post

ইসলামী আন্দোলনের কেমন কর্মী হবো

সৈয়দ জালাল উদ্দিন উমরী ।। অনুবাদ : শুকরান সাবিত

১৩ মে ২০২৩

আমরা ইসলামী আন্দোলনের কেমন কর্মী হবো? এই প্রশ্নের আগে আসুন আরেকটি প্রশ্ন লক্ষ্য করি। ইসলাম কি কোনো আন্দোলন? এর জবাব যদি হ্যাঁ-বোধক হয় তবেই উপরের প্রশ্নটি অর্থ বহন করবে, অন্যথায় নয়। ইসলামকে যখন একটি আন্দোলন হিসেবে দেখতে চাই তখন আধুনিকতার ধ্বজাধারীদের পক্ষ থেকে বিরোধিতা আসে, এমনকি ধর্মীয় কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকেও এ বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। আধুনিক ধ্যান-ধারণায় ইসলাম একটি ধর্ম মাত্র। আর ধর্মের ব্যাপারে তার বোঝাপড়া হচ্ছে- এটা কিছু পূজা-অর্চনা, পুরাণ এবং পালনীয় রসম-রেওয়াজ। তার মতে, মানুষ ধর্ম গ্রহণ করতে পারে, ধর্মীয় আমলও করতে পারে; কিন্তু জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এর কোনো সম্পর্ক নেই এবং থাকাও অনুচিত।

বর্তমানে পুরো দুনিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এই মতের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। তার কাছে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার, সামাজিক জীবন তার থেকে রইবে আলাদা। ধর্মের ব্যাপারে এই চিন্তার যথার্থতা প্রমাণের জন্য বলা হয় ধর্ম যদি মানুষের সামাজিক বিষয়াদির সাথে সম্পর্ক রাখে তাহলে দুনিয়া বিশৃঙ্খলার চারণক্ষেত্রে পরিণত হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- তারাই এসব কথা বলছে, যারা নিজেরাই দুনিয়াকে ফিতনা-ফ্যাসাদে ভরিয়ে তুলেছে। বর্তমানে দুনিয়া জুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ তা ধর্ম সৃষ্ট নয়। বরং খোদাদ্রোহিতা এবং ধর্ম-বিরোধিতার তিক্ত-বিষাক্ত ফল, যা মানুষকে বাধ্য হয়েই আস্বাদন করতে হচ্ছে।

ধর্ম বিষয়ে আধুনিক এই দৃষ্টিকোণের সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু ধর্ম আর তার অনুসারীরা। তারা এই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে ধর্ম শুধু রুহের তাযকিয়া (পরিশোধন) ও পবিত্রতার জন্য। তাদের কথা হচ্ছে যতক্ষণ না মানুষ দুনিয়া এবং তার সকল জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে নফস ও সকল কামনা-বাসনা পদদলিত করে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ এই সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে না। এজন্য বিভিন্ন ধরনের বিশেষ বিশেষ তরিকা তারা সামনে এনেছে। এরই প্রেক্ষিতে আধ্যাত্মিক উন্নতি প্রত্যাশীরা দুনিয়া ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছেন পাহাড়-জঙ্গল আর গুহায়। উদ্ভাবিত হয়েছে সন্ন্যাস প্রথা। এই প্রথা আধুনিক কালের ধর্ম ভাবনাকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছে। এজন্য এর ছড়িয়ে পড়ার সুযোগও সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবেই উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে ধর্মকে মানুষের সামাজিক জীবন থেকে পৃথক করে দিয়েছে। এ জন্যই ইসলামকে যখন আমরা আন্দোলন বলি তখন এই দুই মতের বিরোধিতা করি এবং তাদেরকে ভুল ও বাতিল বলে ঘোষণা করি।

আন্দোলন হচ্ছে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড ও তৎপরতা পরিচালনা। তা যে প্রকৃতির হবে, তার তৎপরতাও হবে সে প্রকৃতির। কিছু উদাহরণের মাধ্যমে একে খুব সহজে বোঝা যেতে পারে। এই সময়ে সমাজে অসততা আর ঘুষ সর্বত্র শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে রয়েছে। ধরুন, আপনি এর বিরুদ্ধে সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করবেন। তাহলে নিশ্চয় এর একটি বিশেষ ক্ষেত্র থাকবে। তা নয় কি? অথবা শিক্ষাকে সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলন যদি আপনার লক্ষ্য হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তার একটি খাস পরিসীমা থাকবে। কিন্তু ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট পরিসীমার নয়, মানুষকে পুরোপুরি বদলে দেওয়ার আন্দোলন। তার ব্যক্তিগত জীবনের সাথে সাথে সামাজিক জীবনও ইসলাম বদলে দিতে চায়। ইসলাম দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিপ্লবী আন্দোলন। মানুষকে নফস ও তার লালসা, জাতি ও গোত্র, রসম ও রেওয়াজ এবং প্রতিটি ছোট-বড় গোলামি থেকে মুক্ত করে এক খোদার বান্দা ও গোলাম বানিয়ে তার সকল আহকামের অনুগত করা এই আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে- “আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে পরিত্যাগ করো।” (সূরা নাহল : ৩৬)

এই ঘোষণার সাথে সাথেই আসে- মা লাকুম মিন ইলাহি গয়রিহি (তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মাবুদ নেই)। এর পরিষ্কার মানে হচ্ছে উদখুলু ফিস সিলমি কাফফাহ (পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো)। ইসলাম সফলতার জন্য আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যকে জরুরি ঘোষণা করেছে- “আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করো, আশা করা যায় তোমাদের উপর রহম করা হবে।”(সূরা আলে ইমরান : ১৩২)

এই দর্শনের ভিত্তিতে আরবের রুক্ষ জমিনে চৌদ্দশ বছর আগে যে আন্দোলনের সূত্রপাত তা পুরো পরিমণ্ডলে এক হট্টগোলের জন্ম দেয়। যেন সে মৃতদের জীবিত করে ফেলেছে আর ঘুমন্তদের জাগিয়ে দিয়েছে কিংবা দুর্বলকে শক্তি দান করেছে আর পঙ্গুদের হাঁটতে শিখিয়েছে। যারা নিজেদের নফসের অনুগত ছিল তাদেরকে ইসলাম খোদার সত্যকার বান্দায় পরিণত করেছে। যারা বেশুমার খোদার পূজা করত, এক খোদার সামনে তাদের মস্তক অবনত করিয়েছে ইসলাম। যারা লালসা ও কামনার পিছনে ছুটে চলছিল ইসলাম তাদের সীমার মধ্যে চলতে শিখিয়েছে। যারা অর্থহীন রসম রেওয়াজের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল তাদেরকে এক জীবন্ত, মানসম্পন্ন ও মূল্যবান শরিয়তের নিশানবরদার করেছে এই বিপ্লবী আন্দোলন। আর উ™£ান্তদের দান করেছে স্বচ্ছ জীবনোদ্দেশ্য। এভাবে এমন এক উম্মত ইসলাম জন্ম দিয়েছে যারা বিপ্লবী দর্শন নিয়ে এই জাহানের সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়ে দেখতে দেখতেই বিশাল একটি অংশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে ফেলেছে।

ইসলাম ইনসানি জিন্দেগিকে যে সীমার মধ্যে নিয়ে এসেছে তার জিকির উঠলেই আধুনিক কালের সামনে সতের ও আঠার শতকের বিশেষ একটি ধর্মীয় চেহারা-চিত্র ভেসে ওঠে। সে ধর্মের কাছে চিত্ত ও চিন্তার সকল দুয়ার ছিল স্তব্ধ। তার মাধ্যমে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। ভয়ানক নির্মম নির্যাতনেরও শিকার হয়েছিল অনেকেই। খ্রিস্টধর্মের নামে তার অপব্যাখ্যাকারীরা এসব করেছিল। এই নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডের সাথে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। চিন্তা ও দর্শনের উপর ইসলাম কখনও কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। ইসলাম বরং নব নব বিশ্লেষণ ও উদ্ভাবনের পথ খুলেছে এবং সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম মানুষের নফস ও কামনা-বাসনার উপর প্রতিবন্ধকতা দেয়। মুক্তি দেয় সংশয়, সংস্কার এবং ভিত্তিহীন ধারণা থেকে। ভ্রান্ত রসম-রেওয়াজ ও অহেতুক প্রতিবন্ধকতা থেকে সুরক্ষিত রাখে। তাই তার বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সীমাটি কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং তা উন্নতির জামিনদার।

ধর্মের স্থিরতার বিপরীতে ইসলামের এই সার ধারণাই পেশ করে ইসলামী আন্দোলন। এ তো গেল তার হালকা একটি পরিচয়। এবার দেখা যাক এই আন্দোলন কেমন কর্মী চায়। এখানে একটি কথা স্পষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি যে সেই ব্যক্তিকেই কোনো আন্দোলনের কর্মী বলা যায় যে তাতে সময় ব্যয় করে এবং তার কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করে। কিন্তু এ সময় আমার সামনে রয়েছে Standard ও আদর্শ কর্মীর ধারণা। আদর্শ কর্মী সে যে নিজের পুরো জীবন আন্দোলনকে সঁপে দেয়। তার জন্যই চিন্তা ও সংগ্রাম করে, তার চিন্তায় অস্থির হয়ে যায় এবং আন্দোলনের ইচ্ছার সামনে নিজের ইচ্ছাকে কুরবানি দেয়। তার জান, মাল, শক্তি ও যোগ্যতা সবকিছুই আন্দোলনের জন্য ওয়াকফ হয়ে যায়। হতে পারে আপনি তার জন্য কর্মীর পরিভাষা হালকা মনে করতে পারেন এবং অন্য কোনো পরিভাষা ব্যবহার করতে চাইবেন, কিন্তু আমার দৃষ্টিতে আন্দোলনের সর্বোচ্চ কাজ আঞ্জাম দেওয়া ব্যক্তিটিও তার কর্মী। এই আন্দোলনের আদর্শ ও Standard কর্মী হতে হলে ব্যক্তিকে জবরদস্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। নিজের ভেতর জন্ম দিতে হবে বিশেষ দক্ষতা। এগুলো হচ্ছে-

যে ব্যক্তি ইসলামী আন্দোলনের Standard কর্মী হতে চায় তার জন্য সবার আগে জরুরি হচ্ছে সে ইসলামের গভীর জ্ঞান অর্জন করবে। সে ইসলামকে ভালোভাবে বুঝবে, তার আহকাম ও লক্ষ্য সম্পর্কে জানবে এবং তার রুহ ও মেজাজকে নিজের ভেতর আত্মস্থ করবে। তার এই জ্ঞান ও জানাশোনা এতটা বাড়াতে হবে যাতে ইসলামের অভ্রান্ততার উপর তার শরহে সদর হাসিল হয়। তার ভেতর এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে হবে যে কেবল ইসলামেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। দুনিয়া বাতিল মতাদর্শের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে এবং ভ্রান্ত চরিত্র ও কর্ম তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দিনের আলোয় সে এটি দেখতে সক্ষম হবে। উপরন্তু তার কাছে সত্যের নূর রয়েছে এবং তা এই অন্ধকার দুনিয়াকে রাহে হক দেখাতে পারবে; দুনিয়ার কোনো মতবাদের সামনেই তার এই বিশ্বাস ক্ষয়ে যাবে না। কুফর ও জুলমাত থেকে দুনিয়াকে মুক্তকারী আল্লাহর নবীদের কাছেও এই ধরনের শরহে সদর অর্জিত ছিল। এজন্যই পাহাড়ের ওপর রাখলে তা বিচূর্ণ হয়ে যাওয়া কিংবা জমিনের ওপর রাখলে তা বিদীর্ণ হয়ে যায় এমন দায়িত্বের ভার নবী ও রাসূলগণ অনায়াসে বহন করতেন। কুরআন মাজিদে রাসূল সা.কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, দাওয়াতে দ্বীনের ভারি জিম্মাদারি আপনার কোমর ভেঙে দিচ্ছিল, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আপনাকে নিয়ামত স্বরূপ শরহে সদর দিয়েছেন। যার কারণেই এই পথে অটল থাকা এবং সকল শত্রুতা মোকাবিলা করা আপনার জন্য সহজ হয়ে গেছে। “আমি কি তোমার বক্ষ বিদীর্ণ করিনি? তোমার সেই ভারি দায়িত্ব কি হালকা করে দিইনি যা তোমার কোমর ভেঙে দিচ্ছিল? এছাড়া তোমার জন্যই তোমার জিকিরের আওয়াজ উচ্চকিত করেছি।” (সূরা আলাম নাশরাহ : ১-৪)

আল্লাহর রহমতে আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি যখন আল্লাহর নাম নিতে আমাদের তেমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। এটিও আল্লাহর অনুগ্রহ যে দুনিয়ার সর্বত্রই ইসলামী আন্দোলন ইসলামের দাওয়াত ও প্রতিনিধিত্বের ফরজ দায়িত্ব পালন করছে। ওইসব আন্দোলন অত্যন্ত চমৎকার পদ্ধতিতে দ্বীন বোঝানোর খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। অনুভব করা যায় অনেক মানুষই এসব আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, দৃষ্টিভঙ্গি, বক্তব্য ও অভিধাগুলো আয়ত্ত করেছে, কিন্তু অনেকেই তার রুহানিয়াত ও মৌলিক চাহিদাকে পুরোপুরি মন-মগজে ধারণ করতে পারেনি। এসব আন্দোলনের প্রভাবে এটা তো বলা সহজ যে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, কিন্তু এর সার বক্তব্য ব্যাখ্যা করা বেশ মুশকিলই হবে। আন্দোলনগুলো এই সত্যটি জোরালোভাবেই উপস্থাপন করেছে যে মানুষের চরিত্র গঠন, সামাজিক সংস্কার ও রাজনৈতিক সংগঠন সঠিক পন্থায় পরিচালিত হতে পারে কেবল ইসলামের মাধ্যমেই। এজন্য জিন্দেগির সকল ক্ষেত্রে রাজত্ব করার অধিকার কেবল ইসলামেরই রয়েছে। কিন্তু আপনি এমন মানুষ পাবেন, যারা সেসব আন্দোলনের সাথে সম্পর্কের খাতিরে এই বিপ্লবী মতের চর্চা করে, কিন্তু তার গূঢ়ার্থ ও তার জটিলতা সম্পর্কে পূর্ণরূপে ওয়াকিবহাল নয়। এসব আন্দোলন বলেছে যে ইসলাম আকিদা, আখলাক, জীবন, সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির জন্য অনন্য সাধারণ নীতি উপস্থাপন করেছে এবং দীন-দুনিয়ার সমস্ত সমস্যা খুবই পরিকল্পিত উপায়ে সমাধান করেছে। এজন্য বুদ্ধিমান মাত্রেই কামনা জীবনের সমস্ত ক্ষেত্র তারই অনুসারী হোক এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তার কাছেই সোপর্দ করে দেওয়া হোক। কিন্তু এমন মানুষ খুবই কম পাওয়া যাবে যে এই চিন্তার সাথে ঐকমত্যের অতিরিক্ত জীবনের কোন একটি ক্ষেত্রে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পেরেছেন।

সন্দেহ নেই, আন্দোলনে নির্বিশেষ থাকে। আবার বিশেষ কর্মীও থাকে। এজন্য আন্দোলনের প্রত্যেকের কাছেই উন্নত বুদ্ধিবৃত্তি আশা করা যায় না। বিশেষ কর্মীদের অবস্থান নেতৃত্ব ও পরিচালনার অন্যদিকে সাধারণ কর্মীরা ¯্রফে অনুসরণ করে চলে। জ্ঞান ব্যতিরেকে নেতৃত্ব হাসিল করা যায় না। স্লোগান আর দাবি-দাওয়া সাধারণের জন্য। জ্ঞানীরা দুনিয়াকে তার গূঢ়ার্থ বোঝায়। ইসলামী আন্দোলনের আদর্শ কর্মীদেরকে জ্ঞানীদের কাতারে শামিল হতে হবে। এজন্য ইসলামের অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই অধ্যয়নের দুইটি দিক- প্রথমত, ইসলামের সাধারণ অধ্যয়ন। ব্যক্তি যেন ইসলামের বুনিয়াদি মাসয়ালা, হুকুম-আহকাম ও তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এমন জ্ঞান অর্জন করে যাতে সংক্ষেপে তার পরিচয় ব্যাখ্যা করতে পারে। ইসলামী আন্দোলনের প্রত্যেক কর্মীর জন্য এ পর্যন্ত অধ্যয়ন অবশ্য কর্তব্য। কোনোমতেই এতে গাফেল হওয়ার সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, ইসলামের অধিকতর অধ্যয়ন। মানে উচ্চ দক্ষতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি জন্মানো। সন্দেহ নেই বর্তমান জমানায় ইসলামের সমস্ত দিকের উপর এই প্রকৃতির অধ্যয়ন কঠিনই শুধু নয়, অসম্ভবও হতে পারে। অতএব ইসলামের সাধারণ অধ্যয়নের সাথে সাথে অন্তত একটি দিকে অধিকতর অধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনের প্রস্তুতি আদর্শ কর্মীদের নিতে হবে। যাতে সে কর্মী ইসলামের এই অধ্যায়ে বিশদভাবে মতপ্রকাশের যোগ্যতা হাসিল করতে পারে। যাতে অন্তত একটি দফায় দুনিয়াকে পরিতৃপ্ত করতে পারে। এর জন্য বেশ মেহনত করতে হবে। যারা জ্ঞানের বিভিন্ন ময়দানে কাজ করছেন সেসব যুবকদের প্রতি আমার অনুরোধ হচ্ছে- তারা যেন এই প্রস্তুতি থেকে গাফেল না হয়। একজন জ্ঞান-অনুসন্ধিৎসুর সাথে জ্ঞান সংক্রান্ত বাতচিতই হতে পারে। সে যদি জ্ঞানের ময়দানে নাকাম হয় তাহলে তার যে ক্ষতি হবে তা হয়তো আর কোন ভাবেই সংশোধন করা সম্ভব নয়।

সব আন্দোলনের কর্মীরাই তার মুখপাত্র। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকেও এই মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ কিংবা নির্বিশেষে, মসজিদে-মাদ্রাসায়, স্কুল-কলেজে, বাজারে, পার্কে, সভা-সমাবেশ অর্থাৎ সর্বত্রই তিনি এই মুখপাত্র ও বিশ্লেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। নিজের কথা-বার্তায়, বক্তৃতায়, সাংবাদিকতায়, আলোচনা-বিতর্কে অর্থাৎ সম্ভাব্য সকল মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের মেজাজ মোতাবেক এই দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে। আপনি সকল স্থানেই ইসলামের একজন উকিল এবং অনুবাদক কিংবা দোভাষী হিসাবে উপস্থাপিত হবেন। দুনিয়ার সকল বাহাস-বিতর্কের গতি ইসলামী আন্দোলনের দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে আপনাকে। প্রতিটি চ্যালেঞ্জের জবাব আপনার কাছে মওজুদ থাকতে হবে আর সকল জটিলতা ইসলামের আলোয় সমাধান করতে হবে। এটি একটি দীর্ঘতর কাজ। যতক্ষণ না দুনিয়া ইসলামের ছায়াতলে আসছে আর তার বিজয় ধ্বনিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এই কর্ম চলতে থাকবে। এই গুরুত্বপূর্ণ  দায়িত্ব আপনাকে আদায় করতে হবে। আপনি কি এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন?

ইসলামী আন্দোলনের কর্মী তো সে যার পুরো জিন্দেগি ইসলামী আন্দোলনের রঙে রাঙানো। মঞ্চে যা দৃশ্যমান, নিজের জীবনেও তা দৃশ্যমান হতে হবে। সে তার আখলাক, তার আমল, তার মুয়ামালাত সবকিছু আন্দোলন মোতাবেক পরিচালনা করে। কিন্তু যার মধ্যে এসব বিশেষত্ব নাই সে এর কর্মী আর কী হবে, বরং সে হবে এর বদনাম ও বেইজ্জতির কারণ।

কথা ও কাজের বৈপরীত্য প্রতিটি আন্দোলনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইসলামী আন্দোলনের জন্যও এটি প্রাণঘাতী বিষ। তাই এই আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত নওজোয়ানের জন্য তার সকল কার্যক্রম আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোতাবেক হতে হবে। আজকের দুনিয়ায় বিশ্বব্যাপী যুবকরা মানসিক উপনিবেশের শিকার। তাদের জীবন ও চরিত্র ঘুণে ধরেছে, অগণিত ভুল কর্মে ডুবে আছে তারা। তাদের জন্য ছড়াচ্ছে ফিতনা ফাসাদ, বিস্তার ঘটছে যিনা ও অনৈতিকতার, বড়দের প্রতি আদব-শ্রদ্ধা উঠে যাচ্ছে, শিক্ষায়-তালিমে তাদের কোনো আগ্রহ নেই, তাদের শক্তি লক্ষ্যহীন ও খারাপ কাজে ব্যয় হচ্ছে এবং তাদের জন্য তাদের পিতা-মাতা পেরেশান ও অসম্মান হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যদি কোনো যুবক ইসলামের সঠিক চিত্র উপস্থাপন করে, চরিত্র ও ব্যক্তিত্ববান হয়, বড়দের আদব ও শ্রদ্ধা করে, ছোটদের কষ্ট না দেয়, তার কর্মকাণ্ডে পিতা-মাতা, আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবরা সন্তুষ্ট হয় তাহলে তার ভাষাহীনতাও আপনাআপনি ভাষা পেয়ে যাবে। তার চুপ থাকার মধ্যেও তৈরি হবে অগ্নিঝরা বক্তৃতার শক্তি। সে মঞ্চে না গিয়েও সবসময় মঞ্চে থাকে। কানের পর্দায় আঘাত লেগে তার কথা ফিরে আসে না, বরং দিল ও দেমাগের গভীরে প্রবেশ করে। সে যে হকের উপর অটল আছে এবং হকের দিকে দুনিয়াকে আহ্বান করছে, তার দলিল মূলত তারই উপস্থিতি। ভাবুন তো, কোনো কর্মী কি এত বড় হাতিয়ার থেকে মাহরুম হতে পারে?

মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বহু দক্ষতা দান করেছেন। একজন যুবক তো এসব দক্ষতায় ও যোগ্যতায় পরিপূর্ণ থাকে। বলা যায়, তারা অমূল্য শক্তি ও দক্ষতার খাজনা নিয়ে চলে। এ দিয়ে তারা অপকর্মও করতে পারে, আবার গঠনমূলক কর্মও আঞ্জাম দিতে পারে। আপনি ইসলামী আন্দোলনের কর্মী। আপনার মধ্যে শক্তি আর দক্ষতার যে ভাণ্ডার রয়েছে তা এই আন্দোলনের খিদমতে ব্যয় করুন। আপনি জানেন, এই দক্ষতা আপনি আপনাআপনি অর্জন করেননি। বরং তা আল্লাহ তায়ালার আমানত। তার ব্যাপারে রোজ কিয়ামতে জিজ্ঞাসিত হবেন। আপনার কাছে ইলম আছে, তাহলে সেই ইলমের ব্যাপারে প্রশ্ন হবে। যে হায়াত, মাল ও দৌলত অর্জন করেছেন তার ব্যাপারেও প্রশ্ন হবে। হাদিসে এসেছে-

“কিয়ামতের দিন যতক্ষণ না এই পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে ও তার জবাব দেওয়া হবে ততক্ষণ মানুষের কদম নড়বে না- সে তার জীবন কিভাবে যাপন করেছে, যৌবনকাল কিভাবে ব্যয় করেছে, যে ইলম সে হাসিল করেছে তার মোতাবেক কতখানি জীবন পরিচালনা করেছে, সম্পদ কিভাবে ও কোথা থেকে অর্জন করেছে এবং তা কিভাবে ব্যয় করেছে।”

আপনি যেসব যোগ্যতা পেয়েছেন, তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এই আন্দোলনের জন্য। খুব সতর্কতার সাথে দেখছেন আপনার এই যোগ্যতা তার কোনো কাজে আসছে কি না? হতে পারে দুনিয়ার বাজারে আপনার এই যোগ্যতার অনেক মূল্য, কিন্তু আন্দোলন তার বিনিময়ে কিছুই করতে পারছে না। তবুও নিছক এই কারণে যে বাজারে তার মূল্য অনেক বেশি, যোগ্যতাগুলো নিলাম করে দিবেন না। এই দুনিয়া আর দুনিয়ার অনুসারীরা একটা ভ্রম। আর আপনার যোগ্যতা, বিশ্বাস করুন- এতটা মূল্যবান যা এই মাটির টুকরার বিনিময়ে বিক্রি করা যায় না। এখানকার মনি-জহরত দিয়েও তার তুলনা চলে না। এর মূল্য তো আপনি আজ ধারণাই করতে পারবেন না। এর সঠিক মূল্য তখন জানা যাবে যখন আল্লাহর কাছে তা পৌঁছাবে। আপনি এতটা বিনিময় পাবেন যে এই দুনিয়ার সকল বঞ্চনার অনুভূতি ভুলে যাবেন। যার ফলে আপনার সকল তামান্না, সকল কামনা পূরণ হয়ে যাবে।

এই আন্দোলন কার? আপনাদেরই আন্দোলন। আপনারাই এর বাহুবল। আপনারা ভবিষ্যতের নেতা, যাদের ওপর এটি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। এই আমানত একদিন আপনাদের হাতে সঁপে দেওয়া হবে। ভাবুন, আপনার ওপর কতবড় জিম্মাদারি আসতে যাচ্ছে! মনে রাখবেন, এই আন্দোলনের সাথে দুনিয়ার ভবিষ্যৎ জড়িত। সকল দিকে ছেয়ে যাওয়ার জন্য এই আন্দোলন এসেছে, আর আল্লাহ চাইলে ছেয়ে যাবেই। দুয়া করি, এই পরিবর্তনের ঝাণ্ডা আমাদের হাতে থাকুক আর তা আমাদের হাতেই সম্পন্ন হোক।


ইকামতে দ্বীনের জন্য জ্ঞানগত প্রস্তুতির জরুরত

ইসলাম একটি জীবনব্যবস্থা। পুরো জীবনে তা আমাদের পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে দুনিয়ার সকল মতবাদ ভুল ও বাতিল। ইসলামে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের দায়িত্ব হচ্ছে, ওই সমস্ত মতবাদ খতম করে আল্লাহর এই জমিনে তার প্রেরিত জীবনব্যবস্থা কায়েম ও গালিব তথা বিজয়ী করা। এটিই ইকামতে দ্বীন।

খুব বেশিদিন নয়, এই কয়দিন আগেও আমাদেরই অনেকের কাছেই ইকামতে দ্বীন অভিধাটি বড় আশ্চর্যের ছিল। কিন্তু নিকট অতীতের এই অপরিচিত স্বর আজ দুনিয়ার সর্বত্র বুলন্দ হচ্ছে। এই গান এখন মানুষের মুখে মুখে গীত হচ্ছে আর দুনিয়াভর মানুষ বিভিন্ন নামে তার ছায়াতলে মিলিত হচ্ছে।

ইকামতে দ্বীন কোনো আবেগী স্লোগান নয়। একে বুদ্ধি ও যৌক্তিকতা মুক্ত জোশ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলা চলে না। অতীতকে জীবিত করার মিথ্যা আশ্বাস ও আকাক্সক্ষাও নয় এটি। ইকামতে দ্বীন বরং বাতিল মতবাদের আগুনে জ¦লতে থাকা দুনিয়াকে দ্বীনে হকের ছায়াতলে নিয়ে আসার এক সুচিন্তিত ও সুসংহত প্রচেষ্টার নাম।

কখন, কোথায় এবং কোন পরিস্থিতিতে ইকামতে দ্বীনের আন্দোলন শুরু হয়েছে কিংবা তার তাত্ত্বিক ভিত্তি কী ছিল এবং সেই ভিত্তি কতখানি উন্নত হয়েছে, তার Value ও Appreciation কতটুকু হয়েছে- এসব প্রশ্নে এই বাহাস নয়। অবশ্য এটি সত্য যে এদেশে ইকামতে দ্বীনের সূচনার পিছনে চিন্তা ও দর্শন, মজবুত দলিল ও যুক্তির শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। এজন্য চিন্তাশীল অনেককেই এ আন্দোলন নিজের দিকে আকৃষ্ট করেছে এবং তাদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এখন মনে হয়, যে জ্ঞানগত প্রস্তুতি নিয়ে এর সফর শুরু হয়েছিল তাতে কোনো উন্নতি সংঘটিত হয়নি। অথচ এ সময়ে সকল ক্ষেত্রে এই প্রস্তুতি উন্নততর হওয়ার কথা ছিল। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পক্ষে শুরুতে যেসব দলিল উপস্থাপন করা হয়েছিল, তার সম্পর্কে জানাশোনাও কমে আসছে। জ্ঞানগত প্রশ্ন ও বিতর্ক আমরা যেভাবে ভয় পাচ্ছি এবং নিজেদের আঁচল বাঁচিয়ে তাকে অতিক্রম করে আমরা চলছি এটি বলা অসঙ্গত হবে না যে সেসব দলিল এখন আমাদের মন-মগজে সতেজ নাই! কখনও কখনও মনে হয়, আর এ খেয়াল ভিত্তিহীনও নয় যে ইকামতে দ্বীনের আন্দোলনের জন্য জ্ঞান ও তত্ত্বগত প্রস্তুতির গুরুত্বই আমাদের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। জ্ঞানগত অপ্রস্তুতি ও অভাবের সাথে এই বন্ধুর পথ চলা সম্ভব নয়, বহু সমস্যা ও কাজের ভিড়ে এই অনুভূতি যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে। অথচ কোন মতবাদ পছন্দ করা ও তাতে অটল থাকা বিপদসঙ্কুল কাজ। এর সাহস ও হিম্মত এবং শক্তি ও দক্ষতা ইলম থেকেই জন্ম নেয়। এই দুনিয়া মতবাদের একটি জঙ্গল স্বরূপ। জ্ঞানের বলেই মানুষ এর থেকে কোন একটি বাছাই করে। যখন তার জ্ঞান দৃঢ় হয়ে ঈমানে রূপ নেয় তখন তার মধ্যে পাহাড়ের ন্যায় অনড়তা ও এস্তেকামাত পয়দা হয়। তখন সে নির্ভয়ে নমরুদের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যও প্রস্তুত হয়ে যায়। যদি ইলম না থাকে তাহলে মানুষ কোন একটি চিন্তার ওপর অটল থাকতে পারে না। ভিন্ন মতের একটা ঢলই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

একজন দাঈর অবস্থান থেকে ভাবলে জ্ঞানের জরুরত ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যেতে পারে। দাঈর জন্য ইলম একটি প্রাথমিক ও বুনিয়াদি প্রয়োজনীয়তা। ইলমের মাধ্যমেই তার দাওয়াতি কাজ চলে। কোনো মতবাদ দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করা এবং তা মেনে নেওয়ার জন্য দাওয়াত দিতে গেলে জরুরি হচ্ছে মানুষ ওই মতবাদ শুধু ভালোভাবে বুঝলেই হবে না, বরং যেসব জ্ঞানগত ও তাত্ত্বিক বুনিয়াদের ওপর সে মতবাদ প্রতিষ্ঠিত তা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হতে হবে। এই পথে একজন দাঈর কাছে জ্ঞানের ভিত যতখানি শক্তিশালী হবে সে ততখানিই অগ্রসর হতে পারবে। যেখানে তার জ্ঞানের সীমানা শেষ সেখানেই তাকে থামতে হবে। বরং ভয় হচ্ছে সে ওই সফর থেকেই না ফিরে আসে আর সাহস হারিয়ে ফেলে! জ্ঞানের সামান্য রত্ন নিয়ে দাওয়াতের পিচঢালা দীর্ঘ পথে যাত্রা করা একটি মুজিজা ছাড়া কিছুই নয়। আর মুজিজা সব সময় প্রকাশ হয় না।

আমার সাথে আপনার সাথে যদি কারো প্রীতি ও ভালোবাসা থাকে তাহলে হতে পারে সে দলিল ছাড়াই আমাদের কথা মেনে নিবে। কিন্তু দুনিয়ার সাধারণ কায়দা হচ্ছে যেকোনো দাবি দলিলের বলে মানা হয়। আর দাবি যত বড় হয়, তার জন্য তত বড় দলিলের প্রয়োজন হয়। দাওয়াত ও তাবলিগের জন্য একজন দাঈর জ্ঞানের সীমা প্রতিপক্ষের জ্ঞানের চেয়ে বেশি হওয়া প্রয়োজন। অন্তত তার সমান না হলে কোনোভাবে চলে না। অল্প জানাশোনার মাধ্যমে নিরক্ষর কিংবা স্বল্পশিক্ষিতদের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে দাওয়াতি কাজ চালানো যেতে পারে, কিন্তু শিক্ষিত স্তরে কথা বলার জন্য সেভাবে জ্ঞানগত প্রস্তুতি নিতে হবে। তার জন্য সে মানের দলিল উপস্থাপন করতে হবে। উপস্থাপন পদ্ধতিও সে মানের অর্জন করতে হবে। দাঈ কোনো জানাশুনা মানুষকে তার জ্ঞানের স্বল্পতার সীমানায় এনে কথা বলতে পারে না, এজন্য তাকে বিপরীত জনের জ্ঞানের বরাবর পৌঁছাতে হবে। এ ছাড়া সে কখনও এর তাত্ত্বিক মাহাত্ম্য অনুভব করতে পারবে না এবং এসব কথায় মনোযোগ দেওয়ার যোগ্য বলে মনে করবে না।

আমাদের ইলমি তরক্কির পথে এক বড় বাধা সম্ভবত এটিও যে আমরা ইলমি দিক থেকে আমাদের চেয়ে নিম্নস্তরের লোকদের শ্রোতার আসনে বসিয়েছি। গভীর জানাশোনা স্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করিনি। মানুষ নিজের চেয়ে দুর্বল মানুষকে যুক্তিতে চুপ করিয়ে মূলত নিজেই প্রতারণার শিকার হয়। সে ভাবে এটিই সমগ্র দুনিয়ার জ্ঞানের স্তর, আর সে নিজের দলিলের বলে সবাইকে বশ করতে পারবে। এখান থেকেই তার জ্ঞানগত অধঃপতন শুরু হয়। বরং ইলমি তরক্কির জন্য তার চেয়ে জ্ঞান ও চিন্তায় উঁচু স্তরের মানুষের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। একজন দাঈকে প্রতিপক্ষের তুলনায় চিন্তাগত দিক থেকে এতটা উচ্চ ও সুরক্ষিত মাকামে পৌঁছানো দরকার যাতে কোনো দিক থেকেই তার ওপর হামলা সম্ভব না হয় কিন্তু চারদিকে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। এই চিন্তাগত স্থায়িত্ব ছাড়া দুনিয়ার কোনো আদর্শিক ইনকিলাব আসতে পারে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইলমি পরিবেশ আমরা তৈরি করেছিলাম তা এখন কেন বদলে গেল? কিংবা যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতার জন্ম দিয়েছিলাম তা কমজোর হলো কেন? এর জবাবে বলা যেতে পারে, আমরা আমাদের যাত্রার শুরুতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানগত ও তাত্ত্বিক বিষয়ে কথা বলেছিলাম। আধুনিকতা যেসব প্রশ্ন ছুড়েছে তার জবাব দিয়েছিলাম এবং জ্ঞানের দুনিয়ায় প্রচলিত ভুল ধারণা দূর করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু খুব বেশিদিন এই সিলসিলা জারি রাখা যায়নি। নতুন নতুন বিষয় আমরা আত্মস্থ করতে পারিনি। বরং পুরাতন রচনাগুলোরই পুনরাবৃত্তি, তার সহজীকরণ ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে নিয়োজিত হয়েছি। এভাবে যে ইলমি প্রবণতা জন্ম নিয়েছিল, যখন তার উপযুক্ত রসদ এবং তার লালন-পালনের উপাদান সরবরাহ করা গেল না তখন তা মূর্ছা গেল।

ইলমি ময়দানে আমরা যে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম তা জারি রাখা যায়নি এবং যে দ্রুততার সাথে আমরা অগ্রসর হয়েছিলাম তাতে পরিবর্তন এসেছে। এটি সত্য। এখন তার স্বভাব ও প্রবণতা আমাদের বোঝা উচিত এবং নতুন ভাবে নতুন বলে বলীয়ান হয়ে তা দূর করার চেষ্টা করা উচিত।

তবে এই ধীরতার স্বীকার করেও এটি বলতে আপত্তি নেই যে এই সময়ে যে একেবারে নিরঙ্কুশ শূন্যতাই তৈরি হয়েছে তা সত্য নয়। ইদানীংকালে আলোচনায় বেশ কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে, পুরাতন বিষয়গুলোতে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে, সাধারণভাবে ইঙ্গিত করা যেতে পারে এমন কিছু বিষয়ের ওপর বিশদ আলোচনা করা হয়েছে আর দলিলের প্রয়োজন ছিল এমন কিছু বিষয়ে দলিল উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া যেসবের নতুনভাবে উপস্থাপনের জরুরত ছিল তা উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যেসব বিষয়ের দিকে আগে মনোযোগ দেওয়া হয়নি অথবা কম ছিল সেসবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। বড় কথা হচ্ছে জ্ঞানগত আত্মবিশ^াস জন্ম হয়েছে। এই কাজটায় অমনোযোগিতা এবং তা সম্পর্কিত ফায়দা অর্জন না করা এক ধরনের ইলমি লোকসান। ইকামতে দ্বীনের পতাকাবাহীদের কোনোভাবেই এই লোকসান মেনে নেওয়া উচিত নয়।

অনেক সময় এই ধরনের প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায় যে মনে করা হয় ইসলামকে জ্ঞান ও তাত্ত্বিক দিক থেকে তো প্রমাণ করা হয়ে গেছে, প্রত্যক্ষভাবে কায়েম করা বাকি রয়েছে শুধু। এটি এক ধরনের খামখেয়ালি। এই পৃথিবী বিভিন্ন মতবাদের স্থান। মতবাদের যুদ্ধ বড় কঠিন। এটি এক দফাতেই সফলতার সাথে শেষ হয়ে যায় না। বরং এখানে রোজ রোজ নতুন হামলা হতেই থাকে। যেকোনো মতবাদের জিন্দা থাকতে হলে শুধু নিজের উপস্থিতিরই না, বরং নিজের শক্তি ও ক্ষমতার প্রমাণ অবিরত উপস্থাপন করতে হয়। যে মতবাদ কদমে কদমে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে না যে সে অন্য মতবাদের ওপর বিজয়ী হতে পারে, প্রতিপক্ষ মতবাদ কখনই নিজের পরাজয় ও পশ্চাদপসরণের ঘোষণা দিয়ে সে মতবাদের অনুশাসন মেনে নিবে না। পৃথিবীতে বহু মতবাদ জন্ম নিয়েছে, কিন্তু যখন মতবাদের লড়াইয়ে সে পরাজয় বরণ করে নিয়েছে তখন তাকে প্রাণহীন ও মৃত মনে করে ইতিহাসের ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এখানে যেকোনো মতবাদের পতাকাবাহী প্রতিটি ক্ষণেই তাত্ত্বিক লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে। এক লহমার জন্য তা থেকে গাফেল হয়ে গেলেই প্রতিপক্ষের জন্য তাকে ময়দান ছেড়ে দিতে হবে। এই মামলায় ইতিহাস বড়ই বে-রহম। সে না আগে কখনো রেয়াত দিয়েছে, আর না এখন দিবে!

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা এই আন্দোলনের যে তাত্ত্বিক গুরুত্ব নির্ধারণ করতে চাচ্ছি তার জন্য বেশুমার ইলমি প্রস্তুতি প্রয়োজন। এই প্রস্তুতি ধর্ম, দর্শন, আখলাক ও আইনসহ অনেক ক্ষেত্র থেকেই হতে হবে। ভুল ও বাতিল মতবাদও জ্ঞানের জোর ও শক্তিতে অনেক সময় ছড়িয়ে যায়; বর্তমানেও বিশ্বব্যাপী এক ধরনের মতবাদ ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের কাছে যে দ্বীনে হক রয়েছে, যদি তাকে আজকের জ্ঞানের মানের আলোকে পেশ করা হয় তাহলে দুনিয়া থেকে বাতিল মতবাদের অন্ধকার দূরীভূত হয়ে সত্য দ্বীনের আলো ছড়িয়ে যাওয়া খুব দূরে নয়। কিন্তু এই ময়দানে যদি আমাদের প্রস্তুতি পরিপূর্ণ না হয়, তাহলে ভয় হচ্ছে আমরা আমাদের দুর্বল ওকালতির কারণে আল্লাহর দ্বীনের হাক্কানিয়াত প্রমাণ করতে পারব না এবং তার পক্ষে মজবুত দলিলের অভাবে নতুন প্রজন্ম তাকে মনোযোগ-অযোগ্য মনে করে ছুড়ে ফেলবে। এটি কত বড় যে লোকসান হবে পুরো মানবজাতির জন্য! আমাদের জন্য তো অবশ্যই! দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা এই লোকসান থেকে আমাদের রক্ষা করুন। 

লেখক : ইসলামী স্কলার, নেতা- সাবেক জামায়াতে ইসলামী হিন্দ

অনুবাদক : শিক্ষার্থী, চবি

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির