post

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক

২৩ মে ২০১৯

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক-মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য । আতিকুর রহমানইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ হিসেবে অন্যান্য সকল দিকের মতো শ্রমজীবী মানুষদের সব সমস্যার সার্বিক ও ন্যায়ানুগ সমাধানের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম চায় শ্রমিক ও মালিকের সৌহার্দ্যমূলক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন এক বিধানের প্রচলন করতে, যেখানে দুর্বল শ্রেণীকে শোষণ-নিপীড়নে পিষ্ট করার জঘন্য প্রবণতা থাকবে না। শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকের সম্পর্ক, আচার-ব্যবহার কী রকম হবে সে সম্পর্কে ইসলামের সুন্দর নীতিমালা রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক ও মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক ভৃত্য-মনিবের সম্পর্ক নয়। ইসলামে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের ও সাহায্যকারীর। নিজের পরম আত্মীয়ের মতোই শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যদের মতই তাদের আপ্যায়ন করা, শ্রমিকের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করাকে ইসলাম মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে শামিল করেছে। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘আপন সন্তান-সন্ততির মতো শ্রমিকদের মানসম্মানের সাথে তত্ত্বাবধান করো। আর তাদের তা খেতে দেবে, যা তোমরা নিজেরা খেয়ে থাকো।’ (মিশকাত, ইবনে মাজাহ) শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ককে ভাই ভাই উল্লেখ করে রাসূল (সা) শ্রমিকদের অধিকার ও পাওনার ব্যাপারে যে উক্তি করেছিলেন তা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। মহানবী (সা) বলেছেন, ‘মজুর-শ্রমিক ও ভৃত্যদের যথারীতি থাকা ও পোশাক দিতে হবে।’ মহানবী (সা) শ্রমিককে আপনজনের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের আপনজন ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে যেমন ব্যবহার কর, তাদের সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করবে।’ একই কথা মহানবী (সা) আরেক হাদিসে উল্লেখ করেছেন এভাবে, ‘তোমরা অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোন রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না, তাদেরও তোমাদের মতো একটি হৃদয় আছে। ব্যথা দানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন কর না।’ (বুখারি) মালিকরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিকদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করবে সে সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেছেন, ‘এরা (শ্রমিকরা) তোমাদের ভাই, আল্লাহ এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যে ব্যক্তির ভাইকে তার অধীন করে দিয়েছেন, তার উচিত সে যা খাবে তাকেও তা খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তা পরাবে, আর যে কাজ তার পক্ষে সম্ভব নয়, সে কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেবে না। আর যদি কষ্ট দেয় তাতে নিজেও তাকে সাহায্য করবে।’ (আহমদ ৫/১৬৮, আবু দাউদ ২/৩৩৭)। রাসূল (সা) আরও বলেছেন, ‘তোমার যে পরিমাণ কাজ অনায়াসে করতে পারবে, সে পরিমাণ কাজই তোমরা (তোমাদের অধীনস্থদের জন্য) আয়োজন কর।’ (নাসাঈ, ইবনে মাযাহ) ইসলাম মালিককে সহনশীল হতে শিক্ষা দেয় এবং শ্রমিকের দোষত্রুটি ক্ষমা করে দিতে উৎসাহিত করে। শ্রমিকের প্রতি মালিক যাতে সহনশীল থাকে এবং তার ভুলত্রুটি ক্ষমার মতো মহৎ মনের অধিকারী হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে রাসুল (সা) এক হাদিসে বলেছেন, ‘মজুর চাকরদের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্ত্বের লক্ষণ। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেছেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (সা) এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা) চাকর-বাকরের অপরাধ আমি কতবার ক্ষমা করব? রাসুল (সা) চুপ রইলেন। সে পুনরায় তাঁকে প্রশ্ন করলে এবারও তিনি চুপ রইলেন। সে পুনরায় তাঁকে প্রশ্ন করলে এবারও তিনি চুপ রইলেন। চতুর্থবার বলার পর বললেন, ‘প্রত্যেক দিন সত্তরবার তাকে ক্ষমা করবে। (আবু দাউদ) মালিকের অভদ্র আচরণকে ঘৃণা করে রাসূল (সা) বলেছেন, “অসদাচরণকারী মালিক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” রাসূল (সা) নিজের জীবনে এ আদর্শগুলো বাস্তবায়ন করে মানব জাতির নিকট দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। রাসূল (সা) এর একান্ত খাদেম হজরত আনাস (রা) বলেন, ‘আমি নবী (সা) এর অধীনে দশ বছর কাজ করেছি, তাঁর খেদমত করেছি। কিন্তু তিনি কোনো দিন আমাকে ভর্ৎসনা করেননি। কোনো দিন বলেননি, এটা এভাবে কেন করেছ, ওটা ওভাবে কেন করোনি? (বুখারি) রাসূল (সা)-এর অনুকরণে তার সাহাবায়ে কেরামও তাদের অধীনস্থদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। একদা হযরত ওমর (রা) আপস চুক্তি সম্পাদনের জন্য যখন বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে রওনা হলেন তখন তিনি এবং তার ভৃত্য পালাক্রমে উটের ওপর সওয়ার হয়ে মদিনা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত দীর্ঘপথ অতিক্রম করেছিলেন। এমনকি বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছার পর সেখানকার লোকেরা বুঝতে পারেনি এ দু’য়ের মধ্যে কে আমিরুল মুমিনীন!। কবির ভাষায়- ‘ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি/ মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।’ (কাজী নজরুল ইসলাম)

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক-মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য । আতিকুর রহমানইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার: শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে ইসলাম যতটা গুরুত্ব দিয়েছে পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম বা চিন্তাদর্শে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাইতো রাসূলুল্লাহ (সা) শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের অধিকার প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হলো।

১. উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাবার অধিকার: শ্রমের সাথে পারিশ্রমিকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। শ্রমের বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া একজন শ্রমিকের অধিকার। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ১৫০ জায়গায় শ্রম/আমল এবং তার পারিশ্রমিক বা আজর এর কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই যারা ঈমান গ্রহণ করলো এবং সৎকর্ম সম্পাদন করলো তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত পুরস্কার (পারিশ্রমিক/ফল)।” এ আয়াতসহ অন্যান্য আয়াতে যদিও আখিরাতে দ্বীনি কাজের জন্য আল্লাহ পুরস্কারের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তা শুধু আখিরাতের সাথেই সম্পৃক্ত নয়। দুনিয়ার কাজের ব্যাপারেও যেখানেই শ্রম থাকবে সেখানেই পারিশ্রমিক থাকতে হবে। একজন শ্রমিক অন্যেক কাজ করে অর্থের প্রয়োজনে। তিনি তার শ্রম দিচ্ছেন নিজের জীবন পরিচালনা এবং তার পোষ্যদের ভরণ-পোষণ নির্বাহ করার জন্য। তাই তাকে যিনি শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করবেন উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়া তার নৈতিক দায়িত্ব। ইসলামী বিধানে শ্রমিক, চাষি এবং অন্যান্য শ্রমজীবীকে কেউ বিনা পারিশ্রমিক খাটাতে পারে না। ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে শ্রমিকের কাজের ফল বা মজুরি কিংবা পারিশ্রমিক যথাযথ দেয়া এবং কোনোরকম জুলুম-অন্যায়, নিপীড়ন, শোষণ করা উচিত নয়। যদি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ আলোচনার ভিত্তিতে শ্রমিককে নির্ধারিত পারিশ্রমিক প্রদান না করে, তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক কমিয়ে দেয় কিংবা ঠকিয়ে দেয় তিনি হবেন আল্লাহর দৃষ্টিতে জালিম। আর জালিমের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তার কোনো সাহায্যকারী কিয়ামতে থাকবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, “প্রত্যেকের মর্যাদা তার কাজ অনুযায়ী, এটা এজন্য যে, আল্লাহ প্রত্যেকের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দিবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না ।” (সূরা আহকাফ : ১৯) অনেক সময় শ্রমিকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মালিকগণ উপযুক্ত মজুরি প্রদান না করে ইচ্ছামত মজুরি দেন এবং শ্রমিকদের বঞ্চিত করেন ও ঠকান। আর শ্রমিকগণ নীরবে তা সহ্য করে থাকে। এ ধরনের কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ যদি শ্রমিকের মজুরি না দেয় অথবা দিতে গড়িমসি করে, তার বিষয়ে বলতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হবো। আর আমি যাদের প্রতিপক্ষ হবো, তাদেরকে পরাজিত করেই ছাড়ব। তাদের একজন হলো, এমন ব্যক্তি যে কাউকে মজুর নিয়োগ করে পুরোপুরি কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তাকে তার পারিশ্রমিক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে দেয় না (বুখারি)

২.পারিতোষিক পূর্বেই নির্ধারণ করার অধিকার: ইসলামী বিধান মতে, মালিকের কর্তব্য হচ্ছে শ্রমিক নিয়োগের আগে অবশ্যই তার মজুরি নির্ধারণ করে দিতে হবে। নবী করিম (সা) নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, ‘কাজের পারিতোষিক/পারিশ্রমিক নির্ধারণ ব্যতিরেকে কোনো শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করবে না।’ (বুখারি,বায়হাকি) রাসূল (সা)-এর আরো নির্দেশনা হচ্ছে, “যে ব্যক্তি কোন শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করতে চায়, সে যেন পূর্বেই তার পারিতোষিক নির্ধারণ করে নেয়।” অর্থাৎ শ্রমিকের বেতন যতক্ষণ পর্যন্ত স্থিরীকৃত না হবে এবং সন্তুষ্ট মনে সে তা গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ বলপূর্বক তাকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না। হযরত শোয়াইব (আ) হযরত মুসা (আ)কে চাকরির শর্তাবলি শোনানোর পরে একজন মালিক হিসেবে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে এই নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলেন : “আমি তোমার ওপর কড়াকড়ি করতে চাই না। তুমি ইনশাআল্লাহ আমাকে সৎ হিসেবেই পাবে।” (সূরা কাসাস : ২৭) অর্থাৎ যেসব শর্ত স্থিরিকৃত হয়েছে তা আমি যথাযথভাবে অনুসরণ করব। তার চাইতে অধিক শ্রম তোমার কাছে চাইব না এবং যে পারিতোষিক নির্ধারণ করা হয়েছে তার পুরাটাই পরিশোধ করব। এ ব্যাপারে তুমি আমারও সদাচারী পাবে।

৩. কাজ শেষে বিলম্ব ব্যতিরেকে পারিশ্রমিক পাবার অধিকার: শ্রমিককে পরিশ্রম শেষে বা কাজ সম্পাদন করামাত্রই অনতিবিলম্বে তার মজুরি দেওয়া বা প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের সর্বপ্রধান দায়িত্ব। রাসূল (সা) বলেছেন, ‘শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।” অর্থাৎ শর্তানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হবে। কোনোভাবেই তাকে হয়রানি কিংবা ধোঁকা দেয়া যাবে না। অন্য হাদিসে রাসূল (সা) বলেছেন : “ধনীর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও পরের হক আদায় করতে বিলম্ব করা জুলুম।” ইসলামের বক্তব্য হলো- শর্তানুযায়ী এবং ওয়াদা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পরিশোধ না করলে তা মুনাফেকি। আর মুনাফেকি করা হরাম। রাসূল (সা) বলেন- “মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে আর যখন তার কাছে কোনো জিনিস আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে।”

৪. সাধ্য/সামর্থ্যরে বাইরে কাজ না করার অধিকার: শ্রমিকের ইসলাম স্বীকৃত একটি অধিকার হলো মালিক পক্ষ থেকে তাকে এমন কাজ দেয়া যাবে না যা তার সাধ্য ও সামর্থ্যরে বাইরে। যদি মালিকপক্ষ এমন কাজ দেয় যা তার শর্তের আওতায় নয় কিংবা শারীরিক ও মানসিকভাবে মেনে নেয়ার মতো নয় কিংবা যে কাজটি চাপিয়ে দিলে ভবিষ্যতে তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে তবে শ্রমিকের সে কাজটি না করে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে। হযরত মুসা (আ) যখন হয়রত শুআইব (আ)-কে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিলেন তখন বললেন- “আমি তোমার ওপর কঠিন কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।” ইসলামের একটি মূলনীতিই হলো সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে না দেয়া। আল্লাহ তাআলা সে কথা এভাবে বলেন- “আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে/নফসকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না।” হজরত ওমর (রা) অভ্যাস ছিল যে, “তিনি প্রত্যেক শনিবার মদিনার আশপাশে তদারকি করতেন এবং কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে নিয়োজিত দেখলে তার কাজের বোঝা লাঘব করে দিতেন।” (মুয়াত্তা মালিক) কাজেই শ্রমিক দিয়ে এমন ধরনের কাজ করানো আদৌ সঙ্গত হবে না যা তার জন্য অতি কষ্টকর বা সাধ্যাতীত। সর্বদা মনে রাখতে হবে শ্রমিক মালিকের হাতের ক্রীড়নক নয় বরং সে তারই সমমর্যাদার অধিকারী স্বাধীন এক সত্তা। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনে হাযম (র) বলেন, ‘মালিকের জন্য উচিত শ্রমিকের নিকট থেকে ততটুকু কাজ নেওয়া, যতটুকু সে সামর্থ্য অনুযায়ী অনায়াসে সুষ্ঠুভাবে করতে পারে।’

৫. শক্তি কমে গেলেও শ্রমিকের কাজে অব্যাহত থাকার অধিকার: কোনো শ্রমিককে মালিকপক্ষ যদি যুবক থাকা অবস্থায় নিয়োগ দান করেন আর জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বার্ধ্যক্যের কারণে কিংবা অসুস্থতার কারণে কাজে কিছুটা অক্ষমও হয়ে পড়ে তবে সে শ্রমিককে বিদায় দেয়ার অধিকার মালিকের নেই। শ্রমিকের সে অবস্থায়ও কাজে অব্যাহত থাকার অধিকার রয়েছে। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনো সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে কর্ম থেকে বিদায় নিতে বা দিতে কোনো অসুবিধা নেই। এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এর জীবন কালের একটি ঘটনা প্রতিধানযোগ্য। রাসূলের জামানায় এক ব্যক্তি তার একটি উটকে যুবক থাকতে কঠিন কঠিন বোঝা চাপিয়ে দিতো। এক পর্যায়ে উটটি বৃদ্ধ হয়ে গেলে সে উটটিকে ভরণপোষণের দায় থেকে বাঁচার জন্য জবেহ করার ইচ্ছে পোষণ করলে রাসূল (সা) তাকে বললেন- “তুমি ওর যৌবনকাল খেয়ে ফেলেছো আর যখন বৃদ্ধ হয়েছে তখন তুমি তাকে জবেহ করতে ইচ্ছে করেছো।” তখন ঐ ব্যক্তি উটটিকে ছেড়ে দিলো।

৬. যথাযথ সম্মান পাবার অধিকার: ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি মানুষ সম্মানিত। অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকেই মানুষ হিসেবে সম্মান পাবার অধিকার সংরক্ষণ করে। সে ধনী হোক কি গরিব হোক, শ্রমিক হোক কি মালিক হোক। শ্রমিক সাধারণ শ্রেণির বলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় মালিকপক্ষ তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল করেন, তাকে অপছন্দনীয় উপনামে ডাকাডাকি করেন, অযথা কষ্ট দেন কিংবা মাঝে মধ্যে তার সাথে এমন আচরণ করেন যেন মনে হয় সে কোনো মানুষই নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে তা অবৈধ ও হারাম। শ্রমিক যত সাধারণই হোক না কেন তাকে সাধারণ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা মানুষের মর্যাদা রক্ষায় বলেন- “নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।” রাসূল (সা) বলেন- “একজন মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের জীবন, সম্পদ ও সম্মান হানি করা হারাম।” আল্লাহর রাসূল (সা) শ্রমিকের সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের নিমিত্তে শ্রমিকের সাথে বসে খেতেন। তিনি শ্রমিককে সেসব খাবার খাওয়াতে বলেছেন যা মালিক খাবেন, সেসব পোশাক-পরিচ্ছদ পরাতে বলেছেন যা মালিক পরিধান করবে। এর মানে হলো শ্রমিককে অন্য বস্ত্র ও বাসস্থানের ক্ষেত্রে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। তাকে অমর্যাদাকর খাবার কিংবা বস্ত্র পড়ানোর ব্যবস্থা করা যাবে না।

৭. ধর্ম কর্ম পালন করার অধিকার: ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক সর্বাবস্থায় স্বীয় ধর্ম কর্ম পালন করার অধিকার সংরক্ষণ করবে। মালিকের পক্ষ থেকে শ্রমিককে মৌলিক ধর্ম কর্ম পালন করার প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া কর্তব্য এবং এ ব্যাপারে কোন ধরনের বাধা প্রদান করা যাবে না। যদি কোন মালিক তার প্রতিষ্ঠানে ধর্ম কর্ম পালন করার সুযোগ না দেন কিংবা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন তবে আল্লাহর ভাষায় সে চরম ভ্রষ্টতার মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে। আল্লাহ বলেন- “যারা পার্থিব জীবনকে ভালোবাসে এবং আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় ও তাতে বক্রতা সৃষ্টি করে তারা চরম ভ্রষ্টতার মধ্যে নিপতিত। মুসলমান শ্রমিক হলে তাকে ফরয নামাজ, ফরজ রোযা পালন করার জন্য সুযোগ দিতে হবে। কোনো মালিক যদি শ্রমিককে ফরয পালনের সুযোগ না দেন তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সে শ্রমিক মালিকের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করতে পারবে। কারণ ধর্ম পালন করার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত একটি অধিকার।

৮. ন্যায়সঙ্গত পারিশ্রমিক পাবার অধিকার: ইসলামে শ্রমিকদেরকে ন্যায়সঙ্গত পারিশ্রমিক দেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছে। শ্রমিকদেরকে দেশে প্রচলিত রীতি অনুসারে উপযুক্ত আহার্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ দিতে হবে। (মুয়াত্তা মালিক) অর্থাৎ মজুরির পরিমাণ এরূপ হবে যেন তা কোন দেশ ও যুগের স্বাভাবিক অবস্থা ও চাহিদা অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত হয় এবং উপার্জনকারী তার উপার্জন দ্বারা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে। এক কথায় মালিক তার লালন-পালনের পরিপূর্ণ জিম্মাদার। মালিকের পক্ষে যদি শ্রমিককে এই পরিমাণ মজুরি দেয়া সম্ভব না হয়, যা দিয়ে সে তার ন্যায়ানুগ ও স্বাভাবিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তার প্রয়োজন পূর্ণ করা হবে। রাসূল (সা) এর নিম্নোক্ত হাদিসটিই এর প্রমাণ: “যে ব্যক্তি আমাদের (অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের) কোন কাজের দায়িত্ব পালন করবে, তার যদি স্ত্রী না থাকে, তাহলে সে যেন বিবাহ করে নেয়। আর তার যদি কোন আবাস না থাকে, তাহলে সে যেন একটি আবাস গ্রহণ করে। আর যদি তার কোন বাহন না থাকে তবে যেন সে একটি বাহন গ্রহণ করে। যদি তার খাদিমের প্রয়োজন হয়, তাহলে যেন খাদিম গ্রহণ করে। এগুলোর বাহিরে যদি সে কিছু নেয় পুঞ্জীভূত করার জন্য, তাহলে সে পরকালে চোর বা আত্মসাৎকারী হিসেবে উত্থিত হবে।” এই হাদিসটি সরকারি কর্মচারীদের ব্যাপারে বলা হলেও এর বিধান সর্বশ্রেণীর শ্রমিকদের ওপর প্রযোজ্য। যেহেতু উভয় ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন কারণই কার্যকর রয়েছে। আর তা হচ্ছে তার প্রয়োজন মিটানো। যেন মানসিক স্থিতিশীলতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে শ্রম দিতে পারে। তা ছাড়া, তারা সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। প্রজাদের সুখ-শান্তি বিধান করাইতো ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মহানবী (সা) এ জন্যই বলেছেন : “ইমাম বা রাষ্ট্রপতি (প্রজাদের ব্যাপারে) দায়িত্বশীল। তাকে প্রজাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” এ জন্যই হজরত ওমর (রা) বলতেন, “ফোরাতের তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবো?” আরো বলতেন : “বাগদাদের রাস্তায় পথ চলতে গিয়ে একটি গাধাও যদি পা পিছলে পড়ে যায়, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবো? কারণ রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামত করার দায়িত্বতো আমার।” একদা একজন মালিক এসে খলিফা ওমর (রা)কে তার শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নালিশ করল যে, তারা আমার জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে গেছে। ওমর (রা) শ্রমিকদের এর সত্যতা ও কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা জানায় যে, মালিক তাদেরকে ন্যায়সঙ্গত পারিশ্রমিক দিচ্ছে না, যা দিয়ে তাদের জীবনের মৌলিক প্রয়োজনাদি পূরণ করা সম্ভব। তখন মালিককে ধমক দিয়ে বললেন : “হে চোর.. এরা যদি আবার চুরি করে, তাহলে আমি তোমার হাত কেটে দেবো।” আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলে কারীম (সা) কোনদিন কোন শ্রমিকদের মজুরি কম দেননি।”(বুখারি)

৯. লভ্যাংশের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব লাভ করার অধিকার: ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকদের লাভের মধ্যে অংশীদার হওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এর নিমিত্তে ইসলাম মুদারাবাত, মুজারাআত প্রভৃতি পন্থা নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের মুনাফার অংশীদার হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। নবী করিম (সা) শ্রমিককে মজুরিদান করার পরও তাকে লাভের অংশ দেয়ার জন্যও উপদেশ দিয়ে বলেছেন, ‘শ্রমিকদের তাদের শ্রমার্জিত সম্পদ (লাভ) হতেও অংশ দিও। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।’ (মুসনাদে আহমাদ) অন্য একটি হাদিসে রাসূল (সা) বলেন : “তোমার ভৃত্য যদি তোমার জন্য রান্না করে এবং তা নিয়ে তোমার কাছে আসে, রান্না করার সময় আগুনের তাপ এবং ধোঁয়া তাকে কষ্ট দিয়েছে, তখন কষ্টকে কিছু লাঘবের জন্য তোমার সঙ্গে বসিয়ে তাকে খাওয়াবে।” যে কষ্ট স্বীকার করে রান্না করে তার যেমন রান্না করা খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি যে শ্রমিক টেক্সাইলে কাজ করে, তার শ্রম দিয়ে মালিকের যে মুনাফা হয়, বেতনের বাইরেও তার ওই মুনাফার একটি অংশ ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী তার প্রাপ্য।

১০. বৃদ্ধ বা অসুস্থকালীন বা অক্ষমতাজনিত ভাতা পাওয়ার অধিকার: শ্রমিক বৃদ্ধ, অসুস্থ, পঙ্গু, অসহায় ও অকর্মণ্য হয়ে পড়লে তার জীবিকা নির্বাহের কোন পথই থাকে না, যা দিয়ে সে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করবে। এমতাবস্থায় বৃদ্ধ, পঙ্গু, অসুস্থ, অসহায় ও দুর্বল লোকদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব মালিক তথা সরকারের। তাই সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের সমস্ত প্রয়োজন পূরণ করবে, প্রয়োজন অনুপাতে ভাতা নির্ধারণ এবং তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করবে। ১১. ক্ষতিপূরণের দায়ভার গ্রহণ না করার অধিকার: মিল-কারখানা বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে সেখানে মুনাফা হবার সাথে সাথে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল বা মালিকের সম্পদের ক্ষতি সাধিত হতে পারে। এতে অর্থপিপাসু ও আত্মসর্বস্ব মালিকগণ জঘন্য লালসার বশবর্তী হয়ে শ্রমিকগণের কাজ খারাপের অভিযোগ এনে ক্ষতিপূরণের নামে শোষণ করতে তৎপর হয়ে ওঠে। এটা যথারীতি শ্রমিকের অধিকার হরণ। তাদের শ্রমের যৎকিঞ্চিৎ অবমূল্যায়ন করা যেন না হয় সেদিকে মালিকগণের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ইবনে হাযম (র) বলেন, ‘যাকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রমিক হিসাবে রাখা হয়েছে, তার হাতে যদি ক্ষতি বা কোন কিছু নষ্ট হয়ে যায়, তবে ক্ষতি পূরণের দায়িত্ব শ্রমিকের ওপর বর্তায় না। হ্যাঁ, সে যদি ক্ষতি করার ইচ্ছা নিয়ে তা করে তবে অন্য কথা। আর এই ব্যাপারে কোনো সাক্ষী না থাকলে মজুরের কথাই গ্রহণযোগ্য হবে কসমসহ।’

১২. মালিকের পক্ষ থেকে শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা প্রাপ্তির অধিকার: শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন সাধারণত দারিদ্র্যসীমার একেবারেই নিচে বসবাস করে। তাই তাদের অধিকাংশের মাথা গুঁজার ঠাঁই পর্যন্ত থাকে না। যদিও কিছু লোকের বাসস্থান থাকে, তবে তাদের কাজের তাকিদে নিজ জায়গা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাতে হয়। ফলে তারা হয় উদ্বাস্তু। তারা যেন নিদ্রা ও বিশ্রামসহ সুস্থ থেকে মনোযোগের সঙ্গে কাজ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব মালিকের ওপর বর্তায়। মালিকের পক্ষ থেকে এটি এক ধরনের অনুগ্রহ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি তাদের প্রাপ্য অধিকার। ওমর (রা) সরকারি কর্মচারীদেরকে নির্দেশ দিতে গিয়ে বলতেন, ‘সবচেয়ে ভালো এবং সৎ শাসনকর্তা হচ্ছে সে-ই যার অধীনে সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার সাথে থাকে। আর সবচেয়ে খারাপ শাসনকর্তা সেই, যার প্রজা-সাধারণ অভাব ও অশান্তিতে দিন যাপন করে। মালিকগণ শ্রমিকদের যে অর্থ প্রদান করে থাকে, এতে যদি তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ না হয়, তবে সে স্বীয় প্রয়োজন পূরণার্থে মালিকের নিকট দাবি-দাওয়া পেশ করার অধিকার রাখে। তাদের যথোপযুক্ত দাবি পূরণের কথা উল্লেখ করে মহানবী (সা) বলেন, ‘শ্রমিকদেরকে যথারীতি খাদ্য ও পোশাক দিতে হবে’।

১৩. অবকাশ বা ছুটি পাওয়ার অধিকার: শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বিশ্রাম, আপনজনদের সাথে একত্রে থাকা ও সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার জন্য সাপ্তাহিক ও বাৎসরিক ছুটি প্রয়োজন। বিশ্রামহীনভাবে বা ছুটি ব্যতীত টানা কাজ করতে শ্রমিককে বাধ্য করানো যাবে না। একসঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কাজ করার পর কিংবা নিরবচ্ছিন্ন কয়েকদিন কাজ করলে তাকে ছুটি বা অবসর দিতে হবে। আরাম ও বিশ্রামের সুযোগ করে দিতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “আল্লাহ তোমাদের প্রতি সহজতা ও নম্রতা আরোপ করতে চান, কঠোরতা ও কঠিনতা আরোপ করতে ইচ্ছুক নন।” (সূরা বাকারা : ১৮৫) রাসূলে কারীম (সা) বলেন, “তোমরা সহজ পন্থা অবলম্বন কর, কঠোরতা অবলম্বন করবে না।” নবী করীম (সা) আরো বলেছেন, “তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নেবে, তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও পুণ্য লেখা থাকবে।” (তারগিব ও তারহিব)

১৪. কাজের সময় ও ধরন জানা থাকার অধিকার: মালিক একজন শ্রমিকের দ্বারা কী ধরনের কাজ নেবে এবং কত ঘণ্টা কাজ করতে হবে, তা উভয়পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। রাসূল (সা) বলেছেন, “কাজের প্রকৃতি ও পরিমাণ না জানিয়ে কাউকে কাজে নিয়োগ করা যাবে না।” বর্তমানে আন্তর্জাতিক শ্রমনীতি অনুসারে সকল দেশের এবং সব ধরনের কাজের জন্যেই আট ঘণ্টা সময় নির্ধারিত করা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের বিধান ন্যায়নীতি বিরোধী। কারণ সহজ, হালকা ও ভারী কাজের মধ্যে পার্থক্য, শীত ও গ্রীস্ম প্রধান দেশের মধ্যে কাজের সময়ের পার্থক্য এবং রৌদ্র তাপের মধ্যে আট ঘণ্টা মাটি কাটার কাজ করা আর এয়ারকন্ডিশনে বসে আট ঘণ্টা কাজ করার মধ্যে পার্থক্য থাকা ইনসাফের দাবি। সুতরাং কাজের পরিবেশ ও প্রকৃতি বিবেচনায় কাজের সময় নির্ধারিত হওয়া উচিত। ইনসাফের দাবি হচ্ছে-শ্রমিকের নিকট হতে ততক্ষণ কাজ করে নেয়া যাবে, যতক্ষণ সে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সক্ষম। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, “কারো ওপর সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না।” (সূরা বাকারা : ২৩৩)

১৫. আনুপাতিকভাবে মজুরি পাওয়ার অধিকার: ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিকের শ্রমের অনুপাতে মজুরি নির্ধারণ করা মালিকের কর্তব্য। মালিক শ্রমিকদের ভরণপোষণের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করার অজুহাতে কর্মচারীদের ওপর সক্রিয় শক্তিবলে অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারবে না। কেউ অতিরিক্ত বা অতি উত্তম কাজ করলে বা কাউকে দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করালে তার জন্য অতিরিক্ত মজুরি বা পুরস্কার দিতে হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “যে লোক একবিন্দু পরিমাণ উত্তম কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে।” (সূরা জিলযাল ৭) মালিক যদি অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকের ওপর চাপিয়ে দেয়, তাহলে তাকে সাহায্য করার ব্যাপারে রাসূল (সা) নির্দেশ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “শক্তি সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কাজ শ্রমিকের ওপর চাপাবে না। যদি তার সামর্থ্যরে অতিরিক্ত কোনো কাজ তাকে দাও তাহলে সে কাজে তাকে সাহায্য কর। (বুখারি, মুসলিম)

১৬. সমান কাজের সমান মজুরি পাওয়ার অধিকার: সব মানুষের মেধা ও দক্ষতা সমান নয়। এ কারণে সবার উৎপাদন ক্ষমতাও সমান নয়। আবার বিভিন্ন পরিমাণ উৎপাদনের জন্য সমান পারিশ্রমিক প্রদান যুক্তিসঙ্গত নয়। সমান কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক প্রদানের নীতিমালা গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য। প্রত্যেকের কর্মানুযায়ী তার মর্যাদা নির্ধারিত হয়। কুরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে : “প্রত্যেকের মর্যাদা তার কর্মানুযায়ী, এটা এ জন্য যে, আল্লাহ প্রত্যেকের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।” (সূরা আহ্কাফ : ১৯)

১৭. প্রতিকার চাওয়ার অধিকার: কোনো শ্রমিক যদি যথাযথ অধিকার ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন তবে তার প্রতিকারের অধিকার রয়েছে। তিনি সেজন্য ন্যায় ইনসাফের ভিত্তিতে প্রতিকার চাইতে পারবেন। কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারবেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক-মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক, অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য । আতিকুর রহমানইসলামের দৃষ্টিতে মালিকের প্রতি শ্রমিকের দায়িত্ব-কর্তব্য:

ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ হিসেবে শ্রমিকের প্রাপ্ত অধিকারের বিষয়ে যেমন মৌলিক নির্দেশনা প্রদান করেছে তেমনিভাবে মালিকের প্রতি শ্রমিকের দায়িত্ব-কর্তব্য কী হবে সে বিষয়েও আলোকপাত করেছে। শ্রমিক ও মালিক উভয়কে তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে ইসলাম শ্রমনীতিতে ভারসাম্য আনয়ন করেছে। নিম্নে মালিকের প্রতি শ্রমিকের যে দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে তা উল্লেখ করা হলো।

১. যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা: মালিকের প্রতি একজন শ্রমিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, তিনি যে কাজের জন্য তাকে নিয়োগ দিয়েছেন সে দায়িত্ব যথাযথভাবে সাধ্যমত পালন করা। দায়িত্ব পালনে কোনো গাফিলতি না করা। এ ব্যাপারে রাসূল (সা:) বলেন, “তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল আর তোমাদের প্রত্যেককে সে দায়িত্ব সম্পর্কে জবাব দিতে হবে। একজন শ্রমিক বা কর্মচারী যখন ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করে তাঁর পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে তখনি তা হালাল বা বৈধ উপার্জন হিসেবে বিবেচিত হবে।

২. চুক্তি মোতাবেক প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা: ইসলাম মালিককে শ্রমিকের প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি শ্রমিককেও তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। মালিক তার পুঁজি বিনিয়োগ করেছে বলেই শ্রমিকের জন্য কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। সেহেতু মালিকের অবদানের কথা স্মরণ রেখেই শ্রমিককে চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করতে হবে এবং মালিকের সম্পদ সংরক্ষণে যতœবান হতে হবে। কারণ মালিক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে শ্রমিকের পারিশ্রমিক সে পরিশোধ করবে কী করে? রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “আল্লাহ ঐ শ্রমিককে ভালোবাসেন যে সুন্দরভাবে কার্য সমাধা করে।” কোন শ্রমিক যদি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে, তাহলে তার দ্বিগুণ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে রাসুল (সা) বলেন, “তিন শ্রেণীর লোকের দ্বিগুণ সওয়াব প্রদান করা হবে। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হলো-ঐ শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক্ব আদায় করে এবং আল্লাহর হকও আদায় করে।” (মিশকাত শরিফ : হা/১১)

৩. আমানতদারির সাথে দায়িত্ব পালন করা এবং খেয়ানত না করা: শ্রমিকের দায়িত্ব হলো মালিক কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব আমানতদারিতার সাথে পালন করা। তাতে কোনোভাবে খেয়ানত না করা। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি দায়িত্ব আমানতদারির সাথে পালন করা ফরজ। খেয়ানত করা হারাম। রাসূল (সা) বলেন- “যার আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই আর যার ওয়াদা পালন নেই তার দীন নেই।”

৪. মালিকের সম্পদ চুরি না করা: ইসলাম চুরিকে হারাম করেছে। মালিকের পক্ষ থেকে ন্যায়সঙ্গত পারিশ্রমিক দেয়ার পরও যদি শ্রমিক মালিকের সম্পদ চুরি করে তা হবে অত্যধিক গর্হিত কাজ। রাসূল (সা) বলেন, “যাকে আমরা কোনো দায়িত্ব প্রদান করেছি (কর্মচারী নিয়োগ করেছি) আর তাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দিয়েছি তখন সে তার প্রাপ্য অধিকারের বাইরে যা গ্রহণ করবে তা হবে চুরি পর্যায়ের।”

৫. মালিকের সাথে কোনোরূপ প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ না করা: মালিকের সাথে শ্রম বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শ্রমিকের প্রতারণা করাকে ইসলাম নিষেধ করেছে। রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রতারণা করে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”

৬. কাজে গাফিলতি না করা: ইসলাম কাজে গাফিলতিকে কোনমতেই সমর্থন করে না। আল্লাহ বলেন, “দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন তাদের জন্য মেপে অথবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।” (সূরা মোতাফফিফিন : ১-৩) আয়াতের অর্থ হলো, নিজে নেয়ার সময় কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নেয়। কিন্তু অন্যকে মেপে দিতে গেলে কম দেয়। ফকিহদের মতে, এখানে তাওফিফ বা মাপে কম-বেশি করার অর্থ হলো, পারিশ্রমিক পুরোপুরি আদায় করে নিয়েও কাজে গাফিলতি করা। অর্থাৎ আয়াতে ওই সব শ্রমিকও শামিল যারা মজুরি নিতে কমতি না করলেও কাজে গাফিলতি করে; কাজে ফাঁকি দিয়ে ওই সময় অন্য কাজে লিপ্ত হয় বা সময়টা অলস কাটিয়ে দেয়। তাদেরকে কঠোর শাস্তির হুমকি দেয়া হয়েছে। শ্রমিকের কাজে ফাঁকি দেয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কোনো শ্রমিক যদি মালিকের কাজে ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে বেতন উত্তোলন করে থাকে কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের পরে কাজে উপস্থিত হয়ে তা গোপন করে থাকে এজন্য তাকে কিয়ামতের মাঠে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। রাসূল (সা) বলেছেন, “শ্রমিক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক এবং সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।”

৭. কাজকে নিজের মনে করে সম্পাদন করা: কাজে নিয়োগ পাওয়ার পর শ্রমিক কাজকে নিজের মনে করে সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ পূর্ণ দায়িত্বশীলতার সাথে স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে কাজটি সম্পাদন করে দেয়া তার দায়িত্ব হয়ে যায়।

৮. আখিরাতের সফলতার জন্য কাজ করা: একজন শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন করবে, তা যেন হালাল হয় এবং এর বিনিময়ে সে যেন পরকালীন সফলতা লাভে ধন্য হয় তার প্রতি লক্ষ্য রাখবে। সেবার মানসিকতা নিয়ে পরম আগ্রহ ও আনন্দের সাথে কাজটি সম্পন্ন করাই হবে শ্রমিকের নৈতিক দায়িত্ব।

পরিশেষে বলা যায় ইসলাম মূলত এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় যেখানে শ্রমিক-মালিক সবার অধিকারই সংরক্ষিত থাকবে এবং চাওয়ার আগেই প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দিতে সবাই উদ্বুদ্ধ হবে। এতে উভয়ের মধ্যে সুমধুর সম্পর্ক বিরাজ করবে। কাজেই শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষ যদি ইসলামের প্রদর্শিত নীতিমালা অনুসরণ করে তাহলে একদিকে শ্রমিকদেরকে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হবে না। অন্যদিকে মালিকরাও শ্রমিকদের শোষণ করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসবে। উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং একে-অপরের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এ জন্য শ্রমিকদের অধিকার স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সম্মিলিতভাবে ইসলামী শ্রমনীতি অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আসুন শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা ইসলামী শ্রমনীতি কায়েমের আন্দোলনে শামিল হই এবং মেহনতি মানুষের আর্তনাদ ও আর্তচিৎকার বন্ধ করে তাদের মুখে হাসি ফুটাই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সহায় হোন।

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির