post

কাতার : মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মূল খেলোয়াড়?

ড. মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন

০৯ আগস্ট ২০১৭
আগে থেকে না হলেও এখন বলা যায় কাতার অনেকটা খেলায় অভ্যস্ত হয়েছে। ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আয়োজনকারী কাতার বিশ্বরাজনীতিকে এ ইঙ্গিত দিচ্ছে ফুটবলে না হলেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির খেলায় তারা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো জাতি নয়। তারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখছে। এগারো হাজার বর্গ কিলোমিটারের এ দেশটি অতিদ্রুত এত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করলো কিভাবে এ নিয়ে রীতিমতো গবেষণা ও পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি অন্যান্য আরব দেশের মতোই সামনে চলার চেষ্টা করেছে। তবে পার্থক্য ছিল তারা রাজতন্ত্রের সাথে সামাজিক গণতন্ত্রের একটি মিল করতে চেয়েছে। তারা অন্যান্য আরব দেশগুলোর রাজতন্ত্রের মতো সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে মূল্যহীন করে তোলেনি। থানি পরিবার প্রথম থেকে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সাথে নিজেদের জড়িত করতে চেয়েছে। মানবিক সাহায্যের কার্যক্রম ইসলামী দর্শনের আলোকেই কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, বরং জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য অবারিত করেছে। কেবল ধর্মীয় কিছু মসজিদ তৈরি বা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা কিংবা কিছু প্রচারককে সহযোগিতা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং সেনিটেশন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বিভিন্ন মানবিক বিপর্যয়ে তারা পূর্ব-পশ্চিম সকল স্থানেই তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। এ সাহায্যে কেবল ইসলাম ও মুসলমানরাই প্রাধান্য পায়নি। তারা দেশের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সেনিটেশনে যেকোনো আরব রাষ্ট্রের চেয়ে এগিয়ে। মুসলিমবিশ্ব যেখানে শিক্ষা ও নারী উন্নয়নে সবচাইতে পিছিয়ে সেখানে কাতার আমার মনে হয় একমাত্র মুসলিম দেশ যেখানে শিক্ষার হার এবং কোয়ালিটি এডুকেশন সকলের জন্য অবারিত। তবে সকল কিছু ছাপিয়ে ‘আল-জাজিরার প্রতিষ্ঠা’ কাতার এক অন্যরকম মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। একটি রাজতান্ত্রিক দেশ কতটুকু উদার হলে একটি স্বাধীন ও উদারনৈতিক মিডিয়ার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যেখানে চাকরি পাওয়ার জন্য পৃথিবীর সেলিব্রেটি সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। আর কাতার তাদেরকে সম্মানও দেখিয়েছিল। আস্থা ও বিশ্বাসের স্থান অটুট রেখে এখনো আল-জাজিরা তাদের সংবাদ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে। এখন বলতে পারেন সবইতো ভালো তাহলে কাতারের ওপর কেন তাদের প্রতিবেশীরা ক্ষিপ্ত? আজকের প্রবন্ধে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হবে। উপরে উল্লিখিত সকল কিছু কাতারের জনগণ তথা বিশ্ববাসীর জন্য সুখবর হলেও পাশের আরব তথা সৌদি আরবের জন্য সুখকর ছিল না। সৌদি আরবের রাজতন্ত্র আর কাতারের রাজতন্ত্র এক নয়। যেমন ফ্রান্সের ধর্মনিরপেক্ষতা আর আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষতা এক নয়। ফান্সের ধর্মনিরপেক্ষতায় স্কুল-কলেজ, উন্মুক্ত স্থানে কোনো ধর্মীয় কার্য সম্পাদন এবং ধর্মীয় প্রতীক প্রদর্শন নিষিদ্ধ। যে কারণে কোনো মুসলিম ছাত্রী স্কুলে হিজাব পরে যেতে পারে না। কিন্তু আমেরিকায় রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পূর্ণ পৃথক তবে ধর্ম পালনের অধিকার সকলের জন্য সুরক্ষিত। রাষ্ট্র কোন ধর্মকে সহযোগিতা করে না তবে সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। এমনিভাবে কাতার রাজতান্ত্রিক তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল আইনকানুন মানা, মানবাধিকার রক্ষাসহ সকল কিছুর ইনডেক্সে অন্যান্য আরব রাষ্ট্র থেকে সামনে এগিয়ে আছে। এ এগিয়ে থাকাই মূলত কাতারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট দেশ কাতারের পাশের একমাত্র বিশাল দেশ সৌদি আরবের ওপর কাতার অনেকাংশে নির্ভরশীল। খাদ্য, বিভিন্ন সাপ্লাই, কনস্ট্রাকশনসহ সকল বিষয়ে কাতার অনেকটা সৌদি আরবের ওপর নির্ভরশীল। এ নির্ভরশীলতাকে সৌদি আরব কাতারের দুর্বলতা ভেবেই ভুল করেছে। সৌদ পরিবার সম্পাদিত নজদির ‘তাওহিদের’ দর্শন রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের মাধ্যমে বিশ্বমুসলিম সমাজকে শিরক্-এর বিপদ থেকে রক্ষা করেছে এটা নির্দ্বিধায় ভালো বলা যায়। যে কারণে বিশ্বের অধিকাংশ উলামা-মাশায়েখ এখনো সৌদ বংশের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজকে ভক্তিভরে স্মরণ করে। আমরাও এ জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এ পরিবারের অনেক সদস্যের উচ্ছৃঙ্খল চলাফেরা অনেকের কাছেই গ্রহণীয় নয়। মক্কা-মদিনা শরিফের খাদেম হিসেবে সৌদি বাদশাহর যেভাবে মুসলিমবিশ্বকে ঐক্যের ছায়াতলে নিয়ে আসার কাজ করা উচিত ছিল সে অর্থে তিনি তা করেছেন বলে মনে হয় না। বরং মাঝে মধ্যে তাদের আচরণে বিতর্কই বরং উসকে ওঠে। সৌদরা তাদের নীতি ও আচরণের কারণে জনগণের কাছে তেমন জনপ্রিয় নন এ কথা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী সৌদিদের অনেকে অকপটে বলে বেড়ান। এসব বিবিধ কারণে কোনো সমালোচনা, স্বাধীন মিডিয়া, জনগণের মৌলিক স্বাধীনতাকে সৌদ বংশের বর্তমান শাসকেরা ভয় পান বলে অনেক লেখায় স্পষ্ট উঠে এসেছে। আর এ কারণেই দেশটির পূর্ব মাথায় এক ফোঁটার মতো দেশ কাতারের এরূপ স্বাধীন চলার বিষয়টি পছন্দ হয়নি। তা ছাড়া মিসরের ব্রাদারহুড ও ফিলিস্তিনের বৈধ ও নির্বাচিত হামাসকে সৌদি আরব তাদের জন্য হুমকি মনে করে। আর কাতার তাদেরকে জনসমর্থনযুক্ত রাজনৈতিক দল মনে করে। এসব বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তবে অবশ্য এ কথা সত্য এর পেছনে অন্য রাজনৈতিক খেলা যে নেই তা নয়। সেটা আরেক অধ্যায়। উল্লিখিত বিভিন্ন কারণে সৌদি আরব কাতারের ওপর নাখোশ ছিল। কারো মতে, নাখোশ আরো বেশি উসকে দেয় সম্প্রতি সৌদি আরবে ট্রাম্পের সফর। বলা হয় একটি বিরাট অর্থনৈতিক চুক্তির ব্যাপারে কাতার ট্রাম্পের জামাতার সাথে একমত হতে পারেনি। অবশ্য এর বিকল্প মতও আছে। এ অবরোধের মাধ্যমে মিসরকে দিয়ে ফিলিস্তিনের সীমানা পাল্টানোর কথাও কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। রাজনীতিতে অসির চেয়ে মসি অনেক কার্যকর কথাটি বাঙালি সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত। সৌদি আরব বুদ্ধিভিত্তিক মোকাবেলায় না গিয়ে হঠাৎ করে সকল ধরনের অবরোধ আরোপ করে বিপাকে পড়েছেন। আমরা জানি যারা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেয় তারা কোনো জাতিকে শাসাতে চাইলে প্রথমে হুমকি দেয়, কোনো বিষয় থেকে সরে আসতে বলে এরপর ধীরে ধীরে অবরোধের দিকে যায়। কিন্তু ‘স্ট্র ইনদা উইন্ড’ বলে কূটনীতির যে পরিভাষা আছে তাকে আমলে না নিয়ে একদিনেই সকল ধরনের অবরোধ আরোপ করে নিজেদের অসারতা নিজেরাই প্রমাণ করেছে। তা ছাড়া অবরোধ কার্যকর না হলে কী করা হবে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা তাদের কাছে ছিল না। পক্ষান্তরে অবরোধ প্রত্যাহারের শর্ত হিসেবে আল-জাজিরাকে সংযুক্ত করে এবং রাজনৈতিকভাবে তুরস্ক ও ইরানকে একঘরে করার শর্তযুক্ত করে বরং সারাবিশ্বে বিশেষ করে মুসলিমবিশ্বে তারা অনেকটা ধিক্কারের পাত্র হয়েছেন। রমজান মাসে অবরোধ আরোপ করে সৌদি আরব নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়েছে। সামাজিক মিডিয়ায় পূর্বে সৌদি আরবের বিপক্ষে কেউ কিছু বললে অনেকে এর প্রতিবাদ করতো। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে ভয়ে সৌদি আরেবের পক্ষে কেউ মন্তব্য পর্যন্ত করে না। আরব ঐতিহাসিক বিরোধ হিসেবে তুরস্কের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে কমাতে হলে সৌদি আরবের উচিত ছিল কাতারকে নিজের আঁচলে আগলে রাখা। ইরানের ব্যাপারেও একই কথা। বরং অবরোধ আরোপের পরে মধ্যপ্রাচ্যসহ সকল স্থানে তুরস্ক ও ইরানের প্রভাব ও ব্যবসা বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একদিক থেকে কাতারের সাতাশ লক্ষ লোকের খাদ্য-পানীয় সরবরাহ করা থেকে বিরত থেকে সৌদি আরব বাজার হারিয়েছে, অপর দিক থেকে তুরস্ক ও ইরানের প্রভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে। গত অর্ধশতাব্দী ধরে চেষ্টা করে তুরস্ক ও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি এক অবরোধ তাদের সে সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। অপর দিকে অবরোধের শিকার হয়েও কাতার বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতির পরিচয় দিয়েছে। অবরোধকে তারা জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও নিজেদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছে। যেখানে একদিনের নোটিশে সৌদি আরব সকল কাতারিকে বের করে দিয়েছে, সেখানে কাতার তা করেনি অধিকন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতে যে গ্যাস সরবরাহ লাইন আছে তা বন্ধ করেনি। সবাই মনে করেছিল তাও বন্ধ করে আমিরাতকে কাতার চাপে ফেলবে। এমনিতে মুসলিমবিশ্ব হাজারো সঙ্কটে নিমজ্জিত। সেখানে কাতার নামক ছোট দেশটির অগ্রসরমান অর্থনীতি কিঞ্চিৎ হলেও মুসলিমবিশ্বের আশার আলো হিসেবে ছিল। এ অহেতুক অবরোধের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমরা মনে করি, সুন্নি এদেশগুলো একই দর্শনে বিশ্বাসী। যেকোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা যায়। এটাই রাসূল (সা)-এর তরিকা। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিসর সবই আমাদের ভাই। ভাইয়ের সম্পর্ককে ওপরে তুলে ধরলে যেকোনো সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা যায়। প্রয়োজনে ওআইসির উদ্যোগে সকলে একসাথে হতে পারে। আশা করি অচিরেই কাতার সঙ্কটের সমাধান হবে। ছোট দেশটিতে আবারো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরে আসবে। লেখক : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির