙ্গে। ইউক্রেন তত দিনে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছে। কিন্তু বেলারুশ তখনো সে রকম ঘোষণা দেয়নি। আবার গর্বাচেভকে না জানিয়ে এ রকম একটা বৈঠকে বসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ১৯৯১ সালের ৭ ডিসেম্বর রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং বেলারুশের নেতা স্ট্যানিস্লাভ পূর্ব বেলারুশের এক বিরাট খামারবাড়িতে গিয়ে মিলিত হলেন। বৈঠক শুরুর অল্প পরেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির লক্ষ্যে চুক্তির প্রথম লাইনটির ব্যাপারে একমত হন সবাই। লাইনটি ছিল এ রকম- ‘ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআরের কোনো অস্তিত্ব আর নেই।’ এর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন অস্তিত্ব চূড়ান্তভাবে হারিয়ে যায়। কার্যত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়।

নতুন রূপে স্নায়ুযুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার সাথে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধ শেষে মুসলিম বিশ্বের সাথে আদর্শিক দ্বন্দ্ব এবং চীন, জাপান ও কোরিয়ার সাথে বাণিজ্যিক যুদ্ধ শুরু হয়। তবে এই যুদ্ধের সূচনার আগে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলে স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের লেখা গ্রন্থ, ‘দ্য ক্ল্যাশ ও সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দ্য রিম্যাকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’। আলোড়ন সৃষ্টিকারী স্যামুয়েল পি হান্টিংটন লেখক আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ফরেন পলিসির যুগ্ম সম্পাদক এবং আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি প্রথম তুলে ধরেন আগামী দিনে পাশ্চাত্য সভ্যতার জন্য চ্যালেঞ্জ হলো ইসলাম। ১৯৯৩ সালে তার ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন’ নামে একটি নিবন্ধ ‘ফরেন অ্যাফেয়ার’র প্রকাশিত হয়। পরে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করে আমেরিকার নতুন বিশ্ব বা নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার গড়ার মূল দর্শন এই পুস্তক। ইসলামের অগ্রযাত্রাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তারা নতুন আরেক স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যারই পরিণতি ইরাকে আগ্রাসন, ইরান অবরোধ, মিশরে ইসলামপন্থী নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মুরসির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান, আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ মুসলিম দুনিয়ার ইসলামী আদর্শের রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে বিভিন্ন তকমা লাগিয়ে নির্মূল অভিযান। ঘটনার সূচনা আগে হলেও নতুন এই স্নায়ুযুদ্ধ জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায় অনেক পরে।

স্নায়ুযুদ্ধ আবার ফিরে আসছে বিশ্বে? ২০১৮ সালের এপ্রিলে সিরিয়ায় সন্দেহজনক রাসায়নিক হামলাকে ঘিরে মুখোমুখি অবস্থান নেয় রাশিয়া আর পশ্চিমা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা সহযোগীরা সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছে আর সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে সমর্থন যোগানো রাশিয়া বলছে এটি যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি করবে। এর মধ্যেই জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, “প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসছে স্নায়ুযুদ্ধ।” এমনিতেই যুক্তরাজ্যে সাবেক এক রুশ গুপ্তচর আর তার মেয়েকে নার্ভ এজেন্টে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ নিয়ে কূটনৈতিক যুদ্ধে রয়েছে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব। বিষয়টি একটি মুসলিম ভূখণ্ড এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নির্মমতা নিয়ে হলেও জাতিসংঘ স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে দেখছে ইউরোপের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্বকেই। আসলে প্রতিপক্ষ নির্যাতিত মুসলমানদেরকে পর্দার আড়ালে রাখার এই রহস্য উন্মোচন না করলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট কাটবে না। একটি মাত্র নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের লেখা গ্রন্থ, ‘দ্য ক্ল্যাশ ও সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দ্য রিম্যাকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ গ্রন্থের সূচনাতে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের দিক বদলের কাহিনী যে ঘটনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন আজকের নিবন্ধটিতে তা উল্লেখ করেই শেষ করছি, ‘১৯৯২ সালের ৩ জানুয়ারি, রাশিয়া ও আমেরিকার বিজ্ঞজনদের একটি সভা মস্কোর সরকারি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং রাশিয়ান ফেডারেশনের জন্ম হয়েছে। এর ফলে অডিটোরিয়ামের সামনে থেকে লেনিনের মূর্তি সরিয়ে দেয়ালে রাশিয়া ফেডারেশনের পতাকা লাগানো হয়েছে। কিন্তু একজন আমেরিকান লক্ষ্য করলেন পতাকাটি উল্টো করে লাগানো হয়েছে। বিষয়টি তিনি রাশিয়ান কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর তারা বিনাবাক্য ব্যয়ে তা ঠিক করে লাগালেন।’ (সূত্র : দ্য ক্ল্যাশ ও সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দ্য রিম্যাকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ অধ্যায়-১)। এর মাধ্যমে লেখক যে সূক্ষ¥ ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা হলো তোমার আদর্শ ও চেতনা যাই হোক না কেন, নতুন বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকতে হলে তোমাকে আমেরিকার কথা মতো কথা নিজেকে সংশোধন করে নিতে হবে, তবেই তুমি নিরাপদ, তা না করলে খবর আছে!’

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির