post

ইসলামী গানে কাজী নজরুল ইসলাম

মাওলানা আবদুল বাতেন

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাংলা সাহিত্যের বর্তমান প্রধান কবি আল মাহমুদ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন কাজী সাহেব উপরে ছিলেন সাধারণ মানুষ আর ভিতরে ছিলেন দারুণ ক্লাসিক্যাল। এই ক্লাসিক্যাল মানুষটি কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র কবিই ছিলেন না, বাংলা সাহিত্যের চির দীপ্তমান উজ্জ্বল নক্ষত্র। লেটো গানের দলের দুখু মিয়া একাধারে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সাংবাদিক, সম্পাদক, সৈনিক, ইমাম, মুয়াজ্জিন, রুটির কারিগর, বাদক, সংগঠক ইত্যাদি গুণে গুণাম্বিত ছিলেন। এই পৃথিবীতে আর এ রকম আরেকটা মানুষ পাওয়া যাবে না যার জীবনে এতো উপাধি থাকে। কাজী নজরুল ইসলাম তার সাহিত্যকর্মে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন “গানে আমি কিছু দিতে পারছি।” নজরুল গানে এই কথার মাহাত্ম্য খুঁজে পাওয়া যায়। নজরুল সঙ্গীতে চিত্রধর্মী বৈশিষ্ট্যের সাথে ভাবের মাহাত্ম্য, সুরের কারুকাজ, শব্দচয়ন জাদুকরী কর্মকাণ্ড, বলিষ্ঠ জীবনবোধের দীপ্ত কথামালা ও মানবিক আবেদন, উদ্দীপনা, বেদনার মর্মধ্বনি ঝংকৃত হয়েছে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে শাহ মুহাম্মদ সগীর, সাবিরিদ খান, সৈয়দ সুলতান, মোহাম্মদ খান, দৌলত কাজী, হায়াত মাহমুদসহ আরো অনেক কবি সাহিত্যিক তাদের পুঁথিসাহিত্যকর্মে ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, কবিতা, হামদ-নাত লেখার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। কেবল পুঁথিসাহিত্য নয়, লোকসাহিত্য ও বাউল ও ফকিরদের গানে সুফি ভাবমূলক, মুর্শিদি, মারফতি, জারি এবং পালা গান হামদ নাতের দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়। এইসব গান ভক্তহৃদয়ে আকুতি নিবেদন আছে, আছে মরমি ভাবের ভাবোচ্ছ¡াস, অভাব নেই সামাজিক জগতের কোন আভাসের। নজরুলের সৃষ্টিধারা অনন্য। পূর্ববর্তীদের সাথে হামদ-নাত, মরমি, মারফতি ও মুর্শিদি চরিত্রের মিল থাকলেও নজরুলের সঙ্গীতাঙ্গিক সম্পূর্ণ নতুন, আধুনিক এবং কেবল শব্দ ও বাক্যবিন্যাস বা কবিতার আঙ্গিক নয়, সুরের আধুনিকতা আঙ্গিকও। নজরুলের গান বাউল বাংলা সুরের সঙ্গে আছে মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক, ইরান এবং পশ্চিম দক্ষিণ ভারতীয় ধ্রুপদ সঙ্গীত ও ঠুংরী কাওয়ালি গজলের বিমিশ্রণ। কল্পনা, কথা, সুর ও কবিত্ব-শক্তির এমন ঐন্দ্রজালিক মহিমা ইতঃপূর্ব তার পূর্বসূরিদের রচনায় পাওয়া যায়নি। “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে/যেন ঊষার কাল রাঙা রবি দোলে” এই সব কালজয়ী গান তার জীবন্ত উদাহরণ। কাজী নজরুলের ইসলামী গানে যা পাওয়া যায় :

১. গানের বক্তব্য মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদীসভিত্তিক : নজরুলের গানে ইসলামের আদর্শ পবিত্র কুরআন ও সুনাহ সংমিশ্রণ রয়েছে নিবিড়ভাবে। রাসূল (সা.)-এর জীবন আদর্শ পবিত্র কুরআনের বাস্তব রূপ। নজরুলের ইসলামী গানের পরতে পরতে ছড়ানো আছ কুরআনের বক্তব্যের নির্যাস। কোথাও শাব্দিক অনুবাদের মত, কোথাও ভাবার্থ বা বিশ্লেষণমূলক। যেমন : “যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তাহলে আমারই অনুসরণ কর, আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।” (হাদীস)। কবি নজরুল বলেন, “আল্লাহকে যে পাইতে চায় হযরতকে ভালোবেসে,” অথবা “খোদার হাবিব শেষ নবী তুই হবি নবীর হাবিব”।

২. নজরুলের গানে ইসলামের মূলভিত্তি কথা : ঈমানের মূল কথা হচ্ছে লা-শরীক আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া ইলাহ্ নেই, মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ এক, একক, অদ্বিতীয়, শরিকহীন মন নেয়ার দিক নজরুল তার গানে তুলে ধরেছেন “লা-শরীক আল্লাহ’ মুর নামল কি বান পাহাড় তুর”, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহুর পাল তুল” ইত্যাদি গানের রূপ। ইসলামের মূলভিত্তির কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের কথা বলা আছে, কুরআনÑ “আকিমুস সালাতা ওয়াআতুয্ যাকাত”-সালাত কায়েম করা এবং যাকাত দাও। কবি নজরুল বলেন “নামাজ পড়ো মিঞা ওগো নামাজ পড়ো মিঞা”, “মসজিদে ঐ শোনরে আজান চল নামাজে চল”, যাকাত সম্পর্কে “দে যাকাত দে যাকাত, তোরা দে রে যাকাত”। কুরআনুল করীম নাযিল হয়েছে পবিত্র সিয়ামের মাস, “শাহরু রামাদানাল্লাযি উনযিলা ফি-হিল্ কুরআন” রমজান সেই মাস, যে মাসে কুরআন নাযিল হয়েছে। নজরুলের গানে এই কথা এভাবে এসেছে “ওগো রমজান---আনিয়াছিলে দুনিয়াত তুমি পবিত্র কুরআন”।

৩. নজরুলের গান কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা : পবিত্র কুরআনের প্রথম বাণী “ইকরা বিসমি রাব্বিকা ---” -পাঠ করুন আপনার রবের নামে। “লা খাওফুন আলাইহিম” -তাদের কোনো ভয় ভীতি নাই। “ইন্নাল্লাহা ওয়া মালাইকাতুহু ই’য়ুসাল্লুনা আলানাবীয়্যি”-নিশ্চয় আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পাঠ করেন। আর নজরুল তার গানে লিখেছিলেন “আল্লাহ আমার প্রভু/আমার নাহি নাহি ভয়/আমার নবী মুহাম্মদ/তাঁহার তারিফ জগৎময়।” পবিত্র কুরআনে আছে “হুদাল্লিল মুত্তাকিন” -এ কিতাব (আল-কুরআন) মুত্তাকিনদের জন্য পথ প্রদর্শক। নজরুল গেয়েছেন “সেই দরিয়ায় পারাপারের তরী ভাসে কুরআন”, “পথ না ভুলি তাইতো দিলেন পাক কুরআনের বাণী”, “তাবিজ হয়ে ঝুলব বুকে কুরআন খোদার বাণী” কুরআন “ফাতহুন কারিব”-আসন বিজয়। নজরুল উল্লেখ করেন তার লেখায় “খোদা তুমি ছাড়া বিশ্বে কারও করতাম না ভয়/ তাই এ বিশ্ব হয়নি মোদের কভু পরাজয়” কুরআন বলছে “তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না/ তোমরাই বিজয়ী, যদি তোমরা মু’মিন হও।” কুরআন বলছে “ফাসাব্বিহ, বিহাম্দি রবিকা ক্বাবলা তুলুইশ্ শামস ---”-সূর্য উদয়ের আগে তোমরা রবের গুণগান কর।’ নজরুল বলেন-“আল্লাহর নাম লইয়া বান্দা রোজ ফজরে উঠিও”।

৪. নজরুলের গানে ইসলামের মানবতাবাদী আবেদন : নজরুলের গানে উঠে এসেছে মানুষের মানবতাবাদী কথামালা যেমন : “মরিব ক্ষুধায় কেহ নিদারুণ/ কারো ঘরে রবে অঢেল ধন, এ জুলুম সহনি কা ইসলাম সহিবে না আজওয়া”, “শুকনা রুটি খোরমা খেয়ে যাদের খলিফা হয়ে শাসন করিল রে অর্ধেক জাহান”,“নারীর প্রথম দিয়েছ মুক্তি নর সম-অধিকার, মানুষের গড়া প্রাচীর ভাঙিয়া করিয়াছে একাকার”। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে “বল, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু জগৎসমূহের রবের জন্য”। আর নজরুল লিখেছেন “এমনি দিন কুরবানি দেন পুত্র হজরত ইব্রাহিম তেমনি তারা খোদার রাহে আয় রে হবি কে শহীদ”।

৫. বিশ্ব মুসলিম, পরকাল, ইসলামী জাগরণ নজরুলের গানের প্রকাশ : পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে, “ওয়া’অতাসিমু বিহাবলিল্লাহি জামিআও ওয়া-লা তাফাররাকু” Ñ তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। নজরুল প্রত্যাশা করেন “হোক বিশ্ব মুসলিম এক জামাত”, “ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর/ তখনো জাগিনী যখন যোহর/ হেলায় খেলায় কেটেছে আসর/ মাগরিবের ঐ শুনি আযান/ জামাতে শামিল হওরে এশাতে এখনো জামাতে আছে স্থান”। নজরুল তার গানে সব সময় তার শেষ মৃত্যু যেন ভাল হয় সেই দোয়াই করেছেনÑ “আমার যখন পথ ফুরাবে আসবে আঁধার রাতি/ তখন তুমি হাত ধরো মোর হয়ে পথের সাথী”, “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই”, “রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার/ বিচার চাহিনা তোমার/ দয়া চাহে এ গুনাহগার”, “সেদিন তোমার দীদার আমি পাব কি আল্লাজি?”। ইসলামী পুনর্জাগরণ, ইসলামের চিরদীপ্ত শপথ নজরুলের গানে ফুটে উঠেছে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার মতো। “বাজিছে দামামা বাঁধ রে আমামা শির উঁচু করি মুসলমান/ দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার ভাঙ্গা কিল্লায় উড়ে নিশান”, “দিক দিক পূর্ণ: জ্বলিয়া উঠেছে দীন-ই ইসলামী লাল মশাল” ,“বাজল কি সে ভোরের সানাই”, “তাওফিক দাও খোদা ইসলাম/ মুসলিম জাঁহা পূর্ণ হাক আবাদ” ইত্যাদি গানগুলো ইসলামী পুনর্জাগরণ, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাস শ্রদ্ধার ভাব প্রকাশিত হয়েছে।

৬. নজরুলের গানে বিদেশী শব্দের ব্যবহার ও শিল্পীসত্তা : নজরুলের পূর্ব দু’একজন কবি তাদের সাহিত্যকর্মে আরবি, ফার্র্সি শব্দ ব্যবহার করে নতুন রূপে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, কী বিষয় ও ভাবের সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ সঙ্গতি রক্ষা করতে পারেননি। নজরুলই প্রথম তার লেখায় কবিতায় শাত-ইল-আরব, খেয়াপারের তরণী, কুরবানি, মুহররম, রণভেরী ও ফাতেহা-ই দোয়াজদহম প্রভৃতি কবিতায় আশ্চর্য কুশলতায় আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করে বাঙালি মুসলমানদের মাঝে সাংস্কৃতিক দিকগুলো সার্থকভাবে পরিস্ফুট করে তোলেন। নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানির সাহচর্যে কাজ শুরু করলে ইসলামী গান লেখার তাকিদ পান। এর আগে ১৯২৮ সালে “চল্ চল্ চল্ ” ও “ভোরের সানাই” দুটি গান লিখেছেন সম্ভবত এই দুটি গানই নজরুলের প্রথম ইসলামী প্রেরণামূলক গান। ১৯৩০ সালের পর নজরুলের ওস্তাদ জমীরউদ্দিন খানের কাছ থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সাথে সাথে উর্দু কাওয়ালি ও গযল আয়ত্ত¡ করেন এবং উর্দু ইসলামী গানের অনুসরণে বাংলা ইসলামী গান লেখার প্রয়োজন অনুভব করেন। শিল্পী সুরস¤্রাট আব্বাস উদ্দীনের বারবার তাগিদের ফলে নজরুল ইসলামী গানের প্রতি নজর দেন এবং লিখেন। বিশ্ব মুসলিমের ঈদের সর্বকালের সেরা গান “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ” তখন রচিত হয়। এই পৃথিবীর ইতিহাস বাঙালি মুসলমানদের জন্য কাজী নজরুল সাহিত্য অঙ্গন আলোকবর্তিকা, অনেক আরবি কবি সাহিত্যিক বলেছেন ইসলামী জাগরণ ও গণবিপ্লবের সঙ্গীত-¯্রষ্টা এমন কোনো কবি আরব জগতে জন্মগ্রহণ করে নাই। কাজী নজরুলের ইসলামী গান ভাব-ভাষা ও কল্পনা তথা সার্বিক রচনা সৌন্দর্য গভীর চিত্তাকর্ষক। তার গানে আলাদাভাবে সুর ও কাব্য মর্যাদা রক্ষিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানের সংখ্যা দুইশত বাষট্টি এর বেশি হলেও তার রচিত সাহিত্যের কর্মের তুলনায় ইসলামী গান অনেক কম। কী তার রচিত ইসলামী গানের প্রতিটি শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস, সুরের হৃদয়ছোঁয়া টান সব মিলিয়ে সেরাদের সেরা স্থানের দাবিদার। বাঙালি মুসলমানদের জন্য ইসলামী সঙ্গীত লিখে নজরুল যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তা চিরদিন চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। পৃথিবীতে নজরুলকে জানে এমন প্রতিটি মুসলমান হৃদয়ে হৃদয়ে তাঁকে স্থান দিয়েছে। মহান আল্লাহ একটি গানের একটি লাইনের জন্যেও হয়তো মাফ করে দিতে পারেন কবিকে। আমাদের বিশ্বাস আমার মহান আল্লাহ তা করবেন। নজরুল নিজের মূল্যায়ন নিজেই করেছেন তা দিয়েই শেষ করব “কাব্য ও সাহিত্যে আমি কি দিয়েছি, জানি না; কিন্তু সঙ্গীতে যা দিয়েছি; সে সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবে। এই বিশ্বাস আমার আছে।” লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির