post

কারাস্মৃতির অন্তরালে

২৭ মার্চ ২০১২
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম ফজরের নামাজ আদায় করে জেলার ফাইলে যাওয়ার প্রস্তুতির পালা। যাওয়ার সময় ভাবলাম, যাক, অনেকদিন পর সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে গজল গাওয়ার সুযোগ পাব। কারণ রাজশাহী জেলে জেলার ফাইলে আমদানির সামনে আমরা একসাথে বসে গান গাইতাম। এটাই ওখানের নিয়ম। একজন কয়েদি চমৎকারকণ্ঠে বলতো আমরা সবাই সম্মিলিতো কণ্ঠে গাইতাম। সূরা ফাতিহার অর্থ ছন্দ আকারের সেই বাণী- “অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি / বিচার দিনের ও স্বামী / যত গুণ ও গান হে চিরমহান/তোমারই অন্তর যামী” একযোগে সবাই বললে খুব ভালোই লাগত। কিন্তু চট্টগ্রাম আমদানিতে এই রকম গজল গাইবার সুযোগ পেলাম না। জেলার ফাইল সম্পন্ন হওয়ার পর এবার ওয়ার্ড বণ্টনের পালা। অবশ্য চট্টগ্রাম জেলে অর্থের লেনদেন প্রকাশ্য দেখিনি যেটা ঢাকা জেলে হয়। জেলখানায় টাকার লেনদেন আইনত দণ্ডনীয় হলেও টাকা ছাড়া যেন কিছুই চলে না। এরই মধ্যে সকালের নাশতা। লালচে রঙের আটার রুটি একটি আর এক টুকরা গুড় হাতে নিয়ে মুখে দিতেই এক ভাই এসে সালাম দিয়ে বললেন, রেজাউল ভাই আমার পরিচয় করে দিচ্ছি পরে,আগে নাশতা সেরে নিন, বলেই খুব চমৎকার ৩টি পিঠা দিলেন। বেশ বড় বড়। অনেক কষ্টে ২টি খেলাম। পাশের একজনকে ১টি দিলাম। পিঠা নিয়ে আসা ভাই বললো, আপনি আসবেন জেনে আমরা সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। আলাপ শেষ হতে না হতেই কয়েকজন আমদানির সামনে জড়ো হয়ে গেলেন। প্রত্যেকের সাথে পরিচয় করলাম। প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে অন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। আমাকে পেয়ে যেন এক অন্যরকম আনন্দ সবার মধ্যে। ভাইয়েরা প্রত্যেকে তাদের নতুন জামা-পাঞ্জাবি, বেডকভার আমার জন্য নিয়ে আসলেন। এখানে যেন দিতে পারার আনন্দই বড়। ত্যাগের মধ্যেই খুঁজেছে সবাই সুখ। ভাবছিলাম, কারাগারে এসেছি তো? অবস্থা দেখেতো তা মনে হয়না। ইসলামী আন্দোলনের বিনেসুতার এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কী মধুর কী অনন্দের তা শুধু এই আন্দোলনের কর্মীরাই বুঝতে পারে। বাইরে থেকে এটি উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়! এটা কেবল এ আন্দোলনেই শুধু সম্ভব। আমাদের প্রতিপক্ষরা আমাদেরকে মোকাবেলার জন্য কত না আয়োজন, কত না কঠোরতা অবলম্বন করে কিন্তু সীসাঢালা প্রাচীরের মতো যে ভ্রাতৃত্বের তা ছেদ করা কি সম্ভব? রাসূলে করীম (সা)-এর আন্দোলনে এমন এক ঐতিহাসিক ভ্রাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে ।  “মদিনার সমাজের তখন একটা বড় রকমের সমস্যা ছিল মোহাজেরদের পুনর্বাসন। লোকেরা একের পর এক ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসছিল। মাত্র কয়েক হাজার অধিবাসী সম্বলিত ও এই মাঝারি পর্যায়ের জনপদে তাদেরকে ঠাঁই দেয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বস্তুত এটা এমন একটা সমস্যা, যা ইতিহাসে যখনই দেখা দিক না কেন, বিব্রতকর হয়ে দেখা দিয়ে থাকে। মদিনার সমাজ ও তার রাষ্ট্রপ্রধান যেরূপ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই। কোনো অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়নি, কোনো আইন চাপিয়ে দেয়া হয়নি, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ সরকারিভাবে বরাদ্দ করতে হয়নি, শরণার্থীদের সংখ্যা নির্ধারণ করে কোনো কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি এবং কোনো বল প্রয়োগ করা হয়নি। কেবল একটি নৈতিক আবেদন দ্বারা এত বড় জটিল সমস্যার সমাধান মাত্র কয়েক দিনে করে ফেলা হয়। বিশ্বনবী (সা) আকিদা, আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে সত্যিকারার্থে একটা নতুন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়ে দেন এবং এক একজন আনসারির সাথে এক একজন মোহাজেরের ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। প্রত্যেক আনসারি নিজের সহায়-সম্পদ, ঘরবাড়ি, বাগবাগিচা ও ক্ষেত-খামার অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে নিজ নিজ আদর্শিক সাথীকে দিয়ে দিচ্ছিলেন। কেউ কেউ তো নিজের একাধিক স্ত্রীর মধ্যে থেকে একজনকে তালাক দিয়ে তার দ্বীনী ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। অপর দিকে মোহাজেররা নিজেদেরকে এতদূর আত্মসম্ভ্রমী প্রমাণ করেন যে, তারা বলতেন, আমাদেরকে ক্ষেত-খামার বা বাজার দেখিয়ে দাও, আমরা ব্যবসায় করে বা শ্রম খেটে জীবিকা উপার্জন করতে পারবো। অবিবাহিত, বিশেষত উঠতি বয়সের যেসব মোহাজের সংসারী হওয়ার পরিবর্তে নিজেদেরকে ইসলামী শিক্ষা অর্জনে নিয়োজিত করতে চাইছিলেন, তাদের বাসস্থান ছিল সুফফা অর্থাৎ মসজিদে নববীর একটা চত্বর। বিনির্মাণ কাজের জন্য এটা একটা গুরুত্বপুর্ণ প্রতিষ্ঠানের রূপ নেয়। সুফফাবাসী সাহাবীদের অভিভাবক ছিল ইসলামী সমাজ। রাসূল (সা) স্বয়ং তাদের প্রয়োজন পূরণে মনোযোগী ও সক্রিয় থাকতেন”। যাক আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ২৬ সেলের ১১ নম্বর কক্ষে। পূর্ব  থেকেই প্রশাসন রুমটি আমার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলাম। সেলে থাকা কয়েকজন ভাই আগে থেকে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। রাতের খাবার-দাবার আর জেলখানার একাকী সংসার জীবন শুরু হয়ে গেল। যথারীতি কয়েদি মুহাম্মদ হোসেন আমাকে সার্বিক দেখাশোনা করতে লাগল। অবশ্য আমি একাকী থাকতে খুব সাচ্ছন্দ্য বোধ কখনো করি না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের ৩১৮ নম্বর কক্ষে মাত্র কিছুদিন খুব কষ্ট করে ছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্বশীলদের সিদ্ধান্তের কারণে। এমএ পরীক্ষার সময়  আমাকে কয়েকজন ভাই পড়ালেখার সুবিধার্থে আমাকে  রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে বলত, এবার আপনি পড়–ন। আমরা বাইরে আছি। এভাবে সে ভাইয়েরা তাদের দায়িত্বশীলকে পড়ালেখায় সহযোগিতা করে। এটা অকল্পনীয়!। সমন্বিত এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে রেজাল্ট ভালো করা যায়। আর দায়িত্বশীল ভালো ফলাফল একটা বড় দাওয়াতি কাজও বটে!    (চলবে) লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির