post

এবনে গোলাম সামাদ জীবন, কর্ম ও চিন্তাধারা

সরদার আবদুর রহমান

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

প্রফেসর ড. এবনে গোলাম সামাদ একাধারে দেশের একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও বহুমাত্রিক লেখক। রাজধানীর বাইরে অবস্থান করেও গত প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল যাবৎ তাঁর চিন্তাধারা বাংলাদেশের বহু মানুষকে আকর্ষিত করেছে বলে তিনি জাতীয় পর্যায়ের একজন আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষক ও শিক্ষক হলেও রাজনীতির বিশ্লেষণ, ইতিহাস ও শিল্পকলায় তিনি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর প্রচুর লেখালেখি রয়েছে- যা মননশীল বক্তব্যে ঋদ্ধ। যৌবন থেকে পরিণত বয়স অবধি কলম ধরে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে ইতিহাসের অমূল্য উপাদান সংরক্ষণ করেন। তিনি কলাম লেখক হিসেবে বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত। তিনি মূলত রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়েই বেশি লিখতেন। তাঁর লেখায় মুক্তচিন্তার ছাপ লক্ষ করা যায়। তাঁর লেখায় গভীর ইতিহাসচেতনতারও ছাপ রয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশেষ রাজনৈতিক আনুগত্যের অনুপস্থিতি তাঁর রচনাগুলোর বিশেষ আকর্ষণ। আছে এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা- যা সচরাচর দেখা যায় না।

পরিচয় এবনে গোলাম সামাদের পৈতৃক বসতভিটা ছিল সাবেক যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মোহাম্মদপুর থানার ছাত্ররাজপুর নামক গ্রামে। পিতার রেলওয়ের চাকরির সূত্রে তারা রাজশাহী শহরে স্থায়ী হন। এই শহরেরই শিরোইল মহল্লায় ১৯২৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর এবনে গোলাম সামাদের জন্ম হয়। পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ ইয়াসিন ও মাতার নাম নছিরন নেসা। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। পিতা মোহাম্মদ ইয়াসিন রেলওয়ে বিভাগে চাকরি করতেন স্টেশন মাস্টার হিসেবে। চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে উত্তর বাংলা এবং পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন স্টেশনে কাজ করেছেন। সেই সুবাদে তার অগ্রজদের মধ্যে কয়েকজন কলকাতাতেই থেকে গেছেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর এদেশে তারা ফিরে আসেননি। মৌলভী ইয়াসিন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন উদ্বোধনের ৭ দিন পর স্টেশন মাস্টার হিসেবে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাজশাহীতে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি শহরের সিপাইপাড়াতে (নগরীর ফায়ার ব্রিগেডের মোড়) জমি ক্রয় করে পাকা বসতবাড়ি নির্মাণ করেন। মোহাম্মদ ইয়াসিনও চাকরি জীবনের শুরু থেকেই লেখালেখির অভ্যাস গড়ে তোলেন। তিনি নাটক, উপন্যাস এবং প্রবন্ধসহ মোট ৭টি গ্রন্থ রচনা করেন তাঁর জীবদ্দশায়। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে বলে জানা যায়। এবনে গোলাম সামাদের বড় বোন দৌলতুন নেসা খাতুন ছিলেন রাজনীতিক ও সাহিত্যিক। বৈবাহিক সূত্রে তিনি রংপুরে স্থায়ী হন এবং সে সময়ের প্রখ্যাত নেতা আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে সম্পৃক্ত হন এবং কারাবন্দী হন। তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্তফ্রন্টের টিকিটে রংপুর-বগুড়া মহিলা আসনের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। দৌলতুন নেসা একজন সুসাহিত্যিকও ছিলেন।

শিক্ষা এবং কর্মজীবন এবনে গোলাম সামাদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পিতার মাধ্যমে। এরপর রাজশাহী শহরের হোসেনীগঞ্জ মহল্লার কালা পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন পাঠ গ্রহণের পর তাকে ভর্তি করা হয় স্থানীয় শেখপাড়ায় ভূষণ পণ্ডিতের পাঠশালায়। এরপর পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীদের দ্বারা পরিচালিত তারিনী বাবুর পাঠশালায় ভর্তি হয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। সেখান থেকে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার ব্যাপটিস্ট মিশনারি স্কুল থেকে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে। সেখান থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজে এবং সেখান থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আইএসসি পাস করেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (বর্তমানে শেরেবাংলা বিশ^বিদ্যালয়) থেকে ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচার (বিএজি) ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর চলে যান ইংল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে। ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্ল্যান্ট প্যাথোলজিতে পড়াশুনা করে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে। দেশে ফিরে এসে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তেজগাঁও জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে অ্যাসিস্টেন্ট প্ল্যান্ট প্যাথোলজিস্ট হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সরকারের একটি বৃত্তি নিয়ে ফ্রান্সে যান এবং সেখানকার পুয়েতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীবাণুতত্ত্বের উপর মৌলিক গবেষণা করে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের ‘ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল এগ্রোনোমিক’ থেকে মাইক্রোবায়োলজিতে সুপেরিয়র সার্টিফিকেট লাভ করেন। এছাড়া ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভার্সাই কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি গবেষণাগারে গবেষক হিসেবে চাকরি করেন এক বছর। এ প্রসঙ্গে ড. সামাদ লিখেছেন: ‘তাঁর বাবা একটি বাড়ি বিক্রয় করে যে টাকা পান তা দিয়ে তাকে পাঠান বিলাতে। তাঁর সেখানে আরো পড়বার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি অর্থের অভাবে।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ফ্রান্সের পুয়েতিয়েকে ‘সেরা ছাত্র-শহর’ এবং শিল্প ও ইতিহাসের শহর হিসেবে বিশেষভাবে খ্যাত বলে মনে করা হয়। এছাড়া প্যারিস শহরে রয়েছে নৃ-তত্ত্ব জাদুঘর। সেই জাদুঘরে অনেক সময় কাটিয়েছেন ড. এবনে গোলাম সামাদ। এ ধরনের চারণক্ষেত্র তাঁর নৃ-তত্ত্ব, সাহিত্য ও শিল্প সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের পথ প্রশস্ত করে।

শিক্ষক জীবন ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে তিনি ঢাকায় পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে চাকরি করেন চার বছর। চাকরির পাশাপাশি শেখেন ফরাসি ভাষা। ১৯৬৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানে প্রভাষক পদের জন্য দরখাস্ত করেন এবং এই পদে নিয়োগ পেয়ে ১৯৬৪ সালের ১১ নভেম্বর উদ্ভিদবিজ্ঞান প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এই বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ১৯৭৯ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৯ সালের ১৭ আগস্ট প্রফেসর পদে উন্নীত হন। তাঁর অবসরোত্তর ছুটি শেষ হয় ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে। অবসর জীবনের পুরো সময় এমনকি মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে কেবল লেখালেখির মধ্যেই নিয়োজিত রেখেছিলেন। ক্লাসে তিনি গতানুগতিক ধারায় পড়াতেন না। শিক্ষার্থীদেরকে সর্বদা ব্যবহারিক উদাহরণ দিয়ে বুঝাতেন। তিনি যখন ‘প্ল্যান্ট প্যাথলোজি’ পড়াতেন তখন শিক্ষার্থীরা যেন উদ্ভিদের মনস্তত্ত্ব পড়তো। বলতেন, ‘প্ল্যান্ট’ হচ্ছে ‘উদ্ভিদ’ আর ‘প্যাথোজ’ হচ্ছে ‘দুঃখ’। অর্থাৎ ‘উদ্ভিদের দুঃখ’। আর তাদের এই দুঃখের কারণ হলো মানুষ।

পারিবারিক জীবন ব্যক্তিগত জীবনে ড. এবনে গোলাম সামাদ দুটি বিবাহ করেন। ফ্রান্সে থাকাকালে তিনি প্রথমা স্ত্রী ফ্রান্সের এক নাগরিক বিদুষী নারী ফ্রার্সিম দোর্দাকে বিবাহ করেন এবং দুই পুত্র ও এক কন্যার পিতা হন। ফ্রার্সিম দোর্দাকে বাংলাদেশেও নিয়ে আসেন। তবে একাত্তরের আগে তিনি ফ্রান্সে ফিরে যান এবং ইতোমধ্যে ফ্রান্সে তিনি মারাও গেছেন। এই স্ত্রীর দুই পুত্র ও এক কন্যা রয়েছেন। তবে তাদের কেউ বাংলাদেশে বসবাস করেন না। দ্বিতীয় স্ত্রী জাহানারা সামাদ তাঁর ২ পুত্র শাহরিয়ার সামাদ ও আল ফাত্তা সামাদ এবং ১ কন্যা আয়েশা সামাদকে নিয়ে রাজশাহীর নিজ বাসভবন নছিরন ভিলায় বসবাস করেন। পড়া ও লেখার প্রতি তিনি এতটাই নিবিষ্ট ও নিমগ্ন থাকতেন যে, পরিবারের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেননি। পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার সময় দেশের অবস্থার প্রতি তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কথাই প্রকাশ পেতো। যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও অর্থলাভের প্রতি ঝোঁক দেখা যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবনে গোলাম সামাদ ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বাড়ির নিকটে অবস্থিত পদ্মা নদী পার হয়ে ভগবানগোলা দিয়ে ভারতের কলকাতায় উপস্থিত হন। এসময় তিনি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতের একাধিক রাজ্যও ভ্রমণ করেন। ১৯৭১-এ কলকাতায় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদনাকর্মে যুক্ত হন। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাঁর জীবনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। এই সংগ্রামের নানা ঘটনার সাক্ষী তিনি। কলকাতায় অবস্থানকালে তাঁর মনে বিপুল ভাবান্তর সৃষ্টি করে। তিনি কলকাতা গিয়ে বুঝতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ বলতে ভারত যা বুঝায়, বাংলাদেশের মানুষ তা বুঝায়নি। ভারত চেয়েছিল ¯্রফে পাকিস্তান ভাঙতে। আর বাংলাদেশের মানুষ চেয়েছে একটি পৃথক রাষ্ট্র গড়তে। স্বাধীনতা লাভের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগদান করেন।

সাহিত্যকর্ম এবনে গোলাম সামাদের পেশা শিক্ষকতা হলেও তিনি পরিচিতি পেয়েছেন লেখক-চিন্তাবিদ হিসেবে। বেশি সমাদৃত হয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আত্মমুখী হলেও তার চিন্তাচর্চার সাথে জনসম্পৃক্তির কখনো অভাব ঘটেনি। বিশেষ করে তাঁর চিন্তাচর্চা চলমান স্রােতের সাথে ভেসে যায়নি। একজন স্বাধীন চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি খুব ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সাথে জড়িয়েছিলেন। খুব কম বয়সেই তার লেখা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ড. এবনে গোলাম সামাদের একান্ত আগ্রহ ছিল। উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হলেও তিনি শিল্পের ইতিহাসও রচনা করেন। বাংলাভাষায় ইসলামী শিল্পকলার ওপর প্রথম বই ছিল ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে। আশির দশকে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যভুক্ত ছিল। তিনি বিজ্ঞান, সমাজ-সংস্কৃতি, সাহিত্য, ইতিহাস, শিল্প, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। এসব বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ এবং বহু সম্পাদকীয় কলাম, প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। জীবাণুতত্ত্বের শিক্ষক এক সময় ঝুঁকে পড়েন নৃ-তত্ত্বের দিকে। প্যারিসের নৃ-তত্ত্ব জাদুঘর তার এই আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে দেয়। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে অসংখ্য কলাম লিখেছেন। এগুলিতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক প্রবাহ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্কট, ভাষা ও সাহিত্য, চিত্র ও শিল্পকলা ইত্যাদি প্রসঙ্গ বলিষ্ঠভাবে তাঁর অভিমত প্রকাশিত হতো। এছাড়াও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস ভিত্তিক পাঠ্যতালিকা এবং পাঠ্যতালিকারও বই রয়েছে তাঁর। গ্রন্থগুলো হলো: ১. বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি ২. আত্মপক্ষ ৩. আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ৪. বাংলাদেশ : সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া ৫. বায়ান্ন থেকে একাত্তর ৬. আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এবং আরাকান সঙ্কট ৭. মানুষ ও তার শিল্পকলা ৮. ইসলামী শিল্পকলা ৯. শিল্পকলার ইতিকথা ১০. বাংলাদেশে ইসলাম ১১. বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ ১২. বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য ১৩. উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ১৪. জীবাণুতত্ত্ব ১৫. উদ্ভিদ সমীক্ষা ১৬. প্রাথমিক জীবাণুতত্ত্ব ১৭. নৃতত্ত্বের প্রথমপাঠ ১৮. নৃতত্ত্ব ১৯. আমার স্বদেশ ভাবনা ২০. রাজশাহীর ইতিবৃত্ত ২১. বাঙালির জন্ম পরিচয় ২২. বাংলাদেশ কথা ২৩. নির্বাচিত কলাম (২ খণ্ড) ২৪. নির্বাচিত রচনাবলি (৩ খণ্ড)

পুরস্কার জাতীয় শিশু-কিশোর পত্রিকা মাসিক নতুন কিশোরকণ্ঠের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮’তে ভূষিত করা হয়। এছাড়া তিনি রাজশাহী সংস্কৃতিকেন্দ্র পুরস্কারেও ভূষিত হন।

মৃত্যু ১৫ আগস্ট ২০২১ রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নিজ বাসভবনে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। একই দিন বিকেলে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ^বিদ্যালয়ের নিজস্ব গোরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।

চিন্তাধারা এবনে গোলাম সামাদ মানবজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি বিষয়েরই ব্যাখ্যা দিতে পারঙ্গম ছিলেন- একথা বলাই যায়। দেশের যেকোনো বুদ্ধিজীবীর বিতর্কিত বক্তব্যের জবাব দেয়ার মতো সক্ষমতা তিনি অর্জন করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কলকাতা অবস্থান করে সেখানকার সময়কালীন অবস্থা স্বচক্ষে অবলোকন করার পাশাপাশি যুদ্ধে বহির্বিশ্বের দেশগুলোর কূটনৈতিক টানাপড়েনও তিনি পর্যবেক্ষণ করেন। ফলে, তাঁর দেয়া মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ প্রচলিত মোহ কাটিয়ে এক ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপনা হাজির করে। বাকি জীবন তাঁর রচনাবলিতে তারই বহিঃপ্রকাশই লক্ষ্য করা যায়। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক। কোনো দল কিংবা নির্দিষ্ট মতের গণ্ডিতে তিনি আবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর রচনায় তিনি নিজের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবস্থানকে শক্তিমত্তার সঙ্গে তুলে ধরেন। সারাজীবন বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য মাটির নিকটবর্তী শিকড় খোঁজার চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর চিন্তাধারার কিছু নমুনা এখানে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করা হলো। ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে তথাকথিত পারস্পরিক সংঘাত নিয়ে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “ধর্ম ও রাজনীতিকে পরস্পরের বৈরী ভাববার কোনও কারণ তো দেখি না। ধর্ম আমাদের কতকগুলি মূল্যবোধ প্রদান করে। এইসব মূল্যবোধের ভিত্তিতে আমরা চাই জীবনকে পরিচালিত করতে। রাজনীতির লক্ষ্য যদি হয় উন্নত সমাজজীবন গড়া তবে ধর্মের মূল্যবোধগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই ধর্ম যুগে যুগে রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। যে বিলাতের কাছ থেকে আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণা দাঁড় করেছি সে দেশের রাজনীতিও ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করতে পারেনি।.... বিলাতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাইবেলের যুক্তি টানা হয়েছে। তারা বলেছে- আমরা সকলেই আদম সন্তান, মানুষে মানুষে ব্যবধান তাই থাকতে পারে না।” তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক। এর চেতনা বা আদর্শ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ শব্দটা একেকজন একেক অর্থে ব্যবহার করছেন। যাকে বলা হচ্ছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ- তার ছিল দুটি রূপ। বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছিল একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। আর ভারত চাচ্ছিল সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশকে তার একটি অঙ্গরাজ্যে অথবা চৎড়ঃবপঃড়ৎধঃব-এ পরিণত করতে।” মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কেউ কেউ ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আজ যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির কথা বলছেন তারা একটা বিশেষ রাজনৈতিক মতলবেই তা বলছেন। আমি এদের এই বক্তব্য সমর্থন করতে পারি না। ১৯৭১-এ সমস্যা ছিল স্বাধীনতা অর্জনের, আর আজ সমস্যা হলো স্বাধীনতা রক্ষার। আমি মনে করি আমাদের স্বাধীনতা কেবলমাত্র একটি দেশই বিপন্ন করে তুলতে পারে- সে হলো ভারত। আমি তাই আমাদের দেশের সমস্ত ভারতবিরোধী দলকে এখন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসাবে গণ্য করতে চাই। ... মুসলিম চেতনাকে অগ্রাহ্য করে আমাদের জাতীয়তাবাদ টিকে থাকতে পারে না।” এবনে গোলাম সামাদের চিন্তা-চেতনার ধারা প্রধানত বাংলাদেশের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যকেন্দ্রিক প্রবহমান দেখা গেছে। তাঁর প্রায় প্রতিটি গ্রন্থেই কোনো না কোনোভাবে এটি প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষত আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ও বাংলাদেশে ইসলাম গ্রন্থ দুটিতে এই বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। এতে তিনি এখানকার মানুষের নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক পরিচয় বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করে প্রকৃত পরিচয় স্থির করতে প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলা ভূখণ্ডে ইসলাম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মধ্য এশিয়া থেকে আগত ইসলাম প্রচারকগণ এবং যুদ্ধবিজয়ী শাসকদের মহানুভবতার প্রভাবে। এই অঞ্চলে যে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর বিকাশ ঘটেছে তাতে মূল অবদান রেখেছেন মুসলমান শাসক ও অমাত্যবর্গ। এজন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল উদারচিত্তের। এই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, “অনেকে বলেন, ধর্মের সাথে রাজনীতিকে যুক্ত করা উচিত নয়। কিন্তু ইসলামে চাওয়া হয়েছে এমন রাষ্ট্র গড়তে- যা হবে ন্যায় ও মানব কল্যাণভিত্তিক। ইসলামে সমাজজীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে খাটো করে দেখবার চেষ্টা হয়নি। আসলে ইসলামের আরম্ভই হয়েছে একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে।” অপর একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে আমরা চেয়েছিলাম সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে একটা পৃথক স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র (ঘধঃরড়হ ংঃধঃব) গড়তে। একদিন যা ছিল পূর্ব পাকিস্তান, আজ তাই হলো বাংলাদেশ। বর্তমান বাংলাদেশের সীমানা রচিত হতে পেরেছে পাকিস্তান হবারই ফলে। বাংলাদেশ হবার পেছনে আছে একটা পৃথক ইতিহাসের ধারা। যাকে ভুলে গেলে বড় রকমের রাজনৈতিক ভুল করা হয়। খুঁজে পাওয়া যায় না আজকের বাংলাদেশের পৃথক অস্তিত্বের ভিত্তি। ১৯৭১-এ আমরা স্বাধীনতা চেয়েছি। মিশে যেতে চাইনি অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে। কিন্তু সাবেক পাকিস্তান ভাঙতে না ভাঙতেই এদেশে সৃষ্টি হতে পারলো হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। যেরকম কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্ভব হতে পারবে বলে আগে অনুমান করা যায়নি। সাধারণত মুসলমানদের বলা হয় ‘সাম্প্রদায়িক’। কিন্তু বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানরা হিন্দু-বৗদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ গঠন করে যে মনোভাবের পরিচয় প্রদান করলেন তাকে নিশ্চয় অসাম্প্রদায়িক মনোভাব বলে চিহ্নিত করা যায় না। একেও বলতে হবে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক মনোভাবেরই পরিচায়ক। যেটা এদের কাছ থেকে আগে প্রত্যাশা করা যায়নি। ‘ইসলাম ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে’ শীর্ষক আরেকটি কলামে তিনি উল্লেখ করেন, “বাংলাভাষী হিন্দুরা কোনো দিনই চাননি একটি পৃথক স্বাধীন দেশ গড়তে। তারা চেয়েছেন, ভারতীয় মহাজাতির অংশ হয়ে বাস করতে। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানরা চেয়েছেন একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। বাংলাদেশে বাংলাভাষী মুসলমান কেবলমাত্র একটি ধর্ম সম্প্রদায় নয়। তারা হলেন এ দেশের বাস্তব ভিত্তি।” ‘নারী স্বাধীনতা নিয়ে বিভ্রান্তি’ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, “মানুষের মধ্যে সেই আদিম যুগ থেকেই গড়ে উঠেছে বিশেষ শ্রম বিভাজন- সন্তান প্রতিপালনকে নির্ভর করে। মেয়েরা সন্তান প্রতিপালনের জন্য করেছে ঘরের কাজ। অন্যদিকে পুরুষেরা করেছে বাইরের কাজ। এই শ্রমবিভাজনকে এখন আমাদের দেশে বিশেষভাবে ভেঙে ফেলবার চেষ্টা চলেছে নারী স্বাধীনতার নামে। মেয়েদের বোঝাবার চেষ্টা হচ্ছে ঘরের কাজ ছোট আর বাইরের কাজ সম্মানজনক। কিন্তু সন্তান প্রতিপালনে অবহেলা হলে মানব অস্তিত্ব হয়ে উঠবে বিপন্ন। যে সম্বন্ধে বলা হচ্ছে না কিছু। আর এখান থেকে সৃষ্টি হতে পারছে নারী স্বাধীনতার ভুল ব্যাখ্যা। ঘরের কাজ পুরুষের ইচ্ছায় চলে না। ঘরের কাজ মেয়েরা করে আপন ইচ্ছায়, সন্তান প্রতিপালনের অভিলাষ নিয়ে।”

এবনে গোলাম সামাদ বরাবরই ছিলেন একজন নির্মোহ ও প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব। তাঁকে কখনোই কারো দ্বারা প্রভাবিত হতে দেখা যায়নি। কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি সভার আবহাওয়া বুঝে বক্তব্য দেয়ার রীতি মান্য করতেন না। বরং দেখা যেতো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করতে। এতে আয়োজকদের বিব্রত হতে হলেও কিছু করার থাকতো না। তিনি বিশেষ রাজনৈতিক চিন্তার অধিকারী থাকলেও তার দ্বারা বশীভূত হননি। প্রতিটি বিষয়েই স্বাধীন মত প্রকাশের শক্তিমত্তা তিনি অর্জন করেছিলেন। তাঁর চিন্তাধারা লালন ও প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ড প্রকৃত স্বাধীনসত্তা নিয়ে অস্তিত্ববান থাকতে পারে-এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ দেখা যায় না। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থকার

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির