post

একটি তাফসীরগ্রন্থই যখন একটি আন্দোলন মুহাম্মদ কুতুব অনুবাদ : রাহাত বিন সায়েফ চৌধুরী

০৬ জুন ২০২১

‘ফী যিলালিল কুরআন’ সম্পর্কে কিছু লেখার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। সাইয়েদ কুতুব (রাহিমাহুল্লাহ) এই তাফসীরটি তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের সময়ে লিখেন। একই সাথে এ তাফসীর লেখকের আজীবন সংগ্রামের এক জীবন্ত দলিল, লেখকের সে সংগ্রাম ১৯৬৬ সালের ২৯ আগস্ট তাঁর শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছিলো। ১৯৫৪-৬৪ সালে লেখক যখন জেলে ছিলেন, তখন এই তাফসীরের বেশির ভাগ অংশই লেখা হয়। এই সময়ে লেখক সম্পূর্ণ একাকিত্বে নিবিষ্টমনে লেখালেখি করেছেন, তখন তিনি আসলেই ‘কুরআনের ছায়াতলে (ফী যিলালিল কুরআন)’ দিনযাপন করছিলেন। সাইয়েদ কুতুব একটি কুরআনের সমাজ বাস্তবায়নের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন, কারাবরণ করেছেন এবং সব শেষে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। তিনি এমন একটি সমাজ চেয়েছিলেন যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে কুরআনের বিধান মেনে চলবে এবং একটি কুরআনের জাতিগঠন করার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সংগ্রাম ছিলো লেখালেখির মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এবং এর মৌলিক বিধিবিধান, আইন, নীতিমালার উপস্থাপন। এর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে এই তাফসীর ‘ফী যিলালিল কুরআন’। এটি শুধু তাফসীর নয়, এটি এক মহান ‘বিপ্লবের আহবান।

কুরআন হচ্ছে ইসলামের ‘ইশতেহার’। তাই ইসলামের আবির্ভাব কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রজন্ম পার হয়নি, যে সময় কুরআনের এক বা একাধিক তাফসীর লেখা হয়নি। প্রতি প্রজন্মেই কুরআনকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাইয়েদ কুতুব তাঁর জীবনের বড় একটি সময় ‘কুরআনের ছায়াতলে’, কুরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে কাটিয়েছেন। তাই নিছক কুরআনের একটি তাফসীর লেখা তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং তাঁর একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, যা তিনি এই তাফসীর লেখার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে চেয়েছেন। আমাদের এই সময়ের একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, হতে পারে, যা ইতিহাসে কোনো সময়েই ছিল না। এই আধুনিক সময়ই এই তাফসীরকে স্বকীয়তা দিয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে। আজকের মুসলমান, যারা একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের অনুশীলন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তারা তাদের জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে প্রথম প্রজন্মের মুসলমানদের জীবনাচরণের বিপরীত চিত্রই তুলে ধরেছে। প্রথম প্রজন্মের মুসলমানরা তাদের জীবনে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ যে ঘোষণা দিয়েছেন তার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন, “এখন তোমরাই দুনিয়ার সর্বোত্তম জাতি। তোমাদের এই কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য।” (সূরা আলে ইমরান : ১১১) তাই তাঁরা মানব ইতিহাসে এক অতুলনীয় অধ্যায় রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁরা সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মানবতার জন্য এক অতুলনীয় সভ্যতা রচনা করেছিলেন, যে সভ্যতা একই সাথে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। এটি এমন এক সভ্যতা ছিলো যা দু’টি বিপরীত জগতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। এ সভ্যতাই জৈবিকতা ও নৈতিকতা, ধর্ম ও রাজনীতি, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান এবং বাস্তবতা ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সুসমন্বয় ঘটিয়েছে।

এর বিপরীতে মানবতার সামনে পশ্চিমারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের বস্তুবাদী দর্শন ও মতবাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। যা ধর্মকে বাস্তব জীবন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে এবং শুধু ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ করেছে। তাই তাদের গড়া সভ্যতায় মানুষের সাথে ¯্রষ্টার যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তা সমাজ এবং বাস্তব জীবনের উপর কোনো প্রভাবই ফেলে না। তারা জীবনের সকল ক্ষেত্রেকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত করার কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। যার ফলে মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এবং অভিনব নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকৃতির শিকার হচ্ছে। এরপরেও এই বিকৃতি ও ধ্বংসের ফেরিওয়ালারা তাদের বস্তুবাদী মতবাদকে বিজ্ঞানের আবরণে আবৃত করে আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করে থাকে। তাদের উপস্থাপনা দেখে মনে হয় তাদের পথই মুক্তির একমাত্র পথ। তাদের বিকৃত সভ্যতার স্বাভাবিক ফলস্বরূপ তারা এখন দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, মস্তিষ্কের বিকৃতি, আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি, মদ্যাশক্তি এবং অত্যধিক অপরাধ প্রবণতাসহ নানাবিধ স্নায়বিক ও মানসিক রোগে ভোগছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে তাদের এই বিকৃত মতবাদ এবং দর্শন “আধুনিকতার” ছদ্মবেশে এখনকার মুসলমানদের জীবনকে ব্যাপকভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তারা মুসলিম সমাজকে তাদের নিজেদের সমাজের চেয়ে বেশি বিষাক্ত করে ফেলেছে। কারণ এখনকার মুসলিমরা ইসলামের চর্চা ছেড়ে দিয়েছে এবং ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ এবং এর মূলনীতি সম্পর্কে গাফেল হয়ে পড়েছে।

এ বাস্তবতা সামনে রেখেই সাহসী লেখক তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে এ প্রজন্মের মুসলমানদের সামনে প্রকৃত ইসলাম তুলে ধরার কঠিন সংগ্রামে নামেন, যে সংগ্রামের জন্য তিনি নিজের জীবনও উৎসর্গ করেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিলো আজকের মুসলমানরা সেই প্রথম প্রজন্মের মুসলমানদের মতো একটি পরিপূর্ণ ইসলামী জীবনযাপন এবং ইসলামের প্রকৃত অনুসরণ করতে শিখবে। এভাবেই মুসলমানরা বস্তুবাদী সভ্যতার গভীর গর্ত থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে পারবে এবং মানবতাকে মুক্তির সঠিক পথ দেখাতে পারবে। কুরআন হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সেই সংবিধান, যার মাধ্যমে মানুষ তার ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক জীবন পরিচালনা করবে। এটা হচ্ছে সেই কিতাব যা একটি জাতিকে ততদিন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দিতে থাকে, যতদিন না সে জাতি ‘মানবতার ইতিহাসে সর্বোত্তম জাতি’ হওয়ার স্বীকৃতি অর্জন করে। তাই কুরআনের উপর দুই দিক থেকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। প্রথম দিক হচ্ছে কুরআনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, যেখানে দেখা হবে কুরআন কিভাবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মানুষকে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। অন্য দিকটি হচ্ছে কুরআনে বিভিন্ন বিধিবিধান, যা মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক এবং সামগ্রিক ভাবে পুরো মানবসত্তাকে তার মহত্তম স্থরে পৌঁছে দেয়। আসলে ইসলামের বিধিবিধানগুলো মানুষের মুক্তির আসল পথ এবং মানুষের স্বভাবধর্ম। এই কুরআন নাজিল করার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে এমন এক দায়িত্বের জন্য মনোনীত করেছেন, যে দায়িত্বের ভার নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল বা ভূমণ্ডলের সুউচ্চ পর্বত কেউই বহন করার সাহস করেনি। ইসলামের জন্যই আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে তাঁর অন্য সকল সৃষ্টির উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।

এই তাফসীর লেখার ক্ষেত্রে লেখক এই দু’টি দিককেই প্রাধান্য দিয়েছেন। লেখক বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই একটি অভিব্যক্তি বা শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তিনি একটি সম্পূর্ণ আয়াত বা কয়েকটি আয়াত নিয়ে একত্রে আলোচনা করেছেন। আসমানি পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে ইসলামের আলোকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেই আয়াতগুলোর প্রয়োগ অথবা সে আয়াতগুলো থেকে উৎসারিত বাস্তব জীবনের বিভিন্ন বিধিবিধান, যা একটি ইসলামী সমাজ পরিচালনায় ভূমিকা রাখে সে দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইসলামী প্রশিক্ষণ ও ইসলামী জীবনব্যবস্থার কেন্দ্র হচ্ছে ঈমান বা বিশ্বাস। তাই এ বিষয়টি কুরআনের তথা এর সূরাগুলোর বড় একটি অংশ জোড়ে আলোচিত হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ফী জিলালিল কুরআনেও এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী ঈমান এমন কোনো বিষয় নয়, যা শুধু মুখে কয়েকবার উচ্চারণ করেই দায়িত্ব শেষ। জীবনের অন্যান্য সাধারণ ঘটনার মতো ঈমান ভুলে থাকার মতো কোনো বিষয় না, মুমিন জীবনে ঈমানের গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে অসতর্ক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে ঈমান হচ্ছে মুমিন জীবনের কেন্দ্র। এই ঈমানকে কেন্দ্র করে একজন মুমিনের চিন্তা, চেতনা, ভালো লাগা, খারাপ লাগা, জীবনের সিদ্ধান্তসমূহ অর্থাৎ জীবনের সবকিছুই আবর্তিত হবে। আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস এই বিশ্বব্যবস্থা ও মানব হৃদয়ের গভীরে, গভীর ভাবে প্রতিভাত। ঈমান বা বিশ্বাস মানুষের আবির্ভাব ও জীবন সম্পর্কে একটি পরিপূর্ণ জীবনদর্শন দেয়, যা মানবরচিত অন্য যে কোনো জীবন দর্শনের থেকে আলাদা। যে সকল বিশ্বাসী এই সত্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে, তাদের অনুভূতি, তাদের চিন্তা-চেতনা এমনকি তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচার আচরণ, অবিশ্বাসী এবং যাদের ঈমান বা বিশ্বাস দুর্বল তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। যারা বিশ্বাস বা ঈমানকে একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবে দেখে, যারা মনে করে ঈমান হচ্ছে নিছক একটি দার্শনিক অবস্থান, তাদের ঈমান তাদের জীবনাচরণের উপর খুব কমই প্রভাব বিস্তার করতে পারে বা একবারেই পারে না। একটি সমাজ বা জাতি যাদের জীবন বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়, তাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। সে সমাজের লক্ষ্য, আদর্শ, সামাজিক সম্পর্ক ও তাদের অর্জন অন্য যে কোনো সমাজের চেয়ে আলাদা হবে, যাদের কাছে ¯্রষ্টা, বিশ্বব্যবস্থা, জীবন ও মানুষ সম্পর্কিত ইসলামী ধারণা বা দর্শন নেই। কুরআনে এই চিত্রটি খুবই সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। একদিকে তোলে ধরা হয়েছে বিশ্বাসীদের চিত্র, যাদের হৃদয় আল্লাহর একত্ববাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের বিপরীতে তোলে ধরা হয়েছে অবিশ্বাসীদের চিত্র, যারা সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে আল্লাহর নাফরমানিতে মগ্ন হয়েছে। একদিকে সেই সমাজের ছবি আঁকা হয়েছে যারা ইসলামকে জীবনবিধান হিসেব মেনে নিয়েছে, অন্যদিকে আঁকা হয়েছে তাদের চিত্র যারা মানুষের তৈরি বিভিন্ন মতবাদ ও মূল্যবোধকে নিজেদের জীবন বিধান হিসেবে অনুসরণ করছে। এভাবে কুরআন পাশাপাশি দুদিকের চিত্র উপস্থাপন করে তাঁর অনুসারীদের জীবনে সত্যিকারের সফলতা আসলে কী, সেটা শিক্ষা দিতে চেয়েছে। এর পরে জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিধিবিধান দেয়ার মাধ্যমে কুরআন ব্যক্তি ও সমাজকে সেদিকেই পথ প্রদর্শন করেছে যে পথে চললে, “পৃথিবীর মধ্যে সর্বোত্তম জাতি হওয়া যায়, হওয়া যায় অন্য জাতির জন্য আদর্শ।”

লেখক আসলে ‘কুরআনের রঙে’ নিজেকে রাঙাতে পেরেছিলেন। তাই তিনি এ তাফসীর লেখার মধ্য দিয়ে পাঠকদের কাছে তাঁর সে অভিজ্ঞতাকে, কুরআনের উপস্থাপিত চিত্রের সাথে মিলিয়ে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তিনি একজন বিশ্বাসীর ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন, তাঁর অনুভূতি, তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর চিন্তা-চেতনা, তাঁর সংগ্রাম তোলে ধরেছেন। পাশাপাশি তিনি মানুষের জন্য দেয়া আল্লাহর বিভিন্ন বিধিবিধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করেছেন। এসব নিয়েই ‘ফী জিলালিল কুরআনে’র মূল আলোচনা। এ তাফসীরে লেখক মানুষের বিশ্বাস (ঈমান) এবং বিশ্বাস কিভাবে মানুষের সামগ্রিক জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, তা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। বিশ্বাস কিভাবে মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি সিদ্ধান্ত নেয়ায়ও ভূমিকা রাখে সেটা থেকে শুরু করে, আইন প্রণয়নে বা সমাজ পরিচালনায় বিশ্বাসের ভূমিকা কী সেটা নিয়েও আলোচনা করেছেন। লেখক মূলত দুটি কারণে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রথমত কুরআনেই এ বিষয় নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা করা হয়েছে। এ বিষয়গুলো আলোচনার মাধ্যমে কুরআন কিভাবে সকল অবস্থায়, সকল বিষয়ে মানুষকে পথ দেখায় সেটা ফোটে উঠেছে। যেমন- মানুষের নিরাপত্তা ও ভয়ে, সুখে ও দুঃখে, দরিদ্রতা ও সচ্ছলতায়, ব্যক্তি ও সমাজকে, যুদ্ধ ও সন্ধিতে, সবল ও দুর্বলকে, নিজের প্রবৃত্তির চাহিদাকে সংবরণ করতে ও শত্রুর সাথে মোকাবেলায়, সর্বাবস্থায় কুরআন সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। কুরআনেই বারবার আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়েছে এবং আল্লাহর বিধানের বিপরীত সকল মত ও পথকে অস্বীকার করার কথা বলা হয়েছে। এভাবে নিজের সব কিছুকে কুরআনের কাছে সমর্পণ করা ছাড়া ঈমানের দাবি করাটা আসলে এক অসার দাবি, বাস্তব কাজের মধ্যে এর প্রতিফলন না থাকলে আল্লাহর কাছে এ বিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বর্তমান সময়ের মুসলমানরা ভুলেই গেছে বা তারা জানেই না যে, বাস্তব জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ বা প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদের ঈমানের দাবি অনুযায়ী। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া ইসলামের স্বরূপ কখনই প্রস্ফুটিত হবে না, না ব্যক্তিগত পর্যায়ে, না সামাজিক পর্যায়ে।

লেখক কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন নিদর্শন যা এই পৃথিবীতেই দৃশ্যমান, সেগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। এ নিদর্শনগুলো একজন সর্বশক্তিমান ¯্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। এক্ষেত্রে লেখক সচেতনতার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের কিছু বিশ্লেষণেরও আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি এসকল নিদর্শন নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন, কারণ কুরআনেই বারবার এ নিদর্শনগুলোর উল্লেখ আছে। এ নিদর্শনগুলো মানুষের মনে নাড়া দেয়, চিন্তায় আলোড়ন তৈরি করে, পাশাপাশি আল্লাহর বড়ত্ব ও মহত্ত্ব বুঝতে একটি কার্যকর উপায়। এ নিদর্শনগুলো নিয়ে ভাবলে মানুষ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য। তিনি তাঁর তাফসীরে আখিরাতের একটি জীবন্ত চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন, কারণ কুরআনের প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠায় এ চিত্র আঁকা হয়েছে। মানুষের মনে ধর্মীয় চেতনা পুনরুজ্জীবিত করতে আখিরাতের আলোচনার বিকল্প নেই। আখেরাতের মাধ্যমেই আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে একই সাথে ভয় ও আশার এক দ্বিমাত্রিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

বর্তমান দুনিয়ার বিকৃত ও জাহেলি ব্যবস্থার বিপরীতে, তিনি ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-পদ্ধতি এবং কিছু মৌলিক ও অপরিবর্তনীয় মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। মানুষ নিজের বুদ্ধির উপর নির্ভর করে আল্লাহর বিধান থেকে বিমুখ হয়। মানুষ ঔদ্ধত্যের সাথে দাবি করে যে, সে নিজের প্রয়োজন এবং যথার্থ জীবনপদ্ধতি সম্পর্কে তার ¯্রষ্টার চাইতে বেশি জানে! লেখক এ দাবির অসারতা এবং ইসলাম ও জাহেলিয়াতে মধ্যে যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান সেটা তুলে ধরেছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ না করার করুণ পরিণতি। তিনি ব্যক্তি ও সমাজকে কিভাবে ইসলামের আলোকে প্রশিক্ষিত করে তোলা যায় সেটা বোধগম্য ভাষায় আলোচনা করেছেন। এ আলোচনার মাধ্যমে লেখক একদিকে কুরআনে বর্ণিত প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উপর আলোকপাত করেছেন, অন্যদিকে এর দ্বারা বর্তমান সময়ের ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছেন। সে সময় জাহেলিয়াত বেষ্টিত একটি জায়গায়, যেখানে সবাই ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য কাজ করা আন্দোলনের জন্য এ আলোচনা ছিলো খুবই প্রাসঙ্গিক। এক্ষেত্রে লেখক কুরআনে উপস্থাপিত পদ্ধতিতেই, মানুষের মনের মধ্যে এর শিক্ষাকে গেঁথে দেয়ার জন্য “ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষা” এর উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কুরআনে বর্ণিত ঘটনাগুলো মানুষের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে এবং ভুল পথ থেকে বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়।

এভাবেই এ তাফসীর গ্রন্থটিকে সাজানো হয়েছে। এ তাফসীরটি পড়লেই একজন পাঠক অন্যান্য সাধারণ তাফসীর থেকে এটি কেন আলাদা, সেটা সহজেই বুঝতে পারবেন। আমরা একটু সহজ করে যদি বলি, এটি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে লেখা একটি তাফসীর। যা সেই মহৎ লক্ষ্য অর্জনের উপায় বাতলে দেয়। এর লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের মহান আহবানের প্রচার, এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতির বর্ণনা, এর অনন্য শৃঙ্খলাপদ্ধতি তুলে ধরা, যা অতীতের মতোই আজকের দুনিয়ায়ও ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সমান প্রাসঙ্গিক। এ বিষয়গুলো ছাড়াও এ তাফসীরের আরও একটি বিশেষত্ব রয়েছে, যে দিকে লেখক সচেতন ভাবেই তাঁর পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। এ তাফসীরটি লেখকের জীবনের সক্রিয় ইসলামী আন্দোলন এবং ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে লেখক যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এর বাস্তব অভিজ্ঞতার ফসল। এটা আসলেই সত্য যে, আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত হওয়া ছাড়া কুরআনকে যথাযথ ভাবে অনুধাবন করা অসম্ভব। ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন’ এ সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কুরআনের প্রগতিশীলতার সন্ধান পাওয়া বা কুরআনের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব নয়। ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন’ মানুষের চিন্তার জগতে ও সমাজজীবনে একটা সর্বাত্মক বিপ্লব সৃষ্টি করে। “ইসলাম” কোনো নির্জীব বস্তু নয় যে এটাকে ঘরের এক কোণে সাজিয়ে রাখা যায়। আসলে “ইসলামী আন্দোলন” হচ্ছে একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। এ আন্দোলন সব সময় সক্রিয়, কখনো স্তিমিত হয় না অথবা এটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রাথমিক ভাবে একজন মানুষের ভেতরে এটি একটি স্বচালিত শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা মানুষকে দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত করে। এর প্রভাবে মানুষ প্রতিনিয়ত আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার প্রচেষ্টা করে, আল্লাহর সন্তুষ্টি খুঁজে, আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে, যা মানুষকে পবিত্রতা, মহত্ত্ব ও ভারসাম্যতার দিকে ধাবিত করে। সমাজের ক্ষেত্রে ইসলাম একটি সর্বাত্মক বিপ্লব, যার লক্ষ্য হচ্ছে, সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করানো, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও যাতে জুলুম ও বিশৃঙ্খলা নির্মূল হয়ে যায় এবং জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম বিজয়ী হয়।” (সূরা আনফাল : ৮)

কেউ যদি ইসলামী আন্দোলন থেকে দূরে থেকে, নিষ্ক্রিয়ভাবে শুধু কুরআন অধ্যয়ন করে, তবে সে কুরআনের মূল উদ্দেশ্য এবং এর অনেক নিদর্শনই বুঝতে পারবে না। কেউ যখন কুরআন পড়ে, সাথে সাথে এর অনুসরণ করে এবং কুরআন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, তখন কুরআন অনুধাবন করার জন্য তাঁর হৃদয়ের চোখ খুলে যায়। এ ছাড়া সে কুরআনের আসল ব্যাখ্যা বুঝতে ব্যর্থ হবে এবং কিছু অপ্রাসঙ্গিক অনুমান করা ছাড়া কিছুই বুঝতে পারবে না। এ তাফসীর থেকেই এ মন্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। লেখক এ তাফসীরের কয়েক খণ্ড ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জড়িত হওয়ার আগে লিখেছিলেন, তিনি পরে সেগুলো পুনরায় লিখেন। এ দুটি সংস্কণের মধ্যকার পার্থক্য যে কারো চোখেই ধরা পড়বে। কুরআনের পথে সক্রিয় সংগ্রামে নামার পরে যে নতুন উপলব্ধি তৈরি হয়েছে, সে কারণেই এ পার্থক্য তৈরি হয়েছে। এ তাফসীরের আরও একটি অনন্য দিক হচ্ছে এর সাহিত্যিক মান, বিশেষ করে এর মূল আরবী সংস্করণে সেটা দেখা যায়। লেখক তাঁর জীবনের প্রথম দিকে একজন সাহিত্যিক হিসেবেই যাত্রা শুরু করেছিলেন, সে কারণে জীবনের শৈল্পিক বোধ তাঁর মধ্যে ছিলো। তিনি একজন প্রকৃত শিল্পী হিসেবেই জীবনযাপন করেছেন, শৈল্পিক দৃষ্টিতে এ পৃথিবীকে দেখেছেন, সকল সুন্দরের প্রতি ছিল তাঁর সহজাত আকর্ষণ এবং তিনি আদর্শের মধ্যে থেকেই শিল্পের চর্চা করেছেন। তবে এ শিল্পবোধ তাকে তাঁর সময়ের রাজনৈতিক কর্তব্য থেকে দূরে রাখতে পারেনি। তাঁর পরবর্তী জীবন ছিলো এক অনন্ত সংগ্রামের জীবন। জীবনের এ অংশে একমাত্র আন্দোলন ছিলো তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তিনি আন্দোলনের জন্য তাঁর দিন-রাত্রি, তাঁর আবেগ-অনভূতি এবং তাঁর পুরো জীবনই উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কি তখন তাঁর শিল্পবোধ হারিয়ে ফেলেছিলেন, যা তাঁর প্রথম জীবনে ছিলো? কখনই না। এই কুরআন শৈল্পিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ, যার ছায়াতলে লেখক তাঁর পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করেছেন। কুরআন থেকে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামের যে চিত্র তিনি এঁকেছেন সেটাও শিল্প মানে সমৃদ্ধ। আমি আশা করি পাঠকগণও এ তাফসীর অধ্যয়নের মাধ্যমে লেখকের মতো ‘কুরআনের ছায়াতলে’ জীবনযাপন করতে পারবেন।

লেখক পরিচিত : মুহাম্মদ কুতুব, সাইয়েদ কুতুবের ভাই। মিসরের একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ। সত্তর দশকের গোড়ার দিকে মুহাম্মদ কুতুব সৌদি আরবে হিজরত করেন। মক্কার উম্মুল কুরা ভার্সিটিতে শরিয়াহ ফ্যাকালটির লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে পরে জেদ্দার কিং আবদুল আজিজে নিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি ইসলামী স্টাডিজের জন্য আন্তর্জাতিক কিং ফয়সাল পুরস্কার অর্জন করেছেন। ইসলামী চিন্তাধারা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাপত্র রয়েছে। ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল জুমার দিন জেদ্দায় মুহাম্মদ কুতুব মৃত্যুবরণ করেন (রাহিমাহুল্লাহ)। মুহাম্মদ কুতুব এ লেখাটি ১৯৭৯ সালে MWH London Publishers থেকে প্রকাশিত IN THE SHADE OF QURAN ৩০ নং ভলিউমের ভূমিকা হিসেবে লিখেন।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির