১ম পর্ব
দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগও অগ্রবর্তী ছিল- এটি ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য। তবে ২০০৮-এর সামরিক সমর্থনপুষ্ট বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার একটি সম্মিলিত আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে মুছে দিতে উদ্যোগী হয়। এর মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে যেকোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম হবে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীর ধারাসমূহ বাতিল করা হয়। তবে আদালত বলে যে, পরবর্তী দুটি মেয়াদের সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে।
কিন্তু এই দু’টি মেয়াদের নির্বাচনের পথে না হেঁটে এই রায়কে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল বিল উত্থাপন ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তা পাস করে নেয়। একই বছর ২৬ জুন এ সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনের বিল সংসদে উত্থাপন করা হয়। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বিএনপিসহ বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) বিল, ২০১১ উপস্থাপন করেন। স্পিকার মো. আবদুল হামিদ বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠান। ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় পর বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে সংসদে বিভক্তি ভোটে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন-২০১১ পাস হয়। বিএনপি সংবিধানের এই সংশোধনের বিরোধিতা করে। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ ত্রয়োদশ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়। এর অধীনে তিনটি নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে তুলে দেওয়ার পর পুরো বিরোধী পক্ষের বর্জনের মধ্য দিয়ে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দলই এ নির্বাচনটি বর্জন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) ও স্বতন্ত্রসহ ১২টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এ ছাড়া নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রবল বিতর্কের সৃষ্টি করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। বিরোধীরাসহ অনেকেই এই নির্বাচনকে ‘নৈশ ভোটের নির্বাচন’ বলে অভিযোগ তোলেন। তাদের অভিযোগ, ভোটের দিনের আগের রাতেই ব্যালট পেপারে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়। পরের দিন কেবল নির্বাচনের মহড়া দেওয়া হয়। এই নির্বাচন তথা ভোটের মহড়া দিয়ে যে ফলাফল প্রকাশ করা হয় তার ময়নাতদন্ত করে পাওয়া যায় বিস্ময়কর সব চিত্র। এই চিত্রের কয়েকটি পর্যালোচনা করে এখানে পত্রস্থ করা হলো।
সহস্রাধিক কেন্দ্রে ৯০% থেকে ১০০% ভোট
সিল মেরেছেন মৃত ব্যক্তিও
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের ময়নাতদন্ত রিপোর্টে দেখা যায় সহস্রাধিক কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৯০ ভাগ থেকে শতভাগ পর্যন্ত। এমনকি প্রবাসী আর মৃত ব্যক্তিও সিল মেরেছেন ব্যালট পেপারে।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, অন্তত ২২৭টি কেন্দ্রে ১০০% ভোট পড়ে। এছাড়াও ৯০ শতাংশ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়ে অন্তত সাড়ে ৭ হাজারের বেশি কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯% ভোট পড়ে- এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭১৯টি। অর্থাৎ ৮০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত ভোট পড়ে এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ২৩ সহস্রাধিক। অন্যদিকে শতভাগ ভোট কাস্ট হওয়া কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছেন মৃত ভোটাররাও। আছেন দীর্ঘদিন যাবৎ প্রবাসীরাও- যারা ভোট দিতে দেশে ফেরেননি। লক্ষণীয় বিষয় হলো, শতভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের মধ্যে এগিয়ে রয়েছে চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগ। রংপুর-৫ আসনে সর্বোচ্চ ৯টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ৮টি, চট্টগ্রাম-৮ ও রংপুর-২ আসনে ৭টি করে, লালমনিরহাট-৩ ও রংপুর-৬ আসনে ৬টি করে, চট্টগ্রাম-৫, কক্সবাজার-৩, ময়মনসিংহ-২, ময়মনসিংহ-১০, দিনাজপুর-১, গাইবান্ধা-৪, নওগাঁ-৩ ও সিলেট-৪ আসনে চারটি করে কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ে।
ভোটবন্যার কিছু নমুনা
গোপালগঞ্জ-১ আসনে কেবল নৌকাকে বিজয়ী করার জন্যই যেন ভোটের ‘ঢল’ নামে। এই আসনের ১৩৩টি কেন্দ্রের ২টি বাদে সবক’টিতেই ৯১% থেকে ৯৭% ভাগ পর্যন্ত ভোট প্রদান করা হয়েছে বলে দেখানো হয়। বাকি দু’টিতেও ভোটের হার ৮৫% থেকে ৮৯% ভাগ। শুধু তাই নয়, মাত্র ৯টি কেন্দ্রে ধানের শীষের ভাগ্যে ১-২টা করে ভোট জোটে। তবু সাকুল্যে মোট প্রাপ্ত ভোট ২১টি। অন্য কোনো প্রতীকের ঘরে যে এসব ভোট গেছে তাও নয়, সেগুলোতেও ২/১টা করে ভোটের দেখা মেলে। সবমিলিয়ে নৌকার ভোট প্রাপ্তি ৩ লাখ ৩ হাজার ৯৪২ ভোট। আর দ্বিতীয় স্থান অধিকারী হাতপাখা প্রতীকের ভোট মাত্র ৭০২টি। আরেকটি ‘ভোট বন্যা’র নমুনাতে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে মোট কেন্দ্র ৯১টি। এর মধ্যে ৯টি কেন্দ্রে ৭১% থেকে ৮৯% ভাগ ভোট পড়ে। বাকি ৮২টি কেন্দ্রেই ৯০% থেকে প্রায় শতভাগ ভোট কাস্ট হয়েছে বলে দেখানো হয়। এর মধ্যে কেবল একটি কেন্দ্রে ধানের শীষের ভোট দেখা যায় সর্বোচ্চ ৬৩৮টি। বাকিগুলোতে শূন্য থেকে ২/৩টি করে ভোট দেখা যায়। অন্য প্রতীকেরও একই দশা। বাকি সব ভোট প্রতিটি কেন্দ্রে ১২শ’ থেকে ৪ হাজার করে কেবল নৌকাতেই পড়েছে বলে দেখানো হয়েছে।
ধানের শীষের ঘাঁটি বলে পরিচিত বগুড়া অঞ্চলের মধ্যে বগুড়া-১ আসনের চিত্রও অনুরূপ। এখানে ১২২টি আসনের মধ্যে ৪২টিতে ৮০% থেকে ৮৯% ভোট কাস্ট হয়। বাকি ৮০টি কেন্দ্রে ৯০% থেকে ১০০% পর্যন্ত ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়। এই আসনেও ধানের শীষের ভোট শূন্য থেকে ডাবল ডিজিটের এবং কয়েকটি কেন্দ্রে তিন ডিজিটের ভোট দেখা যায়। আর চার ডিজিটের হাজার হাজার ভোট কেবল নৌকায় গিয়ে জমা হয়েছে। নৌকার ভোট দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৮ হাজার প্রায়। আর ধানের শীষের ভোট মাত্র ১৬ হাজার ৬৯০। এভাবে অধিকাংশ আসনেই একদিকে দেখা যায় ভোটের প্লাবন, সঙ্গে এই প্লাবনের একতরফা ফায়দা জমা হয় কেবল নৌকার বাক্সে।
মৃত ও প্রবাসীর ভোট প্রদানের নমুনা
একটি জাতীয় দৈনিকের (ডেইলি স্টার) সরেজমিন রিপোর্টের সূত্রে জানা যায়, ‘শতভাগ’ ভোট দেওয়া এলাকায় মৃত এবং প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদের ভোট দেওয়ার প্রমাণ মেলে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা হয়, বগুড়ার চিকাশি মোহনপুর গ্রামের হজরত আলীর স্ত্রী জাহেদা খাতুনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৩ মার্চ। তার ভোটার নম্বর ১০১৪৮২২২৪৯৬৭ (ক্রমিক নম্বর: ২৩৩)। জাহেদার ছোট ছেলে আকবর আলী (৪০) জানান, ২০১৮ সালের জুনে তার মা পারিবারিক কলহের জেরে তার এক প্রতিবেশী আত্মীয়ের হাতে নিহত হন। এই হত্যার পর মামলার প্রধান আসামি মেহের আলী কারাগারে রয়েছেন। অথচ এই কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।
হত্যার দায়ে অভিযুক্ত মেহের আলীর বাবা ইউসুফ আলী জানান, তিনি ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসা এবং মেহের আলীর স্ত্রী আরজিনা বেগম ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেননি। চিকাশি মোহনপুর গ্রামের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী মোহাম্মদ মইনুল হাসান (ভোটার নম্বর: ১০১৪৮২০০০২৮৪) ভোট দিয়েছেন বলেও ভোটার তালিকার মাধ্যমে জানা যায়। মইনুলের মা সালেহা বেগম বলেন, তার ছেলে মালয়েশিয়ায় গিয়েছে প্রায় ১ বছর হলো। বিষয়টি দাঁড়ালো এমন, যিনি নিহত হয়েছেন ২০১৮ সালের জুন মাসে, তিনি ভোট দিয়েছেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। হত্যাকারী জেলে, অথচ তিনিও ভোট দিয়েছেন।
এই শতভাগ ভোট পড়া কিংবা মৃত ব্যক্তির ভোট প্রদানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছুই করণীয় নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সিইসি। এই অস্বাভাবিক ভোট পড়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততাকে উদ্বেগজনক আখ্যা দেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্স-ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান। তাঁর মন্তব্য, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোথাও ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লেই সেখানে কমিশনের আলাদা নজর দেওয়া উচিত।
বহুসংখ্যক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলের দেখা যায়, বহুসংখ্যক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার বিষয়টি একটি ‘অতি অস্বাভাবিক’ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যাই মিলেনি দায়িত্বশীল কোনো তরফে। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে দেখা যায়, অন্তত ২২৭টি কেন্দ্রে ১০০% ভাগ ভোট পড়ে। এছাড়াও ৯০ শতাংশ থেকে ৯৯.৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়ে অন্তত সাড়ে ৭ হাজারের বেশি কেন্দ্রে। কিন্তু এই গুরুতর বিষয়ে দায়িত্বশীল মহলের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যার পরিবর্তে গেজেট প্রকাশের কথা বলে বিষয়টি তারা এড়িয়ে যান।
শতভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোর মধ্যে আছে দিনাজপুর-১ আসনে চারটি, দিনাজপুর-২ আসনে তিনটি, দিনাজপুর-৪ আসনে দুটি, দিনাজপুর-৬ আসনে একটি, নীলফামারী-৩ আসনে একটি, লালমনিরহাট-১ আসনে দুটি, লালমনিরহাট-৩ আসনে ছয়টি, রংপুর-১ আসনে দুটি, রংপুর-২ আসনে সাতটি, রংপুর-৪ আসনে তিনটি, রংপুর-৫ আসনে নয়টি, রংপুর-৬ আসনে ছয়টি, কুড়িগ্রাম-৩ আসনে দুটি, গাইবান্ধা-৪ আসনে চারটি, বগুড়া-১ আসনে দুটি, বগুড়া-২ আসনে একটি, বগুড়া-৫ আসনে দুটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনে তিনটি, নওগাঁ-২ আসনে দুটি, নওগাঁ-৩ আসনে চারটি, নওগাঁ-৪ আসনে তিনটি, রাজশাহী-৬ আসনে দুটি, নাটোর-১ আসনে একটি, সিরাজগঞ্জ-১-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-২-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-৩-এ তিনটি, সিরাজগঞ্জ-৪-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-৫-এ একটি, সিরাজগঞ্জ-৬-এ তিনটি, মেহেরপুর-২-এ একটি, যশোর-৩-এ একটি, বাগেরহাট-২-এ একটি, খুলনা-৬-এ একটি, বরিশাল-১-এ দুটি, বরিশাল-৩-এ একটি, টাঙ্গাইল-৫-এ একটি, টাঙ্গাইল-৬-এ একটি, জামালপুর-৪-এ তিনটি, শেরপুর-১-এ দুটি, ময়মনসিংহ-১-এ একটি, ময়মনসিংহ-২-এ চারটি, ময়মনসিংহ-৪-এ একটি, ময়মনসিংহ-৬-এ দুটি, ময়মনসিংহ-৭-এ একটি, ময়মনসিংহ-৮-এ দুটি, ময়মনসিংহ-৯-এ একটি, ময়মনসিংহ-১০-এ চারটি, ময়মনসিংহ-১১-এ একটি, নেত্রকোনা-৫-এ একটি, মানিকগঞ্জে-১-এ একটি, মানিকগঞ্জ-২-এ তিনটি, মুন্সীগঞ্জ-১-এ দুটি, মুন্সীগঞ্জ-২-এ দুটি, মুন্সীগঞ্জ-৩-এ তিনটি, ঢাকা-১, ঢাকা-৪, ঢাকা-১২ ঢাকা-১৮ ঢাকা-১৯ ও ঢাকা ২০ আসনে একটি করে, গাজীপুর-১-এ তিনটি, গাজীপুর-২-এ একটি, গাজীপুর-৩-এ একটি, নরসিংদী-৩-এ তিনটি, নারায়ণগঞ্জ-১-এ একটি, ফরিদপুর-২-এ দুটি, মাদারীপুর-১-এ একটি, মাদারীপুর-২-এ একটি, সুনামগঞ্জ-২-এ একটি, সুনামগঞ্জ-৫-এ দুটি, সিলেট-১-এ দুটি, সিলেট-৩-এ দুটি, সিলেট-৪-এ চারটি, সিলেট-৫-এ একটি, সিলেট-৬-এ একটি, মৌলভীবাজার-৩-এ দুটি, হবিগঞ্জ-৩-এ একটি, হবিগঞ্জ-৪-এ একটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২-এ ৮টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩-এ দুটি, কুমিল্লা-১, কুমিল্লা-৭ ও কুমিল্লা-১০ আসনে একটি, চাঁদপুর-৩-এ তিনটি, ফেনী-১-এ একটি, ফেনী-২-এ একটি ও ফেনী-৩-এ দুটি, নোয়াখালী-২-এ একটি, নোয়াখালী-৬-এ একটি, লক্ষ্মীপুর-১-এ একটি, চট্টগ্রাম-৫-এ চারটি, চট্টগ্রাম-৮-এ সাতটি, চট্টগ্রাম-১০-এ দুটি, চট্টগ্রাম-১১তে একটি, চট্টগ্রাম-১২তে একটি, চট্টগ্রাম-১৪তে দুটি, চট্টগ্রাম-১৫তে একটি, কক্সবাজার-১-এ তিনটি, কক্সবাজার-২-এ দুটি, কক্সবাজার-৩-এ চারটি, কক্সবাজার-৪-এ একটি, খাগড়াছড়িতে একটি ও বান্দরবানে একটি কেন্দ্রে।
পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, বাংলাদেশে যেখানে ভোট পড়ার হার ৩০-৪০ ভাগে নেমে এসেছে সেখানে এতোগুলো কেন্দ্রে একবারে একশত ভাগ ভোট পড়া কখনোই স্বাভাবিক বিষয় হতে পারে না। এটা আইনের চোখে দোষণীয় হতো না যদি ঐ কেন্দ্রগুলোর মৃত, প্রবাসী, কারাবন্দী প্রভৃতি ভোটার না থাকতো। এই শতভাগ ভোট পড়ার ঘটনা পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকেই পচিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) স্বীকার করেন, জাতীয় নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া ‘স্বাভাবিক’ নয়। তবে নির্বাচনের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ায় তা খতিয়ে দেখার বিষয়ে ইসির করণীয় কিছু নেই। তবে কেউ ক্ষুব্ধ হলে আদালতে যেতে পারেন। গত ১ জুলাই রাজধানীতে একটি প্রশিক্ষণের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এই তথ্য প্রমাণ করে, বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আমি মনে করি তারা চারবার ভোট চুরি করেছে। একবার হলো, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের এলাকায় মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার ও জেলে পাঠানো। দ্বিতীয়বার হলো, ভোটের আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরে দেয়া। তৃতীয়বার হলো, ভোটের দিন ভোট বাক্স ভর্তি ও আবার কেন্দ্র দখল। আর চতুর্থ চুরি হলো, ভোটের হিসাব মেলাতে গিয়ে গরমিল করা।’ তিনি এই নির্বাচন বাতিল করে দ্রুত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দেওয়ার দাবি করেন। অপরদিকে, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমরা শতভাগ ভোট পড়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখছি। কোথাও শতভাগ ভোট পড়েছে কিনা আমার জানা নেই। এ নিয়ে আমার কোনো কথা থাকতে পারে না।’ অতীতে বাংলাদেশে এরকম শতভাগ ভোট পড়ার নজির আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতে কোনো নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়েছে এমন আমি শুনিনি, আমার জানা নেই।’
প্রায় ৯০০টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে
কোনো ভোটই পড়েনি
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কেন্দ্রভিত্তিক যে ফলাফল নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করে তাতে অনেক ‘অস্বাভাবিক’ অবস্থা ও অসঙ্গতির মধ্যে অন্যতম হলো প্রায় ৯০০টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে কোনো ভোটই পড়েনি। এর বিপরীতে নৌকায় পড়ে তিন থেকে চার অংকের (ডিজিট) ভোট। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, কোনো কেন্দ্রে বিশেষ প্রতীকের ব্যালটে কোনো ভোট না পড়ায় তাদের কিছুই করার নেই।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত কেন্দ্রভিত্তিক রেজাল্টশিটের তথ্যে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও তার জোটের ধানের শীষ প্রতীকে ৮৮৯ কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। বিএনপিসহ ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে ২৮২ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১০৮টি আসনের ৮৮৯টি কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা একটি ভোটও পাননি। এছাড়া অনেক কেন্দ্রে মাত্র ১টি ভোট পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সাধারণত যে সকল কেন্দ্রে বরাবর প্রধান দুই প্রতীকের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে থাকে সেসকল কেন্দ্রে দেখা যায় নৌকার ভোট যেখানে ৪ ডিজিট অতিক্রম করেছে সেখানে ধানের শীষ শূন্য থেকে শুরু করে ডাবল ডিজিট অতিক্রম করতে পারেনি।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের গোপালগঞ্জ-১ আসনের ১৩৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২৫টিতে ধানের শীষ প্রতীকে কোনো ভোটই পড়েনি। বাকি ৮টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪টি কেন্দ্রে ধানের শীষে ভোট পড়েছে মাত্র ১টি করে। এসব কেন্দ্রে ধানের শীষের শূন্য ভোটের বিপরীতে নৌকার ভোটের পরিমাণ ১০০০ থেকে ৩৯০০ পর্যন্ত। এখানে সর্বোচ্চ ৯৮ ভাগেরও বেশি ভোট পড়েছে বলে দেখানো হয়েছে। প্রায় একই অবস্থা গোপালগঞ্জ-২ ও ৩ আসনে। গোপালগঞ্জ-২ আসনে ১৪৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০৬ কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকে কোনো ভোট পড়েনি। এসব কেন্দ্রে ধানের শীষের বিপরীতে নৌকার ভোট প্রাপ্তি তিন ডিজিট থেকে চার ডিজিট পর্যন্ত। গোপালগঞ্জ-৩ আসনের ১০৮ কেন্দ্রের মধ্যে ৮৯ কেন্দ্রে ধানের শীষের ভোট একেবারে শূন্য। বিপরীতে নৌকার ভোট ১০০০ থেকে ৩৮০০ পর্যন্ত। এই আসনে ভোট কাস্টের হার ৯৯.৬২ ভাগ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এছাড়া রাজবাড়ী-২ আসনের ২৯ কেন্দ্রে, ফরিদপুর-১ আসনের ২৯ কেন্দ্রে, মাদারীপুর-১ আসনের ৪৭ কেন্দ্রে, মাদারীপুর-২ আসনের ৩৫ কেন্দ্রে, মাদারীপুর-৩ আসনের ৪০ কেন্দ্রে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের ৪৯ কেন্দ্রে, কুমিল্লা-১১ আসনের ৩০ কেন্দ্রে, সিরাজগঞ্জ-১ আসনের ৮৫ কেন্দ্রে, নড়াইল-২ আসনের ১৯ কেন্দ্রে, বাগেরহাট-১ আসনে ১২ ও বাগেরহাট-২ ও ৪ আসনে ১৩টি করে কেন্দ্রে, বরিশাল-১ আসনে ২৬ কেন্দ্রে, পিরোজপুর-১ আসনে ১২ কেন্দ্রে এবং শেরপুর-১ আসনের ১৭টি কেন্দ্রে একটি ভোটও পাননি ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা। চট্টগ্রাম-১ আসনে দেখা যায়, নৌকা প্রতীকের ভোট প্রাপ্তির সংখ্যা কোনো কোনো কেন্দ্রে যেখানে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে সেখানে ধানের শীষের প্রাপ্ত ভোট শূন্য থেকে বড়জোর দেড়শ’ পর্যন্ত। চট্টগ্রাম-১৩ আসনেও অনুরূপ দেখা যায়, নৌকা প্রতীকের ভোট প্রাপ্তির সংখ্যা কোনো কোনো কেন্দ্রে যেখানে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে সেখানে ধানের শীষের প্রাপ্ত ভোট শূন্য থেকে বড়জোর আড়াইশো পর্যন্ত।
অন্যদিকে, উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর-৬ আসনে ৭০ ভাগ থেকে ৯৪ ভাগ পর্যন্ত ভোট কাস্ট দেখানো হলেও এখানে সকল কেন্দ্রেই ধানের শীষের ভোট সিঙ্গেল থেকে ডাবল ডিজিটে সীমিত থেকেছে। বিপরীতে নৌকার ভোট কোনটিতেই ৪ ডিজিটের নিচে নামেনি। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে দেখা যায়, কোনো কোনো কেন্দ্রে নৌকা প্রতীক যেখানে পেয়েছে ৩৪৬৩ ও ২২৩৫ ভোট সেখানে ধানের শীষের ভোট একেবারে শূন্য। এই আসনে ধানের শীষের ভোট যেখানে সিঙ্গেল থেকে ২ ডিজিট অতিক্রম করতে পারেনি সেখানে নৌকার ভোট ৪ ডিজিটের নিচে নামেনি। কোনো কোনো কেন্দ্রে ধানের শীষের ভোট ২, ৩, ৫, ৬, ১২, ১৪, ২২, ২৪-এই সংখ্যায়। যদিও এই আসনে ভোট প্রদানের হার ৯৭ ভাগ পর্যন্ত দেখা গেছে। লালমনিরহাট-১ আসনে দেখা যায়, একটি কেন্দ্রে নৌকার ভোট যেখানে যথাক্রমে ২৬০৯ ও ১৯৪৩ ভোট, সেখানে ধানের শীষের ভোট একেবারে শূন্য। এই আসনের ২৪টি কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো ভোট নেই। এর অন্যান্য কেন্দ্রে নৌকার ভোট যেখানে ৪ ডিজিটের নিচে নামেনি সেখানে ধানের শীষের ভোট সিঙ্গেল ও ডাবল ডিজিট অতিক্রম করতে পারেনি। এখানে সর্বোচ্চ ৯৬ ভাগ পর্যন্ত ভোট কাস্ট দেখানো হয়েছে। রাজশাহী-৫ আসনে দেখা যায়, একটি কেন্দ্রে নৌকার ভোট যেখানে ২৪৯০, সেখানে ধানের শীষের ভোট মাত্র ৩টি। অপর একটি কেন্দ্রে নৌকার ভোট ১৬০০, আর ধানের শীষের ভোট মাত্র ৯টি। এভাবে এই আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে ৪ ডিজিট বনাম সিঙ্গেল-ডাবল ডিজিটের লড়াই হতে দেখা যায়।
দেশের মধ্যাঞ্চলের হিসাবে দেখা যায়, ঢাকা-৩ আসনের একটি কেন্দ্রে নৌকার ভোট যেখানে ৩৩৮২, সেখানে ধানের শীষের ভোট মাত্র ৫টি। এভাবে দেখা যায়, বিভিন্ন কেন্দ্রে নৌকার ভোট যেখানে ১৪০০ থেকে প্রায় ৪০০০ পর্যন্ত, সেখানে ধানের শীষের ভোট মাত্র ১০, ১১, ১৭, ১৮টি। হাতেগোনা কয়েকটি কেন্দ্রে ধানের শীষের ভোট ৩০০ থেকে ৪০০টি দেখা যায়। ফেনী-২ আসনে দেখা যায়, নৌকার ভোট প্রাপ্তি ২০০০ থেকে ৩০০০ ছাড়িয়ে গেলেও ধানের শীষের ভোট শূন্য থেকে দুই ডিজিটের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ১১২টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ১২টিতে ৩ ডিজিটের ভোট পাওয়া গেলো। একটি কেন্দ্রে নৌকার ভোট যেখানে ২৬৩৫, সেখানে ধানের শীষের ভোট শূন্য।
আকস্মিক উল্লম্ফন
পূর্বাঞ্চলের তথ্যে দেখা যায়, ঢাকা-৬ আসনে নৌকা প্রতীকের পরিবর্তে জাপার লাঙ্গল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এখানে অধিকাংশ কেন্দ্রে লাঙ্গল ও ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে ভোট প্রাপ্তির হার তিন ডিজিটে প্রায় সমতালে এগোলেও নির্দিষ্ট কয়েকটি কেন্দ্রে এই হার অস্বাভাবিক ওঠানামা করেছে। যেমন একটি কেন্দ্রে লাঙ্গলের ভোট হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে ১৪০১ হয়েছে। আর বিপরীতে ধানের শীষের ভোট নেমে দাঁড়িয়েছে ৮৫টিতে। অপর একটিতে লাঙ্গলের ভোট যেখানে ১৭৬৬, সেখানে ধানের শীষের ভোট মাত্র ৪৬টি। এভাবে লাঙ্গলের ভোট চার ডিজিটে উল্লম্ফন ঘটলেও ধানের শীষের ভোট দুই ডিজিটে নেমে গেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে সকল কেন্দ্রে নৌকা বিজয়ী হয়েছে সেগুলোর হাতেগোনা কিছু কেন্দ্র ছাড়া কোনটিতেই ধানের শীষ বেশি ভোট পায়নি। অর্থাৎ পরাজিতরা শতকরা ৯৯টি কেন্দ্রেই পরাজিত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া যায়। সিলেটের আসনগুলোতেও অনুরূপভাবে কিছু কিছু কেন্দ্রে নৌকা ও ধানের শীষের ভোট প্রাপ্তিতে ভারসাম্য থাকলেও আকস্মিকভাবে কিছু কেন্দ্রে নৌকার ভোট প্রাপ্তিতে বিপুল উল্লম্ফন ঘটে গেছে।
(চলবে)
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থপ্রণেতা
আপনার মন্তব্য লিখুন