post

করোনাকালে চাপাবাজির বাজেট

ফাহিম ফয়সাল

০২ জুলাই ২০২০

জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। বাজেটের মাধ্যমে জনগণের ওপর জুলুম করা হতে পারে। আবার জনগণের কল্যাণও হতে পারে। বাজেট সম্পর্কে না জানলে আপনি বুঝতে পারবেন না কিভাবে কী হচ্ছে। যাদের লক্ষ্য একটি কল্যাণকর সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দেয়া তাদের অবশ্যই বাজেট সম্পর্কে পরিষ্কার বুঝ ও হালনাগাদ থাকতে হবে। ১১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে আগামী এক বছরের জন্য সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। বলাই বাহুল্য বিপুল সংখ্যক ঘাটতি মেটানো হবে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। এবার বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। দেশ-বিদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। অগণিত মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তেই আছে। সহসা করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো আভাস নেই। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অর্থনীতি বিপর্যস্ত। চাকরি হারিয়ে, ব্যবসায় ধস নেমে পথে বসেছেন অগণিত মানুষ। আয় নেই তাই সঞ্চয় ভেঙে চলতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ছুটছেন। অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি কেবল শুরু। যত দিন যাচ্ছে ভয়াবহ মন্দা আরো ব্যাপকতর হচ্ছে। এমতাবস্থায় এই বাজেট কেমন হলো?

আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কি যৌক্তিক? জাতীয় আর ব্যক্তির বাজেটের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে ব্যক্তি আয় অনুযায়ী ব্যয় নির্ধারণ করে কিন্তু সরকার ব্যয় অনুযায়ী আয় করার চেষ্টা করে। সম্পূর্ণ উল্টো হিসাব। এবার জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৭১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২০ শতাংশ। বস্তুত জিডিপি হচ্ছে দেশের জনগণের মোট আয়। জনগণের আয়ের ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ সংগ্রহ করার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। এগুলো সবই আনুমানিক হিসাব। কিন্তু এ থেকে বুঝা যায় সরকার ধরে নিয়েছে জনগণ এবার রেকর্ড পরিমাণ আয় করবে এবং সরকারও রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় করবে। একদিকে করোনার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা মারাত্মক নেতিবাচক আর সরকারের হিসাব বেহিসাবি ইতিবাচক!

বিগত বছরে রাজস্ব আদায়ের তুলনায় এবারের লক্ষ্যমাত্রাচিত্রের বাম পাশের নীল রঙের পিলারগুলো দেখলে বুঝা যাচ্ছে রাজস্ব আদায় প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। লাল রঙের পিলারটি হচ্ছে গেল অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আদায়ের চিত্র। আর শেষের খয়েরি রঙের পিলারটি হচ্ছে এবারের বাজেটে আয়ের লক্ষ্য। মে পর্যন্ত ১১ মাসে এবার রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যা আদায় হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেটাই আদায় হচ্ছে না। সেখানে করোনাকালীন সময়ে প্রায় দ্বিগুণ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি কি সম্ভব?

রাজস্ব আদায়ে সরকার যেসব রদবদল করলো

ব্যক্তিগত আয়কর করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ বছর পর আড়াই লাখ টাকা থেকে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের আগে থেকেই তিন লাখ টাকা ছিল। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ছিল ৪ লাখ টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। আনুপাতিক হারে সব ক্যাটাগরিতেই সর্বনিম্ন করসীমা বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন পরিমাণ আয়ের ওপর বিভিন্ন হারে কর দিতে হয়। বার্ষিক তিন লাখ আয়ে কোনো কর নেই। এর পরের এক লাখে ৫ শতাংশ, তারপরের তিন লাখের জন্য ১০ শতাংশ, এরপরের চার লাখের জন্য ১৫ শতাংশ, এরপরের পাঁচ লাখের জন্য ২০ শতাংশ এবং এর থেকে বেশি যেকোনো পরিমাণের জন্য ২৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। আগের বছরের তুলনায় ব্যক্তিগত কর হার কমেছে এবং করের সর্বনিম্ন সীমাও বেড়েছে।

ব্যাংক লেনদেন ও সঞ্চয়ের ওপর আবগারি শুল্ক ব্যাংক লেনদেন ও সঞ্চয়ের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। এক লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক লেনদেন করমুক্ত। এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত দিতে হয় ১৫০ টাকা। পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত দিতে হয় ৫০০ টাকা। এই হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের জন্য ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করে এবার তিন হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এক কোটি থেকে পাঁচ কোটির জন্য তিন হাজার টাকা বৃদ্ধি করে ১৫ হাজার করা হয়েছে। পাঁচ কোটির চেয়ে বেশি লেনদেনের জন্য ১৫ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে আবগারি কর ৪০ হাজার টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। বস্তুত ব্যাংক লেনদেন একটি স্বাভাবিক কার্যক্রম। এটা আয় বা ব্যবসার মুনাফা নয়। তারপরও ব্যাংক লেনদেন বা সঞ্চয়ের ওপর বার্ষিক কর কেটে নেয়া হয়।

সঞ্চয়পত্রের সুদের ঘানি টানছে জনগণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি সরকারের প্রকৃত আয় নয় বরং উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ। সঞ্চয়পত্রে জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা (জাগো নিউজ, ৮ জুন ২০২০)। সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে বিপুল অর্থ খরচ করতে হচ্ছে সরকারকে। এ জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে সুদ হার কমানো ছাড়াও নানা বিধিনিষেধ প্রয়োগ করেছে সরকার। সঞ্চয়পত্রে সুদের টাকায় উৎসে কর গেল বছর ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা হয়। এ বছরও এটা বহাল রাখা হয়েছে। তবুও তরতর করে বাড়তেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। কারণ ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদে টাকা পাওয়া যায় প্রায় দ্বিগুণ। গাড়ি মালিকদের বার্ষিক কর বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া বিআরটিএর বিভিন্ন সার্ভিসের ওপর কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্কহার পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।

বিনিয়োগে বাধা করপোরেট কর বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে করপোরেট কর আদায় করা হয়। এবার শুধুমাত্র একটি ক্যাটাগরিতে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয়ের ওপর কর হার ২৫ শতাংশ। আর পুঁজিবাজার তালিকার বাইরের কোম্পানিকে দিতে হয় ৩৫ শতাংশ। সরকার এবার তা কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে। গ্রিন সার্টিফিকেটধারী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিকে দিতে হয় ১০ শতাংশ আর গ্রিন সার্টিফিকেট যাদের নেই তাদের দিতে হয় ১২ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ও সিগারেট কোম্পানির করপোরেট কর হার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ। এগুলোর কর হার আগের মতোই আছে। বাংলাদেশে করপোরেট কর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে করপোরেট কর থেকে এসেছে মোট রাজস্বের ৬০ শতাংশ। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ছিল ৪৫ শতাংশ। উচ্চ করপোরেট করের কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ কম হয় এবং বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে যায়। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের কাঁচা টাকার লোভে সরকার করপোরেট কর কমাচ্ছে না।

মোবাইল-ইন্টারনেট ও তামাক পণ্যে খরচ বাড়লো মোবাইলে কথা বলায় প্রতি ১০০ টাকায় সরকার নিতো ২২ টাকা। এবার নিবে ২৫ টাকা। ইন্টারনেট ব্যবহারেও কর বাড়ানো হয়েছে। তামাক পণ্য থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকার আয় করেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে সবরকম তামাক পণ্যে শুল্কহার বাড়ানো হয়েছে। সরকার এই খাত থেকে ভালো রাজস্ব আদায়ের আশা করছে।

তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স ও কালো টাকা তৈরি পোশাক রফতানিতে উৎসে কর গতবার প্রস্তাবিত বাজেটে ছিল ১ শতাংশ। কিন্তু পরে এনবিআর থেকে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়। এবারের বাজেটে দশমিক ৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অবশ্য করোনার আগেই গেল অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে তৈরি পোশাকের রফতানি কম হয়েছে। লকডাউনের পর থেকে নতুন অর্ডার এসেছে খুব কম এবং একের পর এক অর্ডার বাতিলও হয়েছে। সবমিলিয়ে এই খাত থেকে রাজস্ব আয় প্রচুর কমে যাবে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশের আয়ের বড় অংশ থাকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বৈধপথে অর্থ পাঠানো উৎসাহিত করতে গত বছর থেকে সরকার ২ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। এতে সরকারের ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হলেও রিজার্ভ বাড়ছে। ঘুষ দুর্নীতির অর্থ ছাড়াও সরকারের রাজস্ব নথিতে ব্যক্তির অপ্রদর্শিত আয়ের নাম ‘কালো টাকা’। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে (বিবিসি)। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার স্থায়ী নিয়ম চালু করে বর্তমান সরকার। এবারের বাজেটে জরিমানা ছাড়াই শুধু ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎ ১৪-১৮ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে এক হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এর চেয়ে ঢের বেশি পাচার হয় বিদেশে। অল্প কিছু টাকার জন্য অন্যায়ের বৈধতা দেয়া যৌক্তিক নয়। শুধু সুইস ব্যাংকেই ২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশীদের আমানত রয়েছে ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। সুইস ব্যাংক অর্থের উৎস জানায় না। তাই এখানে বৈধ ও অবৈধ কত টাকা রয়েছে সেটা জানার সুযোগ নেই। সর্বোপরি অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পূর্বের তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হবে বলাই বাহুল্য। সরকার যেসব খাতে কর বাড়িয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে পূর্বের তুলনায় দেড় লাখ কোটি টাকা বেশি আয় করতে পারবে এটা অবাস্তব ও অসম্ভব। বরং আগে যা উঠানো সম্ভব হয়েছে সেটাই যদি এবার অর্জন করতে হয় তাহলে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতা বৃদ্ধি করতে হবে। আয় কম হওয়ার একটা বড় কারণ দুর্নীতি। রাজস্ব কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে বা তাদের সাথে যোগসাজশ করে অনেকে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক আয় কম দেখায়। অনৈতিকতার মূলোৎপাটন না হলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সুযোগ নেই।

ব্যয়ের খাতে কী অবস্থা? করোনাকালে ব্যয়ের আকার বাড়িয়েছে সরকার। অর্থনীতির ভাষায় অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে নাকি সরকারের ব্যয় বাড়াতে হয়। সে যুক্তিতে গতানুগতিক ধারণায় বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে।বরাবরই বাজেটের বেশির ভাগ যায় জনপ্রশাসন খাতে। করোনাকালেও সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে এই খাতে। এবারে এর পরিমাণ ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এই খাতের বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় হয় ১৩ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ভাতায়। ব্যয়ের আরো একটি বড় আপত্তির জায়গা হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। গত বছর ৭ ডিসেম্বর ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বেসরকারি কোম্পানিগুলো গত ১০ বছরে উঠিয়ে নিয়েছে ৫১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিমাণ বেশি হওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

সুদ পরিশোধে আকাশচুম্বী ব্যয় এবার অনুদান ব্যতীত বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা যা গত বছরের তুলনায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। এটা কাগুজে হিসাব। করোনা পরিস্থিতির কারণে টালমাটাল অর্থনীতিতে এ বছর সরকারের আয় কমে যেতে বাধ্য। বাস্তবে খরচের লাগাম টেনে না ধরলে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। বাজেটের ঘাটতি পোষাতে সরকার দেশ-বিদেশের ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণ নেয় এবং টাকা ছাপায়। টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি হু হু করে বেড়ে যায় যার প্রভাব পড়ে দ্রব্যমূল্যে। বস্তুত এই ঋণের টাকা জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে পরিশোধ করা হয়। এই অর্থবছরে সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এই টাকায় দুটো পদ্মা সেতু হয়ে যায়! গত ছয় বছরে সুদ পরিশোধে ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ।

মন্দা পরিস্থিতি উত্তরণে বাজেট কতটা সহায়ক? বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণার তথ্য মতে, কর্ম হারিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। দেশে দরিদ্রের হার এখন ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৭ জুন দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশ পেয়েছে ইতোমধ্যে ১৭ লাখ প্রবাসী চাকরি হারিয়েছেন। দেশে ফিরে এসেছেন ৮ লাখের বেশি প্রবাসী শ্রমিক। এই প্রবণতা সময়ের সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া গার্মেন্টস আর পরিবহন শ্রমিকরাও কর্ম হারিয়েছেন ব্যাপক হারে। গার্মেন্টস শিল্পে বাইরের দেশের অর্ডার কমে গিয়েছে রাতারাতি। করোনা পরিস্থিতি বৈশ্বিক সমস্যা হওয়ার কারণে গার্মেন্টস শিল্প শিগগিরই আগের অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। গার্মেন্টসের কত শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন এবং বেতন পাচ্ছেন না এই পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও অনুমান করা যায় প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিকের অর্ধেকই নির্মম বাস্তবতার শিকার। লকডাউন এবং মন্দা অর্থনীতির কারণে পরিবহন শ্রমিকরাও হারিয়েছেন কাজের সুযোগ। খালি হাতে বসে থাকতে হয়েছে তাদেরও। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অনেক শহরের বাসা-বাড়িতে প্রচুর টু-লেট ঝুলছে। আয় না থাকায় বাসা ভাড়া দিতে না পারার কারণে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সব পর্যায়ের মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। লকডাউনের সময় দেখা গেছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। সার্বিক পরিস্থিতি একটি মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত করছে। এমতাবস্থায় বাজেটে জনপ্রশাসন যেমন অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে এমন কিছু নিম্নবিত্ত ও চাকরি/কাজ হারানো ব্যক্তিদের জন্য দরকার ছিল। গরিবের হাতে টাকা দেয়া শুধু মানবিক প্রয়োজন নয়, সার্বিক অর্থনীতির মন্দা কাটাতে এটাই কার্যকরী। কারণ গরিব মানুষেরা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ভোক্তা। গরিবের হাতে টাকা এলে সকল পর্যায়ে তখন অর্থের সঞ্চারণ হয়। সরকার খরচ বাড়ালে হিউজ পপুলেশনের হাতে অর্থ পৌঁছাবে অর্থনীতির এই সূত্র মেনে বাজেটের আকার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অর্থ যদি পায় জনপ্রশাসনে কর্মরত ব্যক্তি, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, ২ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া প্রবাসী তাহলে সম্পদ তো আরো পুঞ্জীভূত হবে। যে প্রবাসী দেশে ফিরে এলেন, যিনি বিদেশে চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরার প্রতীক্ষায় আছেন, অর্ডার না থাকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি যাদের ছাঁটাই করছে, যারা শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামে যেতে বাধ্য হলেন তাদের জন্য সরকারি সহযোগিতা কোথায়? হ্যাঁ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার ব্যয় করে। ৮১ লাখ উপকারভোগীর জন্য গত বছর বরাদ্দ ছিল ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এ বছর ১৬ লাখ ১৫ হাজার নতুন উপকারভোগী করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর টাকার অঙ্কে বাড়ানো হয়েছে মাত্র এক হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অথচ করোনা পরিস্থিতির কারণে ইতোমধ্যে এক কোটি ৪৩ লাখ মানুষ দরিদ্রের কাতারে শামিল হয়েছেন।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে কে কত টাকা পান? দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে ১২ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা, ঈদবোনাস ১০ হাজার টাকা, নববর্ষ বোনাস ২ হাজার টাকা এবং বিজয় দিবস ভাতা ৫ হাজার টাকা পান। ৪৪ লাখ ব্যক্তি মাসে বয়স্ক ভাতা পান ৫০০ টাকা করে। ১৭ লাখ বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা পাচ্ছেন ৫০০ টাকা করে। ১০ লাখ অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ৭০০ টাকা করে পান। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয় ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে। (বাংলা ট্রিবিউন, ৩ জুন ২০২০)

গণপরিবহন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত এই তিনটি খাতের মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাত। আর বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এই তিনটি খাত হয়ে পড়েছে ব্যবসায়িক পণ্য/সেবা। সরকারের খরচ মূলত দুই ধরনের। রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যয় এবং উন্নয়ন ব্যয়। গণপরিবহন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে মুনাফামুক্ত সেবা খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে অবশ্যই উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে। এবার রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।

এবার দেখুন পরিবহন ও যোগাযোগ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র।

পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাবরই উন্নয়ন ব্যয় অত্যধিক বেশি থাকলেও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ঠিক বিপরীত চিত্র। উন্নয়ন ব্যয় না বাড়ালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত বেসরকারি উদ্যোগের মুনাফা অর্জনের মাধ্যম হিসেবেই থেকে যাবে।

করোনা প্রণোদনায় কোন খাত কত টাকা পেলো? করোনা পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে ১৯টি প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে সরকার।এই প্রণোদনার সব অর্থ সরকারের ভর্তুকি নয়। সরকার প্রণোদনার আওতায় সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীদের ৯ শতাংশ হারে ঋণসুবিধা দিবে এবং সুদের অর্ধেক সরকার বহন করবে। এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্রদান করলেও সরকারের এখানে প্রকৃত ব্যয় হবে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মতো যা আগামী অর্থবছরের বাজেট থেকে মেটানো হবে। বাজেটের গুড় খাচ্ছে দুর্নীতি নির্মাণকাজে রডের বদলে বাঁশ এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের খাটের তলে সরকারি চাল-ডাল-তেল পাওয়ার মতো দুর্নীতির চিত্র এ দেশের সকলেরই দেখা। কিন্তু লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়তো অনেকেরই জানা নেই। বাংলাদেশে দুর্নীতি মোটা দাগে দুই ধরনের। বিভিন্ন সেবা পেতে ঘুষ দেয়া এবং রাষ্ট্রীয় কেনাকাটা ও খরচে অতিরিক্ত দেখানো। টিআইবির খানা জরিপের তথ্য মতে ২০১৭ সালে ১৫টি সরকারি সেবা খাতে মোট ঘুষের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। এটা ২০১৫ সালের তুলনায় ২১.২ ভাগ বেশি। সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের ভাউচারে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়। ২০১৭ সালে টিআইবির খানা জরিপের তথ্য মতে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির হার ৪২.৫ শতাংশ। সম্প্রতি একটি হাসপাতালের আইসিইউ এর শুধু একটি পর্দা ক্রয়ে ৩৭ লাখ টাকা মূল্য দেখানো হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিটি বালিশ কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৯৭ টাকা আর সেই বালিশ বিল্ডিংয়ে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে প্রতিটি ৭৬০ টাকা। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। বস্তুত চলমান সবগুলো মেগা প্রকল্পে খরচের নামে চলছে হরিলুট। আমদানি রফতানির সময় ভুলভাল তথ্য দেখিয়ে অর্থ পাচার হয় দেদার। প্রায় ১৫০০ কোটি ডলার প্রতি বছর পাচার হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ব্যবসায়ীরা আমদানি রফতানিতে সঠিক তথ্য লিখলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেতো। পাচারের কারণে রাজস্ব আয় ও দেশে বিনিয়োগ দুটিই হারাচ্ছে সরকার, যার প্রভাব পড়ছে বাজেট বাস্তবায়নসহ সার্বিক অর্থনীতিতে। সরকারি টাকায় বিদেশ সফরের কিছু উদাহরণ অত্যন্ত চাঞ্চল্যের জন্ম দিয়েছে। ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে, বোয়িংয়ের দুটি বিমান কিনতে ৪৫ ব্যক্তি আমেরিকা যাচ্ছেন। পুকুর খননে দক্ষতা অর্জন করতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বিদেশ সফরে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের আট শিক্ষক ও কর্মকর্তা লিফট কিনতে যান সুইজারল্যান্ড ও স্পেনে। শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের একটি দল নাসা আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়। পুরস্কার আনতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার শিক্ষার্থীদের সাথে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে বিজয়ী শিক্ষার্থীদের আমেরিকায় যাওয়া না হলেও সরকারি কর্মকর্তারা ঠিকই আমেরিকা ঘুরে এসেছেন। এভাবে ফিরিস্তি দিতে গেলে চলতেই থাকবে। মিডিয়াতে যা আসে লোকে তা জানতে পারে। তাহলে অজান্তে ঘটে চলেছে কতশত দুর্নীতি! বাজেট কতটা জনকল্যাণমুখী ও সুষম উন্নয়নের হবে সেটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের নৈতিক চরিত্রের ওপরে। চরম নৈতিক অধঃপতন বিদ্যমান রেখে ব্যবস্থাপনার উন্নতি করে কখনো জনকল্যাণ সম্ভব না। এ জন্য আল্লাহর দাসত্ব ও রাসূলের অনুসরণে সৎ লোক তৈরির বিকল্প নেই। সৎ লোকের শাসনের মাধ্যমেই সম্ভব কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির