post

ইসলামী পুনর্জাগরণে গবেষণার ভূমিকা

১০ জুলাই ২০১৫
মু’তাসিম বিল্লাহ# আজকের আধুনিক বিশ্বে যে জাতি প্রযুক্তিতে, জ্ঞানে ও বিজ্ঞানে উন্নত সে জাতি নেতৃত্বের চেয়ারে উপবিষ্ট। শারীরিক শক্তিতে নয়, মেধায়-যোগ্যতায় যে বেশি দক্ষ পরিচালনায় সে বেশি সার্থক। এখানে একটি ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায়। আল্লামা ইকবালের সময় এক জন কুস্তিগির ছিল যাকে গামা পালোয়ান নামে ডাকা হতো। গামা পালোয়ান প্রতিদিন সকালে ভালো মানের নাশতা করে শারীরিক ব্যায়াম করতেন এর পর অন্য কাজ করতেন কিন্তু মজার বিষয় হলো অনেক সময় শারীরিক ব্যায়াম করার পর, তার দেহ থেকে ঘাম বের হতো। আর এ জন্য সে গর্বিত ছিল। আল্লামা ইকবাল তাকে একটু শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি সেমিনারে আহবান করলেন। সেমিনারে তার আগে কয়েক জন বক্তা বক্তব্য পেশ করলেন। এর পর গামা পালোয়ানকে বক্তব্য দেয়ার জন্য নাম ঘোষণা করা হয়। তিনি ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুরু করলেন, কিছু বলার চেষ্টা করছেন কিন্তু কোন কথা তার জবান দিয়ে আসছিলো না। তিনি এতটুকুই বললেন যে, আমার আগে অনেক বক্তা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন এবং পরেও গুরত্বপূর্ণ আলোচনা হবে, সকলকে ধন্যবাদ বলে কথা শেষ করলেন। এরপর গামা পালোয়ান বললেন, হে আল্লামা ইকবাল তুমি আমাকে কি এক কঠিন পরীক্ষা নিলে যে এক মিনিটেই আমার শরীর থেকে ঘাম বের হলো অথচ আমি এই ঘাম ঝরানোর জন্য প্রতিদিন সকালে দুই-তিন ঘণ্টা পরিশ্রম করি। আল্লামা ইকবাল উত্তর দিলেন হে গামা পালোয়ান, মুসলিম জাতির জন্য তোমার মত হাজার হাজার পালোয়ানের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন হলো একজন জ্ঞানীর যে মুসলিম জাতিকে পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দিতে পারবে। আসলেই বর্তমান সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য সেই ধরনের জ্ঞানী নকিব দরকার যে এ ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে কুরআনের আলোয় আলোকিত করবে। সকল সঙ্কটের মূল কারণ খুঁজে বের করার জন্য গবেষণামূলক কার্য পরিচালনা করবে। গবেষণার মাধ্যমে আসহাবে রাসূলের কর্মপন্থা অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করবে। সকল মুসলিমকে কুরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। একান্ত মোটিভেশন পরিচালনা করবে। শ্রেণী বিভক্ত মুসলিম জাতিকে এক তাওহিদের পতাকার নিচে এনে সকল ভেদাভেদের অবসান ঘটিয়ে শুধু আল্লাহ ও রাসূলের সা: আনুগত্যের আহবান জানাবে। আর এ সকল কাজ করার জন্য অবশ্যই সেই কুরআনের গবেষণায় কর্মরত দায়ী দরকার যে সমাজের সকল জাহিলিয়াত রোগের চিকিৎসা দিতে পারবে। গবেষণা কী গবেষণা কী এমন প্রশ্ন আসলেই রিসার্চ (জবংবধৎপয) শব্দটি চলে আসে, রি শব্দের অর্থ আবার বা পুনরায়, আর সার্চ শব্দের অর্থ খোঁজা, অনুন্ধান করা। বাংলায় গো+এষণা শব্দটিকে গবেষণা শব্দ হিসেবে বাংলা অভিধানে ধরা হয়। বাংলা সাহিত্যের বিদ্যান লোকেরা মজা করে বলেন গো মানে গরু আর এষণা মানে হলো কাছে ডাকা অর্থাৎ রাখালের গরু হারিয়ে যাওয়ার পর, সে যে পরিমাণ পেরেশান হয়ে গরু খোঁজে একজন গবেষক ঠিক সেই পরিমাণ পেরেশান হয়ে নতুন জ্ঞান অন্বেষণ করেন। তবে জবংবধৎপয শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে কিছু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। যেমন- R- Rational of thinking, E-Expert and Exhaustive treatment, S-Search for solution, E- Exactness, A-Analytical analysis of adequate data, R-Relationship of facts, C-Careful recording, Critical observation, Constructive attitude. H-Honesty, Hard work. অর্থাৎ গবেষণাকর্মে যুক্তিযুক্ত চিন্তা পদ্ধতি, সুদক্ষতা, আউটপুট-ভিত্তিক পর্যালোচনা, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা, যথার্থতা, প্রাপ্ত তথ্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, তথ্যের সাথে সম্পর্ক, সতর্ক তথ্য সংগ্রহ, গঠনমূলক বিশ্লেষণ এবং সততা ও কঠোর পরিশ্রম থাকতে হবে। পারিভাষিক অর্থে ইসলামী পন্ডিত ইমাম রাগিব ইসফাহানি বলেন-গবেষণা হলো উন্মুক্তকরণ এবং নতুন কিছু অনুসন্ধান করা। ড. ইয়াহইয়া ওয়াহাব বলেন- পাথর খন্ডে গর্ত খনন করার মতো পরিশ্রম করে নতুন তথ্য পাওয়াটাই হলো গবেষণা। গ্রিন বলেন, অনুসন্ধানের আদর্শায়িত, মানসম্মত প্রদ্ধতির প্রয়োগই হলো গবেষণা। ড. খুরশিদ বলেন, বিজ্ঞানসম্মতভাবে নতুন জ্ঞান অন্বেষণ হলো গবেষণা। সর্বশেষে এভাবে বলা যায়, বিভিন্ন প্রদ্ধতির প্রয়োগে, বিজ্ঞানের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে, কোন সমস্যার সমাধানের নামই হলো গবেষণা। কেন গবেষণা করবো হজরত ওমর (রা) অর্ধ পৃথিবীর শাসক ছিলেন। তার প্রাসাদ ছিল, ছিল রাজার আসন ও শান শওকাত, উজির-নাজির এবং সৈন্যবাহিনী। কিন্তু তাঁর প্রাসাদ কি দিয়ে তৈরি হয়েছিল? কাজী নজরুল ইসলামের কথায় “অর্ধ পৃথিবী করেছে শাসন ধুলার তখতে বসে/ খেজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসে।’’ আর এ অর্ধ জাহানের শাসন করেছেন আব্বাসীয় ও উসমানীয় খলিফারা। এ সময় রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে সাথে বিজ্ঞানের অঙ্গনেও ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন এ ধুলায় আসন গ্রহণ করা মুসলিমরা। আধুনিক মেডিক্যাল বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা। বীজগণিত শাস্ত্রের জন্মদাতা জাবির ইবনে হাইয়্যান। সর্বপ্রথম পৃথিবীর মানচিত্র কে তৈরি করেছেন? কে সৌরমন্ডল ও জ্যোতির্মন্ডল সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছেন? কে সর্বপ্রথম ডিগ্রির মাপে পৃথিবীর ব্যাস ও পরিধি নিরূপণ করেছিলেন? তিনি মুসা আল খারেজমি। সে সময় ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বীজগণিতের ওপর পাঠ্যসূচিভুক্ত হয়েছিল জাবির ইবনে হাইয়্যানের রচিত আল-জাবর নামক গ্রন্থটি যার ইউরোপীয় নাম এলজাবরা। নাইট্রিক এসিড, এন্টিমনি, কিউরিক, ক্লোরাইড, সোডা, বিট্রিয়ল, সল্ট অ্যামোনিক এবং লেড এসিটেড এর জনক কে- তিনি-ই জাবির ইবনে হাইয়্যান। হাম ও বসন্ত রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে কে প্রথম কলম ধরেন? তিনি হলেন মোহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া। তাঁর গ্রন্থের নাম হলো ‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’। বিশ্বের অস্ত্র চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে অবদান বেশি, কর্ডোভা হাসপাতালের বিখ্যাত অস্ত্রো চিকিৎসক আবুল কাসেম আল জাহরাবি। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন মুসলিম বিজ্ঞানী আবুল হাসান। সেই সময়ের বড় বড় কয়েকটি লাইব্রেরি হলো- খলিফা মামুন প্রতিষ্ঠিত বাগদাদের একটি লাইব্রেরি দারুল হিকমা। সেখানে রক্ষিত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ। আর এ লাইব্রেরি তৈরি করতে তার খরচ হয়েছিল সেই সময়ের সাত বিলিয়ন ডলার। কায়রোতে ছিলো ‘সুলতান লাইব্রেরি’ যেখানে বইয়ের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। ইসরাইল গবেষণাকর্মে ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে প্রতি বছরে। আর সকল আরব রাষ্ট্রগুলোর একত্রে ব্যয় করে ৫৩৫ মিলিয়ন ডলার। আমেরিকা একাই ব্যয় করে ১৬৮ বিলিয়ন ডলার, যা সমস্ত দুনিয়ার মোট বরাদ্দের ৩২ ভাগ। এরপর জাপান ১৩০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয় গবেষণা খাতে। এখন জানতে ইচ্ছে হয় কতজন আন্তর্জাতিক মানের গবেষক আছে আরব দেশগুলোতে? উত্তরে বলতে হবে একজনও নেই। কিন্তু শুধু ইসরাইলে আন্তর্জাতিক মানের ২৪ হাজার গবেষক আছে। এবং ইসরাইল জাতির বাজেটের ৩৪.৬ অংশ ব্যয় করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকর্মে। বর্তমান এ সঙ্কটে মুসলিম জাতির মুক্তির জন্য ঈমানদার, খোদাভীরু, সৎ ও যোগ্য পন্ডিত তৈরির জন্য কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা পালনের ও আমলের বিকল্প নেই। ইসলাম যেহেতু কালজয়ী ধর্ম, বিজয়ী আদর্শ ও বাস্তবভিত্তিক ধর্ম তাই গবেষণার ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টিতে এবং দিবা-রাত্রির আবর্তনের মধ্যে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করোনি। সব পবিত্রতা একমাত্র তোমারই। আমাদেরকে তুমি দোজখের শাস্তি থেকে বাঁচাও।” (সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১) কুরআনের হুকুম আমরা পালন করছি না, করছে আমেরিকা, তারা প্রতিষ্ঠা করেছে নাসা, তারা গবেষণা করছে চাঁদে, গবেষণা যান পাঠাচ্ছে মঙ্গল গ্রহে। আমরা মুসলিম জাতি বসে বসে তাদের প্রশংসায় সময় অতিবাহিত করছি। অথচ আল্লাহ বলছেন, “যারা জানে আর জানে না; তারা কি সমান হতে পারে? চিন্তা-ভাবনা কেবল তারাই করে, যারা বুদ্ধিমান।” (৩৯ : ৯) এখানে আল্লাহ অশিক্ষিতদেরকে অন্ধের সাথে তুলনা করেছেন, যারা গবেষণা করে না তাদেরকে বুদ্ধিহীন বলেছেন। আরো বলছেন যারা বুদ্ধিমান তোমরাই কেবল চিন্তা-ভাবনা করো। এখন মুসলিম জাতিকে বুদ্ধিমান হতে হলে আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে হলে গবেষণার বিকল্প কি হতে পারে? একজন পরিপূর্ণ মুসলিম কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে না? কুরআনিক বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে না? যদি আমরা ঈমানদার হতে চাই তাহলে অবশ্যই কুরআন-হাদিসের আলোকে, বাস্তবতার জ্ঞানে-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। আর যদি কোন মুসলিম পরিপূর্ণ ঈমানদার ও এর সাথে সাথে গবেষকও হতে পারে তাহলে আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেবেন। যেমন- আল্লাহ বলেন- “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দেন।” (৫৮ : ১১) এ ছাড়াও আবু হুরাইরা রা: বর্ণনা করেন। রাসূল সা: বলেন, যদি কোন ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের জন্য ঘর থেকে বের হয়, তাহলে আল্লাহ তার জান্নাতে যাবার রাস্তা সহজ করে দেন। (তিরমিজি) এখানে রাসূল সা: বুঝাতে চেয়েছেন জ্ঞান অর্জন করাটাও একটি ইবাদত। আর আল্লাহ এর প্রতিদানস্বরূপ ঐ ব্যক্তিকে জান্নাত দান করবেন। তাহলে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ও জিহাদ যেমন ফরজ, ঠিক তেমনি প্রত্যেক মুমিনের জন্য জ্ঞান অর্জন করাও একটি ফরজ যেখান থেকে বিরত থাকা কোন মুমিনের উচিত নয়। লেখক : কেন্দ্রীয় গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির