post

ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অপূর্ণ প্রত্যাশাগুলো....

প্রফেসর মো. মোসলেমউদ্দীন শিকদার

১৯ মার্চ ২০২৩

এককালে বাংলার অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল পূর্ব বাংলা ও আসামের মুসলিম নেতৃবৃন্দের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও ঐতিহাসিক অবদান। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম এটুকু জানে যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথম সিঁড়ি ধাপে ধাপে বেয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার চূড়ান্ত অভ্যূদয় ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে আমাদেরকে আরো জানতে হবে এবং প্রয়োজনে জানাতে হবে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ইঙ্গ-হিন্দু জোটের দুর্লঙ্ঘ বাঁধার প্রাচীর ডিঙিয়ে উপমহাদেশ বিভক্তির ফলে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসেবে এ ভূখণ্ডটি না পেলে পশ্চিম বাংলা ও কাশ্মীরের ন্যায় আজো আমাদেরকে হয়তো পরাধীন থাকতে হতো। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হলে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও ১৯৭১ এর স্বাধীনতা অর্জন ছিল সুদূরপরাহত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও পটভূমি কি ছিল, কারা এর পক্ষে ও বিপক্ষে ছিল, তার বস্তুনিষ্ঠ সঠিক ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়াই বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের প্রয়াস। অবশ্য এ কাজের জন্য এরূপ একটি প্রবন্ধ আদৌ যথেষ্ঠ নয় প্রয়োজন একটি তথ্যবহুল সুবিশাল গ্রন্থের। 

১৯০৫ সালে বৃটিশ সরকার কর্তৃক বঙ্গভঙ্গ ঘোষণায় এ অঞ্চলের যে নব জাগরণের ঢেউ ওঠে, তার ফলে চতুর্দিকে এক মহাজাগরণের সৃষ্টি হয়। ১৯১১ সালে বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় বঙ্গভঙ্গ বাতিল ঘোষণা, শতাব্দী বঞ্চিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ ভূখন্ডের (নতুন প্রদেশের) বহুমুখী উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্থ করে। এমতাবস্থায় তৎকালীন বঙ্গ-ভারতের অবিসংবাদিত জননেতা নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ বাহাদুর (১৮৬৬-১৯১৫), নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী (১৯৬৩-১৯২৯), শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক (১৯৭৩-১৯৬২) প্রমুখ মুসলিম নেতৃবর্গের আবেদনে সাড়া দিয়ে তৎকালীন বৃটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেন। মূলত: আকস্মিক ও অনৈতিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদের অপূরণীয় ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে পূর্ববঙ্গবাসীকে আশ্বস্ত করার অমূল্য উপহার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বৃটিশ সরকার প্রধানের এ ঘোষণায় কোলকাতায় কায়েমী স্বার্থবাদী সামন্ত বুর্জোয়া শ্রেণি এবং তাদের এতদাঞ্চলের দোসর বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরূদ্ধে আদা-জল খেয়ে লাগে। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের আপোষহীন সংগ্রাম ও সরকারের আন্তরিকতার দরুণ ১০ বছর বিলম্বে হলেও এ মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়। বস্তুত ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সাংস্কৃতিক আবহ, ধর্মীয় চেতনাসহ সুকুমার বৃত্তির প্রায় সকল শাখা-প্রশাখার জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তথা অসাম্প্রদায়িকভাবে সম্পন্ন হয়। বরং কিছুটা তিক্ত হলেও সত্য যে, বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ এই মহতী উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছিল, তাদেরই অধিকাংশ শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারী মুসলমানদের চেয়ে সঙ্গত কারণেই অধিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে এবং শতবর্ষ পরেও তা প্রায় সমানগতিতে বহাল রয়েছে। (ত্রয়োদশ শতকে বখতিয়ার খিলজি’র বঙ্গবিজয়ের প্রাক্কালে বাংলায় মুসলিমরা ছিল সংখ্যালঘু, ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের ২য় আদমশুমারীতে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু হয়। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়েই ১৯৪৭ ও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ)

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের নাম নিশানা মুছে ফেলার যে গভীর দুরভিসন্ধিমূলক অভিযান শুরু হয়েছে এবং মাদ্রাসাপাঠ তথা ইসলামপ্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত অঘোষিতভাবে চলছে, তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সচেতন কোনো নাগরিকের পক্ষেই নীরব দর্শক হয়ে থাকা অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করি। সঙ্গত কারণেই এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তো নয়ই, অত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য এবং প্রতিষ্ঠাকাল অবধি কায়েমী স্বার্থবাদী মহল ও ক্ষমতাসীন কর্ণধারদের প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা সংক্ষেপে কিছুটা আলোকপাত করার প্রয়াস নেব, ইনশাআল্লাহ। 

প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি (বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়া)

বিশ শতকের বাংলা ভারতের ইতিহাসে বোধহয় সবচেয়ে বেশী আলোচিত ইস্যু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও তৎসঙ্গে কিছুটা সম্পর্কিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা। বঙ্গভঙ্গ ছিল তৎকালীন বৃটিশ সরকারের সুদীর্ঘ চিন্তা-গবেষণার ফসল যা কার্যত শুরু হয়েছিল ১৮৫৪ এবং তা কার্যকরী হয়েছিল লর্ড কার্জনের আমলে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর। ইতিহাস স্বাক্ষী, সত্যিকার অর্থে এটা কোনো বঙ্গভঙ্গ ছিল না। তৎকালীন কায়েমী স্বার্থপুজারী বর্ণবাদী হিন্দুরা ঘোলাজলে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে এটাকে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ বলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দিল, তা শতবর্ষ ধরে দাবানলের ন্যায় গোটা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে চলছে। সাম্প্রতিকালে আসামে জাতিগত দাঙ্গায় বাংলা ভাষাভাষী শত শত মুসলমান হতাহত ও হাজার হাজার নারী ও শিশু নির্যাতিত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আতঙ্কের মাঝে অবস্থান করছে। বৃটিশ সরকারের অধীনে ১৯০৫ সালে উপমহাদেশের এক-তৃতীয়াংশ জন-অধ্যুষিত বিশালায়তন বঙ্গ প্রেসিডেন্সী ও আসাম দু’ভাগে এবং ১৯১২ সালে পুনঃ বিভাজন পূর্বক নতুন প্রশাসনিক বিন্যাস হলো। 

আর এদেশের ইতিহাস সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, অতীতে এ ভুখণ্ড অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গৌড় ইত্যাদি বহু নামে ও ভাগে বিভক্ত থাকলেও ‘বঙ্গমাতা’ নামে কখনোই অভিহিত ছিল না। কায়েমী স্বার্থবাদীদের এ অপ-প্রচারের রহস্য নগ্নভাবে উন্মোচিত হলো ১৯৪৭ সালে, যখন তাদের কথিত ‘বঙ্গমাতা’কে নিজেরাই একরকম ‘নরবলি’ দিল। 

১৯০৫-১১ সালে তথাকথিত ‘বঙ্গমাতার’ অখণ্ডতা রক্ষার নামে বাঙালী জাতীয়তা, অবিভাজ্যতার ধুয়া তুলে যারাই এক রাষ্ট্রের অধীনে প্রশাসনিক সুবিধার্থে নতুন প্রদেশ গঠনের তীব্র বিরোধীতা, সশস্ত্র ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, এমনকি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তোষামোদ পূর্বক বঙ্গভঙ্গ বাতিল করেই ছাড়লো, তাদেরই আপোষহীন আন্দোলনের ফলে ১৯৪৭ সালে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পূর্বাঞ্চল পাকিস্তান নামে একটি পৃথক রাজ্যের অংশ হয়। আজ পিছনে ফিরে বঙ্গভঙ্গকে (১৯০৫) সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাসে একটি প্রধান বিভাজক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যা ১৯৪৭ সালে বাংলা তথা ভারত বিভাগ অনিবার্য করে তুলেছিল (জেন. আর ম্যাকলেন)। (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন কৃত ‘বঙ্গভঙ্গের শতবর্ষ : ফিরে দেখা ইতিহাস’ প্রবন্ধ, দৈনিক ইত্তেফাক, ঈদ সংখ্যা, ১নভেম্বর, ২০০৫, ঢাকা, প্রবন্ধটি বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য।) বিভক্ত বাংলার শতকরা সাড়ে বাষট্টি ভাগ নিয়ে গঠিত হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান’, যা ১৯৭১ সাল থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, বাকিটুকু আজকের পশ্চিম বঙ্গ যা স্বাধীন ভারতের একটি প্রদেশ মাত্র। ১৯০৫ সালে বাংলা বিভাগ পূর্বক পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের আগে ও যে বাংলা ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সীর আয়তন ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ বর্গমাইল, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তার আয়তন দাড়িয়েছে মাত্র ৩০ হাজার বর্গমাইলে। 

১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে সমগ্র বাংলা ও আসাম নিয়ে অখণ্ড স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবার অমিত সম্ভাবনা ও সুযোগ ছিল। শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আকরাম খান, আবুল হাশিম গংরা শুধু নন, মুসলিম লীগ হাই কমান্ড মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পর্যন্ত কলিকাতা মুর্শিদাবাদসহ যুক্ত বাংলার পক্ষে ‘বসু-সোহরাওয়ার্দী’ উদ্যোগে সম্মতি দিলেন। কিন্তু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীরা শুধুমাত্র প্রভাবশালী কতিপয় বর্ণহিন্দু নেতার সাম্প্রদায়িক স্বার্থপ্রণোদিত একগুয়েমির দরুণ অখণ্ড স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগের সদ্বব্যবহার করা গেল না। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক ও স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রাণপুরুষ এম. আর আখতার মুকুল যথার্থই বলেছেন, ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশের সেই অবহেলিত বাঙ্গালীরা কিন্তু এখন স্বাধীন। এঁদের নিজস্ব পতাকা রয়েছে, এঁদের জাতীয় সংগীত বাংলায় পরিবেশিত হচ্ছে আর একমাত্র এঁদেরই রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এই বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী এখন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবার প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।’ (এম.আর আখতার মুকুল, কলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি, ২০১৪, পৃষ্ঠা-২৬৭।) আর ১৯০৫-১১ সালে ঢাকাকে রাজধানী করে গঠিত নতুন প্রদেশ যদি বহাল থাকতো, তাহলে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পূর্ববঙ্গকে অনেকদিক দিয়ে উন্নত এবং ঢাকাকে সমৃদ্ধ মহানগরী হিসেবে পাওয়া যেত। উন্নয়নের সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে আমরা আরো সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পেতাম। মুল আলোচনার সুবিধার্থে আমরা আরো একটু পিছনে ফিরে তাকাই। 

১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লীর রাজ দরবারে বৃটিশ রাজা মহামান্য পঞ্চম জর্জের ঘোষণায় বঙ্গভঙ্গ রদ হলে মুসলিম বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ হতভম্ব হয়ে পড়েন। এ খবর পূর্ববাংলা ও আসামের শোষিত বঞ্চিত মুসলমানদের কাছে ছিল আসলেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। কেননা বঙ্গভঙ্গের ফলে সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে তাদের মধ্যে সার্বিক যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল, দিল্লী সরকারের ঘোষণায় তা কর্পূরের মত উবে যায়। মুসলমানেরা নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও তাহজিব তমদ্দুন রক্ষার্থে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং ভারত সরকারের কাছে দারুণ প্রতিবাদ জানায়। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ পূর্ব বাংলার মুসলমানদের অসন্তুষ্টির ব্যাপারে আঁচ করতে পেরে ঢাকায় চলে আসেন এবং সাগ্রহে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দের ২৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল ১৯১২ সনের ৩১শে জানুয়ারি লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে দেখা করেন এবং বলেন, ‘যদি বঙ্গভঙ্গ রদ একান্তই পুনর্বিবেচনা না করা হয়, তবে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা সর্বদিক দিয়ে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের বিকল্প দাবী, কমপক্ষে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। জবাবে লর্ড হার্ডিঞ্জ বলেন, That the Government of India realized that education was the true salvation of the Muslims and that the Government of India, as an earnest of their intentions, would recommend to the secretary of state, the constitution of a University at Dacca. On 2nd February, 1912 a Communique was published stating the decision of the Government of India that the constitution of a university of Dacca (Dr. M.A Rahim, The History of the University of Dacca, PP. 4-5, 1981, Calcutta University Commission Report, Vol-IV, P.-133)

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর মহামান্য আগাখানের নেতৃত্বে ভারতের ৩৫ জন মুসলিম নেতা সিমলায় ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎপূর্বক মুসলমানদের পক্ষে যে কয়টা সুনির্দিষ্ট দাবী পেশ করেন, মুসলমানদের ধর্মীয় ও তাদের বুদ্ধিগত জীবনের কেন্দ্ররূপে একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল অন্যতম। ১৯১১ সালের ১৯ আগষ্ট লর্ড হেয়ার ও লর্ড চার্লস বেইলীর দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষ্যে এক জনাকীর্ণ সংবর্ধনা সভায় পৃথক দুটো মানপত্রে নবাব সলিমুল্লাহ ও নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী জানিয়েছিলেন। 

প্রতিষ্ঠাকালীন প্রভাবশালী মহলের বাধা বিপত্তি 

এভাবে মুসলীম নেতৃবৃন্দের পৌনঃপুনিক দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এতে একযোগে বাঁধার সৃষ্টি করেন হিন্দুনেতারা। তারা বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্র-পত্রিকায় এ ব্যপারে জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা এবং বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯১২ সালের ২৮শে মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে তাঁরা সভা করেন। দুঃখজনক এই সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইতিপূর্বে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আহুত শোভাযত্রা ও রাখিবন্ধন কর্মসূচীতেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। (আমিনুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা, লেখা প্রকাশনী, ৫৬/ডি, কলেজ ষ্ট্রিট, কলকাতা, ৭৩, পৃষ্ঠা-১৪১।)

পরিতাপ ও বিস্ময়ের ব্যাপার, পূর্ববঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের বিশাল জমিদারী ছিল, তাঁর মুসলিম প্রজারা লেখাপড়া শিখুক, উচ্চশিক্ষিত হোক, তাঁর কাব্য ও সাহিত্যের মূল্যায়ন করুক, তা কি তাহলে তিনি চাননি? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য উপাচর্য্য স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে ডা. স্যার রাসবিহারী ঘোষ, বাবু গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জী প্রমুখ বাংলার এলিটগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরূদ্ধে ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জকে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন এবং ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত স্যাডলার কমিশনের কাছে ১ম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৭) ধুঁয়া তুলে নানারূপ আপত্তি উত্থাপন করতে থাকেন। এমনকি ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে যে হিন্দু প্রতিনিধি দল লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে এ ঘৃণ্য অভিমত প্রকাশ করেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হবে অভ্যন্তরীন বঙ্গভঙ্গের সমতুল্য, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানগণ অধিকাংশ কৃষক, অতএব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে তাদের কোনো উপকার হবে না।’ সাম্প্রদায়িকতার দোহাই দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রস্তাবিত মোহামেডান কলেজ (ইসলামীয়া কলেজ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ খোলা নিয়ে কলকাতার মতলববাজ মহলের প্রশ্নের জবাবে নওয়াব আলী চৌধুরী বলেন, “অর্ধ শতাব্দীর অধিককাল ব্যাপী সংস্কৃত কলেজ তথা হিন্দু কলেজ চলে আসছে। এছাড়া ক্যালকাটা মাদ্রাসা, হিন্দু স্কুল ও কলেজ ইত্যাদি (সমসাময়িক) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি না করে তবে মোহামেডান কলেজ (মুসলিমদের উদ্যোগ) তা করবে কেন?” সমকালীন ইতিহাস সাক্ষী জনাব চৌধুরী ও শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের মতো প্রভাবশালী মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনমনীয় ভূমিকা না থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ইসলাম শিক্ষা নয়, আরবী, উর্দু ও ফারসী ভাষার কারিকুলাম থাকা হয়ত সম্ভবপর হতো না। শের-ই-বাংলার একাধিক ভাষণে তা দ্ব্যার্থহীন ভাষায় উল্লেখিত। 

ইতিপূর্বে বঙ্গভঙ্গ রহিত আন্দোলনের সময় মুসলিম স্বার্থের ঘ্রান পেয়ে সব হিন্দুরা যেমন একমন-একপ্রাণ হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিকার ক্ষেত্রেও তাই হলো। ঢাকাসহ পূর্ব বঙ্গের হিন্দুরা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে বাঁধা দেবার জন্য সবান্ধবে এগিয়ে এলো। হিন্দু নেতৃবৃন্দ ১৯১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায়, ১০ ফেব্রুয়ারি নারায়নগঞ্জ ও ফরিদপুরে, ১১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ ও বরিশালে বিক্ষোভ সভা করেন। তাদের বক্তব্যের মুলকথা ছিল, ‘ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে বাঙালী জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং তাদের মধ্যে বিরোধিতার তীব্রতা বেড়ে যাবে। এর ফলে শিক্ষার মান নিম্নগামী হবে, কারণ পূর্ব বাঙলার অধিকাংশ মুসলমানই চাষা-ভুষা (কৃষক প্রজার), আরো কত কি ধরণের বক্রোক্তি। 

‘A History of the Freedom Movement’ গ্রন্থের চতুর্থ খন্ডে ‘স্বাধীনতা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা’ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, পূর্ব বাংলার প্রায় দুইশত গণ্যমান্য হিন্দু ঢাকায় প্রখ্যাত উকিল বাবু আনন্দ রায়ের নেতৃত্বে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবার ক্ষোভ ও প্রতিহিংসায় তারা এটাকে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘ফাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’, এমনকি তারা এও বলেছিল, A good College (Dacca College) was killed to create a bad university (আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত আমার সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) যা হোক, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ প্রদত্ত প্রায় পাঁচশত একর জমি মতান্তরে ছয়শত একর, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রদত্ত কয়েক লক্ষ টাকা এবং শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও তাকিদে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সকল বাঁধা দূরীভুত হয়। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর পি.জে হার্টগ ও (P.J. Hartog) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকে বাংলার অনুন্নত ও অবহেলিত মুসলমানদের উন্নতির মাধ্যম হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপক পরিষদের প্রথম সভায় বলেন, ‘Dacca University scheme intended to provide extended opportunities of education to the Muslim community’ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে ইতিহাস বিভাগের প্রথম বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের অপর এক স্মৃতিকথা ‘জীবনের রত্নদ্বীপে’ উল্লেখিত উপাচার্য্য হারতাগকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদ্রুপ করে প্রদত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রী রামকৃষ্ণ ভান্ডার করের এক বক্তৃতা থেকে জানা যায় মুসলমানদের প্রতি তাদের বৈরিতা, বিরোধিতা ও ঘৃণা কত তীব্র ছিল। 

শিশু বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাপথে ষড়যন্ত্র অব্যাহত  

বাংলার মুসলমানদের আপোষহীন দাবীর প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও কায়েমি স্বার্থবাদী মহল একে কখনো সুনজরে দেখতে পারেনি। তাদের বৈরিতার দরূণ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই উপযুক্ত বরাদ্দের অভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভীষণ অর্থকষ্ট ভোগ করতে হয় এবং অঙ্গহানিও ঘটেছিল। তারা সুপরিকল্পিতভাবে এটাকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ রাখার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়েছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, ১৪ সদস্য বিশিষ্ট নাথান কমিটির সুপারিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌনঃপুনিক ব্যয়ের খাতে (Recurring expenditure) ১৩ লাখ টাকার প্রস্তাব থাকলেও বাংলার সরকারের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পি.সি মিত্র তা বাতিলপূর্বক মাত্র ৫ লাখ টাকা করেন। মন্ত্রী মহোদয়ের এ নির্দেশে মাননীয় উপাচার্য্য অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বলেন, ‘The Minister for Education had directed the university to retrench restrict expenditure so as to manage with a recurring grant of five Lac taka only. With this inadequate grant, it was difficult to set up a Residential cum Teaching University combined with a tutorial system and providing special facilities to Muslim students so that their numbers might increase’। 

মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় বুঝেশুনেই এ আঘাতটি করেছিলেন। কেননা তিনি এবং তার সম্প্রদায় চাইতেন না যে, বাংলার মুসলমানরা শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হোক। মন্ত্রীবরের ব্যয় সংকোচনের এই নির্দেশ যে কয়টি বিভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, তার মধ্যে আরবী ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগ ছিল অন্যতম। কেননা, এ বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ তখনো শেষ হয়নি। মন্ত্রীর ন্যায় তাঁর দোসররা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাপর্বে যেকোন ক্ষতি করতে দ্বিধাবোধ করতো না। খোদ উপাচার্য মহোদয় অভিযোগ করে যে, স্নাতক পূর্ব ছাত্রদের ভর্তি ফি মাত্র ৮ টাকা ধার্য ছিল। কিন্তু নিন্দুকেরা ৬০/- টাকা গুজব ছড়ানোর ফলে ১৯২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষে ভর্তি কার্যক্রম ব্যাহত হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫৮ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবস্থাপক পরিষদের প্রথম বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৭ আগষ্ট, ১৯২১। সভাপতির ভাষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চ্যান্সেলর লরেন্স জন লুমনি ড্যানডাস বলেন, ‘our next difficulty has been in satisfying the expectation of the Mohammedan community. Inspite of our best endeavors, we have so far been able to secure only a small number of Mohammedan for the teaching staff. He hoped that the Muslim students, who represented barely nine percent of the university student in Bengal, and were attracted to executive service would come to this university in larger numbers and equip themselves to undertake teaching..’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে যারা সবচাইতে বেশী অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেখা গেল সেই সুবিধাভোগীরাই শিক্ষার জোরে দখল করলো অধিকাংশ চাকুরি। যেহেতু মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষা শুরু করে অনেক পরে, তাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাদানের যোগ্যতাসম্পন্ন লোক মুসলমানদের মধ্যে পাওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ বাস্তব সত্যটি মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর অকপটে স্বীকার করেন, ‘But I wish publicly to state my desire to increase the number of the Muslims in the teaching staff without relaxing the standard of University Teaching. I fully understand and sympathetic with the anxieties of the Muslim Community in this matter.’

উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে ৩টি অনুষদ ও ১২টি বিভাগের ৫৪জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৮ জন ছিলেন মুসলমান। হাতে গোনা কয়েকজন ইউরোপীয় ছাড়া বাকী সবাই ছিলেন হিন্দু। কাজেই কি শিক্ষকতায়, কি ব্যবস্থাপনা কমিটি, হিন্দু কর্মচারী কর্মকর্তা এমন কি হিন্দু ছাত্রছাত্রীরাই অধিকতর ফায়দা গ্রহণ করে। তৎকালে বৃহত্তর বাংলায় মোট ৪৪টি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রের মধ্যে সর্বাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে মাত্র ৯টি কলেজ ছিল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাতে কলকাতা এমনকি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় Teaching cum Affiliating বিশ্ববিদ্যালয় না হতে পারে সেজন্যও হিন্দু নেতারা বিরোধীতা করেন। এ ব্যাপারে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বহু দেন-দরবার করেন। জনাব চৌধুরী জোর দাবী করেন, ‘The Colleges of the Eastern Bengal should be affiliated to the Dacca university .... the interests of their higher education would continue to suffer as before if their colleges are not treated separately.’  

কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার পঙ্গুদশা থেকে মুক্তি পেয়ে পূর্ণাঙ্গ অ্যাফেলিয়েটিং ক্ষমতাসহ যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত লেখক ও ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর লিখিত মন্তব্য উদ্ধৃত হলো, ‘ঢাকায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হল বটে, তবে কলকাতার বাবু বুদ্ধিজীবিদের ষড়যন্ত্রের কারণে একে পঙ্গু বিশ্ববিদ্যালয় করে রাখা হলো। প্রদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর এর প্রভাব পড়তে দেওয়া হলো না। প্রদেশের সব হাইস্কুল ও কলেজের এফিলিয়েটিং অথরিটি আগের মতই থাকলো বর্ণহিন্দু নিয়ন্ত্রিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। (অধ্যাপক আবদুল গফুর, আমার কলেজ কথা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০০, পৃষ্ঠা : ৩০৩-৩০৪) ১৯১৬ সালের ৩রা এপ্রিল এ.কে ফজলুল হক বঙ্গীয় আইন পরিষদে বলেন, ‘ব্যয়-বাহুল্যের অজুহাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হলে পাটনায় নতুন হাইকোর্ট ও একটি অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে হতে পারে?’

১৯১২ সালের ৪ঠা এপ্রিলের এক পত্রে লন্ডনের ভারত সচিব বাংলা সরকারকে প্রদত্ত নির্দেশে এও ছিল যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে এবং মুসলমান ছাত্রেরা নিজেদের নিজেদের ধর্মীয় তাহজিব ও তমদ্দুন রক্ষায় সফল হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যসূচীতে আরবী, ফারসী ও ইসলামী শিক্ষা বিষয় সন্নিবেশনে শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হককেও যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হয়। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বর্ণনা লেখকের উদ্দেশ্য নয়। প্রবন্ধকার বলতে চায় যে পরাধীন দেশে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকার ও তাদের দোসর ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির সাথে বহুমুখী সংগ্রাম করে শুধুমাত্র ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করলো, আজকে দু’দুবার করে দেশকে স্বাধীন করে এখনো পুনঃ আন্দোলন করতে হবে? স্বাধীন বাংলার অভ্যূদয়ের অর্ধশত বছর পরে স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি পর্যালোচনায় যে কেউ হতাশ হবেন বৈকি!

প্রাক স্বাধীনতাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলামফোবিয়া’র বলি (১৯৪০-৭০)

১৯৪০ সালে অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক উত্থাপিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবকে বর্ণহিন্দু পত্রিকাগুলো ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে বিদ্রোপক্তি করে। এ সময়ে পাকিস্তান ইস্যুতে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা নবউদ্যমে শিহরিত ও নতুন সাজে সজ্জ্বিত। পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনালগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘পাকিস্তান’ শীর্ষক পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদক, ফেনীনিবাসী ও ঢাবি’র অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজির আহমদ ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ২ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে’র একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিবাদমান সাম্প্রদায়িক কোন্দল নিরসন করতে গিয়ে নির্মমভাবে শহীদ হন। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় ও স্মারক রচনাবলীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকালীন ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে দারুণ প্রতিক্রিয়া পরিষ্ফুট। (ঐ সময়ে ঢাবি’র ছাত্র ও পরে পুলিশের আইজি এবং সচিব জনাব আবদুল খালেক, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক পল্লীকবি জসিমউদ্দীন ও ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন প্রমুখ তাঁদের স্মৃতিচারণে শহীদ নাজিরের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সূত্র- মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, পৃষ্ঠা : ৪৬২-৭৯, ২০১২, খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা)

১৯৪১ সালে জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় চলতে গিয়ে মোতাহার নামক এক মুসলিম ছাত্র হিন্দুদের হাতে নিষ্ঠুর বলির শিকার হয়। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ‘বিচারপতি হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট’ বাতিলের দাবীতে বিক্ষোভরত অবস্থায় বাবুল, মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ নামক তিনজন মেধাবী ছাত্র শাহাদাৎ প্রাপ্ত হয়। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হলে উহা সরকার বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে ‘নুরখান শিক্ষানীতি’র বিরূদ্ধে যৌক্তিক ও বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ইসলামপন্থী ছাত্রদের উপরে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী ছাত্ররা প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঐ বছর ১৫ই আগষ্ট (১৯৬৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের সেরা কৃতিছাত্র, ইসলামী ছাত্রসংঘ নেতা উক্ত সশস্ত্র ক্যাডারদের হাতে রেসকোর্স ময়দানে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহাদাৎ বরণ করেন। উল্লেখ্য, আওলাদে রাসূল আল্লামা সাঈয়েদ মাহমুদ মোস্তফা মাদানীর  নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ জানাযা শেষ করে বগুড়ার বাড়িতে শহীদ আবদুল মালেক (১৯৪৭-১৯৬৯) কে সমাহিত করা হয়। 

স্বাধীনতা উত্তরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালে নিরীহ দেশবাসীকে নির্বিচারে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্র তথা পাক সামরিক জান্তা দায়ী। এজন্য ১৯৩৮ সালে পরলোকগত পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা মহাকবি আল্লামা ইকবাল কিংবা ১৯৪৮ সালে মৃত পাকিস্তানী রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অপরাধ কি? এ নির্মম সত্যটি আমরা কে না জানি যে, ১৯৪৭ সালে অত্র ভূখণ্ড আমাদের বাবা-দাদাদের দাবীতে পাকিস্তানভূক্ত না হলে ১৯৭১ সালে আমরা কিছুতেই স্বাধীনতার মুখ দেখতে পেতাম না। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পাকিস্তানের অবদান জানতে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও তাঁর রাজনৈতিক মুরুব্বী সোহরাওয়ার্দী ও আবুল মনসুর আহমাদের ভূমিকা, মন্তব্য ও রচনাবলী যথেষ্ঠ মনে করা যায়। অথচ ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের প্রণেতা ও উত্থাপক এবং স্বাধীন বাংলার স্বাপ্নিক শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হক (তৎকালে প্রথম বাঙালী গভর্ণর) প্রতিষ্ঠিত ইকবাল হল ও প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক অলি আহাদের ভাষায় সারা বিশ্বের অন্যতম ক্ষণজন্মা পুরুষ কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র নামে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো আবাসিক হলের নাম পরিবর্তন কেন করা হলো? এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এককালীন কোষাধক্ষ্য ও এম.পি মো. মোহাইমেন প্রণীত ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে খানিকটা উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। ‘স্বাধীন পাকিস্তান হয়েছিল বলেই আজকে স্বাধীন বাংলার উৎপত্তি হয়েছে। অখণ্ড ভারতের অংশ হিসেবে যদি পূর্ববঙ্গ থাকতো, তার থেকে আলাদা করে বাঙালী মুসলমানদের আবাসভূমি হিসেবে বাংলাদেশ কখনোই সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম বদলে সূর্যসেন হল, ইকবাল হলকে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও জিন্নাহ এভিনিউকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ করা হলো। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে, এসবের কি প্রয়োজন ছিল।’ (পৃষ্ঠা : ৩৬-৩৭) মরহুম মোহাইমেন সাহেবের সাথে খানিকটা সুর মিলিয়ে বলতে চাই যে, এদেশের কোনো খ্যাতনামা ব্যক্তির নামে হল করতে হলে নতুন কোনো আবাসিক ভবনের নামকরণ করা যেতো। অথচ যে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গীয় আইন পরিষদের ভিতরে ও বাইরে এত কিছু করলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য নিজের আংশিক জমিদারী বন্ধক রেখেছিলেন, সেই চৌধুরী সাহেবের নামে কোনো আবাসিক হলের নামকরণ করা কি উচিত ছিল না? অনেক বিলম্বে নবাব চৌধুরীর নামে সিনেট ভবনটি করার জন্য ধন্যবাদার্হ বটে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের বন্ধুরা শুধু পাকিস্তান বিদ্বেষী ছিলেন না, ছিলেন ইসলাম ও মুসলমানদের জাতশত্রু। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ও শের-ই-বাংলা এ.কে ফজলুল হকের নামে প্রতিষ্ঠিত দুটো আবাসিক হলের নামসহ কবি নজরুল ইসলাম কলেজ ও জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র অজুহাতে ইসলাম ও মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়া হলো যাদের খুশী করতে তারা কি অসাম্প্রদায়িক? মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা আল কুরআনের আয়াত, “রাব্বী জিদনী ইলমা, ইক্করা বি-ইসমি রব্বিকাল্লাজি খালাক্ক” ইত্যাদি আল্লাহর পবিত্র বাণী যথাক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাবোর্ডের মনোগ্রাম থেকে মুছে ফেলা হয়। ইসলাম ও আল্লাহর নাম নিয়ে কত জেনারেল, কত ধর্মপ্রাণ সরকার ক্ষমতায় এলো গত তিনযুগে, কেউ কি ওগুলো পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নিলেন, বরং মুর্তি গড়ার সহায়তা করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলে ছাত্ররা দাড়ি-টুপি নিয়ে চলাফেরা করলে, ছাত্রীরা বোরখা-হিজাব পরিহিত হলেই শিবির, জঙ্গী, মৌলবাদী, আলকায়দা, রাজাকার ইত্যাদি বিদ্রুপ করা হয়। শুধু কি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, বর্তমান সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রী নিবাসে প্রতিরাতে ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়প্রাপ্ত সন্ত্রাসীদের হাতে আবরার, ফুলপরিরা যেভাবে হতাহত, লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হচ্ছে, এসব অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দেশ ও জাতির পরিণাম ভেবে আঁৎকে উঠতে হয়। 

১৯৭১ এর স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস কখনো ম্লান হতে থাকে আবার কখনো গৌরবোজ্জ্বল মনে হতে থাকে। মাঝে মধ্যে ছাত্রদের অস্ত্রের ঝনঝনানি, সশস্ত্র সন্ত্রাস ও মারামারি চলতে থাকে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মোহসিন হলে ‘সেভেন মার্ডার’ কথিত দলীয় কোন্দলের কথা জেনেছিলাম। সাম্প্রতিককালে বহু বিরতির ফসল ডাকসু নির্বাচনে ভিপি নুর ও তার সঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে কত ঘটনা-রটনা ঘটছে। এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য, নৈতিক চরিত্র ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আলোকিত নাগরিক অদূর ভবিষ্যতে তৈরি হবে কি না জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারীদের নিয়ে কয়েক বছর পর পর ২৫ জন রেজিষ্ট্রার্ড গ্রাজুয়েটসহ সিনেট নির্বাচনে যা ঘটছে তা কি মেনে নেওয়ার মতো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের উচিত পুরো ক্যাম্পাসে যথার্থমানের শিক্ষা-দীক্ষা ও গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে বহুঘোষিত ‘ঐক্য-শিক্ষা-শান্তি ও প্রগতি’র পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ও বহাল রাখা। 

বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, এখানকার ৮৫% অধিবাসী নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়। একটি মুসলিম মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দেশ হলেও মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যাতে মনে হয় দেশটি হয়তো ইসলাম ও মুসলিম বৈরী দেশ। নইলে ইসলামের স্বার্থে মুসলমানদের বহু ত্যাগ সাধনায় প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামপন্থী ছাত্রছাত্রীরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হবে কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও আবাসিক সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হবে কেন? হালে মাদ্রাসা ছাত্রদের সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের গন্ধ আছে বলেই কি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? চিত্রটি আসলেই দুঃখ ও উদ্বেগজনক। তবে আশার দিক হলো সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের ভর্তির বিরূদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছে তাদের অবস্থানগত ও কৌশলগত কারণেই এটা পারছে, কিন্তু তারা সংখ্যালঘু এবং দেশের সাধারণ জনগণ কিন্তু মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির বিরোধী ভাবনার সাথে একমত নন। এ কথায় কারো বিশ্বাস না হলে অতীতে (১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত) যেভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল, সাহস থাকে তো পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দিয়ে দিন। 

বর্তমান একুশ শতকের শুরুতে ঢাকায় “উচ্চশিক্ষার বৈষম্য ও বাংলাদেশের উন্নয়ন” শীর্ষক এক আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. মনিরুজ্জামান মিঞা বলেছেন, ‘সমমানের পরীক্ষায় পাশ করে আসার পরেও মাদ্রাসা ছাত্রদের অযৌক্তিভাবে বাদ দেওয়ার যে পাঁয়তারা চলছে, তা এক ধরণের ষড়যন্ত্র।’ এই প্রবীণ শিক্ষাবিদ উদ্ভুত সমস্যার আশু ও সুষ্ঠু সমাধানে এগিয়ে আসার জন্য তাঁর উত্তরসূরী ড. এস.এম.এ ফয়েজকে (২০০২-২০০৯) আহবান জানিয়ে গেছেন। পরবর্তী সকল উপাচার্য্য মহোদয়গণ ও সিনেট সদস্যমন্ডলী যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তথা ইতিহাস বিবেচনায় নিয়ে কাজ করেন, তবেই দেশ ও দশের মঙ্গল। এসব নিয়ে আর লেখালেখির অবকাশ থাকে না। 

শুধু ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রেই নয়. মাদ্রাসা থেকে সমমানের ডিগ্রী নিয়ে উত্তীর্ণদের নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি এবং সমমানের মাদ্রাসার শিক্ষককতার অভিজ্ঞতাকে স্কুল কলেজকে স্বীকৃতি দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বিভাগীয় কর্মকর্তাদের অনীহা, আপত্তি ও কার্পণ্যের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এ ধরণের হয়রানী, বিভাজন ও বিদ্বেষমুলক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জাতীয় ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও অগ্রগতির যাত্রাকে ব্যহত করছে। পরিশেষে ইতিহাসের অনুরাগী ছাত্র হিসেবে সকলকে ইতিহাস থেকে এবং বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস স্মরণপূর্বক উহার সাথে যারা বিভিন্নভাবে বর্তমানে সংশ্লিষ্ট তাদের সবাইকে যথাসময়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। 

স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শ’এর কোঠা প্রায় অতিক্রান্ত। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা ও অভিযোগ সত্ত্বেও শত ইতিহাস সৃষ্টির কেন্দ্রস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজো তার ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাতি নিয়ে। পরিশেষে খানিকটা অতিশয়োক্তি মূলক একটা প্রত্যাশা বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. আকতারুজ্জামান এবং তাঁর সুযোগ্য সহকর্মীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অনেকদিন থেকে জানি নবাবদের প্রদত্ত প্রায় পাঁচশত একর জমির প্রায় অর্ধেক (দুইশতাধিক একর) না কি এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলে। স্বাধীনতা উত্তরকালে নগরভবনসহ ঢাকা মহানগরী অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে, অফিস-আদালত বিকেন্দ্রীভুত হয়েছে। এমতাবস্থায়, দখলদারদেরকে যথেষ্ঠ তবে নির্ধারিত সময় দিয়ে পর্যায়ক্রমে ঐসব মহামূল্যবান সম্পত্তি দখলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসহ আরো অনেক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষাবান্ধব সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু দৃষ্টি সবিনয়ে কামনা করছি। 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির