post

আশীষ মাহমুদ

৩১ মে ২০২২

বিশালাকার পৃথিবী তথ্যপ্রযুক্তি ও নয়া যোগাযোগব্যবস্থার ক্রমোন্নতির ফলে দ্রুত ছোট হয়ে আসছে। উত্তর মেরুতে ঘটে যাওয়া ঘটনা দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছে যাচ্ছে সেকেন্ডের চেয়ে কম সময়ের মধ্যে। এতবড় পৃথিবী আজ তাই বলা হচ্ছে গ্লোবাল ভিলেজ। মূলত উন্নত দেশগুলোতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইন্টারনেট আবিষ্কারের সাথে সাথে তথ্যপ্রযুক্তি ও নয়া যোগাযোগব্যবস্থার হাত ধরে এই বিপ্লবের সূচনা ঘটে। ইন্টারনেট বিপ্লব মানুষের জীবনকে সহজবোধ্য করে তুলতে নিত্য নতুন প্রযুক্তির দ্বার উন্মেচন করছে। একুশ শতকের পৃথিবী ইন্টারনেট ছাড়া চিন্তা করা যায় না। মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে ইন্টারনেটের স্যাটাইলাইট ও ক্যাবলের সাথে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যবসা-বাণিজ্য হতে শুরু মানবতার সভ্যতার সবকিছুর কেন্দ্রে এখন ইন্টারনেট।

ইন্টারনেটের হাত ধরে ব্যবসা বাণিজ্যের যে নতুন সূচনা ঘটেছে তাকে বলা হচ্ছে ই-কমার্স বা ইলেকট্রনিক কমার্স। মূলত ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, অর্থ লেনদেন ও ডাটা আদান প্রদানই হচ্ছে ই-কমার্স। সহজ কথায় বলা যায় ইন্টারনেট ব্যবহার করে কোনো কিছু বিক্রি করাকেই ই-কমার্স বলে। বিশ^বাসীর কাছে আজ ই-কমার্স একটি জনপ্রিয় নাম। বিশেষত ঘরে বসে পছন্দমাফিক কেনাকাটার জন্য দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো। ই-কমার্সকে কেন্দ্র করে নিত্য নতুন ব্যবসার দ্বার খুলে যাচ্ছে। এই যেমন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পণ্য ডেলিভারির জন্য কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কুরিরয়ার ব্যবস্থা থাকলে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্ভরশীল। কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ডেলিভারিম্যানের কাজ করে পড়াশোনার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন করছে। ই-কমার্স : ব্যবসার ধরন ই-কমার্স মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান (বিটুবি), ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টু ভোক্তা (বিটুসি), ভোক্তা টু ভোক্তা (সিটুসি) এর মধ্যে বেশি হয়ে থাকে। এছাড়াও সরকারের সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভোক্তার সাথে সরকারের কিছু ব্যবসা কার্যক্রম ই-কমার্র্সের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিশে^র জনপ্রিয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম বর্তমান বিশ^ব্যাপী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িকভাবে দারুণ লাভবান হচ্ছে। মূলত শতভাগ ব্যবসায়িক মনোভাব, পণ্যের মান, দ্রুত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া, গ্রাহকসেবা ও সর্বোপরি বিশ^স্ততা তাদেরকে সাফল্যের দিকে ধাবিত করেছে। যেহেতু গ্রাহক পণ্য হাতে ধরে দেখতে পারেন না তাই পণ্যের মান ও বিশ^স্ততা না থাকলে গ্রাহক দ্রুত ব্যবসা হারিয়ে ফেলেন এবং ভবিষ্যতে ঐ প্ল্যাটফর্ম বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন।

আবার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে প্রতিযোগীর সংখ্যা বেশি বলে যে বিক্রেতা পণ্যের গুণগত মান ধরে রেখে স্বল্প মুনাফায় পণ্য বিক্রি করে তাদের প্রতি গ্রাহকরা বেশি আকৃষ্ট হয়। তাই একজন বিক্রেতাকে পণ্যের বাজারের মূল্যের পাশাপাশি ও অন্য বিক্রেতাদের মূল্যের দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হয়। সকল দিক বিবেচনা করে যারা পণ্য সরবরাহ করতে পারেন তারা ই-কমার্সে সাফল্য পেয়ে থাকেন। উপরিউক্ত বিবেচনায় বিশ^ব্যাপী যে কয়টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রাজত্ব করছে তারা হলো- অ্যামাজন, জেডি ডট কম, আলিবাবা, সুনিং ডট কম, র‌্যাকুটেন, ই-বে, ওয়েফেয়ার, জালান্ডো, কৌপ্যাং ও ফ্লিপকার্ট অন্যতম। এই সকল প্রতিষ্ঠান নিজ দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিশ^বাজারে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। এদের মধ্যে অ্যামাজান ও আলিবাবাকে ই-কমার্স জায়ান্ট বলা হয়। তারা বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ২০২০ সালে এই সকল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মুনাফা নিম্নরূপ- ক্রম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নাম বার্ষিক মুনাফা (বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ১ অ্যামাজন ২৮০.৫ ২ জেডি ডট কম ৮২.৮৬ ৩ আলিবাবা ৭১.৯৮ ৪ সুনিং ডট কম ৩৮.০৬ ৫ র‌্যাকুটেন ১১.৬ ৬ ই-বে ১০.৮ ৭ ওয়েফেয়ার ৯.১৩ ৮ জালান্ডো ৭.২৬ ৯ কৌপ্যাং ৬.২৩ ১০ ফ্লিপকার্ট ৬.১ ই-কমার্স ও বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোতে বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইন্টারনেটের প্রসার ঘটলেও বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশসমূহে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু হয় একুশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। আর বিপুল প্রসার ঘটে ২০১০ সালের পর থেকে। ইন্টারনেটের প্রসারের সাথে সাথে ই-কমার্সের সাথে পরিচিতি ঘটে এই দেশের জনসাধারণের। ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলেও বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি অনেকখানি অগ্রসরমান হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন সেক্টর এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ই-কমার্স নতুন হলেও একবারে পিছিয়ে নেই। ইতোমধ্যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে রকমারি ডট কম, বাগডুম ডট কম, চালডাল ডট কম, পিকাবু ডট কম, দারাজ, ই-ভ্যালি, আলিশামার্ট, আজকের ডিল ডট কম-সহ বহু প্রতিষ্ঠানের আবিভার্ব ঘটেছে। সাম্প্রতিক বিতর্ক সম্প্রতি ই-ভ্যালি, আলিশা মার্ট, ই-ওরেঞ্জসহ দেশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিপর্যয়ের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, গ্রাহক টানতে গিয়ে অধিক ছাড়ে পণ্য সরবরাহ করতে গিয়ে ই-ভ্যালি বা এইসব প্রতিষ্ঠান লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন গ্রাহকের টাকা বা কাক্সিক্ষত পণ্য সরবরাহ দিতে পারছে না আবার অপর দিকে ই-ভ্যালি যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য সংগ্রহ করতো তাদের পাওনা বাকি পড়ে গেছে। অবশ্য গত দুই বছরে ই-ভ্যালির মত গড়ে ওঠা কিছু প্রতিষ্ঠান লোভনীয় ছাড় দিয়ে পণ্য সরবরাহের কথা বলে টাকা আত্মসাত কিংবা বিদেশে মানি লন্ডারিং করেছে বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এছাড়াও ই-কমার্স খাতে আরেকটি বিতর্ক বা সমস্যা হচ্ছে গ্রাহককে যে পণ্য অনলাইনে দেখানো হচ্ছে বাস্তবে তা দেয়া হচ্ছে না। গ্রাহক কাক্সিক্ষত পণ্য না পেয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। অনেক সময় যে পণ্য অর্ডার করা হয়েছে তার বিপরীতে সম্পূর্ণ অন্য পণ্য দেয়া হচ্ছে। যা এই সম্ভাবনাময় খাতকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সাম্প্রতিক বিতর্ক ও এই খাতের সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চিত করা গেলে ই-কমার্স খাত দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের বিস্তার ঘটেনি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে ই-কমার্সের বিস্তার ঘটলেও দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও ৭০ ভাগ গ্রামীণ মানুষ ই-কমার্সের সেবা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী এই খাতে মাসে এখন প্রায় সাতশ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের মত বাজারে এটির পরিমাণ নেহাত কম নয়। আগামী দিনেও এটি যে আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে কোন সংশয় নেই। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে দেশের বিশ^বিদ্যালয়-কলেজ পড়–য়া তরুণ সমাজ ই-কমার্স ব্যবসায় অগ্রসর হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণদের আগমন এই খাতের চেহারা বদলে দিতে যথেষ্ট। বিশ^ব্যাপী চলা করোনার এই দুঃসময়ে অনেক তরুণ ই-কমার্স খাতে অল্প বিনিয়োগে ব্যাপক সফলতার মুখ দেখেছে। যা অন্যান্য তরুণ-যুবকদের এই খাতে বিনিয়োগের আকৃষ্ট করেছে। সরকার সম্প্রতি ই-কমার্স নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর সাথে উদ্যোক্তাদের শতভাগ সততার সাথে ব্যবসা করার মনোভাগ যোগ করতে হবে। ই-কমার্স নীতিমালা ও উদ্যোক্তার সততার মেলবন্ধনে গ্রাহকের ভোগান্তি দূর হবে বলে আশা করা যায়। আর গ্রাহক যত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা, বিশ^াস অর্জন করবে ই-কমার্স খাত তত বেশি সামনের দিকে অগ্রসর হবে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এই অগ্রগতিকে ই-কমার্স খাতে কাজে লাগাতে হলে সুষ্ঠু নিয়মনীতি অনুসরণ ও গ্রাহকের আস্থা বিশ^াস অর্জনের বিকল্প নেই। ই-কমার্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন দুয়ার উন্মেচন করবে। অর্থনীতির এই নতুন দুয়ারকে স্বাগত জানাতে সরকার হতে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। ই-কমার্সের পথ সুগম করতে হবে। লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির