post

ইসলামে ভাষাবিজ্ঞান ও মুসলমানদের দক্ষতা

এম মুহাম্মদ আব্দুল গাফ্ফার

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ভাষা হলো মহান রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠতম দান তাঁর সৃষ্ট জীবদের জন্য। সকল সৃষ্টিজীবের মধ্যে মানুষ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘আমি আদম সন্তানকে শ্রেষ্ঠত্ব বৈশিষ্ট্য দান করেছি, তাদের স্থল ও জল পথে যানবাহন দান করেছি এবং তাদেরকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জিনিস দ্বারা রিজিক দিয়েছি, আমাদের বহুসংখ্যক সৃষ্টির ওপর সুস্পষ্ট প্রাধান্য দান করেছি, এসব আমারই একান্ত দয়া ও অনুগ্রহ।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০)।

মহান রাব্বুল আলামিন মহানবী সা.-এর প্রতি যে প্রথম ওহি নাজিল করেছিলেন তার প্রথম বাক্যই ছিলো পাঠ সংক্রান্ত। যেমন মহানবী সা.-কে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করেন ‘পড়ো, (হে নবী) তোমার রবের নাম সহকারে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। জমাট বাঁধা রক্তের এক পিণ্ড হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, আর তোমার রব বড়ই অনুগ্রহশীল, যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন।’ (সূরা আলাক : ১, ২, ৩, ৪)। পবিত্র কুরআনুল কারীমের এ আয়াতগুলো দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা স্বচ্ছ সুন্দর ভাষার দ্বারা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পরিচিতি উপস্থাপন ও মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুগ্রহের বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

স্বচ্ছ সুন্দর ভাষায় আল্লাহর কালাম যে লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত এবং অত্যন্ত সাবলীল ও পরিমার্জিত ভাষায় তা অবতীর্ণ হয় সে কথা অকাট্য প্রমাণে স্বীকৃত। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘বরং এ কুরআন অতীব উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সুরক্ষিত ফলকে (লিপিবদ্ধ)।’ (সূরা বুরুজ)। পবিত্র কুরআনুল কারীমের ভাষা বুঝার পক্ষে সহজ হলেও আরবি ব্যাকরণের মাপকাঠিতে তা অত্যন্ত উচ্চ স্তরের সুসামঞ্জস্যময়। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন ‘আমি এ কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল করেছি, যেন তোমরা (আরববাসীরা) একে ভালো করে বুঝতে পারো, হে রাসূল! আমি এ কুরআনকে তোমার প্রতি ওহি করে অতি উত্তম ভঙ্গিতে ঘটনা ও প্রকৃত ব্যাপারসমূহ তোমার নিকট বর্ণনা করছি, নতুবা এর পূর্বে (এসব বিষয়) তুমি সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলে।’ (সূরা ইউসুফ : ২, ৩)। পবিত্র কুরআনুল কারীমে এ ধরনের আরো বহুসংখ্যক আয়াত রয়েছে যাতে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সংশ্লিষ্টতা সমুজ্জ্বল।

পবিত্র কুরআন ও হাদিস বিশদভাবে পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় যে, তাতে স্বচ্ছ, সুন্দর সহজ সরল অথচ উচ্চাঙ্গের প্রকাশ ভঙ্গিতে পরিপূর্ণ শব্দসম্ভার অতি প্রাঞ্জল মহিমায় উদ্ভাসিত। গোটা আরব জাহানে আরবি ভাষা বলা বা লেখার বিভিন্ন রূপ বিদ্যমান ছিল, তার মধ্যে কাবাকেন্দ্রিক কুরাইশদের ভাষাই ছিল উচ্চারণের দিক থেকে নির্ভুলতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। যে সময়ে আরব জাহানের সাহিত্য জগতে বক্তৃতা ও কাব্যচর্চার চরম উন্নতি তথা উৎকর্ষের যুগ ছিলো তখন ছিলো পবিত্র কুরআনুল কারীম অবতীর্ণের সময়কাল। ঐ সময়ের সাতজন বিখ্যাত কবির বাছাইকৃত কবিতাকে কাবাঘরের ফটকে লটকিয়ে দেওয়া ছিলো যাকে সাবআ মুআল্লাকা বলা হতো। আরবি ব্যাকরণ ও ভাষার সৌন্দর্যতায় যা ছিলো অতুলনীয়। ঐ সময়কালে আল্লাহর দেওয়া বিধান নাজিল হয় যা আরব পণ্ডিতদের সকল বাহাদুরিকে ম্লান করে দেয়। এ মর্মে মহান রাব্বুল আলামিনের চ্যালেঞ্জ এভাবে এসেছে ‘আমার এ বান্দার প্রতি যে কিতাব নাজিল করেছি (তা আমার নাজিলকৃত কিনা?) সে বিষয়ে তোমাদের মনে যদি কোনো প্রকার সন্দেহ জেগে থাকে তবে উহার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে আনো, এ জন্য তোমাদের সকল সমর্থকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করো এক আল্লাহ ভিন্ন আর যার যার সাহায্য সহযোগিতা চাও তা গ্রহণ করো: তোমরা সত্যবাদী হলে এ কাজ অবশ্যই করে দেখাবে। কিন্তু তোমরা যদি তা না করো নিশ্চয়তা কখনো করতে পারবে না ....।’ (সূরা বাকারা : ২৩, ২৪)। মহান রাব্বুল আলামিনের ঐ ঘোষণার চ্যালেঞ্জ আজ পর্যন্ত বহাল আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। ঐ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা কেউ করতে পারবে না। 

আমি যে কথা বলছিলাম তা হলো পবিত্র কুরআনুল কারীম বর্তমানে যে আরবি ব্যাকরণ সম্মত উচ্চারণে সংরক্ষিত ও পঠিত হচ্ছে তা হলো মহানবী সা.-এর বংশের স্বচ্ছ সুন্দর আরবি ভাষায়। হজরত জিবরাইল (আ.) বিশ্বনবী সা.-এর নিকট যে সাহাবীর রা. আকৃতিতে প্রায়ই ওহি নিয়ে আসতেন তিনি ছিলেন দাহিয়্যাল ক্বালবি। হজরত দাহিয়্যাল ক্বালবি রা.-এর আরবি উচ্চারণ ছিল সুন্দর, সাবলীল ও পরিমার্জিত। মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা.-এর শাসনামলে পবিত্র কুরআনুল কারীমকে গ্রন্থাকারে রূপ দেওয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয় এবং একটি বোর্ডও গঠন করা হয়। এই বোর্ডের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত ভাষাবিশেষজ্ঞ সাহাবি হজরত যায়েদ ইবনে সাবিত রা.। এই ওহি লেখক সাহাবি তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ও যোগ্যতা বলে নজিরবিহীন পরিশ্রমের দ্বারা মহাগ্রন্থ আল কুরআনকে সূচিবদ্ধ বই রূপে একত্রিত করেন। এ মহাগ্রন্থ যখন একত্রিত করা হয় তখন এর প্রতিটি শব্দ, আয়াত ও সূরার ক্রমধারা এমনভাবে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাজানো হয়েছে যাতে মহান রাব্বুল আলামিনের দেওয়া নির্দেশনার ব্যতিক্রমের কোনো সুযোগই নেই।

তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা.-এর সময়ে পবিত্র কুরআনুল কারিমের পঠন-পাঠনে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছুটা আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব পরিলক্ষিত হলে সরকার কর্তৃক তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং ঐ সমস্ত আঞ্চলিক সংস্করণগুলো নষ্ট করে দিয়ে হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর আমলে আল কুরআনের মূল কপি নকল করে বিভিন্ন প্রদেশে প্রেরণ করা হয়। এভাবে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ভাষা, ভাব ও অর্থের বিশুদ্ধতা অটুটভাবে সংরক্ষিত হয়। এভাবেই মহানবী সা.-এর হাদিস সংগ্রহের ক্ষেত্রেও বর্ণনাকারীদের তাকওয়া, সততার সাথে সাথে তাদের উদ্ভাবনী ও বিশ্লেষণ শক্তি এবং বিশুদ্ধ আরবি শব্দ ও বাক্যের সঠিক অর্থ নিরূপন ও মর্ম উদ্ধারের বিচক্ষণতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হতো। 

মুসলিম জাহানের খলিফা ও প্রখ্যাত বাগ্মী হজরত আলী রা.-এর পরামর্শক্রমে আসওয়াদ নামক জনৈক ভাষাতত্ত্ববিদ প্রথম আরবি ব্যাকরণ রচনায় মনোনিবেশ করেন। তার রচিত আরবি ব্যাকরণ বইটি ‘ইলমে নাহু’ হিসেবে আরবি ভাষায় খ্যাতিলাভ করেছে এবং যা আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অপরিহার্য সাবজেক্ট হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। এভাবে প্রত্যেক যুগেই মুসলিম মনীষীগণ নিজ নিজ ভাষার সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের যে কৃতিত্ব তা বর্ণনা করতে গেলে বিশাল গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন তা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।

বিগত শতাব্দীর ও মুসলিম ভাষাবিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা উৎকর্ষের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন তা স্মরণীয়। ১৯৫২ সালে ঢাকায় মুসলিম ছেলেরাই মাতৃভাষার দাবিতে জান কুরবান করেছিল। ১৯৫২ সনের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য উদ্দেশ্যই বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বাংলা ভাষার সার্বিক উন্নয়ন। ভাষাবিজ্ঞানে বাংলার মুসলিম মনীষীগণ যে ভূমিকা পালন করেছেন তা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ প্রসঙ্গে বহুভাষাবিদ ডক্টর শহীদুল্লাহ, ডক্টর এনামুল হক, সৈয়দ মুজতবা আলীসহ অনেকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় দু’ ডজন ভাষার সুপণ্ডিত ছিলেন। তিনি মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও অনেকগুলো ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং বহু ভাষার গ্রামার লিখেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি ভি গিরি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ঢাকায় তাকে দেওয়া এক নাগরিক সংবর্ধনার জবাবে তিনি বহু ভাষার সুপণ্ডিত ডক্টর শহীদুল্লাহর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিলেন। 

ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলাম ও মুসলিম জাতি যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে সে ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য সবাইকে সচেতন হবার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে।

লেখক : সদস্য, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, দরগাহ রোড, সিরাজগঞ্জ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির