post

ইসলামে সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা । আলী আহমাদ মাবরুর

২৬ আগস্ট ২০১৯

ইসলামে সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা । আলী আহমাদ মাবরুরইসলামে সহনশীলতা কোনো কাল্পনিক বিষয় নয়, বরং একেবারেই বাস্তব ও প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। ইসলাম সবসময়ই আমাদেরকে ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়ার তাগিদ দেয় এবং অন্যকে ক্ষমা করার জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করে। কুরআন ও হাদীসেও এই ধরনের অসংখ্য রেফারেন্সও পাওয়া যায়। ইসলামকে সাধারণভাবে বলা হয় দীন আল রাহমা অর্থাৎ করুণা ও দরদসমৃদ্ধ জীবনব্যবস্থা। এ কারণে যারা ইসলামের অনুসরণ করেন তাদেরও উচিত যেখানে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ আছে সেখানে প্রতিশোধ না নিয়ে বরং ক্ষমা করে দেয়া এবং অন্যের ভুলে ক্ষুব্ধ না হয়ে বরং আরো বেশি সহনশীল হওয়া। ধৈর্য আর সহনশীলতা প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে আন্তরিকভাবে ধারণ করা উচিত। কারণ এই দু’টি মানবিক গুণাবলী ঈমানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়। একবার রাসূল (সা) কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘ঈমান কী? রাসূল (সা) উত্তরে বলেছিলেন, ঈমান হলো ধৈর্য ও সহনশীলতা। (তথ্য সূত্র: আল সিলসিলাহ আল সাহিয়াহ: ৫৫৪) ইসলাম অনেক কিছুই সহ্য করে। কিন্তু কোন ধরনের অবিচার, দমন, জুলুম এবং আল্লাহ তায়ালা এবং মানবজাতির অধিকার ক্ষুন্ন করার মতো বিষয়াবলীকে সহ্য করে না। সহনশীলতা ইসলামের মৌলিক একটি নীতি। সহনশীলতা মানে ছাড় দেয়া বা প্রশ্রয় দেয়া নয়। সহনশীলতার অর্থ নীতিহীনতাও বা কম তৎপরতাও নয়। অনেকেই অবশ্য এমনটা মনে করে। তারা মন্তব্য করেন, “অমুক ব্যক্তির নৈতিকতা দুর্বল বলেই সে এই বিষয়টা সহ্য করছে।” এই বাস্তবতা ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে হতে পারে তবে ইসলামের ক্ষেত্রে এই মন্তব্য প্রযোজ্য নয়। ইসলাম সকল ধর্মের প্রতি সহনশীল তার মানে এমনটা নয় যে ইসলাম সকল ধর্মকে একই ধরনের গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম অন্য ধর্মকে হেয় করে না ঠিকই কিন্তু তাই বলে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থানে কোন ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ নেই। ইসলাম অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল মানে এমনও নয় যে, আমরা ইসলামের সুমহান বার্তা নিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝে দাওয়াতি কাজও করতে পারবো না। তবে মনে রাখতে হবে, মিথ্যা আর প্রতারণার ব্যাপারে সহনশীল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ইসলাম ব্যক্তিগত পর্যায়ে, সামষ্টিক পর্যায়ে এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। ইসলামের আওতায় রাজনীতি ও আইন কানুনের ক্ষেত্রে যে বিধান দেয়া হয়েছে তারও মূল মন্ত্র হলো সহনশীলতা। সহনশীলতা হলো এমন একটি কর্মপ্রক্রিয়া যার ভেতর দিয়ে মানবাধিকার, বহুমত এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সহনশীলতার অনেকগুলো স্তর আছে। যেমন- ক) পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা-সন্তান এবং ভাইবোনদের মধ্যকার সহনশীলতা। খ) কোন একটি সংগঠন বা সম্প্রদায়ের মধ্যকার সহনশীলতা তথা পরমতসহিষ্ণুতা, বিভিন্ন ধরনের মত ও চিন্তাধারার প্রতি সহনশীলতা। গ) মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যকার সহনশীলতা আন্তঃসংলাপ, পারস্পরিক সহযোগিতা।

নবীজির (সা) উদাহরণ

কেউ যদি নবীজির (সা) জীবন নিয়ে একটু পর্যালোচনা করে তাহলে দেখবেন, তার কীর্তিময় জীবনে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে যাতে বোঝা যায় যে, তিনি অন্যমত এবং অন্য ধর্মের প্রতি কতটা সহনশীল ছিলেন। পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে সর্বোত্তম চরিত্র ও ব্যবহার দান করেছিলেন। তাই তিনি যে কোন মানুষের সাথে সর্বোত্তম ব্যবহার করতেন এবং যে কোন পরিস্থিতিকে অত্যন্ত মার্জিতভাবে মোকাবেলা করতে পারেন। হযরত মুহাম্মদ (সা) তার জন্মের আগেই পিতাকে হারান। মাত্র ৬ বছর বয়সে তার মাও ইন্তেকাল করেন। এরপর থেকে প্রথমে দাদা ও পরবর্তীতে চাচার কাছে তিনি মানুষ হন। শৈশবে অনেকটা সময় তিনি মেষ পালন করেছেন। এই ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে শৈশব ও কৈশোর কালটি পার হলেও আল্লাহ তাকে উন্নত চরিত্রের শিক্ষা দিয়েছেন, পূববর্তী সকল নবী-রাসূল ও সম্প্রদায়ের ইতিহাস শিখিয়েছেন। একই সঙ্গে রাসূলের (সা) আল্লাহ তায়ালা দেখিয়ে দিয়েছেন যে, পরকালীন মুক্তির জন্য আমাদেরকে কিভাবে জীবন যাপন করতে হবে। আমরা রাসূলের (সা) জীবন থেকে আরো শিখতে পারি যে, অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের পেছনে সময় নষ্ট করা যাবে না। কারণ বাস্তব জীবনে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে, ছোটখাটো এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করার কারণেই আমাদের ভেতর সহনশীল অনুভূতি এখন সেভাবে কাজ করছেনা। রাসূল (সা) কখনোই অনিষ্টকারীদেরকে অনিষ্ট দিয়ে মোকাবেলা করেননি। বরং তিনি তাদেরকে বার বার ক্ষমা করে দিয়েছেন। তিনি নিজের জন্য কখনোই রেগে যাননি, কদাচিৎ দুই একবার তিনি রেগেছেন আর সেটাও পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার সম্মানেই। তিনি সত্যকে সবসময় বরণ করে নিয়েছেন, এমনকি তাতে যদি সাময়িক কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তবুও। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) কে কখনো দুটি জিনিসের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হলে তিনি সবসময় সহজটাকে বেছে নিতেন, যদি না তাতে পাপ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে। তবে যদি এতে সামান্যতম কোন গুনাহ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকতো, তাহলে তিনি এর থেকে শত হাত দূরে থাকতেন। রাসূল (সা) কখনোই নিজের স্বার্থে কোন প্রতিশোধ নেননি। কিন্তু যখন কেউ আল্লাহর শানকে, ইজ্জতকে, পবিত্রতাকে কেউ হুমকির মুখে ফেলেছে, শুধুমাত্র তখনই তিনি প্রতিশোধ নেয়ার কথা ভেবেছেন। (সহীহ আল বুখারি: ৩৩৬৭, সহীহ মুসলিম: ২৩২৭) ইসলামে সহনশীলতাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে রাসূল (সা) এমন কিছু করেননি, যা ইসলাম বহির্ভূত। তিনি তান জীবনেও সহনশীলতার সর্বোচ্চ অনুশীলনটাই করেছেন। রাসূলের (সা) জীবন নিয়ে পর্যালোচনা করলে সহনশীলতার অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। নিচে তার একটি কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো: মক্কার কুরাইশরা ছিল ইসলামের চির শত্রু। নবুওয়াত প্রাপ্তির পর সুদীর্ঘ ১৩ বছর রাসূল (সা) মক্কায় ছিলেন। এই পুরোটা সময় কুরাইশরা তাকে উপহাস করেছে, ঠাট্টা করেছে, বিতর্কিত করেছে, আঘাত করেছে, দুর্ব্যবহার করেছে এবং সর্বোপরি শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার করেছে। রাসূল (সা) যখন নামাজ পড়তেন, তখন কুরাইশরা তার পিঠের ওপর উটের আস্ত নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিতো। তারা নবীজি (সা) এবং তার অনুসারীদেরকে বয়কট করে তাদেরকে সামাজিকভাবে একঘরে করে ফেলেছিল। কুরাইশরা একাধিকবার নবীজিকে (সা) হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এমনকি রাসূল (সা) যখন মদীনায় হিজরতের পথে গমন করেন, তখনও তারা দলবল নিয়ে হত্যা করার জন্য তাকে খুঁজে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু এতকিছুর পর নবীজি (সা) যখন বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন, মক্কাকে বিজয় করেন এবং শহরটিকে সবধরনের পৌত্তলিকতা ও মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত করেন, তখন কাফের কুরাইশদের ১৩ বছরের অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিপরীতে তার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? মুসলমানরা যখন মক্কা জয় করলো, দীর্ঘদিন পর নিজ গৃহে ফেরার আনন্দে যখন তারা উচ্ছ্বসিত, তখন অপরপ্রান্তে রাসূল (সা) মক্কার বাসিন্দাদেরকে একত্রিত করেন। মক্কাবাসীরা তখন রীতিমতো ভয়ে তটস্থ। তারা ভাবছিলো, অতীতের সব বর্বর অত্যাচারের কথা স্মরণ করে মুহাম্মাদ (সা) নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিবেন এবং তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করবেন। যাহোক, মক্কাবাসীরা সবাই জড়ো হওয়ার পর নবীজি (সা) তাদেরকে প্রশ্ন করলেন, “হে কুরাইশ সম্প্রদায়, তোমরা কি মনে করো? আমি এখন তোমাদের সাথে কেমন আচরণ করবো? তারা উত্তর দেয়, “আপনি আমাদের উদার একজন ভাই এবং আমাদের সম্মানিত এক ভাইয়ের সন্তান।” এরপর দয়ার সাগর নবীজি (সা.) তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেন এবং ঘোষণা করেন, কেউ তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা চলে যেতে পারো। তোমরা মুক্ত। (বায়হাকি: ১৮০৫৫) শুধু তাই নয়, মক্কার যে অধিবাসীরা এতদিন পৌত্তলিকতার চর্চায় লিপ্ত ছিলেন, মুসলমানদের ওপর অত্যাচার করেছিলেন তাদের সবার প্রতি নবীজি (সা) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে ক্ষমা ও সহনশীলতার এর চেয়ে বড় কোনো উদাহরণ আর দেখা যায় না। এই ঘটনাগুলো ইসলামের সুমহান ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। ইসলামের এই ধরনের অনন্যসাধারণ সব ঘটনার বিপরীতে আমরা ইতিহাসে বিভিন্ন সুপার পাওয়ার দেশগুলোর নির্মমতা, বর্বরতা ও পৈশাচিকতার ভয়াবহ সব উদাহরণ দেখতে পাই। কিভাবে একটি জাতি অন্যায্যভাবে অন্য একটি জাতির উপর আক্রমণ করে, তাদেরকে বন্দী করে অবর্ণনীয় অত্যাচার পরিচালনা করে তার অসংখ্য উদাহরণও আমাদের জানা আছে। অথচ ইসলাম কখনোই এই ধরনের আচরণ সমর্থন করে না। ইসলাম অন্য ধর্মের প্রতিও যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। নবীদেরকেও আল্লাহ তায়ালা জোর করে অন্যের উপর ইসলামকে চাপিয়ে দিতে নিষেধ করেছেন। বরং স্ব স্ব জাতি বা সম্প্রদায়ের কাছে হেদায়েতের বাণী পৌঁছিয়ে তাদেরকে নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনার আলোকে ইসলামকে গ্রহণ করতেই নবী-রাসূলেরা উজ্জীবিত করেছেন। হিজরতের পর মদীনায় গিয়ে রাসূল (সা) দেখতে পেলেন মদীনার আনসার সাহাবীদের পাশাপাশি একটি বড় ইহুদি সম্প্রদায়ও রয়েছে। কিন্তু তিনি কখনোই তাদের নিয়ে পেরেশান হননি। এই ইহুদিদেরকে জোর করে মুসলমান বানাবার কোন চেষ্টাও তিনি করেননি। বরং তিনি মদীনা সনদের ভিত্তিতে তাদের সাথে চুক্তি করেন এবং তাদেরকে আহলে কিতাব হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ইসলাম অন্য ধর্মের প্রতি কতটা সহিষ্ণু, এই ঘটনায় তা বোঝা যায়। মদীনায় মুসলমানদের সাথে ইহুদিদের যে চুক্তি হয়েছিল, তার মাধ্যমে মদীনার ইহুদি সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল এবং তাদেরকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতাও দেয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, মদীনায় ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন করার পর নবীজি (সা) যখন আশপাশের পরাশক্তিগুলোর রাজাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, সেখানেও তিনি কাউকে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করার ভয় দেখাননি। বরং প্রাথমিকভাবে তাদের সবাইকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আবিসিনিয়ার তৎকালীন খ্রিষ্টান রাজাকে রাসূল (সা) যে চিঠি দিয়েছিলেন তার শেষটা অনেকটা এরকম ছিল, “আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম। এখন এই দাওয়াত গ্রহণ করবেন কী করবেন না, তা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার।” রাসূলের (সা) সাহাবীরাও একই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন। ইমাম জয়নুল আবেদীন (রহ) রিসালাতুল হুকুক নামক একটি সনদ প্রণয়ন করেছিলেন। রিসালাতুল হুকুককে বাংলায় অধিকারের সনদ হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। এই সনদে তিনি সমাজে ও সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মানুষের অধিকারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের অধিকারের বিষয়েও তিনি বিশদ আলোচনা করেছেন। এতে বলা হয়েছে, “মুসলিম সমাজে অবশ্যই একটি সীমানা থাকতে হবে যা অমুসলিমদের প্রতি কোন ধরনের জুলুম করা থেকে মুসলমানদেরকে বিরত রাখবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) অমুসলিমদের যে অধিকারের কথা বলে গেছেন, তা নিশ্চিত করতেও মুসলমানদেরকে সদা তৎপর থাকতে হবে।” রাসূল (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অমুসলমান কারও উপর অবিচার করে সে কিয়ামতের দিন আমার শত্রু বলে গণ্য হবে।” মুসলিম খলিফারা প্রায়শই বিভিন্ন অঞ্চলের গভর্নরদের কাছে যে সতকর্তামূলক চিঠি পাঠাতেন, তার ভাষা ছিল অনেকটা এরকম। “আপনার অধীনস্থদের প্রতি সদয় হোন, তাদেরকে ভালোবাসুন। তাদের সাথে লোভী পশুর মত আচরণ করবেন না।” এটা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দুই দফা বিশ্বযুদ্ধ এবং বিশেষত টুইন টাওয়ারে হামলার পর থেকে পশ্চিমা মহল ইসলামকে সন্ত্রাসীদের ধর্ম হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং মুসলমানদেরকেও সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পশ্চিমাদের লেখা ইতিহাসে এভাবে দেখানো হয়েছে যে, মুসলমানদের এক হাতে থাকে কুরআন শরীফ আর অন্যহাতে রক্তমাখা তলোয়ার। অর্থাৎ তারা দাবি করেছেন, মুসলমানরা যেখানেই যায় না কেন, তারা সেখানকার মানুষকে দুটি প্রস্তাব দেয়, হয় ইসলাম মানো না হয় মরো। এটা কোনভাবেই অসত্য নয় যে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিরাট অংশ মুসলমানরা একসময় জয় করেছিল। কিন্তু মুসলমানেরা কখনোই সেখানকার মানুষের উপর জোর করে ইসলামকে চাপিয়ে দেয়নি। মুসলমানদের রাষ্ট্র জয় আর দ্বীন ইসলামের প্রসার ও বিকাশের ইতিহাসে সবসময়ই ভিন্নতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মুসলমানরা দীর্ঘদিন ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করলেও তারা এখানকার মানুষকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেনি। ফলে শাসক মুসলমান হলেও এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বরাবরই অমুসলমান ছিল। পরবর্তীতে ইসলাম ভারতবর্ষে প্রবেশ করে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে নয়, বরং সুফী সাধকদের দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে। এই সত্যটা ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, খুশবন্ত সিং তার ‘দ্য হিস্টোরি অব দ্য শিখস’ গ্রন্থে স্বীকার করে নিয়েছেন। বাস্তবতা হলো, অন্যান্য ধর্মের লোকেরা এবং সেইসাথে পশ্চিমা শাসকেরা মানুষের উপর যতটা অত্যাচার করেছেন, মুসলমান শাসকেরা তার সিকিভাগও করেনি। প্রখ্যাত পশ্চিমা ইতিহাসবেত্তা এবং তুরস্কের মুসলিম শাসনের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, রোডেরিক এইচ ডেভিসন তাই বলেছেন, “যদিও কেউ কেউ বলে যে, তুর্কি মুসলমানেরা জনগণকে শোষণ করেছিল, কিন্তু সত্যি কথা হলো প্রুসিয়ানরা আরো অনেক বেশি বর্বরতম নিপীড়ন চালিয়েছিল, ইংরেজরা আইরিশদেরকে আরো অনেক বেশি শোষণ করেছিল, আমেরিকানরা নিগ্রোদের উপর ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতন করেছিল। ইতিহাসে এমনও দেখা যায় যে, বিধর্মীরা বরং বেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্মান পাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজ ভুখণ্ড ত্যাগ করে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো।

তথ্যসূত্র : আরব নিউজ। আল ইসলাম ওয়েবসাইট রিলিজিয়াস টলারেন্স ইন ইসলাম, সাইয়্যেদ মুহাম্মদ রিজভী। লেখক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির